অনিশ্চিত যাত্রা
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর একটি কথা দিয়েই শুরু করা যাক। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, সংলাপের আশার গুড়ে বালি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির মুখপাত্ররা ধরপাকড়ের মধ্যে থাকায় উপদেষ্টারা এখন বিএনপির একজন মুখপাত্রের ভূমিকায় আছেন এবং তিনি সেই অবস্থান থেকেই কথাটা বলেছেন। সে জন্য তিনি বলেননি, বিরোধী দলের নেতাই প্রথম সংলাপের গুড়ে বালি ফেলেছিলেন, যখন তিনি সংলাপের পরিবর্তে ৪৮ ঘণ্টার এক আলটিমেটাম ছুড়ে দিয়েছিলেন।
তবে জনাব শামসুজ্জামান ভুলও বলেননি। খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম এবং ৫ মে রাতে মতিঝিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় কিছু মানুষ এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের দূত বালিমেশানো গুড় যেটুকু সাফসুতরো করেছিলেন, সংলাপ বিষয়ে মে মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অবস্থান থেকে তাঁর একটা অনমনীয় অবস্থান চলে আসায় ওই গুড়ে আবারও বালি পড়ল। এতে এই গুড় এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত হলে, বা তা ফেলে দিতে হলে, আমাদের আফসোস করা ছাড়া আর কীই-বা করার থাকবে।
গুড়ে বালি দেওয়ার প্রসঙ্গটাই একটু পরীক্ষা করা যাক, যেহেতু সংলাপ নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা, তার একটা কারণ তা থেকে পাওয়া যেতে পারে। এই প্রবচনটি আমাকে ভাবায়, যেমন ভাবায় বাংলা ভাষায় পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নেওয়া আরও কিছু প্রবচন, যেমন ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’, ‘পাকা ধানে মই দেওয়া’, অথবা ‘হাতে মারে না, ভাতে মারে’। এই সব কটির ভেতরে ঠাসা আছে বিদ্বেষ, অন্যের অনিষ্ট করতে পারার চিত্তসুখ এবং এই চিত্তসুখ আরও বিমল করার জন্য প্রয়োজনে নিজের অঙ্গহানি করা। নাকটা একবার কেটে ফেললে প্রতিবেশীর না-হয় সমূহ ক্ষতি হলো, কিন্তু নিজের কি কম হলো? প্রতিবেশী চালাক হলে দুই দিন পর আরেকটা যাত্রার আয়োজন করে ফেলতে পারে, কিন্তু নিজের নাক কি আর গজাবে? নাকি তখন কান কাটার কথা ভাবা যাবে? আর একটা মাত্র নাক কেটে একটা যাত্রা ভাঙতে পারা গেলেও কান কেটে তা পারা যাবে দুবার। বাঙালির পক্ষে সবই সম্ভব।
নৃতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্বের আলোকে যাঁরা সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা বলেন, একটি ভাষার প্রবাদ-প্রবচনে ওই ভাষাভাষীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণ, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ—এসবের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। আর যা হোক প্রবাদ-প্রবচন এক দিনে তৈরি হয় না। এগুলোর পেছনে থাকে একটা জাতির দীর্ঘদিনের আবেগ-বুদ্ধি-জ্ঞানগত বিনিয়োগ এবং আচার-ব্যবহারের ঐতিহ্য। যদি তা-ই হয়, তাহলে একটু আগে উল্লেখ করা প্রবচনগুলো থেকে আমরা কী সন্দেশ পাই? বাঙালি কলহপ্রিয় জাতি? পরস্পরের অনিষ্টচিন্তা তাদের জীবনাচারের একটি মৌল পরিচয়? দুই প্রতিবেশী যদি দুজনের গুড়ে বালি ফেলেন, দুজনকেই গুড়হীন থাকতে হবে। যে যুগে এই প্রবচনের উৎপত্তি, আমার আন্দাজ সে যুগে চিনি সহজলভ্য ছিল না, গুড়ই ছিল প্রধান মিষ্ট দ্রব্য। শুধু শত্রুতার জন্য যদি গুড় খাওয়া থেকে দুজনকেই বঞ্চিত থাকতে হয়, তাহলে এই শত্রুতা নিশ্চয়ই মানবসমাজে প্রচলিত অন্য সব শত্রুতা থেকে আলাদা। এরই নাম আত্মঘাতী শত্রুতা!
আর নিজের নাক কেটে যে পরের যাত্রা ভন্ডুল করে দেয় তাকে কী বলা যায়? নীরদচন্দ্র চৌধুরী মহাশয় এর উত্তরে আমাদের হয়তো বলবেন, আত্মঘাতী বাঙালি। এই নামে যে বইটি তাঁর আছে, তাতে তিনি লিখেছেন, বাঙালি ‘দেশের সেবাও অজ্ঞানে প্রবৃত্তির ঝোঁকে করিয়াছে, আবার অজ্ঞানে প্রবৃত্তির বশেই আত্মহত্যাও করিয়াছে’। বাঙালির সপক্ষে এ কথাটাও নিশ্চয় বলা প্রয়োজন, যেমন চৌধুরী বলেছেন, তার মধ্যে ভালোত্বের কোনো কমতি নেই, উন্নত চিন্তারও অভাব নেই। কিন্তু কোথাও যেন প্রবৃত্তিগতভাবে একটা নেতির চক্রে সে পড়ে যায়, যা থেকে আর সে বেরোতে পারে না। প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনেই তো আছে ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’ আমরা যদি এই প্রবচনটা একদিকে রাখি এবং অন্যদিকে রাখি জনাব শামসুজ্জামানের আক্ষেপের প্রবচনটি (গুড়ে বালি দেওয়ার), তাহলে দেখব একদিকে রয়েছে সমস্যা, কিন্তু অন্যদিকে সমাধানও। এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে, আরও মনোগ্রাহী করে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধের তিনি এভাবে সমাপ্তি টেনেছিলেন—
‘পানীমে মীন পিয়াসী
শুনত শুনত লাগে হাসি।
আমাদের পানিও আছে পিয়াসও আছে, দেখিয়া পৃথিবীর লোক হাসিতেছে এবং আমাদের চক্ষে অশ্রু আসিতেছে, কেবল আমরা পান করিতে পারিতেছি না।’
এক শ একুশ বছর আগে লেখা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ২০১৩ সালের বাস্তবতাটা কী সুন্দরভাবেই না প্রকাশ করলেন। এ জন্যই কবিদের দ্রষ্টা বলেও মান্য করা হয়।
দুই
সংলাপ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আরও বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। সংঘাতের আশঙ্কা, কাগজে লেখা হচ্ছে, রাস্তায় নামতে ফের প্রস্তুত হচ্ছে হেফাজত। লন্ডন থেকে তারেক জিয়া ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে দাবানল ছড়িয়ে দেওয়ার’ ডাক দিয়েছেন এবং সরকার জানাচ্ছে, কোনো অযৌক্তিক দাবি তারা মানবে না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন বাতিল ইতিহাস। আমাদের আশঙ্কা, জুন মাসজুড়ে চলবে দফায় দফায় হরতাল ও ধ্বংসযজ্ঞ। হরতাল কোন দিন দেওয়া উচিত, কোন দিন না—এই বোধটা যখন হারিয়ে গেছে, রমজানে কেউ হরতাল ডেকে বসলেও আমি অবাক হব না। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ, এই দাবানল ছড়ানো, এই দমনপীড়নে, যা হবে তা হচ্ছে দেশের সর্বনাশ। সরকার যে ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে তার প্রমাণ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো, ঢাকায় সব সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা, এমনকি বিএনপিকে দোয়া মাহফিলও করতে না দেওয়া। এভাবে চললে আমাদের ফৌত হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।
অথচ এর বিকল্প আছে। আমরা দশে মিলে কাজ করার ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি, পরস্পরের গুড়ে বালি না মিশিয়ে এক প্রতিবেশী তার উদ্বৃত্ত গুড় অন্য প্রতিবেশীকে দিতে পারি; প্রতিবেশীর যাত্রাকে আরও আনন্দঘন করতে চকচকে নাক নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হতে পারি; প্রতিবেশীর পাকা ধান ভারা বেঁধে তার ঘরে তুলে সাহায্য করতে পারি। এসব যে আমাদের চরিত্রে একেবারে অচেনা, তা তো নয়। একাত্তরে ঠিক এই কাজগুলোই তো আমরা করেছি।
রবীন্দ্রনাথ যে পানি ও পিয়াসের কথা বলেছিলেন, সে দুটো একটুখানি মেলালে কেমন হয়? পানি সামনে নিয়ে বসা পিয়াসী বাঙালিকে দেখে পৃথিবীর লোক যে হাসছে তাতে সন্দেহ নেই—শেষমেশ বান কি মুনের প্রতিনিধিও হেসে ফিরে গেলেন। কিন্তু এতে যে আমরা অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরা চোখের পানি ফেলছি, এই লজ্জার অনুভূতি থেকে শুরু করলে কেমন হয়? যদি দুটি দল একবার, শুধু একবার, দেশটাকে এক নাম্বারে রেখে সংসদের ভেতরে অথবা বাইরে সামনাসামনি বসে, আমি নিশ্চিত পানি ও পিয়াসকে মেলানো যাবে, গুড় ও বালি তাদের নিজ নিজ জায়গায় চলে যাবে, মই তার শুরুর কাজ শেষ করে গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকবে এবং অক্ষত নাকে সকল প্রতিবেশী একটা অভিন্ন যাত্রায় নামবে।
কেউ যদি বলেন এটি করার সামর্থ্য বাঙালির নেই, তাহলে তার সঙ্গে আমি কিছুদিনের জন্য আড়ি দেব। কিছুদিন, যেহেতু একদিন তিনিই স্বীকার করবেন, তার ভুল হয়েছিল।
তিন
পানি ও পিপাসা মেলানোর জন্য নানান ফর্মুলা দেওয়া হচ্ছে। তাতে সরকার বিরক্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ অনেক মন্ত্রী এতে আপত্তি তুলেছেন। তার পরও আমি একটা ফর্মুলা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। অপরাধ মার্জনীয়।
বিরোধী দল যেহেতু নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারটি মেনে নিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনির্বাচিত কেউ সরকারপ্রধান হতে পারবেন না, তাহলে দুই দল মিলে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনীত করুক, যিনি উভয় দলের (ও জোট) আস্থাভাজন হবেন এবং তাঁকে আগামী কোনো উপনির্বাচনে যেমন জুলাই ৩-এ কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনে, অভিন্ন প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসা হোক। তিনি তখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবেই নির্দলীয় (অথবা দ্বিদলীয়, দ্বিজোটীয়) সরকারের প্রধান হিসেবে সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। দেশটা বাঁচবে। আমরাও চোখের পানি মুছে হাসব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
তবে জনাব শামসুজ্জামান ভুলও বলেননি। খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম এবং ৫ মে রাতে মতিঝিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় কিছু মানুষ এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের দূত বালিমেশানো গুড় যেটুকু সাফসুতরো করেছিলেন, সংলাপ বিষয়ে মে মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অবস্থান থেকে তাঁর একটা অনমনীয় অবস্থান চলে আসায় ওই গুড়ে আবারও বালি পড়ল। এতে এই গুড় এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত হলে, বা তা ফেলে দিতে হলে, আমাদের আফসোস করা ছাড়া আর কীই-বা করার থাকবে।
গুড়ে বালি দেওয়ার প্রসঙ্গটাই একটু পরীক্ষা করা যাক, যেহেতু সংলাপ নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা, তার একটা কারণ তা থেকে পাওয়া যেতে পারে। এই প্রবচনটি আমাকে ভাবায়, যেমন ভাবায় বাংলা ভাষায় পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নেওয়া আরও কিছু প্রবচন, যেমন ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’, ‘পাকা ধানে মই দেওয়া’, অথবা ‘হাতে মারে না, ভাতে মারে’। এই সব কটির ভেতরে ঠাসা আছে বিদ্বেষ, অন্যের অনিষ্ট করতে পারার চিত্তসুখ এবং এই চিত্তসুখ আরও বিমল করার জন্য প্রয়োজনে নিজের অঙ্গহানি করা। নাকটা একবার কেটে ফেললে প্রতিবেশীর না-হয় সমূহ ক্ষতি হলো, কিন্তু নিজের কি কম হলো? প্রতিবেশী চালাক হলে দুই দিন পর আরেকটা যাত্রার আয়োজন করে ফেলতে পারে, কিন্তু নিজের নাক কি আর গজাবে? নাকি তখন কান কাটার কথা ভাবা যাবে? আর একটা মাত্র নাক কেটে একটা যাত্রা ভাঙতে পারা গেলেও কান কেটে তা পারা যাবে দুবার। বাঙালির পক্ষে সবই সম্ভব।
নৃতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্বের আলোকে যাঁরা সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা বলেন, একটি ভাষার প্রবাদ-প্রবচনে ওই ভাষাভাষীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচরণ, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ—এসবের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। আর যা হোক প্রবাদ-প্রবচন এক দিনে তৈরি হয় না। এগুলোর পেছনে থাকে একটা জাতির দীর্ঘদিনের আবেগ-বুদ্ধি-জ্ঞানগত বিনিয়োগ এবং আচার-ব্যবহারের ঐতিহ্য। যদি তা-ই হয়, তাহলে একটু আগে উল্লেখ করা প্রবচনগুলো থেকে আমরা কী সন্দেশ পাই? বাঙালি কলহপ্রিয় জাতি? পরস্পরের অনিষ্টচিন্তা তাদের জীবনাচারের একটি মৌল পরিচয়? দুই প্রতিবেশী যদি দুজনের গুড়ে বালি ফেলেন, দুজনকেই গুড়হীন থাকতে হবে। যে যুগে এই প্রবচনের উৎপত্তি, আমার আন্দাজ সে যুগে চিনি সহজলভ্য ছিল না, গুড়ই ছিল প্রধান মিষ্ট দ্রব্য। শুধু শত্রুতার জন্য যদি গুড় খাওয়া থেকে দুজনকেই বঞ্চিত থাকতে হয়, তাহলে এই শত্রুতা নিশ্চয়ই মানবসমাজে প্রচলিত অন্য সব শত্রুতা থেকে আলাদা। এরই নাম আত্মঘাতী শত্রুতা!
আর নিজের নাক কেটে যে পরের যাত্রা ভন্ডুল করে দেয় তাকে কী বলা যায়? নীরদচন্দ্র চৌধুরী মহাশয় এর উত্তরে আমাদের হয়তো বলবেন, আত্মঘাতী বাঙালি। এই নামে যে বইটি তাঁর আছে, তাতে তিনি লিখেছেন, বাঙালি ‘দেশের সেবাও অজ্ঞানে প্রবৃত্তির ঝোঁকে করিয়াছে, আবার অজ্ঞানে প্রবৃত্তির বশেই আত্মহত্যাও করিয়াছে’। বাঙালির সপক্ষে এ কথাটাও নিশ্চয় বলা প্রয়োজন, যেমন চৌধুরী বলেছেন, তার মধ্যে ভালোত্বের কোনো কমতি নেই, উন্নত চিন্তারও অভাব নেই। কিন্তু কোথাও যেন প্রবৃত্তিগতভাবে একটা নেতির চক্রে সে পড়ে যায়, যা থেকে আর সে বেরোতে পারে না। প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনেই তো আছে ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’ আমরা যদি এই প্রবচনটা একদিকে রাখি এবং অন্যদিকে রাখি জনাব শামসুজ্জামানের আক্ষেপের প্রবচনটি (গুড়ে বালি দেওয়ার), তাহলে দেখব একদিকে রয়েছে সমস্যা, কিন্তু অন্যদিকে সমাধানও। এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে, আরও মনোগ্রাহী করে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধের তিনি এভাবে সমাপ্তি টেনেছিলেন—
‘পানীমে মীন পিয়াসী
শুনত শুনত লাগে হাসি।
আমাদের পানিও আছে পিয়াসও আছে, দেখিয়া পৃথিবীর লোক হাসিতেছে এবং আমাদের চক্ষে অশ্রু আসিতেছে, কেবল আমরা পান করিতে পারিতেছি না।’
এক শ একুশ বছর আগে লেখা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ২০১৩ সালের বাস্তবতাটা কী সুন্দরভাবেই না প্রকাশ করলেন। এ জন্যই কবিদের দ্রষ্টা বলেও মান্য করা হয়।
দুই
সংলাপ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আরও বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। সংঘাতের আশঙ্কা, কাগজে লেখা হচ্ছে, রাস্তায় নামতে ফের প্রস্তুত হচ্ছে হেফাজত। লন্ডন থেকে তারেক জিয়া ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে দাবানল ছড়িয়ে দেওয়ার’ ডাক দিয়েছেন এবং সরকার জানাচ্ছে, কোনো অযৌক্তিক দাবি তারা মানবে না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন বাতিল ইতিহাস। আমাদের আশঙ্কা, জুন মাসজুড়ে চলবে দফায় দফায় হরতাল ও ধ্বংসযজ্ঞ। হরতাল কোন দিন দেওয়া উচিত, কোন দিন না—এই বোধটা যখন হারিয়ে গেছে, রমজানে কেউ হরতাল ডেকে বসলেও আমি অবাক হব না। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ, এই দাবানল ছড়ানো, এই দমনপীড়নে, যা হবে তা হচ্ছে দেশের সর্বনাশ। সরকার যে ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে তার প্রমাণ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো, ঢাকায় সব সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা, এমনকি বিএনপিকে দোয়া মাহফিলও করতে না দেওয়া। এভাবে চললে আমাদের ফৌত হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।
অথচ এর বিকল্প আছে। আমরা দশে মিলে কাজ করার ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি, পরস্পরের গুড়ে বালি না মিশিয়ে এক প্রতিবেশী তার উদ্বৃত্ত গুড় অন্য প্রতিবেশীকে দিতে পারি; প্রতিবেশীর যাত্রাকে আরও আনন্দঘন করতে চকচকে নাক নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হতে পারি; প্রতিবেশীর পাকা ধান ভারা বেঁধে তার ঘরে তুলে সাহায্য করতে পারি। এসব যে আমাদের চরিত্রে একেবারে অচেনা, তা তো নয়। একাত্তরে ঠিক এই কাজগুলোই তো আমরা করেছি।
রবীন্দ্রনাথ যে পানি ও পিয়াসের কথা বলেছিলেন, সে দুটো একটুখানি মেলালে কেমন হয়? পানি সামনে নিয়ে বসা পিয়াসী বাঙালিকে দেখে পৃথিবীর লোক যে হাসছে তাতে সন্দেহ নেই—শেষমেশ বান কি মুনের প্রতিনিধিও হেসে ফিরে গেলেন। কিন্তু এতে যে আমরা অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরা চোখের পানি ফেলছি, এই লজ্জার অনুভূতি থেকে শুরু করলে কেমন হয়? যদি দুটি দল একবার, শুধু একবার, দেশটাকে এক নাম্বারে রেখে সংসদের ভেতরে অথবা বাইরে সামনাসামনি বসে, আমি নিশ্চিত পানি ও পিয়াসকে মেলানো যাবে, গুড় ও বালি তাদের নিজ নিজ জায়গায় চলে যাবে, মই তার শুরুর কাজ শেষ করে গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় পড়ে থাকবে এবং অক্ষত নাকে সকল প্রতিবেশী একটা অভিন্ন যাত্রায় নামবে।
কেউ যদি বলেন এটি করার সামর্থ্য বাঙালির নেই, তাহলে তার সঙ্গে আমি কিছুদিনের জন্য আড়ি দেব। কিছুদিন, যেহেতু একদিন তিনিই স্বীকার করবেন, তার ভুল হয়েছিল।
তিন
পানি ও পিপাসা মেলানোর জন্য নানান ফর্মুলা দেওয়া হচ্ছে। তাতে সরকার বিরক্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ অনেক মন্ত্রী এতে আপত্তি তুলেছেন। তার পরও আমি একটা ফর্মুলা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। অপরাধ মার্জনীয়।
বিরোধী দল যেহেতু নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারটি মেনে নিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনির্বাচিত কেউ সরকারপ্রধান হতে পারবেন না, তাহলে দুই দল মিলে এমন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনীত করুক, যিনি উভয় দলের (ও জোট) আস্থাভাজন হবেন এবং তাঁকে আগামী কোনো উপনির্বাচনে যেমন জুলাই ৩-এ কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনে, অভিন্ন প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে নিয়ে আসা হোক। তিনি তখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবেই নির্দলীয় (অথবা দ্বিদলীয়, দ্বিজোটীয়) সরকারের প্রধান হিসেবে সুন্দর একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। দেশটা বাঁচবে। আমরাও চোখের পানি মুছে হাসব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
No comments