মানবাধিকার পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের খবর যেদিন ছাপা হলো, সেদিনই জাতীয় সংবাদমাধ্যমে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্তত দুটি ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেল। রাজধানীর উত্তরায় মঙ্গলবার গভীর রাতে র্যাবের সদস্যদের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই যুবকের মৃত্যু আর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় পুলিশের হাতে আটক এক যুবকের পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ—দুটোই বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান প্রবণতার অপরিবর্তিত চিত্র তুলে ধরছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অন্যান্য বছরের প্রতিবেদনের থেকে এ বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সব বছরই র্যাব-পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান দেওয়া হয় এবং সে রকম কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণও থাকে। এবারের প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দবন্ধ: এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বা গুম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে বাংলাদেশে গুম হয়েছেন ১০ জন মানুষ। তাঁদের অধিকাংশেরই আর হদিস মেলেনি। অল্প যে কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে, তাঁদের শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন। গুমের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সিলেট বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর কথা। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ৩০ জন। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নামে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ অনেক সমালোচিত হয়ে আসছে। দেশের ভেতরেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত প্রবলতর হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সে রকম পদক্ষেপ তো নেয়ইনি, উপরন্তু তাদের আমলে যুক্ত হয়েছে মানুষের গুম হয়ে যাওয়া। এটি মানবাধিকার পরিস্থিতি অবনতির ভয়াবহ দিক। জবরদস্তিমূলক আটক, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক ব্যবহার, বিনা বিচারে দীর্ঘ সময় আটক রাখা ইত্যাদি মানবাধিকারবিরোধী আচরণ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া যেখানে জরুরি, সেখানে এগুলো বাড়ছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, রাজনৈতিক কারণে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনের উদ্দেশ্যেও এসব আচরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে নারী ও শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন, সরকার তাঁদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতিরও কোনো উন্নতি ঘটেনি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উক্তির উল্লেখ করা হয়েছে: দেশে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি। এর বিপরীতে বছরজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলির বিবরণী তুলে ধরে অ্যামনেস্টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র। শুধু সে কারণেই নয়, বাংলাদেশের সংবিধান এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের যে মৌলিক মানবাধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দিয়েছে, সেগুলো রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের নির্বাচিত সরকারকেই।
No comments