মানিক পীরের গান by সৈয়দ জামিল আহমেদ

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করে চলে যাওয়া সীমান্ত অঞ্চলের চারপাশে মানিক পীরের প্রশংসামূলক পরিবেশনা প্রচলিত আছে। এসব পরিবেশনার বিষয় মূলত মানিক পীরের কেরামতি। তাঁর কেরামতি নানা রকম। প্রজননের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর জন্ম হয়নি, তিনি জন্মেছেন ফুল থেকে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কেরামতি হলো: তিনি অন্ধের চোখে আলো দেন, বন্ধ্যা নারীকে দেন সন্তান, তিনি পশুপাখির প্রাণ ফেরাতে পারেন, মৃত মানুষকে পুনরায় জীবনদানের অলৌকিক ক্ষমতাও তাঁর আছে। সর্বোপরি, তিনি সব রকম বালা-মুসিবত দূর করতে পারেন। নিদানকালে, যখন অন্য সব উপায় নিষ্ফল হয়ে যায়, তখন অগুনতি ভক্ত মানিক পীরের দরবারে মানত করেন।
এই প্রবন্ধে আমার মূল প্রস্তাব হলো: মানিক পীরকে বাঞ্ছা করে যেসব রিচুয়াল ও পরিবেশনা চালু আছে, সেগুলো নিম্নবর্গের ‘অব-রাজনীতি’ (Infrapolitics) হিসেবে ক্রিয়া করে। ‘অব-রাজনীতি’ বলতে বোঝানো হচ্ছে ‘বিচিত্র ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরোধের ধরন, যা আপন-নামে কথা কইতে স্পর্ধা করে না’ (স্কট), বরং মোক্ষমভাবে গড়ে তোলে ‘ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ: এগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে এমন সব ক্ষেত্রে, যেগুলো সাধারণত আমরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখি না; এর সন্ধান মেলে—আপাতভাবে—সাংস্কৃতিক বিভেদের মধ্যে’। অব-রাজনীতির ‘অদৃশ্যতা’ মূলত এর গাঠনিক কারণেই; ভীতি, আতঙ্ক ও ‘অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থূল জবরদস্তি’র (যা বশ্যতা আরোপ করে) মতো সাধারণ পরিস্থিতির মুখে নিম্নবর্গের কৌশলগত চয়ন, একে উন্মুক্ত বাহাসে (অর্থাৎ ‘প্রভু ও অধীনস্থের উন্মুক্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’) প্রায় শনাক্ত করাই যায় না। নিম্নবর্গ তাদের অব-রাজনীতি প্রকাশ করে গুপ্ত বাহাস হিসেবে। এভাবেও বলা যায়, এটা ‘গদিনসীনদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির বাইরের ডিসকোর্স, যার অবস্থান মঞ্চের পেছনে’।
লৌকিক ইসলাম কথাটাও একটু স্পষ্ট করে নেওয়া ভালো। লৌকিক ইসলাম বলতে এখানে বোঝানো হবে ‘বুৎপন্ন ও সংশ্লেষী বিন্যাসে গড়ে ওঠা ছোট ছোট সম্প্রদায়, যাদের বসবাস পরিচিত ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্রে নয়, প্রান্তসীমাতে’ (জেফনি)। মূল আর্গুমেন্টটি বেশ জটিল এবং দীর্ঘ, এখানে সীমিত পরিসরে আমি মূল সূত্রগুলো শুধু ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করব। মানিক পীরের পরিবেশনার বর্ণনা দেওয়া এবং এ-জাতীয় পরিবেশনার অব-রাজনীতির খেই ধরিয়ে দেওয়াটাই হবে মূল উদ্দেশ্য।
২.
১৯৯৫ সালের অক্টোবরের এক সন্ধ্যাবেলা। কাশিমপুরের এক কৃষকের বাড়ির উঠানে আমি খড়বিচালির ওপর বসে আছি। আর দশটা গ্রামের মতোই একটা সাধারণ গ্রাম, সাতক্ষীরা থেকে খুব দূরে নয়। আমার থেকে একটু সামনে, উঠানের মাঝখানে আসর বানানো হয়েছে—মানিক পীরের গান পরিবেশিত হবে এখানে। উঠানে বিসদৃশভাবে একটি খেজুরের চাটাইয়ের মাদুর পেতে রাখা হয়েছে। এর ঠিক মাঝখানে একটি বাঁশের খুঁটির ওপর চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে। ওই খুঁটির ওপরই ঝোলানো হয়েছে হ্যাজাক লাইট, সেখান থেকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো আলো বেরোচ্ছে। আসরের চারদিকে শিশু ও বয়স্ক পুরুষেরা বসেছেন, তাঁদের সবার নীরব মনোযোগ পরিবেশনা শিল্পীদের ওপর। মেয়েরা বসেছেন একটু দূরে, যেখানে হ্যাজাকের আলো অনেকটা মিইয়ে এসেছে। দর্শকদের একটি বড় অংশ হিন্দু, মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু, তবে বেশ-কম অতি সামান্য। আসরের পশ্চিম দিকটায় পাতা আসনের (ক্ষুদ্র কাঠের চৌকি) ওপর চামর (ছোট ঝাড়ু) আর ‘আসা’ (ক্ষুদ্র লাঠি, যার ওপরে উল্টানো অর্ধচন্দ্রের ফলক যুক্ত) রাখা হয়েছে। পাঁচজন বাদক যাঁর যাঁর বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন: হারমোনিয়াম-বাদক বসেছেন আসনের ঠিক উল্টোদিকে। জুড়ি ও ঢোলবাদকেরা বসেছেন উত্তর কোণে; এঁদের মুখোমুখি তাশরিফ নিয়েছেন প্রেম-জুড়ি ও চৌতারা-বাদকেরা। এঁদের তিনজন হিন্দু, মুসলমান দুজন। সবাই পুরুষ, কৃষিকাজই এঁদের পেশা। এঁদের গায়েন (মূল গাতক) মুসলমান। ধবধবে সাদা পোশাক পরে—পাঞ্জাবি, পাজামা—তিনি আসরের প্রায় মাঝখানে আসনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে মানিক পীরকে আহ্বান করে গান গাইছেন। তাঁর মিনতি—মানিক পীর এসে যেন আসনটায় বসেন।
গায়েনের নাম শহর আলি সরদার। উনি মানিক পীরের ফকির। তাঁর বাড়ি কাছেধারেই—আখড়াখোলা গ্রামে। গুরু তকব্বর আলি বাউলের (একই জেলার ভাঙ্গা গ্রামের মানুষ) অনুমতি পাওয়ার পর উনি বিয়ে-থা করে সংসারী হয়ে কৃষিকাজ করছেন। শহর আলি শ্যালো টিউবওয়েল পাম্পের একজন মেকানিক। হাটবারের দিন ওষুধ বিক্রি করেন, তখন ভিড় জমাতে তিনি মারফতি গান করেন।
সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কৃষকেরা (প্রধানত হিন্দু) বিপদে-আপদে এ রকম পরিবেশনার মাধ্যমে মানিক পীরের কাছে মানত করেন: বাড়ির কেউ হয়তো গুরুতর অসুস্থ কিংবা মহামারিতে উজাড় হচ্ছে গবাদিপশু। মহামারি চলে গেলে বা অসুখ-বিসুখ দূর হলে মানত পূরণ হওয়ার উপলক্ষে এ রকম পরিবেশনার খরচ জোগানো হয়। অদ্য রজনীর খরচ দিচ্ছেন একজন মুসলিম কৃষক। তাঁর পরিবারের কয়েকজন নানা অসুখ-বিসুখে দীর্ঘদিন ভোগার পর মানতের তরফে নিরাময় পেয়েছেন—এই হলো উপলক্ষ।
শহর আলি তাঁর পরিবেশনা শুরু করে দিয়েছেন—কানু ঘোষের পালা। মানিক পীরকে ঘিরে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে প্রচলিত পালাগুলোর মধ্যে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে লোকপ্রিয়। তিনি যুগপৎ গান গাইছেন ও গানের কথা অভিনয় করে দেখাচ্ছেন। বাদকেরা যাঁর যাঁর বাদ্য বাজাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে গানে ধুয়ো দিচ্ছেন। শহর আলি গান থামিয়ে মাঝেমধ্যে গদ্যবর্ণনায় কাহিনি শোনাচ্ছেন, কাহিনি সংক্ষেপ করার দরকার পড়লে গানের কথাগুলো শুধু আউড়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য বোধ হয় চরিত্রের চিত্রায়ণ। এসব ক্ষেত্রে বাদকদের মধ্য থেকে এক বা একাধিকজন উঠে দাঁড়ান, কোনো একটি বিশেষ ভূমিকায় (পোশাক একটুও না বদলে) অভিনয় করে তারপর ফিরে এসে আবার বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করেন।
কানু ঘোষের পালা মানিক ও তার যমজ ভাই গোপ্তর কাহিনি—এঁরা রাজা করম-দিন ও রানি দুধবিবির সন্তান। তাঁরা ভোগলিপ্সার রাজসিক জীবন ছেড়ে দিয়ে পথে নেমেছেন। ঘুরতে ঘুরতে এসে উপস্থিত হয়েছেন গোকুল নগরে। নানা স্থানে ঘুরে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন শত-সহস্র গোধনের মালিক কানু ঘোষ, আর তার ভাই কিনু ঘোষের ভিটেতে। এসে তাঁরা একটু দুধ মাঙলেন। ভিখারিরা মুসলমান বলে ময়না বুড়ি—কানু আর কিনুর মা—প্রথমে গররাজি হলেও পরে নিমরাজিভাবে অনুমতি দিলেন। তিনি করলেন কি, ১০০ ছেঁদাওয়ালা এক বিরাট পাত্র মানিকের হাতে দিয়ে পাঠালেন এক বন্ধ্যা গাভীর দুধ দুইতে। খোদার অপূর্ব লীলা, মানিক পীরের সেই গরুর দুধ দুইতে কিচ্ছু অসুবিধা হলো না, পাত্রের ছেঁদা বেয়ে একটুও দুধ বাইরে পড়ল না। ময়না বুড়ি ভয়ানক কুপিত হলেন। তাঁর ধারণা, এই দুই ফকির তাঁর সঙ্গে বুজরুকি করেছেন। তিনি পাত্রভর্তি দুধ কেড়ে নিলেন ওঁদের কাছ থেকে। জয়া দুর্গা—তাঁর পুত্রবধূ—ময়না বুড়ির এই পাতকী-কর্ম দেখে ভয় পেয়ে গোপনে দুই ফকিরকে একটু দুধ এনে দিলেন। জয়া দুর্গার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে মানিক পীর তাঁর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই বুড়ি সেখানে এসে উপস্থিত। নিজের বউয়ের এই কীর্তি দেখে ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি পত্রপাঠ পুত্র কানুর কাছে গিয়ে বউয়ের নামে কান-পড়া দিলেন: বউ এক মুসলমান ফকিরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করেছে। কানু হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে ফকিরকে চ্যালা কাঠ দিয়ে বেদম মার শুরু করে দিলেন। কুপিত ভিখারি অভিশাপ উচ্চারণ করলেন, তারপর অন্তর্হিত হলেন।
এক লহমার মধ্যে কানু ঘোষের ভিটেয় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। তাঁর সব গাভি মরে পড়ে রইল। সর্বস্বান্ত হয়ে কানু ঘোষ ভিক্ষে শুরু করেন আর গোবর কুড়ান। ভালোভাবে শায়েস্তা করতে মানিক পীর একটি সাপ পাঠালেন কানুকে মেরে ফেলতে। ছেলের মৃত্যুতে বিচ্ছিন্ন মা শোকে আত্মহারা হয়ে দুই ফকিরের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করলেন, অনেক কষ্টে জমানো নয় পাত্রভর্তি দুধ তাঁদের নিবেদন করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। এরপর তাঁরা সবাই একত্রে শ্মশানে গেলেন। মানিক পীর সেখানে কানুকে পুনরায় জীবন দান করলেন, তাঁর ভিটেবাড়ি, সমস্ত গোধন ফিরিয়ে দিলেন। কানু ঘোষ, জয়া দুর্গা আর ময়না বুড়ি দুই ভাইকে গভীর ভক্তির সঙ্গে কুর্নিশ করলেন।
মানিক পীরের গানের সঙ্গে মেলে এ রকম একটি পরিবেশনা হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত জাগ গান। এটি সবচেয়ে বেশি হয় পৌষ মাসে, আমন ধান ঘরে তোলার পর। রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলে জোয়ান ছেলেদের পাশাপাশি বয়স্ক মুসলমান চাষিরাও মানিক পীরের ভজনায় এসব পরিবেশনায় অংশ নেন। লোকমনে বিশ্বাস, এ রকম পরিবেশনায় অংশ নিলে পীরের স্বর্গীয় করুণাধারা পাওয়া যায়। এই পরিবেশনার একটি ভাষ্যে পাওয়া যাচ্ছে, গোয়ালপাড়ার সোনা পীরের একজন কনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মানিক পীর। কিন্তু সেই অঞ্চলের মানুষজন তাঁদের দেবত্ব স্বীকার করতে নারাজ, যথোচিত ভক্তিও তারা প্রদর্শন করে না। এর সমুচিত জবাব হিসেবে দুই পীর অলৌকিকভাবে দোষী ব্যক্তিদের প্রাণ হরণ করেন, সেই সঙ্গে নয় লাখ গোধন ও কুড়ি লাখ বাছুরও লোপ পায়। এরপর মেয়েদের ক্রন্দনধ্বনি শুরু হলে দুই পীরের অন্তরে দয়ার সঞ্চার হয়, সব গবাদিপশু ও মৃত মানুষ তখন পুনরুজ্জীবন লাভ করে। দুই পীরের মাজেজা এভাবে প্রমাণিত হলে সবাই তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং তাঁদের স্তুতিমূলক গীত রচনা করে।
ওপরে আলোচিত মানিক পীর কাল্টের দুটি পরিবেশনার অব-রাজনীতি স্পষ্ট হয়েছে একটি গুপ্ত বাহাসের মাধ্যমে। মানিক পীরের গান-এর কানু—যে শত-সহস্র গোধনের মালিক—নামটি আমাদের মনে করিয়ে দেবে শ্রীকৃষ্ণের (তাঁকে কানাইও বলা হয়) কথা, যিনি রাখাল লোকনায়ক, প্রায়ই ননী ও মাখন চুরি করতেন গোকুলের গোয়ালিনির কাছ থেকে। এখানে, কানু ও তার মা যখন কাল্টের প্রতীকী মূলধনকে অস্বীকার করল স্বীকৃতি, বশ্যতা, শ্রদ্ধা ও বাধ্যতার রীতিসিদ্ধ দাবি অস্বীকার করার মাধ্যমে, কানু তখন ছাইয়ে পর্যবসিত হলো। এই পর্যায়ে, পীর লোকমানসে অঙ্কিত ইসলামি বিজেতাদের আইকনোক্লাস্টিক ও লুণ্ঠনরত দস্যুর কল্পনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যারা শুধু তলোয়ার দিয়েই শাসন করতে চায়। এ রকম প্রতীকী সহিংসতার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে জাগ গানে, যেখানে মানিক পীর ও সোনা পীর গোয়ালপাড়ায় (এখানে মনে পড়বে গোকুলের কথা) ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ করেন, কারণ ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা তাঁদের দেবত্ব স্বীকার মানতে পারেনি।
‘[মানিক পীর] এর প্রতি কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ হিন্দু সমাজের, যারা গাভির পূজা করে, এ রকম অসামান্য ভক্তি প্রদর্শনের’ পেছনের কারণ কী, তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন দীনেশচন্দ্র সেন। এটার ভিত্তি সম্ভবত ‘[তাদের] পবিত্র পশুর রোগ-বালাইয়ের কতক নিরাময়কারী ক্ষমতা তাঁর আছে।’ কাজেই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে এই মুসলিম পীর আক্ষরিক অর্থেই দুধের সঙ্গে কল্পিত হবেন: তাঁর জন্ম হবে ‘দুধবিবি’র গর্ভে’, তিনি শান্ত হবেন তখনই, যখন তাঁকে দুধ অর্ঘ্য দেওয়া হবে, তিনি রুষ্ট হবেন, যখন চেয়ে দুধ পাবেন না। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি সচকিত ভাবের নিরিখে যাচাই করে নিতে হবে যে ‘গাভি-পূজারি’রা মানিক পীরের শরণও নিতে পারে। এটা মনে রাখা খুবই জরুরি যে মানিক পীর সীমাহীন ভক্তি চান, যে-ভক্তি প্রশ্নাতীত বা যুক্তিসিদ্ধ নয়। কিন্তু মানিক পীর পুরোদস্তুর আলাদা যে কারণে হয়ে যান, সেটা হলো: তিনি এক খোদাকে উপাস্য মেনে কাউকে ধর্মান্তরিত হওয়ার আবদার করেন না। কিন্তু তিনি লড়াই করেন ময়না বুড়ির বিরুদ্ধে, যে মুসলমানদের অস্পৃশ্য জ্ঞান করে, এবং কানু, যে গায়ের জোরে মুসলিমদের উৎপাটন করতে চায়। পাশাপাশি তাঁর জয়া দুর্গার সঙ্গে কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই। এখানে এসেই মানিক পীরের পরিবেশনা নিম্নবর্গের ‘অদৃশ্য’ অব-রাজনীতি হিসেবে তৎপর হয়ে ওঠে।
অব-রাজনীতির এই ভাষা পুরোপুরি উল্টে যায়, যদি কেউ পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকান, গত তিন দশক ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক মার্ক্সবাদ, নকশালবাড়ি আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতি এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে আধিপত্য করছে; যেখানে হিন্দুর সংখ্যা মুসলমানদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছে। মানিক পীরের গান প্রচলিত আছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়, যেখানে মুসলিম ফকিররা কানু ঘোষের পালার অনুরূপ একটি পরিবেশনা করে থাকেন।
পরিবেশনার একটি ভাষ্যে পাওয়া যাচ্ছে, মানিক পীর এক দারিদ্র্যপীড়িত মুসলিম ঘরামির দরজায় গজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। লোকটা এতই গরিব যে তাকে সবাই বলে মুরাদ কাঙাল। দুই ফকিরকে দেওয়ার মতো সম্বল তাঁর কিছুই নেই। তিনি এক সের চালের জন্য নিজের ছেলেকে সওদাগর চাচার কাছে বন্ধক দিলেন। মুরাদ কাঙালের ভক্তির নিদর্শন দেখে মানিক পীর অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি মা লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করলেন, যেন তিনি মুরাদের ওপর অনুগ্রহ করেন, তার ভাত রেঁধে দেন। মানিক পীরের গানে এভাবেই হিন্দু দেবী মুসলমান পীরের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। মুরাদের গরিবি ঘুচে যায়।
লক্ষ্মী হিন্দুদের ধন, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবী। এই পরিবেশনা থেকে পাওয়া যাচ্ছে, মুরাদ কাঙালের দিকে মুখ তুলে চাইতে লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করছেন মানিক পীর। এটাকে হিন্দু দেবীর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ্য বাহাস হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে। কিন্তু এখানে একটি গুপ্ত বাহাসেরও পাঠ নেওয়ার সুযোগ আছে: একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু দেবীর কাছে মানিক পীরের প্রভাব প্রমাণিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে তাঁর কাল্টের কার্যকারিতাও নিরূপিত হলো এখানে। কারণ লক্ষ্মী এখানে তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করছেন। মানিক পীরের ভক্ত তাই দুই তরফের সুনজরেই থাকছে, কারণ দু রকম স্বর্গীয় জগতেই তাঁর প্রবেশাধিকার আছে। এটা আসলে একরকম রফা: আপনি যদি একটা কেনেন (অর্থাৎ মানিক পীর), তাহলে আপনি আরেকটা (অর্থাৎ লক্ষ্মী) মাগনা পাবেন।
৩.
যদিও বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুশাসনে মানিক পীরের কাল্টকে বিলোপ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু এটা প্রমাণিত যে একে উচ্ছেদ করা অসম্ভব। এক স্থান থেকে এটি হারিয়ে গেছে শুধু অন্যত্র মাথা জাগানোর জন্যই। পশ্চিমবঙ্গে যখন লৌকিক হিন্দুমত ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এই কাল্টটিকে হজম করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে তখন এটি নীরবে এর প্রতিপক্ষের পরিসরে ঘুরপথে এগিয়েছে, একে গিলে ফেলা সম্ভব হয়নি। এভাবে গদিনসীন শ্রেণী (হিন্দু-মুসলিম যা-ই হোক) শুধু যে তাদের আধিপত্যের চর্চায় নিম্নবর্গকে হজম বা ধ্বংস করে ফেলতে পারেনি তা-ই নয়—এখানে যদি কেউ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য স্মরণ করেন—তারা সোজা কথায় এই লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে নিম্নবর্গের অব-রাজনীতির কৌশলের ফলেই।
আন্তোনিও গ্রামসি যেমন বলেছেন, ‘[একটি] নির্দিষ্ট সামাজিক-ঐতিহাসিক মুহূর্ত কখনোই সম্ঘন নয়; বরং এর উল্টো, নানাবিধ বিরোধে পরিপূর্ণ।’ মানিক পীর যে পরিসরে কর্তৃত্ব করেন সেটা খুবই অস্পষ্ট, বিষম এবং জটিল। নিষিদ্ধ, না-মঞ্জুরকৃত এ রকম প্রান্তীয় বিষয়গুলোর এত বিচিত্র ধারা যে, বিদ্যমান চর্চার ধর্মতাত্ত্বিক ও প্রার্থনাসংক্রান্ত রীতির একটি ঐকতানমূলক ও আনুক্রমিক বিন্যাসের মধ্যে একে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। বহু ধারা, বিসদৃশ স্বর এবং অধিক্রমণমূলক বিন্যাস থেকে উদ্ভূত যে পরিসর শাসন করেন মানিক পীর, সেটা অসংগতিপূর্ণ ভেক্টরের জন্ম দেয় এবং নিজেকে একটি সুশৃঙ্খল নির্মাণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে আপত্তি করে। এসব ভেক্টর বাংলাদেশে বিলোপ আর পশ্চিমবঙ্গে হজম করে ফেলার হুমকি প্রতিরোধে ক্রিয়াশীল থাকে এবং সেই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অভ্যাসকে লৌকিক হিন্দুত্বের ওপর আরোপ করতে চেষ্টা করে। স্বর্গীয় ফেরেববাজের মতোই মানিক পীর একটি অন্তহীন ইঁদুর-বেড়াল খেলা খেলেন কট্টর ধর্মানুসারীদের সঙ্গে খোলস-বদল ও কৌশলের মাধ্যমে, এক কাঠামো থেকে সরে গিয়ে অন্য কাঠামোতে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে। নাগরিক কেন্দ্রে তাঁর স্বর প্রায় শোনাই যায় না। প্রান্তে বসবাস করে তিনি কখনোই স্বধর্মে দীক্ষা দেন না, আর সেই সঙ্গে লৌকিক হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণ্যবাদের তরিকায় মানানসই হয়ে উঠতেও ঘোর আপত্তি করেন।
মানিক পীরের কাল্টকে ঘিরে গড়ে ওঠা চোরাটান ও বিরোধগুলো মোটামুটি এ রকমই। এর ভিত্তিতে আমরা এই দরকারি সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে নিম্নবর্গের ধর্মচৈতন্য অনিবার্যভাবে ‘আত্মপ্রবঞ্চনা’ নয় (গ্রামসি)। বরং এটা ‘প্রকৃত রাজনৈতিক তৎপরতার সাধারণ পরিকাঠামো’ সৃষ্টি করতে পারে (গ্রামসি)। ‘অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থূল জবরদস্তি’-এর পরিস্থিতিতে, যা বশ্যতাকে জোরদার করে, নিম্নবর্গের অব-রাজনীতি স্বতন্ত্র কৌশল এবং ছদ্মবেশী উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেগুলোর সবই কর্তাশ্রেণীর শ্রম, উৎপাদন ও সম্পত্তি বস্তুগতভাবে আত্মসাৎ করাকে প্রতিহত করতে চায়। ‘এটি ছদ্মবেশী ও বেনামা রাজনীতি যা জনপ্রেক্ষিতে অবস্থান করে, কিন্তু যার দ্বৈত অর্থের ফলে যারা এই কাজটি করছে তাদের পরিচয়টি আড়ালে থাকে (স্কট)।
সৈয়দ জামিল আহমেদ: অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাসঙ্গিক রচনা: ‘পারফর্মিং অ্যান্ড সাপ্লিকেটিং মানিক পীর: ইনফ্রাপলিটিকিস ইন দি ডোমেইন অব পপুলার ইসলাম’—সৈয়দ জামিল আহমেদ; টিডিআর: দি ড্রামা রিভিউ ৫৩: ২ (টি২০২) সামার ২০০৯।
==================================
গল্প- চুপি চুপি বাঁশি বাজে  গল্প- বিধুহীন  গল্প- অসমাপ্ত চুম্বনের ১৯ বছর পর...  গল্প- বসন্ত বিলাপ  খোয়াবের প্রতিলিপি  গল্প- জিঞ্জির ফেরা  দুর্লভ সময়ের হলফনামা  ইচ্ছা ছিল কবি হওয়ার  আমার গ্রন্থাগার  সোনার কমলার খোঁজে  রূপবান ঢাকার রক্তক্ষরণ  নারী জীবনের অচলায়তন  'ত্যাগের' মূল্যায়ন ও মুক্তকণ্ঠ তারুণ্য  মূল সংবিধান সংরক্ষণে সরকারের ইউটার্ন  তুরস্কে জেনারেলদের পদত্যাগ কেন?  ছোট দলগুলো ফুরফুরে মেজাজে!  কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা  গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  একাত্তরের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি  রশীদ করীমে'র সাক্ষাৎকার- 'মনে পড়ে বন্ধুদের'  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ  ফয়েজ আহমেদঃ স্মৃতিতে চিঠিতে  অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারঃ উপন্যাসের জগতের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই  ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা  গল্প- চাল ডাল লবণ ও তেল  ক-য়ে ক্রিকেট খ-য়ে খেলা  গল্পসল্প- ডাংগুলি  হ্যারল্ড পিন্টারের শেষ সাক্ষাৎকারঃ আশৈশব ক্রিকেটের ঘোর  সূচনার পিকাসো আর ভ্যান গঘ  আল্লাহআকবরিজ সি সি  গল্প- কবি কুদ্দুস ও কালনাগিনীর প্রেম  গল্পসল্প- আমার বইমেলা  বাংলাদেশ হতে পারে বহুত্ববাদের নির্মল উদাহরণ  শিক্ষানীতি ২০১০, পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি এবং জাতীয় স্বার্থ  চীন-ভারত সম্পর্ক এবং এ অঞ্চলে তার প্রভাব  নারী লাঞ্ছনার সর্বগ্রাস  গল্প- স্বপ্নের মধ্যে কারাগারে


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ জামিল আহমেদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.