আজকের গল্প by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
নাতি গল্প বলছে তার পুতুলকে।
আর আমি ‘এ্যাড ভারবাটিম’ লিখছি। জীবনটাই যে গল্পের খনি।
মালী এখন রাজার জন্য চা বানাবে।
মালী এসে বলল, ‘রাজা, চিনি নেই, জুস দিই?’ রাজার সম্মতির অপেক্ষা না করেই মালী জুস নিয়ে এল। কিন্তু জুসের মধ্যে শুধুই পানি, অল্প একটু লবণ মেশানো। ‘এই আছে, আজকের মতো এইটুকুই খান।’
রাজা জুস খেয়ে বললেন, ‘মালী, রাজ্যের অবস্থা ভালো, না খারাপ?’
মালী বলল, ‘আপনার জুসের মতোই। চায়ের গল্পে পরে আসছি।’
এরপর আজকের প্রথম আলোর খবর। গল্পের মতোই।
‘হোয়াইট হাউসের জীবন নরকতুল্য’, বলেন মিশেল। ম্যাডাম কার্লা ব্রুনি সার্কোজিকে বলেছিলেন, ‘এটা নরক! আমি সহ্য করতে পারছি না!’ কেরানীগঞ্জের ঢাকা প্রতিনিধি লিখেছেন ‘রাস্তা নয়, যেন চষা জমি’ [সঙ্গে চষা জমির ছবি]। ‘দুর্নীতিতে ফেঁসে গেছে এমডিজি উন্নয়ন লক্ষ্য’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। নির্মলেন্দু-মহাদেব নিলেন না বিজনেস ক্লাসের টাকা। ‘দলতন্ত্র বেশির ভাগ সময়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করে’, বললেন স্পিকার। ‘বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এগারো লাখ, শুনানির জন্য অপেক্ষা একুশ বছর, বিশ বছরেও শেষ হয় যাবজ্জীবন।’ প্রতিদিন একটু একটু করে সংবাদ নোট করে রাখলে এমন একটি বই হয়, যেটি পড়তে ভালোই লাগবে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একটি বই লিখেছেন, যাতে বাংলাদেশের প্রতিদিনের ঘটনা সন্নিবেশিত। বইটি আমি মাঝে মাঝে পড়ি।
দিচ্ছি শুক্রবারের তাজা খবর। বাংলা একাডেমীর চত্বরে বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ছুটে আসা সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা। বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সভা আজ। উপস্থিত হয়েছেন সাধারণ সদস্য, জীবন সদস্য, ফেলো, পুরস্কার পাওয়া শত কবি-সাহিত্যিক। গ্রাম থেকে সর্বাধিক। বছরের পর বছর মফস্বলে থেকেও তাঁরা সাহিত্যের বরপুত্র, সাহিত্যের সেবা করে চলেছেন দিবানিশি। সাহিত্যের ওপর বই লিখেছেন, কেউ কবিতা, কেউ গল্প, কয়েকখানা বই সঙ্গের ঝুলিতে।
আব্বাসী ভাই, এই কবিতার বইটি অবশ্যই পড়বেন। এতে লেখা এক শ বছরের বাংলাদেশ কীভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হবে, তার কথা। আরেকজন ঝাঁকড়া চুলের কবি বললেন, আপনার সঙ্গে ছবি তুলব। নজরুল পড়েছেন ক্লাস এইট পর্যন্ত, আমিও তাই। উনার ছিল বাবরি, আমারও তাই। উনি লিখেছেন, চার হাজার কবিতা, আমি সাড়ে চার হাজার। আমি অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। সত্যি তো, ইনিও তো সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন নজরুলের মতোই। সাহিত্য তাঁর জীবনকে ঘিরে রেখেছে। না-ই বা স্পর্শ করলেন সাহিত্যগগনের সিংহদুয়ার, ভালোবাসায় তো তিনি অম্লান। কিছু শিল্পীকে পেয়েছি, যাঁরা আমার পিতাকে সারা জীবন অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। একজনের নাম আব্বাস মিঞা, তাঁরই মতো বাবরি, তাঁরই মতো গলায় দোতরা বাঁধা এবং সারা বাংলায় আব্বাসের নামেই গান গেয়ে চলেছিলেন। এই চত্বরে তাঁদের একসঙ্গে পেয়ে কী যে ভালো লাগে!
এই বিশেষ অধিবেশনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করেন লেখকেরা। লেখকদের জীবনে সামান্য একটু আনন্দ। বিগত বছরগুলো ধরে কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছি, ছবি তুলেছি, গল্প করেছি। দুপুরের খাওয়ার সময় চলে গেছি জুমার নামাজ পড়তে। এগারোটার দিকে এক কাপ চা পেলে আড্ডাটা আরও স্ফূর্তি পায়।
২০১১-এর ২৪ ডিসেম্বর এ সম্মেলন আমার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। বন্ধু মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানিয়েছেন যে এ বছর আমাকে বাংলা একাডেমীর বিশেষ সম্মানজনক পদ অর্থাৎ ‘ফেলো’ দেওয়া হবে। আমি বাংলা একাডেমীর ফেলো অর্থাৎ ‘পথচারী’ পঞ্চাশ বছর থেকে। পঞ্চাশ বছরে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোয় বাংলা একাডেমীর সুখ্যাতি করেই চলেছি। বলেছি, বাংলা একাডেমী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোকসংগীত সংগৃহীত। মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও পরবর্তী সংগ্রহের তালিকা সর্ববৃহৎ। একাডেমী রক্তের সঙ্গে মিশে, গ্রাম-গ্রামান্তরের লাখ লাখ গিদাল-সংগ্রাহক-উঠতি সাহিত্যিক-উঠতি কবির মতো। বাংলা একাডেমীর চত্বরেই মন ঘুরে বেড়ায়। সম্মানপ্রাপ্তিতে আনন্দিত। এমনটি হয়েছিল আরেকবার। গত বছর সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের ১২৫তম জন্মলগ্নে প্রধান অতিথি। পাঁচ হাজার দর্শক-শ্রোতা, যাদের গান শোনালাম, গল্প শোনালাম ও কাঁদালাম। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। স্কুলের ছাত্র নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, শহীদ তাজউদ্দীন, ড. কামাল হোসেন, ড. বদরুদ্দোজা, সংগীত পরিচালক সমর দাস, সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবিরসহ অজস্র কীর্তিমান পুরুষ। অথচ আমার মতো অধম সেখানে প্রধান বক্তা, গায়ক, গল্পকার।
সভায়এবার চায়ের সময় হলো। চা-পাতা কম, চিনি কম; নয় পানি গরম হয়নি, তবুও তো চা। নাতি বর্ণিত লবণের জুসের চেয়ে অনেক ভালো।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
আর আমি ‘এ্যাড ভারবাটিম’ লিখছি। জীবনটাই যে গল্পের খনি।
মালী এখন রাজার জন্য চা বানাবে।
মালী এসে বলল, ‘রাজা, চিনি নেই, জুস দিই?’ রাজার সম্মতির অপেক্ষা না করেই মালী জুস নিয়ে এল। কিন্তু জুসের মধ্যে শুধুই পানি, অল্প একটু লবণ মেশানো। ‘এই আছে, আজকের মতো এইটুকুই খান।’
রাজা জুস খেয়ে বললেন, ‘মালী, রাজ্যের অবস্থা ভালো, না খারাপ?’
মালী বলল, ‘আপনার জুসের মতোই। চায়ের গল্পে পরে আসছি।’
এরপর আজকের প্রথম আলোর খবর। গল্পের মতোই।
‘হোয়াইট হাউসের জীবন নরকতুল্য’, বলেন মিশেল। ম্যাডাম কার্লা ব্রুনি সার্কোজিকে বলেছিলেন, ‘এটা নরক! আমি সহ্য করতে পারছি না!’ কেরানীগঞ্জের ঢাকা প্রতিনিধি লিখেছেন ‘রাস্তা নয়, যেন চষা জমি’ [সঙ্গে চষা জমির ছবি]। ‘দুর্নীতিতে ফেঁসে গেছে এমডিজি উন্নয়ন লক্ষ্য’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। নির্মলেন্দু-মহাদেব নিলেন না বিজনেস ক্লাসের টাকা। ‘দলতন্ত্র বেশির ভাগ সময়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করে’, বললেন স্পিকার। ‘বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এগারো লাখ, শুনানির জন্য অপেক্ষা একুশ বছর, বিশ বছরেও শেষ হয় যাবজ্জীবন।’ প্রতিদিন একটু একটু করে সংবাদ নোট করে রাখলে এমন একটি বই হয়, যেটি পড়তে ভালোই লাগবে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একটি বই লিখেছেন, যাতে বাংলাদেশের প্রতিদিনের ঘটনা সন্নিবেশিত। বইটি আমি মাঝে মাঝে পড়ি।
দিচ্ছি শুক্রবারের তাজা খবর। বাংলা একাডেমীর চত্বরে বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ছুটে আসা সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা। বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সভা আজ। উপস্থিত হয়েছেন সাধারণ সদস্য, জীবন সদস্য, ফেলো, পুরস্কার পাওয়া শত কবি-সাহিত্যিক। গ্রাম থেকে সর্বাধিক। বছরের পর বছর মফস্বলে থেকেও তাঁরা সাহিত্যের বরপুত্র, সাহিত্যের সেবা করে চলেছেন দিবানিশি। সাহিত্যের ওপর বই লিখেছেন, কেউ কবিতা, কেউ গল্প, কয়েকখানা বই সঙ্গের ঝুলিতে।
আব্বাসী ভাই, এই কবিতার বইটি অবশ্যই পড়বেন। এতে লেখা এক শ বছরের বাংলাদেশ কীভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হবে, তার কথা। আরেকজন ঝাঁকড়া চুলের কবি বললেন, আপনার সঙ্গে ছবি তুলব। নজরুল পড়েছেন ক্লাস এইট পর্যন্ত, আমিও তাই। উনার ছিল বাবরি, আমারও তাই। উনি লিখেছেন, চার হাজার কবিতা, আমি সাড়ে চার হাজার। আমি অবাক হয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। সত্যি তো, ইনিও তো সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন নজরুলের মতোই। সাহিত্য তাঁর জীবনকে ঘিরে রেখেছে। না-ই বা স্পর্শ করলেন সাহিত্যগগনের সিংহদুয়ার, ভালোবাসায় তো তিনি অম্লান। কিছু শিল্পীকে পেয়েছি, যাঁরা আমার পিতাকে সারা জীবন অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। একজনের নাম আব্বাস মিঞা, তাঁরই মতো বাবরি, তাঁরই মতো গলায় দোতরা বাঁধা এবং সারা বাংলায় আব্বাসের নামেই গান গেয়ে চলেছিলেন। এই চত্বরে তাঁদের একসঙ্গে পেয়ে কী যে ভালো লাগে!
এই বিশেষ অধিবেশনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করেন লেখকেরা। লেখকদের জীবনে সামান্য একটু আনন্দ। বিগত বছরগুলো ধরে কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছি, ছবি তুলেছি, গল্প করেছি। দুপুরের খাওয়ার সময় চলে গেছি জুমার নামাজ পড়তে। এগারোটার দিকে এক কাপ চা পেলে আড্ডাটা আরও স্ফূর্তি পায়।
২০১১-এর ২৪ ডিসেম্বর এ সম্মেলন আমার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। বন্ধু মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানিয়েছেন যে এ বছর আমাকে বাংলা একাডেমীর বিশেষ সম্মানজনক পদ অর্থাৎ ‘ফেলো’ দেওয়া হবে। আমি বাংলা একাডেমীর ফেলো অর্থাৎ ‘পথচারী’ পঞ্চাশ বছর থেকে। পঞ্চাশ বছরে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোয় বাংলা একাডেমীর সুখ্যাতি করেই চলেছি। বলেছি, বাংলা একাডেমী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোকসংগীত সংগৃহীত। মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও পরবর্তী সংগ্রহের তালিকা সর্ববৃহৎ। একাডেমী রক্তের সঙ্গে মিশে, গ্রাম-গ্রামান্তরের লাখ লাখ গিদাল-সংগ্রাহক-উঠতি সাহিত্যিক-উঠতি কবির মতো। বাংলা একাডেমীর চত্বরেই মন ঘুরে বেড়ায়। সম্মানপ্রাপ্তিতে আনন্দিত। এমনটি হয়েছিল আরেকবার। গত বছর সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের ১২৫তম জন্মলগ্নে প্রধান অতিথি। পাঁচ হাজার দর্শক-শ্রোতা, যাদের গান শোনালাম, গল্প শোনালাম ও কাঁদালাম। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। স্কুলের ছাত্র নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, শহীদ তাজউদ্দীন, ড. কামাল হোসেন, ড. বদরুদ্দোজা, সংগীত পরিচালক সমর দাস, সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবিরসহ অজস্র কীর্তিমান পুরুষ। অথচ আমার মতো অধম সেখানে প্রধান বক্তা, গায়ক, গল্পকার।
সভায়এবার চায়ের সময় হলো। চা-পাতা কম, চিনি কম; নয় পানি গরম হয়নি, তবুও তো চা। নাতি বর্ণিত লবণের জুসের চেয়ে অনেক ভালো।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments