দলভিত্তিক পৌর নির্বাচন কতটা যৌক্তিক? by বদিউল আলম মজুমদার
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগামী ১২ থেকে ২৭ জানুয়ারি ২০১১ তারিখের মধ্যে সারা দেশে ২৫৯টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার অনেক দিন পর এবং অনেক দাবির মুখে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন না হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পৌরসভা ‘গঠিত’ হয় না, কারণ ‘কুদরত-ই-ইলাহী বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায় [৪৪ ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)] অনুযায়ী, অনির্বাচিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় সরকার বলা যায় না। তাই দেরিতে হলেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ। তবে দলভিত্তিক আসন্ন নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে আমাদের মনে কিছু গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
প্রথমবারের মতো এবারই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী আনিসুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৪ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথম দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবান্বিত করার পাঁয়তারা করছে—বিএনপি প্রথমে এমন অভিযোগ করলেও, পরবর্তীকালে তারাও দলভিত্তিক নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। জাতীয় পার্টিও এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জোগায়। আমাদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আবারও প্রমাণ করল যে তারা আইন, বিধি ও জনকল্যাণের সামান্যই তোয়াক্কা করে। বুদ্ধিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের চরম অনীহা। আপাতদৃষ্টিতে দলীয় স্বার্থের অনুকূলে বলে মনে হলে, এমনকি তারা আত্মঘাতী কাজ করতেও দ্বিধা করে না।
ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষভাবেই হয়ে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘পৌরসভা (নির্বাচনী আচরণ) বিধিমালা ২০১০’-এ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। বিধিমালার ৬(ঙ) ধারা অনুযায়ী, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিজ ছবি ও প্রতীক ব্যতীত অন্য কাহারো নাম, ছবি বা প্রতীক ছাপাইতে কিংবা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ জাতীয় ইস্যুর ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না, তাই পৌরসভা নির্বাচনকে দলনিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশেই এ বিধান করা হয়। কিন্তু নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার এ ধারা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দলভিত্তিক নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে, যার মাধ্যমে পছন্দ হয়নি বলে বিধিমালাকে তারা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একই সঙ্গে এ উদ্যোগের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়েছে, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা আমরা অনেক দিন থেকেই শুনছি।
দলভিত্তিক নির্বাচন জনকল্যাণের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর মাধ্যমে ভোটারদের ‘চয়েস’ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে। নির্দলীয় স্থানীয় নির্বাচনের একটি আকর্ষণ হলো, সমাজকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তি সাধারণত এতে প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আসেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে এসব ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না, ফলে তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের আকর্ষণ কমে যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগতমানে অবনতি, যা ভোটারদের ঠকানোর সমতুল্য এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
আরেকভাবেও দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দলভিত্তিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়নে সবকিছু দলীকরণ করার মানসিকতা জন্মায়। ফলে গ্রামপর্যায়ে জনগণের নায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চনা সৃষ্টি হয় (প্রথম আলো ৫ আগস্ট ২০১০)। এমনিতেই সবকিছুতে আমাদের দেশে দলীয়করণ চরম, যার ফলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও নির্দলীয় ব্যক্তিরা তাঁদের নায্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যাঁদের শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক নেই, তাঁরাও বিভিন্ন ফায়দা থেকে বঞ্চিত হন। দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এ বঞ্চনা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং তা আরও ব্যাপকতা লাভ করবে বলে আমাদের আশঙ্কা। এ ছাড়া এর ফলে দলীয় বিবেচনায় সরকারি বরাদ্দে পৌরসভাগুলোর মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করা হবে।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলের জন্যও মঙ্গলজনক নয়। এতে দলের অভ্যন্তরে দলাদলি প্রকট হতে বাধ্য, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি অশুভ না হয়ে পারে না। এ দলাদলি অহেতুক, কারণ দল মনোনয়ন প্রদান থেকে বিরত থাকলে, দলের মধ্যকার সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পেতেন, যেমন ঘটেছে গত উপজেলা নির্বাচনে। এতে দল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। পক্ষান্তরে দলভিত্তিক নির্বাচনের এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানে দলের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ির কথা প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। এর ফলে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দল জোটভিত্তিক মনোনয়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে (যুগান্তর ২৫ ডিসেম্বর ২০১০)। এ ছাড়া আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক নির্বাচনের ফলে আসন্ন নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
দলভিত্তিক নির্বাচনের অন্য পরিণতিও রয়েছে। এর ফলে দলবাজির তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ এবং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এমনিতেই বর্তমানে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দলাদলি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং গ্রামপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাই তো এখন গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য পৃথক পৃথক চায়ের দোকান দৃশ্যমান। দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের ফলে এ ধরনের বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছাবে। প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলায় গ্রামপর্যায়ে সিপিএম ও তৃণমূল কংগ্রেসের মাস্তানি এবং মারামারি লেগেই আছে, যার ফলে সেখানেও দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি শোনা যাচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিভক্ত ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত জাতি সামনে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকটি যুক্তি উত্থাপন করে, যার অন্যতম হলো, এর মাধ্যমে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। এটি অনেকটা খোঁড়া যুক্তি, কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করা, দলবিশেষের নয়। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে তেমন ভূমিকা রাখেন না, ফলে তাঁদের পক্ষে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলে নীতি-আদর্শ অনেকটা অর্থহীন স্লোগানে পর্যবসিত হয়েছে এবং প্রধান দলগুলো বহুলাংশে ফায়দাবাজি এবং ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলীয় শৃঙ্খলার অধীনে আসবেন। ফলে অপেক্ষাকৃত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা মনোনীত হবেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের পক্ষে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। আমাদের সমাজে অধিকাংশ অন্যায় ও গর্হিত কাজই পরিচালিত হয় সরাসরি দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় অথবা দলীয় সমর্থনে। বস্তুত দলের, বিশেষত সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া কেউ অপরাধ করে পার পায় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক দলীয় অনুশাসনের প্রয়োগ অনুপস্থিত বললেই চলে।
দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে জোরালো যুক্তি হলো, নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ করা হয়। তাঁদের কাছে রাজনীতি মানেই দল, দল ছাড়া তাঁরা রাজনীতির কথা ভাবতেই পারেন না। আর এ কারণেই নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের বিরোধিতা। তবে ‘নির্দলীয়’ আর ‘অরাজনৈতিক’ শব্দ দুটি সমার্থক নয়। বস্তুত নির্বাচনই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দলভিত্তিক হতে পারে, কিংবা নির্দলীয়ও হতে পারে। তাই নির্দলীয় নির্বাচন বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া—এ দাবি সঠিক নয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ হাইকোর্টের ২০০৮ সালের একটি রায়ও (মো. জসীম উদ্দীন সরকার বনাম বাংলাদেশ, রিট পিটিশন নম্বর ৪৯৬৩, সাল ২০০৮] এ সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে আমাদের আশঙ্কা। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত ‘পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০০৮’-এর ধারা ৩ অনুযায়ী, ‘পৌরসভা নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক হইবে না এবং নির্বাচনী প্রচারণায় কোন রাজনৈতিক দলের নাম, প্রতীক অথবা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম বা ছবি ব্যবহার করা যাইবে না।’ (সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্যও একই বিধান রাখা হয়েছিল।) আদালত আচরণবিধির এ ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এমন বিধান মূল আইনে নেই বলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. আবু তারিক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেন।
রায়ে মাননীয় বিচারকেরা নির্দলীয় নির্বাচনকে ‘রাজনীতিবিবর্জিত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ ধরনের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের আশঙ্কা, এ ক্ষেত্রে রায়ে ধারণাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া—সব স্বার্থসংশ্লিষ্টকে সম্পৃক্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া—যা দলকে সম্পৃক্ত করেও হতে পারে, না করেও হতে পারে। বস্তুত ‘পলিটিক্স’ বা রাজনীতি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘পলিস’ (polis) থেকে, যার অর্থ নগরভিত্তিক-রাষ্ট্র (city-state)। তাই ‘পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটিস’-এর (political activities) বা রাজনৈতিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য দল সৃষ্টি নয় বা দলীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধ অবসান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এর সঙ্গে দলের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই—যদিও দল রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই নির্দলীয় নির্বাচনের অর্থ বিরাজনৈতিকীকরণ নয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে বিজ্ঞ আদালত যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার যথার্থতা নিয়েও আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ প্রদত্ত আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলার রায়ের [৪৫ ডিএলআর(এডি)(১৯৯৩)] কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই রায়ে আদালত বলেন, “‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’-এর বিধানের অধীনে নির্বাচন কমিশনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে একমাত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আইনি বিধির সঙ্গে সংযোজন করার ক্ষমতাকে বুঝায়।” তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
প্রসঙ্গত, জনজীবনে দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশে এবারের পৌরসভা নির্বাচনী বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালায় সভা-সমিতি ও মিছিল-শোডাউন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, এসব বিধিনিষেধের কারণে নির্বাচনে উৎসবের আমেজ থাকবে না। এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান—উৎসবের আয়োজন নয়। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হলে নির্বাচন অনুষ্ঠান রুটিন বিষয়ে পরিণত হতে হবে।
পরিশেষে, আমরা মনে করি যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ হওয়া উচিত, কারণ এর পেছনে জোরালো যুক্তি রয়েছে। আমরা আরও মনে করি যে দলভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ঠকবে এবং ভোটারদেরও ঠকাবে। এর মাধ্যমে দলের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে এবং একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে দলাদলি ভয়ানক আকার ধারণ করবে। ফলে দলের প্রতি অনুগত নয় এমন নাগরিকেরা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন এবং সরকারদলীয় ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়েছেন এমন পৌরসভাগুলোই অধিকাংশ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাবে, যা ন্যায়নীতিবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধিতে বাধানিষেধ সত্ত্বেও দলভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আইনি বিধিবিধানকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
প্রথমবারের মতো এবারই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী আনিসুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৪ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথম দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবান্বিত করার পাঁয়তারা করছে—বিএনপি প্রথমে এমন অভিযোগ করলেও, পরবর্তীকালে তারাও দলভিত্তিক নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। জাতীয় পার্টিও এ সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জোগায়। আমাদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আবারও প্রমাণ করল যে তারা আইন, বিধি ও জনকল্যাণের সামান্যই তোয়াক্কা করে। বুদ্ধিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের চরম অনীহা। আপাতদৃষ্টিতে দলীয় স্বার্থের অনুকূলে বলে মনে হলে, এমনকি তারা আত্মঘাতী কাজ করতেও দ্বিধা করে না।
ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষভাবেই হয়ে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘পৌরসভা (নির্বাচনী আচরণ) বিধিমালা ২০১০’-এ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করে। বিধিমালার ৬(ঙ) ধারা অনুযায়ী, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিজ ছবি ও প্রতীক ব্যতীত অন্য কাহারো নাম, ছবি বা প্রতীক ছাপাইতে কিংবা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ জাতীয় ইস্যুর ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না, তাই পৌরসভা নির্বাচনকে দলনিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশেই এ বিধান করা হয়। কিন্তু নির্বাচনী আচরণ বিধিমালার এ ধারা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দলভিত্তিক নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে, যার মাধ্যমে পছন্দ হয়নি বলে বিধিমালাকে তারা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একই সঙ্গে এ উদ্যোগের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়েছে, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা আমরা অনেক দিন থেকেই শুনছি।
দলভিত্তিক নির্বাচন জনকল্যাণের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর মাধ্যমে ভোটারদের ‘চয়েস’ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে। নির্দলীয় স্থানীয় নির্বাচনের একটি আকর্ষণ হলো, সমাজকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তি সাধারণত এতে প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে আসেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে এসব ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না, ফলে তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের আকর্ষণ কমে যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগতমানে অবনতি, যা ভোটারদের ঠকানোর সমতুল্য এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।
আরেকভাবেও দলভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দলভিত্তিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়নে সবকিছু দলীকরণ করার মানসিকতা জন্মায়। ফলে গ্রামপর্যায়ে জনগণের নায্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চনা সৃষ্টি হয় (প্রথম আলো ৫ আগস্ট ২০১০)। এমনিতেই সবকিছুতে আমাদের দেশে দলীয়করণ চরম, যার ফলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও নির্দলীয় ব্যক্তিরা তাঁদের নায্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যাঁদের শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক নেই, তাঁরাও বিভিন্ন ফায়দা থেকে বঞ্চিত হন। দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এ বঞ্চনা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং তা আরও ব্যাপকতা লাভ করবে বলে আমাদের আশঙ্কা। এ ছাড়া এর ফলে দলীয় বিবেচনায় সরকারি বরাদ্দে পৌরসভাগুলোর মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করা হবে।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলের জন্যও মঙ্গলজনক নয়। এতে দলের অভ্যন্তরে দলাদলি প্রকট হতে বাধ্য, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি অশুভ না হয়ে পারে না। এ দলাদলি অহেতুক, কারণ দল মনোনয়ন প্রদান থেকে বিরত থাকলে, দলের মধ্যকার সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পেতেন, যেমন ঘটেছে গত উপজেলা নির্বাচনে। এতে দল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। পক্ষান্তরে দলভিত্তিক নির্বাচনের এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানে দলের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ির কথা প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। এর ফলে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দল জোটভিত্তিক মনোনয়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে (যুগান্তর ২৫ ডিসেম্বর ২০১০)। এ ছাড়া আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক নির্বাচনের ফলে আসন্ন নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
দলভিত্তিক নির্বাচনের অন্য পরিণতিও রয়েছে। এর ফলে দলবাজির তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ এবং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এমনিতেই বর্তমানে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দলাদলি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং গ্রামপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাই তো এখন গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য পৃথক পৃথক চায়ের দোকান দৃশ্যমান। দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের ফলে এ ধরনের বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছাবে। প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলায় গ্রামপর্যায়ে সিপিএম ও তৃণমূল কংগ্রেসের মাস্তানি এবং মারামারি লেগেই আছে, যার ফলে সেখানেও দলনিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি শোনা যাচ্ছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিভক্ত ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত জাতি সামনে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকটি যুক্তি উত্থাপন করে, যার অন্যতম হলো, এর মাধ্যমে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। এটি অনেকটা খোঁড়া যুক্তি, কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করা, দলবিশেষের নয়। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে তেমন ভূমিকা রাখেন না, ফলে তাঁদের পক্ষে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলে নীতি-আদর্শ অনেকটা অর্থহীন স্লোগানে পর্যবসিত হয়েছে এবং প্রধান দলগুলো বহুলাংশে ফায়দাবাজি এবং ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলীয় শৃঙ্খলার অধীনে আসবেন। ফলে অপেক্ষাকৃত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা মনোনীত হবেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের পক্ষে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। আমাদের সমাজে অধিকাংশ অন্যায় ও গর্হিত কাজই পরিচালিত হয় সরাসরি দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় অথবা দলীয় সমর্থনে। বস্তুত দলের, বিশেষত সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া কেউ অপরাধ করে পার পায় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক দলীয় অনুশাসনের প্রয়োগ অনুপস্থিত বললেই চলে।
দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচনের পক্ষে জোরালো যুক্তি হলো, নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ করা হয়। তাঁদের কাছে রাজনীতি মানেই দল, দল ছাড়া তাঁরা রাজনীতির কথা ভাবতেই পারেন না। আর এ কারণেই নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের বিরোধিতা। তবে ‘নির্দলীয়’ আর ‘অরাজনৈতিক’ শব্দ দুটি সমার্থক নয়। বস্তুত নির্বাচনই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দলভিত্তিক হতে পারে, কিংবা নির্দলীয়ও হতে পারে। তাই নির্দলীয় নির্বাচন বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া—এ দাবি সঠিক নয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ হাইকোর্টের ২০০৮ সালের একটি রায়ও (মো. জসীম উদ্দীন সরকার বনাম বাংলাদেশ, রিট পিটিশন নম্বর ৪৯৬৩, সাল ২০০৮] এ সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে আমাদের আশঙ্কা। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত ‘পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০০৮’-এর ধারা ৩ অনুযায়ী, ‘পৌরসভা নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক হইবে না এবং নির্বাচনী প্রচারণায় কোন রাজনৈতিক দলের নাম, প্রতীক অথবা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম বা ছবি ব্যবহার করা যাইবে না।’ (সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্যও একই বিধান রাখা হয়েছিল।) আদালত আচরণবিধির এ ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এমন বিধান মূল আইনে নেই বলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. আবু তারিক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেন।
রায়ে মাননীয় বিচারকেরা নির্দলীয় নির্বাচনকে ‘রাজনীতিবিবর্জিত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ ধরনের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের আশঙ্কা, এ ক্ষেত্রে রায়ে ধারণাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনীতি একটি প্রক্রিয়া—সব স্বার্থসংশ্লিষ্টকে সম্পৃক্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া—যা দলকে সম্পৃক্ত করেও হতে পারে, না করেও হতে পারে। বস্তুত ‘পলিটিক্স’ বা রাজনীতি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘পলিস’ (polis) থেকে, যার অর্থ নগরভিত্তিক-রাষ্ট্র (city-state)। তাই ‘পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিটিস’-এর (political activities) বা রাজনৈতিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য দল সৃষ্টি নয় বা দলীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধ অবসান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এর সঙ্গে দলের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই—যদিও দল রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই নির্দলীয় নির্বাচনের অর্থ বিরাজনৈতিকীকরণ নয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে বিজ্ঞ আদালত যে প্রশ্ন তুলেছেন, তার যথার্থতা নিয়েও আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ প্রদত্ত আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলার রায়ের [৪৫ ডিএলআর(এডি)(১৯৯৩)] কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই রায়ে আদালত বলেন, “‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’-এর বিধানের অধীনে নির্বাচন কমিশনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে একমাত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আইনি বিধির সঙ্গে সংযোজন করার ক্ষমতাকে বুঝায়।” তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
প্রসঙ্গত, জনজীবনে দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশে এবারের পৌরসভা নির্বাচনী বিধিমালা এবং আচরণ বিধিমালায় সভা-সমিতি ও মিছিল-শোডাউন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, এসব বিধিনিষেধের কারণে নির্বাচনে উৎসবের আমেজ থাকবে না। এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান—উৎসবের আয়োজন নয়। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হলে নির্বাচন অনুষ্ঠান রুটিন বিষয়ে পরিণত হতে হবে।
পরিশেষে, আমরা মনে করি যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ হওয়া উচিত, কারণ এর পেছনে জোরালো যুক্তি রয়েছে। আমরা আরও মনে করি যে দলভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ঠকবে এবং ভোটারদেরও ঠকাবে। এর মাধ্যমে দলের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে এবং একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে দলাদলি ভয়ানক আকার ধারণ করবে। ফলে দলের প্রতি অনুগত নয় এমন নাগরিকেরা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন এবং সরকারদলীয় ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়েছেন এমন পৌরসভাগুলোই অধিকাংশ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাবে, যা ন্যায়নীতিবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধিতে বাধানিষেধ সত্ত্বেও দলভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আইনি বিধিবিধানকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভবিষ্যতে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments