দুর্নীতির রিপোর্টে মন্ত্রীরা বেসামাল! by সোহরাব হাসান
কথাবার্তা একটু হিসাব করে বলতে হয়, না হলে বুমেরাং হয়ে নিজের গায়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ আহূত ২৬ ডিসেম্বরের হরতালের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানালে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা রইরই করে উঠলেন। অভিযোগ করলেন, যুদ্ধাপরাধী আহূত হরতালে সমর্থন জানিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করার চক্রান্ত করছে।
প্রথমেই বলা দরকার, হরতাল একটি ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি। কোনো হরতালেই জনগণের মঙ্গল আসে না। তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সততা ও দক্ষতা দেখালে এবং সরকারি দল বিরোধীদের প্রতি সহনশীল আচরণ করলে তারা হরতাল ডাকার সুযোগ পায় না। ওলামা মাশায়েখ আহূত হরতালটি প্রত্যাহার করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তারা প্রমাণ করল, আলোচনা করে যেকোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।
সরকার চাইলে কি আগের হরতালগুলো থেকেও দেশবাসীকে রেহাই দিতে পারত না? অবশ্যই পারত। শুধু বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা মীমাংসায় আসতে হতো। আলোচনা মানে বিরোধী দলের সব দাবি মেনে নেওয়া নয়। সরকার ওলামা মাশায়েখদের দাবিমতে, জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করেনি। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাতেই ওলামা মাশায়েখরা সন্তুষ্ট।
শেষ পর্যন্ত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ২৬ ডিসেম্বরের হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হরতাল ডাকাটাই ছিল অন্যায় ও অযৌক্তিক। তার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাদের দাবিদাওয়া বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিতে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক।
কিন্তু মন্ত্রীরা আগের বক্তব্যের কী ব্যাখ্যা দেবেন? ওলামা মাশায়েখ পরিষদের এক নেতাকে ইঙ্গিত করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন, ২৬ ডিসেম্বরের হরতাল ডেকেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা। সেই যুদ্ধাপরাধীদের ডাকা হরতালে সমর্থন জানিয়ে বিএনপি নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে। এখন সরকার যখন সেই যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আলোচনা করে হরতাল প্রত্যাহার করিয়ে নিল, তখন অবস্থাটি কী দাঁড়াল? কে বেশি আপস করল? এর পরও আমরা মনে করি, হরতাল আহ্বানকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার কোনো অন্যায় করেনি। সরকার একটি অনিবার্য হরতাল তথা ভাঙচুর-অবরোধ থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। কিন্তু শুরুতে তাঁরা যেভাবে বিরোধী দল ও ওলামা মাশায়েখ নেতাদের অভিযুক্ত করেছিলেন, তার মোক্ষম জবাবও দিয়েছেন পরিষদের এক নেতা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ একা দেশ স্বাধীন করেনি। দেশের স্বাধীনতায় তাঁদেরও ভূমিকা ছিল। ওলামা মাশায়েখদের কেউ যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে সরকার অবশ্যই তার বিচার করবে। হরতাল ডাকা না-ডাকার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
ক্ষমতাসীনেরা যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ধরনের সংলাপ, আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়কে গুরুত্ব দিতেন, তাহলে দেশের অনেক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হতো। বিরোধী দল যেসব দাবিতে আন্দোলন করছে, সব কটি যেমন যৌক্তিক নয়, তেমনি ষড়যন্ত্রমূলকও নয়। সরকার সেগুলো নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে আলোচনা করতে পারত। দেশীয় সমস্যা নিয়ে বিদেশি দূতদের সঙ্গে আলোচনার চেয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা উত্তম। বিএনপি বলছে, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার হামলা-মামলা চালাচ্ছে। তাদের এই দাবি অসত্য হলে সরকারের উচিত যুক্তি ও তথ্য দিয়ে তা খণ্ডন করা। কোন নেতার বিরুদ্ধে কী মামলা আছে, তাও দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়া।
রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের করা মামলা নিয়ে সরকার যা করছে, তার প্রতিবাদ এসেছে খোদ সরকারি দলের পক্ষ থেকে। এটি এখন নেতাদের ঘুষ-বাণিজ্যের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের মেয়াদ দুই বছর পার হতে চলেছে। এই দুই বছরে তারা কী করেছে, কী করেনি, কী করার অঙ্গীকার করেছিল, সেই হিসাব এখন জনগণ নিতে চাইবে। কেবল বিএনপি-জামায়াত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
ওলামা মাশায়েখ পরিষদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে যদি সরকার একটি সমঝোতায় আসতে পারে, তাহলে বিএনপির সঙ্গে আসতে পারবে না কেন? তারা আলোচনা করবে নিশ্চয়ই দুর্নীতির মামলা থেকে বিএনপির নেতাদের ছেড়ে দিতে নয়। আলোচনা করবে দেশ পরিচালনায় সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, কীভাবে জনজীবনের সমস্যা সমাধান করা যায়, কীভাবে সংসদ কার্যকর করা যায়, সেসব নিয়ে।
২.
বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির একটি অদ্ভুত রেওয়াজ চালু আছে। সরকারের কোনো দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না। সরকারের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশের বড়-ছোট ও মাঝারি কর্মকর্তা, সরকারের সমর্থক ও পেশাজীবীরা গায়ের জোরে সবার কণ্ঠ রোধ করতে চায়। তারা বিরোধী দলের প্রতিবাদ স্তব্ধ করতে চায়। গণমাধ্যমের কণ্ঠও রোধ করতে চায়। এমনকি স্বাধীন সংস্থাগুলোকেও পেশাদারি দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। এটি সুস্থতার লক্ষণ নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে তারা কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে। টিআইবি কোনো সরকারকে ক্ষমতায় বসায় না, ‘ভূপাত ধরণীতল’ও করে না (করলে চার-চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিএনপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না)। টিআইবি সরকারের বিভিন্ন সেবা খাত নিয়ে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও মতামতের ভিত্তিতে কিছু জরিপ প্রতিবেদন করে থাকে। উদ্দেশ্য, কে কতটুকু সেবা পেল কিংবা পেল না, তা তুলে ধরা। এসব জরিপ শতভাগ নির্ভুল নয়, আবার উদ্দেশ্যমূলক, তা বলারও যুক্তি নেই।
টিআইবি বৃহস্পতিবার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘২০০৭ সালের খানা জরিপে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার বিচার বিভাগের দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। কিন্তু এ দফায় তা বেড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের শতকরা ১০ দশমিক ৯ শতাংশ বিচার বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন। তাঁদের ৮৮ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। সেবাগ্রহীতারা দ্রুত শুনানি হওয়া, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা, নথি তোলা, শুনানির তারিখ পেছানো ও নথিপত্র গায়েব করে দেওয়ার জন্য ঘুষ দেয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন হয়েছে হাইকোর্টের মামলার ক্ষেত্রে, ঘুষের পরিমাণ খানাপ্রতি গড়ে ১২ হাজার ৭৬১ টাকা, জজকোর্টে তা ছয় হাজার ১৭৮ টাকা এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ছয় হাজার ৫৯৮ টাকা।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইনজীবীর হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ; ৪১ শতাংশ মানুষ সময়ক্ষেপণ, ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ আদালতের কর্মকর্তা বা কর্মচারী, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ মুহরির, ২ দশমিক ৭ শতাংশ দালালের হয়রানি এবং ৯ দশমিক ১ শতাংশ নথি তোলায় হয়রানির শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯-১০ সালে সেবা পাওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রায় ৬০ শতাংশ খানা গড়ে সাত হাজার ৯১৮ টাকা ঘুষ দিয়েছে।
‘খাতভেদে ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ে এগিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পুলিশের শনাক্তকরণ প্রতিবেদন ও অনাপত্তিপত্র পেতে সেবাগ্রহীতাদের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গণগ্রেপ্তারের মুখোমুখি হয়ে প্রায় ৮৯ শতাংশ পরিবারকে গড়ে চার হাজার ৪৫ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এরপরই দুর্নীতিতে এগিয়ে আছে ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া কর ও শুল্ক বিভাগের সেবা পাওয়ার জন্য ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সেবা পেতে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার, কৃষিসেবা পেতে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার, স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে সেবা পেতে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার, স্বাস্থ্যসেবা পেতে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, বিমা খাতে ১৫ শতাংশ খানা, ব্যাংকিং খাতে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ খানা, ৭ দশমিক ২ শতাংশ ঋণগ্রহীতা এনজিও থেকে ঋণ নিতে এবং শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ খানা ঘুষ-অনিয়মের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।’ (প্রথম আলো ২৪ ডিসেম্বর ২০১০)।
এসব তথ্য নতুনও নয়, অভিনবও নয়। কিন্তু টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরই মন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রী, সরকারের উপদেষ্টা থেকে আইনজীবী সমিতির সভাপতি, পুলিশের মহাপরিদর্শক থেকে ঢাকার কমিশনার পর্যন্ত শোরগোল তুলেছেন। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। কেউ প্রশ্ন করছেন, এ সময়ে কেন রিপোর্ট দেওয়া হলো? কেউ বলছেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে। কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। আমরা বুঝি না, টিআইবির প্রতিবেদনের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কী সম্পর্ক? মন্ত্রী-নেতারা যখন প্রতিবেদন নিয়ে ঝড় তুলছেন, তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান কী বলছেন? জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছেন, ‘টিআইবি দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশ করেছে, দেশে তার চেয়েও বেশি দুর্নীতি হচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ঐ)
তাহলে দুদক চেয়ারম্যানও কি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন? আরও মজার ব্যাপার হলো, সব বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বৈরিতা থাকলেও প্রতিবেদনের বিষয়ে তারা এককাট্টা। কুমিল্লায় টিআইবির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির এক সদস্য। টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সরকার-সমর্থক ও বিরোধী আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেছেন, প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ মন্তব্য করেছেন সরকার-সমর্থক আইনজীবী নেতারাও। আসল কথা হচ্ছে, বিচার বিভাগ বা পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে কি কমেছে, তা জানতে টিআইবির প্রতিবেদন পড়ার প্রয়োজন নেই। ভূক্তভোগীরাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে প্রধান বিচারপতিও নিম্ন আদালতের বিচারকদের ঘুষ গ্রহণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাহলে টিআইবির দোষটা কোথায়? টিআইবির প্রতিবেদনে অসত্য কিছু থাকলে সরকার চ্যালেঞ্জ করতে পারত।তা না করে মন্ত্রীরা যে ভাষায় গবেষণা-প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন, তা শিষ্টাচার ও ন্যায়নীতিবর্জিত। এর পাশাপাশি মামলা করেও টিআইবির কর্মকর্তাদের খামোশ করার চেষ্টা চলছে। মন্ত্রীরা টিআইবির কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চেয়েছেন। তা চাইতেই পারেন। তাঁরা আইনকানুন মানছেন কি না, ঠিকমতো কর দিচ্ছেন কি না, সেসব দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। এর সঙ্গে টিআইবির পুরো প্রতিবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে সরকার ঠিকমতো দেশ চালাচ্ছে কি না, তা জানতে চাওয়ার অধিকার জনগণের আছে। টিআইবির জরিপে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। তারা ঢালাওভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন মাত্র। আগের জরিপগুলো বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যায়। আগের জরিপে কখনো শিক্ষা খাত, কখনো বন্দর, কখনো স্থানীয় সরকার দুর্নীতির শীর্ষে ছিল। এবারে বিচার বিভাগ ও পুলিশ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে সংশ্লিষ্টদের লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। একসময় বলা হতো, শিক্ষা ভবনের ইটও ঘুষ খায়। সেই বদনাম ঘুচেছে, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি কমেছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৯ শতাংশ থেকে ১৫-তে নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে ৪৪ থেকে নেমে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই এক ধাপ অগ্রগতি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত এই সফলতা দেখাতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না?
আসলে কে মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন, কীভাবে চালাচ্ছেন, তার ওপরও মন্ত্রণালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। মন্ত্রী যদি ঘুষ ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তারাও দুর্নীতি করতে ভয় পাবেন। এই সরল সত্যটি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চালকেরাও বুঝতে পারলে জরিপ নিয়ে এত হইচই করতেন না। কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি টেনে আনতেন না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, তা সবাই চায়। তার অর্থ এই নয় যে মন্ত্রণালয়গুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। আমরা এ রকম কবরের নিস্তব্ধতাপ্রিয় গণতন্ত্র চাই না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
প্রথমেই বলা দরকার, হরতাল একটি ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি। কোনো হরতালেই জনগণের মঙ্গল আসে না। তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় সততা ও দক্ষতা দেখালে এবং সরকারি দল বিরোধীদের প্রতি সহনশীল আচরণ করলে তারা হরতাল ডাকার সুযোগ পায় না। ওলামা মাশায়েখ আহূত হরতালটি প্রত্যাহার করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তারা প্রমাণ করল, আলোচনা করে যেকোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।
সরকার চাইলে কি আগের হরতালগুলো থেকেও দেশবাসীকে রেহাই দিতে পারত না? অবশ্যই পারত। শুধু বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা মীমাংসায় আসতে হতো। আলোচনা মানে বিরোধী দলের সব দাবি মেনে নেওয়া নয়। সরকার ওলামা মাশায়েখদের দাবিমতে, জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করেনি। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাতেই ওলামা মাশায়েখরা সন্তুষ্ট।
শেষ পর্যন্ত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ২৬ ডিসেম্বরের হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। হরতাল ডাকাটাই ছিল অন্যায় ও অযৌক্তিক। তার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাদের দাবিদাওয়া বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিতে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক।
কিন্তু মন্ত্রীরা আগের বক্তব্যের কী ব্যাখ্যা দেবেন? ওলামা মাশায়েখ পরিষদের এক নেতাকে ইঙ্গিত করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন, ২৬ ডিসেম্বরের হরতাল ডেকেছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা। সেই যুদ্ধাপরাধীদের ডাকা হরতালে সমর্থন জানিয়ে বিএনপি নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে। এখন সরকার যখন সেই যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আলোচনা করে হরতাল প্রত্যাহার করিয়ে নিল, তখন অবস্থাটি কী দাঁড়াল? কে বেশি আপস করল? এর পরও আমরা মনে করি, হরতাল আহ্বানকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার কোনো অন্যায় করেনি। সরকার একটি অনিবার্য হরতাল তথা ভাঙচুর-অবরোধ থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। কিন্তু শুরুতে তাঁরা যেভাবে বিরোধী দল ও ওলামা মাশায়েখ নেতাদের অভিযুক্ত করেছিলেন, তার মোক্ষম জবাবও দিয়েছেন পরিষদের এক নেতা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ একা দেশ স্বাধীন করেনি। দেশের স্বাধীনতায় তাঁদেরও ভূমিকা ছিল। ওলামা মাশায়েখদের কেউ যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে সরকার অবশ্যই তার বিচার করবে। হরতাল ডাকা না-ডাকার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
ক্ষমতাসীনেরা যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ধরনের সংলাপ, আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়কে গুরুত্ব দিতেন, তাহলে দেশের অনেক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হতো। বিরোধী দল যেসব দাবিতে আন্দোলন করছে, সব কটি যেমন যৌক্তিক নয়, তেমনি ষড়যন্ত্রমূলকও নয়। সরকার সেগুলো নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে আলোচনা করতে পারত। দেশীয় সমস্যা নিয়ে বিদেশি দূতদের সঙ্গে আলোচনার চেয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করা উত্তম। বিএনপি বলছে, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার হামলা-মামলা চালাচ্ছে। তাদের এই দাবি অসত্য হলে সরকারের উচিত যুক্তি ও তথ্য দিয়ে তা খণ্ডন করা। কোন নেতার বিরুদ্ধে কী মামলা আছে, তাও দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়া।
রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের করা মামলা নিয়ে সরকার যা করছে, তার প্রতিবাদ এসেছে খোদ সরকারি দলের পক্ষ থেকে। এটি এখন নেতাদের ঘুষ-বাণিজ্যের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের মেয়াদ দুই বছর পার হতে চলেছে। এই দুই বছরে তারা কী করেছে, কী করেনি, কী করার অঙ্গীকার করেছিল, সেই হিসাব এখন জনগণ নিতে চাইবে। কেবল বিএনপি-জামায়াত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
ওলামা মাশায়েখ পরিষদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে যদি সরকার একটি সমঝোতায় আসতে পারে, তাহলে বিএনপির সঙ্গে আসতে পারবে না কেন? তারা আলোচনা করবে নিশ্চয়ই দুর্নীতির মামলা থেকে বিএনপির নেতাদের ছেড়ে দিতে নয়। আলোচনা করবে দেশ পরিচালনায় সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, কীভাবে জনজীবনের সমস্যা সমাধান করা যায়, কীভাবে সংসদ কার্যকর করা যায়, সেসব নিয়ে।
২.
বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির একটি অদ্ভুত রেওয়াজ চালু আছে। সরকারের কোনো দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না। সরকারের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশের বড়-ছোট ও মাঝারি কর্মকর্তা, সরকারের সমর্থক ও পেশাজীবীরা গায়ের জোরে সবার কণ্ঠ রোধ করতে চায়। তারা বিরোধী দলের প্রতিবাদ স্তব্ধ করতে চায়। গণমাধ্যমের কণ্ঠও রোধ করতে চায়। এমনকি স্বাধীন সংস্থাগুলোকেও পেশাদারি দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। এটি সুস্থতার লক্ষণ নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে তারা কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে। টিআইবি কোনো সরকারকে ক্ষমতায় বসায় না, ‘ভূপাত ধরণীতল’ও করে না (করলে চার-চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিএনপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারত না)। টিআইবি সরকারের বিভিন্ন সেবা খাত নিয়ে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও মতামতের ভিত্তিতে কিছু জরিপ প্রতিবেদন করে থাকে। উদ্দেশ্য, কে কতটুকু সেবা পেল কিংবা পেল না, তা তুলে ধরা। এসব জরিপ শতভাগ নির্ভুল নয়, আবার উদ্দেশ্যমূলক, তা বলারও যুক্তি নেই।
টিআইবি বৃহস্পতিবার ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘২০০৭ সালের খানা জরিপে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার বিচার বিভাগের দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। কিন্তু এ দফায় তা বেড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের শতকরা ১০ দশমিক ৯ শতাংশ বিচার বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন। তাঁদের ৮৮ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। সেবাগ্রহীতারা দ্রুত শুনানি হওয়া, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা, নথি তোলা, শুনানির তারিখ পেছানো ও নথিপত্র গায়েব করে দেওয়ার জন্য ঘুষ দেয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন হয়েছে হাইকোর্টের মামলার ক্ষেত্রে, ঘুষের পরিমাণ খানাপ্রতি গড়ে ১২ হাজার ৭৬১ টাকা, জজকোর্টে তা ছয় হাজার ১৭৮ টাকা এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ছয় হাজার ৫৯৮ টাকা।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আইনজীবীর হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ; ৪১ শতাংশ মানুষ সময়ক্ষেপণ, ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ আদালতের কর্মকর্তা বা কর্মচারী, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ মুহরির, ২ দশমিক ৭ শতাংশ দালালের হয়রানি এবং ৯ দশমিক ১ শতাংশ নথি তোলায় হয়রানির শিকার হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯-১০ সালে সেবা পাওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রায় ৬০ শতাংশ খানা গড়ে সাত হাজার ৯১৮ টাকা ঘুষ দিয়েছে।
‘খাতভেদে ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ে এগিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পুলিশের শনাক্তকরণ প্রতিবেদন ও অনাপত্তিপত্র পেতে সেবাগ্রহীতাদের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গণগ্রেপ্তারের মুখোমুখি হয়ে প্রায় ৮৯ শতাংশ পরিবারকে গড়ে চার হাজার ৪৫ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এরপরই দুর্নীতিতে এগিয়ে আছে ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা। সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭১ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া কর ও শুল্ক বিভাগের সেবা পাওয়ার জন্য ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সেবা পেতে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার, কৃষিসেবা পেতে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার, স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে সেবা পেতে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার, স্বাস্থ্যসেবা পেতে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, বিমা খাতে ১৫ শতাংশ খানা, ব্যাংকিং খাতে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ খানা, ৭ দশমিক ২ শতাংশ ঋণগ্রহীতা এনজিও থেকে ঋণ নিতে এবং শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ খানা ঘুষ-অনিয়মের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।’ (প্রথম আলো ২৪ ডিসেম্বর ২০১০)।
এসব তথ্য নতুনও নয়, অভিনবও নয়। কিন্তু টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরই মন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রী, সরকারের উপদেষ্টা থেকে আইনজীবী সমিতির সভাপতি, পুলিশের মহাপরিদর্শক থেকে ঢাকার কমিশনার পর্যন্ত শোরগোল তুলেছেন। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজছেন। কেউ প্রশ্ন করছেন, এ সময়ে কেন রিপোর্ট দেওয়া হলো? কেউ বলছেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে। কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। আমরা বুঝি না, টিআইবির প্রতিবেদনের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কী সম্পর্ক? মন্ত্রী-নেতারা যখন প্রতিবেদন নিয়ে ঝড় তুলছেন, তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান কী বলছেন? জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছেন, ‘টিআইবি দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশ করেছে, দেশে তার চেয়েও বেশি দুর্নীতি হচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ঐ)
তাহলে দুদক চেয়ারম্যানও কি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন? আরও মজার ব্যাপার হলো, সব বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বৈরিতা থাকলেও প্রতিবেদনের বিষয়ে তারা এককাট্টা। কুমিল্লায় টিআইবির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির এক সদস্য। টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সরকার-সমর্থক ও বিরোধী আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেছেন, প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ মন্তব্য করেছেন সরকার-সমর্থক আইনজীবী নেতারাও। আসল কথা হচ্ছে, বিচার বিভাগ বা পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে কি কমেছে, তা জানতে টিআইবির প্রতিবেদন পড়ার প্রয়োজন নেই। ভূক্তভোগীরাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে প্রধান বিচারপতিও নিম্ন আদালতের বিচারকদের ঘুষ গ্রহণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাহলে টিআইবির দোষটা কোথায়? টিআইবির প্রতিবেদনে অসত্য কিছু থাকলে সরকার চ্যালেঞ্জ করতে পারত।তা না করে মন্ত্রীরা যে ভাষায় গবেষণা-প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন, তা শিষ্টাচার ও ন্যায়নীতিবর্জিত। এর পাশাপাশি মামলা করেও টিআইবির কর্মকর্তাদের খামোশ করার চেষ্টা চলছে। মন্ত্রীরা টিআইবির কর্মকর্তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চেয়েছেন। তা চাইতেই পারেন। তাঁরা আইনকানুন মানছেন কি না, ঠিকমতো কর দিচ্ছেন কি না, সেসব দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। এর সঙ্গে টিআইবির পুরো প্রতিবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে সরকার ঠিকমতো দেশ চালাচ্ছে কি না, তা জানতে চাওয়ার অধিকার জনগণের আছে। টিআইবির জরিপে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। তারা ঢালাওভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেনি। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন মাত্র। আগের জরিপগুলো বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যায়। আগের জরিপে কখনো শিক্ষা খাত, কখনো বন্দর, কখনো স্থানীয় সরকার দুর্নীতির শীর্ষে ছিল। এবারে বিচার বিভাগ ও পুলিশ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে সংশ্লিষ্টদের লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। একসময় বলা হতো, শিক্ষা ভবনের ইটও ঘুষ খায়। সেই বদনাম ঘুচেছে, শিক্ষা খাতে দুর্নীতি কমেছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৯ শতাংশ থেকে ১৫-তে নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য খাতে ৪৪ থেকে নেমে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই এক ধাপ অগ্রগতি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত এই সফলতা দেখাতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না?
আসলে কে মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন, কীভাবে চালাচ্ছেন, তার ওপরও মন্ত্রণালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। মন্ত্রী যদি ঘুষ ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তারাও দুর্নীতি করতে ভয় পাবেন। এই সরল সত্যটি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চালকেরাও বুঝতে পারলে জরিপ নিয়ে এত হইচই করতেন না। কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি টেনে আনতেন না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, তা সবাই চায়। তার অর্থ এই নয় যে মন্ত্রণালয়গুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। আমরা এ রকম কবরের নিস্তব্ধতাপ্রিয় গণতন্ত্র চাই না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments