মানসিকতার বদল না হলে দেশ বদল হবে না -সুশাসন by বদিউল আলম মজুমদার
‘বদলে যাও, বদলে দাও’—স্লোগানটি সামনে রেখে প্রথম আলো তার একাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। পত্রিকার সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। একই সঙ্গে তাঁদের ধন্যবাদ জানাই স্লোগানটির জন্য। স্লোগানটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ, কারণ সারা পৃথিবী বদলে যাচ্ছে আর আমরা যদি না বদলাই, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা পেছনে পড়ে থাকব। এমনকি আমরা সংকটের মুখোমুখি হব, যা আমাদের ভবিষ্যেক বিপন্ন করে তুলতে পারে।
বস্তুত ইতিহাসের শিক্ষা হলো, পরিবর্তনের সঙ্গে অগ্রগতি-সমৃদ্ধি, এমনকি টিকে থাকাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি বলেই অনেক সভ্যতা অতীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতিতেও তা-ই ঘটছে। চার্লস ডারউইনের ভাষায়, ‘It is not the strongest species that survived, nor the most intelligent, but the ones most responsive to change.’ অর্থাত্ প্রাণিকুলে সবচেয়ে শক্তিশালী কিংবা সবচেয়ে বুদ্ধিমানেরা টিকে থাকেনি, বরং পরিবর্তনের সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পেরেছে, তারাই টিকে রয়েছে।
আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্যও পরিবর্তন আবশ্যক। এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য—আমাদের এ উপমহাদেশেই এককালের পরাক্রমশালী বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কিংবা বিলুপ্তপ্রায়, যার মূল কারণ তাদের পরিবর্তনে অনাগ্রহ। আর এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতার বদল হলেই প্রেক্ষাপট বদলে যায় এবং পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচিত হয়। বস্তুত মানসিকতার বদল সংশ্লিষ্টদের জীবন বদলে দেয়, ফলে বদলে যায় অর্থনীতি, রাজনীতি তথা পুরো সমাজ।
আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কথায় আসা যাক। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সনাতন ধারণা হলো যে বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, দারিদ্র্য দূরীভূত হবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অঙ্গনেও পরিবর্তন আসবে। নিঃসন্দেহে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের মতো দেশে বিশেষত আইনের শাসন তথা সুশাসনের অভাবে উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দুরূহ এবং উত্পাদনের ফলও অনেক ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক নয়। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও প্রয়োজনীয় সামাজিক উন্নয়ন দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল করতে হবে।
মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো চারভাবে বিভাজন করা যায়: জীবন-জীবিকার সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-অংশগ্রহণ বা সুশাসনের সমস্যা এবং অবকাঠামোগত সমস্যা। সামাজিক ও সুশাসনের সমস্যা জনগণকে সংগঠিত করে সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে তুলে বহুলাংশে সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে যথাযথভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি এবং সমাজসচেতন নাগরিকেরা। সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ বিনা বা স্বল্প খরচেই করা সম্ভব। আর সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জনগণের চেতনার উন্মেষ ঘটলে অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য দুরূহ সমস্যা সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই উত্পাদনশীল বিনিয়োগ আবশ্যক। তবে আমাদের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপক বিস্তার ছাড়া দারিদ্র্য দূরীভূত হবে না এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হবে না। আর এ কাজের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুঁজির সংস্থান আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এ কাজে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণকে সংগঠিত করে এবং স্থানীয় সংগঠন গড়ে তুলেও পুঁজির জোগান দেওয়া যায়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগিয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সঙ্গে কৃষিঋণ, শস্যবীমা এবং বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ও ভর্তুকি বিতরণ করে কৃষি খাতেও গতিশীলতা আনা যেতে পারে।
দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে যে শুধু আয়ের অভাবই দারিদ্র্য নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদির অভাবও দারিদ্র্যের অংশ। আত্মমর্যাদা হনন, নিগ্রহ-বঞ্চনা প্রভৃতির উপস্থিতিও দারিদ্র্য অবস্থারই প্রতিফলন। তাই দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন সার্বিক অবস্থা পরিবর্তনের উদ্যোগ। আর আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র এ কাজের জন্য উপযোগী নয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন স্মরণ করা যেতে পারে: ‘তোরা পারবি নে কেউ ফুল ফোটাতে,/ যতই তোরা পাপড়ি টানিস, আঘাত করিস বোঁটতে/ তোরা পারবি নে কেউ ফুল ফোটাতে।’ ফুলের ধর্মই ফোটা, ফুলকে জোর করে ফোটানো যায় না—ফুল গাছকে আগাছা এবং মানুষের হাত থেকে রক্ষা ও পরিচর্যা করলে ফুল আপনা থেকেই ফুটবে। আর এ কাজটি করার জন্য প্রয়োজন মালীর। অর্থাত্ ফুল ফোটার ব্যাপারে মালীর ভূমিকা সহায়কের।
ফুল যেমন স্বাভাবিকভাবেই ফোটে, তেমনিভাবে আত্মশক্তিতে বলীয়ান প্রত্যেক মানুষের পক্ষেও তার নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব। নিজ জীবনের হাল ধরার মতো প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষমতা দিয়েই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো মালীর কাজ করতে পারে। তারা জনগণের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের নিজেদের ভাগ্য গড়ার কারিগরে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমাদের চেতনায় আরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে যে উন্নয়ন শুধু টাকা-পয়সার বিষয় নয়, যদিও অবকাঠামো সৃষ্টির জন্য অর্থের প্রয়োজন। বরং টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অর্থের ছড়াছড়ি দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের জন্ম দিতে পারে। ব্যক্তি আত্মপ্রত্যয়ী না হলে, অর্থের আধিক্য তাকে অসফল ও তার মধ্যে পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এভাবে অর্থ অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের উপলদ্ধিতে আনতে হবে যে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ নয়। একটি দেশের বড় সম্পদ তার জনগণ এবং জনগণের মেধা-সৃজনশীলতা। আর মেধা-সৃজনশীলতার আমরা কোনো অংশেই কারও থেকে কম নই। বিদেশের মাটির সহায়ক পরিবেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের প্রতিনিয়ত পরাভূত করছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তারা প্রমাণ করছে, নজরুলের ভাষায়: ‘বাঙ্গালী তুমি ক্ষুদ্র নও, তুমি তুচ্ছ নও। একবার জেগে উঠ, দেখবে তুমিও বিশ্ববিজয়ী হতে পার।’ এ ছাড়া আমাদের মিষ্টিপানি, উর্বর মাটি ও সম্ভবত গ্যাস-তেলের মতো সম্পদও রয়েছে। আমাদের অভাব মূলত একতার, শৃঙ্খলার, সহিষ্ণুতার ও দৃষ্টিভঙ্গির। এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে আমরাও সম্পদশালী হতে পারব। আমাদের প্রতিবেশীদের অনেকেই তা করতে পেরেছে।
রাজনীতি সম্পর্কেও আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে—রাজনীতির উদ্দেশ্য জনসেবা ও মানুষের কল্যাণ, ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি নয়। মানুষের সঙ্গে শান্তি-সমপ্রীতি গড়ে তোলা, দ্বন্দ্ব-হানাহানি সৃষ্টি নয়। তাদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা, বিভক্তি নয়। সমস্যার সমাধান করা, সমস্যা সৃষ্টি করা নয়। মানুষের মধ্যে আশা-ভরসা জাগ্রত করা, তাদের হতাশ-নিরাশ করা নয়। কারণ চোখের বদলে চোখ নিলে, অন্ধের এবং হাত-পায়ের পরিবর্তে হাত-পা নিলে, পঙ্গুত্বের রাজত্ব সৃষ্টি হয়। আর লুটপাট ও হানাহানির সংস্কৃতিতে এবং হতাশা ও নেতিবাচক পরিবেশে ভালো কিছু ঘটে না; বরংযথেচ্ছাচারের সৃষ্টি হয় এবং সমাজ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়।
এ ছাড়া রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, সমাজকে একত্র করার ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা ও দায়িত্ব সর্বাধিক। যত বেশি ব্যক্তি ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে, ততই তাদের সফলতা। তাই তাদেরই হতে হবে অনেক বেশি উদার ও সহিষ্ণু। এ ছাড়া বিরোধীদের দোষারোপ করে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই—অনেক নাগরিকই মনে করেন, এসব করা হয় সরকারের নিজের অপারগতা ঢাকার জন্য। সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে এগুলো উদ্ঘাটন করার এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার এবং সত্যিকার অর্থেই ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে থাকলে সরকার তা করত।
আন্তরিকভাবে জনগণের কল্যাণ চাইলে বিরোধীদেরও সরকারের কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে, অন্তত জনকল্যাণমূলক কাজে বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়, এমনকি বিরোধীদের জন্যও তা সুবিধাজনক পরিণতি সৃষ্টি করে না। আকাশের দিকে থুতু ছুড়লে তা নিজের গায়ে এসেই পড়ে। ঢিল ছুড়লে পরবর্তী সময়ে পাটকেল খেতে হয়। আর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আগুনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে পরবর্তী সময়ে ছাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
রাজনীতির ক্ষেত্রে মানসিকতা বদলের আরও প্রয়োজন যে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো—জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারাই তাদের প্রভুর আসনে অধিষ্ঠিত। আর এই প্রভুরা জনগণকে ভেড়ার পাল হিসেবেই গণ্য করে এবং তাদের পদে পদে বঞ্চিত করে। আর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হলে এবং তাদের বঞ্চনার অবসান না ঘটলে সত্যিকারের গণতন্ত্র কায়েম ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে না।
এ ছাড়া রাজনীতিকদের উপলব্ধিতে আনতে হবে যে ভোট দিয়ে জনগণ সরকার গঠন করে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। রাজনৈতিক দল হলে উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কোনো সুস্পষ্ট নীতি-আদর্শ বা জনস্বার্থকর কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সিন্ডিকেটের মতো দলের সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান নয়। আর এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিলে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানিই সৃষ্টি হয়, কারণ সুযোগ-সুবিধার পরিমাণের তুলনায় প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক বেশি—ফায়দার লোভে অনেকেই দলের খাতায় নাম লেখায়। উপরন্তু ফায়দাবাজির সংস্কৃতিতে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে না।
রাজনীতিকদের মানসিকতায় আরও পরিবর্তন প্রয়োজন যে দলীয়করণের ফলাফল মঙ্গলকর নয়। দলীয়করণের সংস্কৃতিতে অযোগ্য-অদক্ষরাই সাধারণত লাভবান হন এবং যোগ্য-দক্ষ ও নিরপেক্ষরা বঞ্চিত হন। ফলে সরকারের কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। এ ছাড়া দলবাজির সংস্কৃতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরস্পরকে ল্যাং মারার এক অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতা বিবেচনায় না নেওয়ার এবং পক্ষপাতিত্বের ফলে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। তাই দলীয়করণের ফলে হিতের চেয়ে বিপরীতই বেশি হয়। বস্তুত লাগামহীন দলীয়করণের ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভবিষ্যতে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
রাজনীতিবিদদের স্বীকার করতে হবে যে তাঁদের প্রশ্রয়েই এ দেশে উগ্রবাদের উদ্ভব ঘটেছে। আর রাজনীতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে এবং এর বিস্তার সম্ভব নয়। এ ছাড়া দুর্নীতি ও বঞ্চনা সাধারণ মানুষকে এদিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই উগ্রবাদ রোধ করতে হলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটাতে হবে, দারিদ্র্য দূরীকরণ করতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিকে নৈতিকতার ওপর দাঁড় করাতে হবে এবং উগ্রবাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটাতে হবে।
আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিকতারও বদল হওয়া দরকার। অনেক দিন আগে আমাদের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আফসোস করে বলেছিলেন, সরকার যেন চারদিকে দোকান পেতে বসে আছে জনগণরূপী মক্কেল ধরে হেনস্থা করার জন্য। বস্তুত বাধা দেওয়া, সমস্যা সৃষ্টি করা, হয়রানি করা যেন আমলাতন্ত্রের আজ ধর্ম হয়ে পড়েছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ধরনের আবহ সৃষ্টি করে উেকাচ আদায় করেন কিংবা অন্যভাবে লাভবান হন। দলবাজির সঙ্গে দুর্নীতির এ সংমিশ্রণ আমাদের আমলাতন্ত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
পরিশেষে, এ কথা সুস্পষ্ট যে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনতে হলে—যা করা আমাদের জন্য অতি জরুরি—আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে এবং অন্যদের বদলাতে সহায়তা করতে হবে। প্রত্যেককেই পরিবর্তনের রূপকারে পরিণত হতে হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে, সবার পক্ষেই হয়তো মস্ত বড় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভবপর নয়—কেউ হয়তো পর্বতের পাদদেশের নুড়িপাথর সরাতে পারবে, অন্য কেউ হয়তো পর্বতকেই ঠেলা দিতে পারবে। অসাধারণ কাজ করা অনেকের জন্য সাধারণ ব্যাপার, আর অনেকে অল্পতেই গলদধর্ম। তবু সবাইকেই নিজেদের বদলাতে উদ্যোগী হতে হবে। আশার কথা, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগে আমাদের দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু দিনবদলের জন্য প্রয়োজন মনমানসিকতার পরিবর্তন। তারা কি তা করবে? তাদের কথা রাখবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
বস্তুত ইতিহাসের শিক্ষা হলো, পরিবর্তনের সঙ্গে অগ্রগতি-সমৃদ্ধি, এমনকি টিকে থাকাও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি বলেই অনেক সভ্যতা অতীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতিতেও তা-ই ঘটছে। চার্লস ডারউইনের ভাষায়, ‘It is not the strongest species that survived, nor the most intelligent, but the ones most responsive to change.’ অর্থাত্ প্রাণিকুলে সবচেয়ে শক্তিশালী কিংবা সবচেয়ে বুদ্ধিমানেরা টিকে থাকেনি, বরং পরিবর্তনের সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পেরেছে, তারাই টিকে রয়েছে।
আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্যও পরিবর্তন আবশ্যক। এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য—আমাদের এ উপমহাদেশেই এককালের পরাক্রমশালী বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কিংবা বিলুপ্তপ্রায়, যার মূল কারণ তাদের পরিবর্তনে অনাগ্রহ। আর এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতার বদল হলেই প্রেক্ষাপট বদলে যায় এবং পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচিত হয়। বস্তুত মানসিকতার বদল সংশ্লিষ্টদের জীবন বদলে দেয়, ফলে বদলে যায় অর্থনীতি, রাজনীতি তথা পুরো সমাজ।
আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কথায় আসা যাক। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সনাতন ধারণা হলো যে বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, দারিদ্র্য দূরীভূত হবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অঙ্গনেও পরিবর্তন আসবে। নিঃসন্দেহে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের মতো দেশে বিশেষত আইনের শাসন তথা সুশাসনের অভাবে উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দুরূহ এবং উত্পাদনের ফলও অনেক ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক নয়। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও প্রয়োজনীয় সামাজিক উন্নয়ন দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল করতে হবে।
মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেগুলো চারভাবে বিভাজন করা যায়: জীবন-জীবিকার সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-অংশগ্রহণ বা সুশাসনের সমস্যা এবং অবকাঠামোগত সমস্যা। সামাজিক ও সুশাসনের সমস্যা জনগণকে সংগঠিত করে সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে তুলে বহুলাংশে সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে যথাযথভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি এবং সমাজসচেতন নাগরিকেরা। সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ বিনা বা স্বল্প খরচেই করা সম্ভব। আর সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জনগণের চেতনার উন্মেষ ঘটলে অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য দুরূহ সমস্যা সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই উত্পাদনশীল বিনিয়োগ আবশ্যক। তবে আমাদের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপক বিস্তার ছাড়া দারিদ্র্য দূরীভূত হবে না এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হবে না। আর এ কাজের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুঁজির সংস্থান আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এ কাজে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণকে সংগঠিত করে এবং স্থানীয় সংগঠন গড়ে তুলেও পুঁজির জোগান দেওয়া যায়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগিয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির সঙ্গে কৃষিঋণ, শস্যবীমা এবং বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ও ভর্তুকি বিতরণ করে কৃষি খাতেও গতিশীলতা আনা যেতে পারে।
দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে যে শুধু আয়ের অভাবই দারিদ্র্য নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদির অভাবও দারিদ্র্যের অংশ। আত্মমর্যাদা হনন, নিগ্রহ-বঞ্চনা প্রভৃতির উপস্থিতিও দারিদ্র্য অবস্থারই প্রতিফলন। তাই দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন সার্বিক অবস্থা পরিবর্তনের উদ্যোগ। আর আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র এ কাজের জন্য উপযোগী নয়।
দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি লাইন স্মরণ করা যেতে পারে: ‘তোরা পারবি নে কেউ ফুল ফোটাতে,/ যতই তোরা পাপড়ি টানিস, আঘাত করিস বোঁটতে/ তোরা পারবি নে কেউ ফুল ফোটাতে।’ ফুলের ধর্মই ফোটা, ফুলকে জোর করে ফোটানো যায় না—ফুল গাছকে আগাছা এবং মানুষের হাত থেকে রক্ষা ও পরিচর্যা করলে ফুল আপনা থেকেই ফুটবে। আর এ কাজটি করার জন্য প্রয়োজন মালীর। অর্থাত্ ফুল ফোটার ব্যাপারে মালীর ভূমিকা সহায়কের।
ফুল যেমন স্বাভাবিকভাবেই ফোটে, তেমনিভাবে আত্মশক্তিতে বলীয়ান প্রত্যেক মানুষের পক্ষেও তার নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব। নিজ জীবনের হাল ধরার মতো প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষমতা দিয়েই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো মালীর কাজ করতে পারে। তারা জনগণের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের নিজেদের ভাগ্য গড়ার কারিগরে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমাদের চেতনায় আরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে যে উন্নয়ন শুধু টাকা-পয়সার বিষয় নয়, যদিও অবকাঠামো সৃষ্টির জন্য অর্থের প্রয়োজন। বরং টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অর্থের ছড়াছড়ি দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের জন্ম দিতে পারে। ব্যক্তি আত্মপ্রত্যয়ী না হলে, অর্থের আধিক্য তাকে অসফল ও তার মধ্যে পরনির্ভরশীলতার মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এভাবে অর্থ অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের উপলদ্ধিতে আনতে হবে যে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ নয়। একটি দেশের বড় সম্পদ তার জনগণ এবং জনগণের মেধা-সৃজনশীলতা। আর মেধা-সৃজনশীলতার আমরা কোনো অংশেই কারও থেকে কম নই। বিদেশের মাটির সহায়ক পরিবেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের প্রতিনিয়ত পরাভূত করছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তারা প্রমাণ করছে, নজরুলের ভাষায়: ‘বাঙ্গালী তুমি ক্ষুদ্র নও, তুমি তুচ্ছ নও। একবার জেগে উঠ, দেখবে তুমিও বিশ্ববিজয়ী হতে পার।’ এ ছাড়া আমাদের মিষ্টিপানি, উর্বর মাটি ও সম্ভবত গ্যাস-তেলের মতো সম্পদও রয়েছে। আমাদের অভাব মূলত একতার, শৃঙ্খলার, সহিষ্ণুতার ও দৃষ্টিভঙ্গির। এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে আমরাও সম্পদশালী হতে পারব। আমাদের প্রতিবেশীদের অনেকেই তা করতে পেরেছে।
রাজনীতি সম্পর্কেও আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে—রাজনীতির উদ্দেশ্য জনসেবা ও মানুষের কল্যাণ, ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি নয়। মানুষের সঙ্গে শান্তি-সমপ্রীতি গড়ে তোলা, দ্বন্দ্ব-হানাহানি সৃষ্টি নয়। তাদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা, বিভক্তি নয়। সমস্যার সমাধান করা, সমস্যা সৃষ্টি করা নয়। মানুষের মধ্যে আশা-ভরসা জাগ্রত করা, তাদের হতাশ-নিরাশ করা নয়। কারণ চোখের বদলে চোখ নিলে, অন্ধের এবং হাত-পায়ের পরিবর্তে হাত-পা নিলে, পঙ্গুত্বের রাজত্ব সৃষ্টি হয়। আর লুটপাট ও হানাহানির সংস্কৃতিতে এবং হতাশা ও নেতিবাচক পরিবেশে ভালো কিছু ঘটে না; বরংযথেচ্ছাচারের সৃষ্টি হয় এবং সমাজ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়।
এ ছাড়া রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, সমাজকে একত্র করার ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা ও দায়িত্ব সর্বাধিক। যত বেশি ব্যক্তি ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে, ততই তাদের সফলতা। তাই তাদেরই হতে হবে অনেক বেশি উদার ও সহিষ্ণু। এ ছাড়া বিরোধীদের দোষারোপ করে কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই—অনেক নাগরিকই মনে করেন, এসব করা হয় সরকারের নিজের অপারগতা ঢাকার জন্য। সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে এগুলো উদ্ঘাটন করার এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার এবং সত্যিকার অর্থেই ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে থাকলে সরকার তা করত।
আন্তরিকভাবে জনগণের কল্যাণ চাইলে বিরোধীদেরও সরকারের কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে, অন্তত জনকল্যাণমূলক কাজে বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়, এমনকি বিরোধীদের জন্যও তা সুবিধাজনক পরিণতি সৃষ্টি করে না। আকাশের দিকে থুতু ছুড়লে তা নিজের গায়ে এসেই পড়ে। ঢিল ছুড়লে পরবর্তী সময়ে পাটকেল খেতে হয়। আর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আগুনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে পরবর্তী সময়ে ছাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
রাজনীতির ক্ষেত্রে মানসিকতা বদলের আরও প্রয়োজন যে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো—জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারাই তাদের প্রভুর আসনে অধিষ্ঠিত। আর এই প্রভুরা জনগণকে ভেড়ার পাল হিসেবেই গণ্য করে এবং তাদের পদে পদে বঞ্চিত করে। আর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হলে এবং তাদের বঞ্চনার অবসান না ঘটলে সত্যিকারের গণতন্ত্র কায়েম ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে না।
এ ছাড়া রাজনীতিকদের উপলব্ধিতে আনতে হবে যে ভোট দিয়ে জনগণ সরকার গঠন করে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। রাজনৈতিক দল হলে উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কোনো সুস্পষ্ট নীতি-আদর্শ বা জনস্বার্থকর কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সিন্ডিকেটের মতো দলের সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান নয়। আর এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিলে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানিই সৃষ্টি হয়, কারণ সুযোগ-সুবিধার পরিমাণের তুলনায় প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক বেশি—ফায়দার লোভে অনেকেই দলের খাতায় নাম লেখায়। উপরন্তু ফায়দাবাজির সংস্কৃতিতে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে না।
রাজনীতিকদের মানসিকতায় আরও পরিবর্তন প্রয়োজন যে দলীয়করণের ফলাফল মঙ্গলকর নয়। দলীয়করণের সংস্কৃতিতে অযোগ্য-অদক্ষরাই সাধারণত লাভবান হন এবং যোগ্য-দক্ষ ও নিরপেক্ষরা বঞ্চিত হন। ফলে সরকারের কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। এ ছাড়া দলবাজির সংস্কৃতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরস্পরকে ল্যাং মারার এক অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতা বিবেচনায় না নেওয়ার এবং পক্ষপাতিত্বের ফলে প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। তাই দলীয়করণের ফলে হিতের চেয়ে বিপরীতই বেশি হয়। বস্তুত লাগামহীন দলীয়করণের ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভবিষ্যতে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
রাজনীতিবিদদের স্বীকার করতে হবে যে তাঁদের প্রশ্রয়েই এ দেশে উগ্রবাদের উদ্ভব ঘটেছে। আর রাজনীতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে এবং এর বিস্তার সম্ভব নয়। এ ছাড়া দুর্নীতি ও বঞ্চনা সাধারণ মানুষকে এদিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই উগ্রবাদ রোধ করতে হলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটাতে হবে, দারিদ্র্য দূরীকরণ করতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিকে নৈতিকতার ওপর দাঁড় করাতে হবে এবং উগ্রবাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অবসান ঘটাতে হবে।
আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মানসিকতারও বদল হওয়া দরকার। অনেক দিন আগে আমাদের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আফসোস করে বলেছিলেন, সরকার যেন চারদিকে দোকান পেতে বসে আছে জনগণরূপী মক্কেল ধরে হেনস্থা করার জন্য। বস্তুত বাধা দেওয়া, সমস্যা সৃষ্টি করা, হয়রানি করা যেন আমলাতন্ত্রের আজ ধর্ম হয়ে পড়েছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ধরনের আবহ সৃষ্টি করে উেকাচ আদায় করেন কিংবা অন্যভাবে লাভবান হন। দলবাজির সঙ্গে দুর্নীতির এ সংমিশ্রণ আমাদের আমলাতন্ত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
পরিশেষে, এ কথা সুস্পষ্ট যে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনতে হলে—যা করা আমাদের জন্য অতি জরুরি—আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে এবং অন্যদের বদলাতে সহায়তা করতে হবে। প্রত্যেককেই পরিবর্তনের রূপকারে পরিণত হতে হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে, সবার পক্ষেই হয়তো মস্ত বড় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভবপর নয়—কেউ হয়তো পর্বতের পাদদেশের নুড়িপাথর সরাতে পারবে, অন্য কেউ হয়তো পর্বতকেই ঠেলা দিতে পারবে। অসাধারণ কাজ করা অনেকের জন্য সাধারণ ব্যাপার, আর অনেকে অল্পতেই গলদধর্ম। তবু সবাইকেই নিজেদের বদলাতে উদ্যোগী হতে হবে। আশার কথা, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগে আমাদের দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু দিনবদলের জন্য প্রয়োজন মনমানসিকতার পরিবর্তন। তারা কি তা করবে? তাদের কথা রাখবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments