সিডরের ক্ষত কি শুকানোর মতো -এইদিনে by মিজানুর রহমান
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ভেসে যায়, আশ্রয়হীন হয় অনেক মানুষ। আমার বাড়ি যেখানে, বাগেরহাটের সেই শরণখোলায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমাদের বাড়িটি ভেসে যায়। ইতিমধ্যে আমরা নতুন একটি ঘর তৈরি করেছি। মানুষের জীবন আবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মনোযোগ দিয়ে না দেখলে সিডরের ক্ষতও তেমন চোখে পড়ে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ক্ষত তৈরি হয়, আবার শুকিয়ে যায়। কিন্তু আমার মনের ক্ষতটা শুকাচ্ছে না কেন? এ ক্ষত কি কোনো দিন শুকাবে?
সিংহলিজ ভাষার শব্দ ‘সিডর’-এর আভিধানিক অর্থ ‘চোখ’। তবে আমার কাছে এর অর্থ ‘চোখের জল’। দুই বছর আগে আজকের দিনে ‘সিডর’ নামের সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় আমাকে ও আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে চোখের জলে ভাসিয়েছিল। দানবীয় এই ঘূর্ণিঝড় আমার জীবন থেকে প্রিয় বাবা মো. আদম আলী খান ও মা আনোয়ারা বেগমকে কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আরও অনেক নিকটাত্মীয়কে।
বাবা বা মাকে স্মরণ করে অনেকেই অনেক সুন্দর স্মৃতিচারণা করেন। আমি মুগ্ধ হই, ভালো লাগে। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের সুন্দর স্মৃতিচারণা করার মতো কিছুই আমার মনে নেই। যেই দিনটিতে, আমার বাবা-মা উভয়কেই কেড়ে নিল সিডর, সেদিন থেকে আমার স্মৃতি থেকে বাবা-মায়ের সব সুন্দর সুন্দর ঘটনা মুছে গেছে। আমার বাবার বয়স ছিল ৫৫ ও মায়ের ৫০। তবে বয়সের তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি তরুণ ছিলেন।
শরণখোলার সাউথখালী গ্রামে আমাদের বাড়ি। বলেশ্বর নদের একেবারে কোল ঘেঁষে। আমাদের ঘরটি ছিল খুব বড়, খুব মজবুত। ১৯৮৮ সালের বন্যায় কিছুই হয়নি এ ঘরের। সিডরও কিছু করতে পারবে না—এমনটা ভেবে আমাদের পাশের বাড়িরও অনেকে এসে আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বাতাসের তীব্রতা যখন ভয়াবহ রূপ নেয়, তখন তাদের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন বাবা-মা। বলেছিলেন, ‘তোরা যা, আমরা আসতেছি।’ এর পরও কেন তাঁরা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেন না, এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে চাইব? রাত সাড়ে ১০টা বা পৌনে ১১টায় সিডর মহাশক্তি নিয়ে আবির্ভূত হলে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম দুই ব্যক্তিই হারিয়ে যান মহাকালে।
বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় সিডর আঘাত হানার দিন দুপুরে। আবহাওয়ার খারাপ অবস্থার কথা শুনে বলেছিলাম আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে। তাঁদের কাছে তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সন্ধ্যার পর নিকটাত্মীয়দের কারও মোবাইল ফোনেও আর সংযোগ পাইনি। ১৬ নভেম্বর খুব ভোরে আমার মোবাইল ফোনে কল করে এক আত্মীয় জানান যে, আমাদের ঘরবাড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই এবং বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বিবিসি বাংলার সংবাদে শুনতে পাই শরণখোলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।
খবর শুনেই মুহসীন হল থেকে বেরিয়ে সদরঘাটে গিয়ে বড় ভাইকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কোনো রকমে যখন শরণখোলা উপজেলা সদরে পৌঁছাই, তখন রাত ১০টা। আমার মেজো বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখি, আমার তিন বোনই কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করছেন। আমার ছোট বোনটি ইডেন কলেজে পড়ে। সিডরের দুই দিন আগে ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল সে। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় সে মেজো বোনের বাড়িতেই থেকে যায়। আমি জানতাম, বাবা-মাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বোনেরা জানেন, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু মা সুস্থ আছেন। রাত ১১টার দিকে দুই ভগ্নিপতি বাবা-মায়ের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে উপস্থিত হন। তবে তাঁদের লাশ কোথায় আছে, কেউ জানে না। পরের দিন খুব ভোরে ট্রলার নিয়ে বলেশ্বর নদ দিয়ে আমরা সাউথখালীতে যাই। গিয়ে দেখি, আমাদের বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। বাড়ির কোনো ঘরেরই অবশিষ্টাংশও সেখানে ছিল না। বাড়ির জায়গা থেকে আধা কিলোমিটারও দূরে আমাদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পাই। এর প্রায় চার ঘণ্টা পর পাওয়া যায় বাবার মৃতদেহ। সারা দিন খুঁজেও মায়ের মৃতদেহ পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে সিডর আঘাত হানার চার দিন পর ১৯ নভেম্বর মায়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। চার দিন পরও মায়ের চেহারা একেবারে অক্ষত ও অবিকৃত ছিল। মাকে বাবার পাশেই দাফন করা হয়। এখন ভাবলে বিস্মিত হই, অমন কষ্টের বোঝা বুকে নিয়ে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাবা-মায়ের মৃতদেহ খুঁজে বেড়িয়েছি! পৃথিবীতে কোনো সন্তানকে যেন তাঁর বাবা-মায়ের মৃতদেহ খুঁজতে না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ও বন্ধুরা সেই দুর্যোগের সময়ে আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছেন। কারও প্রতিই মৌখিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। আমাদের তখন মাস্টার্স পরীক্ষা চলে। এর মাঝেই সহপাঠীরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সবার এ মানবতাবোধই আমাকে বাঁচার সাহস জুগিয়েছে। মনে ঝড় আর বুকে কষ্ট নিয়েই ২৩ নভেম্বর পরীক্ষায় অংশ নিই। পরীক্ষা শেষ করে এখন চাকরিও করছি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, জীবনের সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আসলেই কি সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে? তাহলে কেন কোথাও সিডর সম্পর্ক কথা শুনলে, লেখা পড়লে আমার চোখে পানি চলে আসে? ‘সিডর’ অর্থ চোখের পানি না তো কী!
সিংহলিজ ভাষার শব্দ ‘সিডর’-এর আভিধানিক অর্থ ‘চোখ’। তবে আমার কাছে এর অর্থ ‘চোখের জল’। দুই বছর আগে আজকের দিনে ‘সিডর’ নামের সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় আমাকে ও আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে চোখের জলে ভাসিয়েছিল। দানবীয় এই ঘূর্ণিঝড় আমার জীবন থেকে প্রিয় বাবা মো. আদম আলী খান ও মা আনোয়ারা বেগমকে কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আরও অনেক নিকটাত্মীয়কে।
বাবা বা মাকে স্মরণ করে অনেকেই অনেক সুন্দর স্মৃতিচারণা করেন। আমি মুগ্ধ হই, ভালো লাগে। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের সুন্দর স্মৃতিচারণা করার মতো কিছুই আমার মনে নেই। যেই দিনটিতে, আমার বাবা-মা উভয়কেই কেড়ে নিল সিডর, সেদিন থেকে আমার স্মৃতি থেকে বাবা-মায়ের সব সুন্দর সুন্দর ঘটনা মুছে গেছে। আমার বাবার বয়স ছিল ৫৫ ও মায়ের ৫০। তবে বয়সের তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি তরুণ ছিলেন।
শরণখোলার সাউথখালী গ্রামে আমাদের বাড়ি। বলেশ্বর নদের একেবারে কোল ঘেঁষে। আমাদের ঘরটি ছিল খুব বড়, খুব মজবুত। ১৯৮৮ সালের বন্যায় কিছুই হয়নি এ ঘরের। সিডরও কিছু করতে পারবে না—এমনটা ভেবে আমাদের পাশের বাড়িরও অনেকে এসে আমাদের ঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বাতাসের তীব্রতা যখন ভয়াবহ রূপ নেয়, তখন তাদের সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন বাবা-মা। বলেছিলেন, ‘তোরা যা, আমরা আসতেছি।’ এর পরও কেন তাঁরা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেন না, এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে চাইব? রাত সাড়ে ১০টা বা পৌনে ১১টায় সিডর মহাশক্তি নিয়ে আবির্ভূত হলে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম দুই ব্যক্তিই হারিয়ে যান মহাকালে।
বাবার সঙ্গে শেষ কথা হয় সিডর আঘাত হানার দিন দুপুরে। আবহাওয়ার খারাপ অবস্থার কথা শুনে বলেছিলাম আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে। তাঁদের কাছে তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সন্ধ্যার পর নিকটাত্মীয়দের কারও মোবাইল ফোনেও আর সংযোগ পাইনি। ১৬ নভেম্বর খুব ভোরে আমার মোবাইল ফোনে কল করে এক আত্মীয় জানান যে, আমাদের ঘরবাড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই এবং বাবা-মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বিবিসি বাংলার সংবাদে শুনতে পাই শরণখোলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।
খবর শুনেই মুহসীন হল থেকে বেরিয়ে সদরঘাটে গিয়ে বড় ভাইকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কোনো রকমে যখন শরণখোলা উপজেলা সদরে পৌঁছাই, তখন রাত ১০টা। আমার মেজো বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখি, আমার তিন বোনই কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করছেন। আমার ছোট বোনটি ইডেন কলেজে পড়ে। সিডরের দুই দিন আগে ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল সে। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় সে মেজো বোনের বাড়িতেই থেকে যায়। আমি জানতাম, বাবা-মাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বোনেরা জানেন, বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু মা সুস্থ আছেন। রাত ১১টার দিকে দুই ভগ্নিপতি বাবা-মায়ের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে উপস্থিত হন। তবে তাঁদের লাশ কোথায় আছে, কেউ জানে না। পরের দিন খুব ভোরে ট্রলার নিয়ে বলেশ্বর নদ দিয়ে আমরা সাউথখালীতে যাই। গিয়ে দেখি, আমাদের বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। বাড়ির কোনো ঘরেরই অবশিষ্টাংশও সেখানে ছিল না। বাড়ির জায়গা থেকে আধা কিলোমিটারও দূরে আমাদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পাই। এর প্রায় চার ঘণ্টা পর পাওয়া যায় বাবার মৃতদেহ। সারা দিন খুঁজেও মায়ের মৃতদেহ পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে সিডর আঘাত হানার চার দিন পর ১৯ নভেম্বর মায়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। চার দিন পরও মায়ের চেহারা একেবারে অক্ষত ও অবিকৃত ছিল। মাকে বাবার পাশেই দাফন করা হয়। এখন ভাবলে বিস্মিত হই, অমন কষ্টের বোঝা বুকে নিয়ে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাবা-মায়ের মৃতদেহ খুঁজে বেড়িয়েছি! পৃথিবীতে কোনো সন্তানকে যেন তাঁর বাবা-মায়ের মৃতদেহ খুঁজতে না হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ও বন্ধুরা সেই দুর্যোগের সময়ে আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছেন। কারও প্রতিই মৌখিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। আমাদের তখন মাস্টার্স পরীক্ষা চলে। এর মাঝেই সহপাঠীরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সবার এ মানবতাবোধই আমাকে বাঁচার সাহস জুগিয়েছে। মনে ঝড় আর বুকে কষ্ট নিয়েই ২৩ নভেম্বর পরীক্ষায় অংশ নিই। পরীক্ষা শেষ করে এখন চাকরিও করছি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, জীবনের সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আসলেই কি সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে? তাহলে কেন কোথাও সিডর সম্পর্ক কথা শুনলে, লেখা পড়লে আমার চোখে পানি চলে আসে? ‘সিডর’ অর্থ চোখের পানি না তো কী!
No comments