ড. ইউনূসের ভাষণের সমালোচনা ও একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ by নজরুল ইসলাম খোকন
প্রথমত, তার এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই। আমি নিশ্চিত, আরো অনেকেই একমত পোষণ করবেন না। এটি না করার কারণ, কোনো গণ-বিপ্লব কখনো পরিকল্পনা করে হয় না। সেটিই যদি হবে তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছিলেন সেটিও পরিকল্পনারই অংশ হওয়ার কথা। কারণ, শেখ হাসিনার সেই মন্তব্যের পরই কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হঠাৎ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে দেখা যায়। এ ছাড়াও যেকোনো অভ্যুত্থান সফল হওয়ার নেপথ্যে কিছু ইমোশনাল এলিমেন্ট থাকতে হয়। এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে ইমোশনাল এলিমেন্ট তাহলে কী? সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, শহীদ আবু সাঈদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে জীবনোৎসর্গ করার মতো বীরত্ব। মূলত এরপরই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক গণ প্রতিবাদ মুখর হয়ে বিপ্লবী মানসিকতা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এখন শহীদ আবু সাঈদের এই জীবনোৎসর্গকে আপনি কোন পরিকল্পনার অংশ বলবেন? কিংবা শহীদ মীর মুগ্ধ’র পুলিশের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ‘পানি লাগবে পানি’ সেই হৃদয় বিদারক চিৎকারকে কোন পরিকল্পনা অংশ বলতে চান? সুস্থ মস্তিষ্কে এই ঘটনাগুলোকে পরিকল্পিত বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এই আন্দোলন (পরবর্তীতে গণ-অভুত্থ্যান) যে অনেক গোছানো ছিলো সেটি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে ৯ দফা এবং ৯ দফা থেকে ১ দফায় আসা পর্যন্ত পুরো আন্দোলনটিতে সমন্বয়করা যথেষ্ঠ দক্ষতা এবং পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সেক্ষেত্রে অধ্যাপক ইউনূস এটিকে well designed না বলে well organized বললে হয়তো ব্যাপারটি সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতো না। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এমন ভুল জনাব ইউনূস কেন করলেন? তিনি কি জ্ঞাতসারে করলেন নাকি অজ্ঞাতসারে করলেন? কিংবা তিনি কি আসলে অন্য কিছু বুঝাতে গিয়ে ভুল শব্দ চয়ন করে ফেলেছেন? এর উত্তর আসলে তিনিই ভালো দিতে পারবেন। এবার সমালোচকদের ব্যাপারে একটু বলি। কেউ কেউ দেখছি অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্যটি এমনভাবে লুফে নিয়েছেন মনে হয় যেন এমন একটি ভুলের জন্য তারা দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন! বলতে শুরু করেছেন, ওহ আচ্ছা তাহলে সব কিছুই দীর্ঘদিনের গভীর পরিকল্পনার( যেটিকে তারা মূলত ষড়যন্ত্র বলতে চাইছেন) অংশ! অর্থাৎ পতিত স্বৈরাচার যে গণহত্যা চালিয়েছে তার দায় চাপানোর মতো একজনকে তাহলে পাওয়া গেলো! আর তিনি হলেন ড. ইউনূস। ভাই, আপনারা ঘাপটি মেরে থাকা গণহত্যাকারীদের সমর্থক। এটুকু বোঝার জন্য রকেট সাইন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। এবার চলেন, ইউনূসের আরো দুয়েকটি বক্তব্যের প্রসঙ্গে যাই যে বক্তব্যগুলো আমার ধারণা আমিতো বটেই অনেকেই ভালোভাবে নেননি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নিতে যেদিন প্যারিস থেকে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “আপনারা, আমার কথা শুনতে হবে, যদি না শোনেন তাহলে আমি থাকব না”, উনার মতো মানুষের র কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। স্যার, আমরা এতদিন আপনার কথা শুনেছি, এখন আপনি এবং আপনার উপদেষ্টাদের আমাদের ( অর্থাৎ গণমানুষের) কথা শুনতে হবে তবেই আপনার সরকারের ভুল করার সম্ভাবনা কম থাকবে। জাতির উদ্দেশে ভাষণে আপনি সরকারের মেয়াদ নিয়ে বলেছিলেন, “জনগণ যতদিন চাইবে ততদিনই আমরা থাকবো” । এটিও আপনার মারাত্মক ভুল বক্তব্য মনে করি। পৃথিবীতে কোনো সরকারই অনির্দিষ্ট মেয়াদের হয় না। কোনো সরকারের মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল হতে পারে না। আপনার সরকারেরও একটা স্পষ্ট টাইম ফ্রেম অবশ্যই থাকতে হবে। মাস দেড়েক হওয়ার পরও আপনার সরকার জাতীর সামনে রাষ্ট্র পরিচালনার সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা কিংবা সময়সীমা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে যা বিপ্লব আর শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই সরকারের সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক হতাশা তৈরি করেছে। আপনাদের প্রতিটি ভুল পদক্ষেপ সমর্থকদের যেমন আশাহত করছে তেমনি পতিত গণ্যহত্যাকারী স্বৈরাচারের ঘাপটি মেরে থাকা সমর্থকদের উল্লসিত করছে। আমরা চাই, আপনি এবং আপনার সরকার সফল হোক। আপনারা ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। সমালোচকদের উদ্দেশে বলি, আমি, আপনি বা যে কেউ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা তার সরকারের উপদেষ্টাদের সংশোধনের উদ্দেশে সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু সমালোচনার উদ্দেশ্য যদি হয় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে “ আগেই ভালো ছিলাম” টাইপের অর্থাৎ গণহত্যাকারীদের সমর্থনে, তাহলে এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৪
No comments