কি করবে হিজবুল্লাহ, ইসরাইল, ইরান!

দীর্ঘদিন হিজবুল্লাহকে শক্ত ও দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন হাসান নাসরাল্লাহ। কিন্তু ইসরাইলি বিমান হামলায় তিনি নিহত হওয়ার পর গ্রুপটি মুখে যতই বলুক তারা আরও বলিয়ান হয়ে লড়াই অব্যাহত রাখবে, প্রকৃতপক্ষে তারা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন নতুন করে তাদেরকে নতুন নেতার অধীনে সংগঠিত হতে হবে। নতুন নেতা নির্বাচন করলে তিনি দলকে হাসান নাসরাল্লাহর মতো দক্ষ হাতে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে গ্রুপকে চালাতে সক্ষম হবেন কিনা- তাও চিন্তার বিষয়। এমন অবস্থায় আলোচনায় হিজবুল্লাহ, ইসরাইল ও ইরান। হাসান নাসরাল্লাহর সঙ্গে নিহত হয়েছেন ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের একজন ডেপুটি কমান্ডার। এমনিতেই হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেয় ইরান। তাদের অভিজাত রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কমান্ডার, যিনি একজন জেনারেল পদধারী ছিলেন, তার মৃত্যু ইরান কিভাবে নেয় তা দেখার বিষয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কন্স্যুলেটে এর আগে হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। তাতে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের বড় মাপের একজন কমান্ডার নিহত হন। তার বদলা নেয়ার হুমকি দেয় ইরান। এক পর্যায়ে প্রায় ৩০০ ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইলে। তবে তার বেশির ভাগই আকাশে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার দাবি করে ইসরাইল। আবার তাদের একজন কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। এবার ইরান কি করবে তা পরিষ্কার নয়।

অন্যদিকে হাসান নাসরাল্লাহকে শুক্রবার রাতে হত্যার পর থেকে লেবাননের ওপর অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। হিজবুল্লাহ যেন পুনর্গঠিত হতে না পারে এ জন্য তারা টার্গেট করে করে হামলা করছে। তবে বেশির ভাগ হামলা হচ্ছে সাধারণ জনবসতিতে। এ বিষয়ে বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা এবং লেবাননে ভয়াবহ হামলার প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যকে ব্যাপক ও অধিক পরিমাণে ধ্বংসাত্মক এক যুদ্ধের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে ইসরাইল। এতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রও যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। এখন কি ঘটতে পারে? এমন প্রশ্ন করে তিনি নিজেই উত্তর দিচ্ছেন- বিষয়টি ব্যাপকভাবে নির্ভর করে তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উপর। তার প্রথমটি হলো- হিজবুল্লাহ এখন কি করবে? হামলার পর হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ। তাদের কমান্ড কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের কমপক্ষে এক ডজন কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। বিস্ফোরণে তাদের পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো ধ্বংস হয়েছে। বিমান হামলায় বেশির ভাগ অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রার্চের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আল বাশা বলেন, হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়া এই গ্রুপের জন্য বড় ক্ষতি। বিশেষ করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে গ্রুপটি। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু ইসরাইল বিরোধী এই গ্রুপটি হঠাৎ করেই লড়াই বন্ধ করবে বা ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করবে- এমনটা ভাবাও ভুল। এরই মধ্যে হিজবুল্লাহ লড়াই অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে। এখনও তাদের আছে হাজার হাজার যোদ্ধা। তাদের অনেকে সিরিয়া যুদ্ধ থেকে ফিরেছেন। তারা প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্রও আছে তাদের হাতে। তার মধ্যে বেশির ভাগই দূর পাল্লার। আগে থেকে নির্দেশিত স্থানে তা হামলা চালাতে পারে। এমনকি তেল আবিব ও অন্যান্য শহরেও আঘাত করতে সক্ষম এসব অস্ত্র। শিগগিরই এসব অস্ত্র ধ্বংস করে দিতে পারে ইসরাইল। তাই তার আগেই এগুলো ব্যবহার করার ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। যদি তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করে ইসরাইলের ওপর হামলা চালায়। সেখানে বেসামরিক মানুষজন নিহত হন, তাহলে ইসরাইলের জবাব হতে পারে আরও ভয়ঙ্কর। লেবাননের অবকাঠামো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে তারা। এমনকি সেই লড়াই ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো- ইরান কি করবে? হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করা হিজবুল্লাহর জন্য যেমন বড় আঘাত তেমনি ইরানের জন্যও বিরাট আঘাত। এ হত্যাকাণ্ডের পর ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান। ইমার্জেন্সি সতর্কতা হিসেবে তারা তাদের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। তেহরানে এক গেস্টহাউজে জুলাই মাসে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়েকে হত্যা করেছে ইসরাইল। এই হত্যার এখনও কোনো বদলা নেয়নি ইরান। কিন্তু এখন যা ঘটছে তাতে ওই অঞ্চলে যারা কট্টরপন্থি আছেন, তাদেরকে কিছু একটা জবাব দেয়ার বিষয়ে ভাবাতে বাধ্য করবে। মধ্যপ্রাচ্যে ভারি অস্ত্রে সজ্জিত মিলিশিয়া মিত্র আছে। একে পশ্চিমারা ‘অ্যাক্সিস অব রেজিসট্যান্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। হিজবুল্লাহ ছাড়াও ইয়েমেনে আছে হুতিরা। সিরিয়া ও ইরাকে আছে বহু গ্রুপ। ইসরাইল এবং ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালাতে এসব গ্রুপকে উৎসাহিত করতে পারে ইরান। তবে ইরান যেভাবেই এমন প্রতিক্রিয়া দেবে, তাতে একটি যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা আছে।
ইসরাইল কি করবে? ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র সহ কমপক্ষে ১৩টি দেশ লেবাননে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করলেও ইসরাইল পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে সামরিক অভিযান স্থগিত করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। তারা মনে করছে, হিজবুল্লাহ এখন পশ্চাৎপদে আছে। তাই তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি বিনাশ না করা পর্যন্ত এই চাপ অব্যাহত রাখতে চায়। এখন দেখার বিষয় লেবাননে স্থল বাহিনী না পাঠিয়ে হিজবুল্লাহর হুমকি থেকে রেহাই পেতে পারে ইসরাইল। তাই স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি পদাতিক বাহিনীর একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস। কিন্তু সর্বশেষ যুদ্ধের পর হিজবুল্লাহ ১৮ বছর সময় পেয়েছে। এ সময়ে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মারা যাওয়ার আগে শেষ প্রকাশ্য জনসভায় হাসান নাসরাল্লাহ তার অনুসারীদের বলে যান, ইসরাইল বাহিনী যদি লেবাননের দক্ষিণ দিয়ে প্রবেশ করে তা হবে হিজবুল্লাহর জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।
এ অবস্থায় ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, লেবাননে প্রবেশ করা আইডিএফের জন্য তুলনামূলক সহজ। কিন্তু গাজার মতো সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক লম্বা সময় লাগবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.