মওলানা রুমির মসনবি শরিফ: সুলতান মাহমুদ গজনভী ও আয়ায by ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আমিরের
নেতৃত্বে সিপাহিরা রাতে তালা ভেঙে আয়াযের কামরায় প্রবেশ করে। সতর্ক
নজরদারিতে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালায় সংরক্ষিত কক্ষে। কিন্তু একজোড়া ছেঁড়া
জুতা আর জীর্ণশীর্ণ জুব্বাটি ছাড়া আর কিছু পেল না। তখন ভয়ে আতঙ্কে হলুদাভ
হলো তাদের চেহারা। বাদশাহর কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না। আয়াযের
বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরিণাম কী হবে তারা জানে। আবার
আত্মস্থ হয়ে তারা বলল, এমন তো হতে পারে না।
সুলতান মাহমুদ গজনভীর প্রাণপ্রিয় গোলাম আয়ায। আয়ায কৃতদাস হয়ে এসেছিল সুলতানের দরবারে। এখন ঈর্ষণীয় রাজকীয় পদে সমাসীন। সুলতানের প্রিয়ভাজন হওয়ায় চারদিকে তার জয়জয়কার। আয়ায একজোড়া পুরোনো চামড়ার সেন্ডেল আর ছেঁড়া জুব্বা ঝুলিয়ে রেখেছিল একটি নির্জন কামরায়। রোজ দরবারে আসার আগে আয়ায সে কামরায় যায়। জুব্বা আর জুতার সামনে নিজের সঙ্গে কথা বলে আয়ায! তুমি সেই লোক, যার সম্বল ছিল পরিধানের এই ছেঁড়া আলখেল্লা আর পায়ে ছিল পুরোনো চপ্পল। কাজেই নিজেকে অত বড় মনে করো না। উচ্চাভিলাষী হইও না। সাবধান!
আপন যোগ্যতায় যারা বড় হয় তাদের শত্রুর অভাব হয় না। আয়াযের বেলায়ও ব্যতিক্রম হলো না। কাছের লোকেরা বাদশাহর কাছে গিয়ে নালিশ করল, জাঁহাপনা! আয়ায তার খাস কামরায় অনেক সোনাদানা জমা করেছে। একটি মটকা তো রতœালংকার হীরা-জহরতে ভর্তি। এ কামরার দরজায় সবসময় তালা ঝুলে। কারও প্রবেশাধিকার নেই। বাদশাহ বললেন, আমার আয়াযের কথা বলছ? তার এমনকি আছে, যা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে বা আমি জানব না?
কাহিনির প্রধান চরিত্রের বাদশাহ গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদ। গজনী তখনকার বৃহত্তর ইরানের অংশ, বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্গত। তার পিতা ছিলেন গজনীর শাসক আবু মনসুর সাবুকতাগীন। ৩৮৭ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন। একের পর এক দেশ জয়, দরবারে জ্ঞানী মনীষীদের সমাদর আর ভারতে ইসলামের বিজেতা হিসেবে তার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ১৭তম ভারত অভিযানে তিনি সোমনাথ মন্দিরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। অসাধারণ বিচক্ষণ, জ্ঞানী, দূরদর্শী ও সাহসী যোদ্ধা সুলতান মাহমুদ গজনভী হিজরি ৪২১ সালে রাজত্বের ৩৩ বছরে ৫১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। প্রিয়ভাজন গোলাম আয়াযকে নিয়ে সুলতান মাহমুদের নানা আখ্যান ফারসি সাহিত্যের অলংকার।
আয়াযের বিরুদ্ধে সভাসদদের অভিযোগ শুনে সুলতান একজন আমিরকে নির্দেশ দিলেন, যাও, গভীর রাতে তার কামরায় অভিযান চালাও। তল্লাশিতে ধনরতœ যা পাবে, তোমাদের। একটি সুরতহাল রিপোর্ট জানিয়ে দেবে রাজসভার সবার কাছে। কারণ এত আদর, যতœ, সম্মান পেয়ে কেউ মাথায় উঠবে, সহ্য করা হবে না। গোপনে ধনরতœ জমা করার মতো হীন কাজ করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সে কি তাহলে বাইরে প্রেম, ভক্তি, বিশ্বস্ততা আর উদ্দীপনা দেখায় আর ভেতরে ভেতরে আখের গোছায়? প্রেমের বিধান হলো, প্রকৃত প্রেমের সন্ধান যে পেয়েছে বন্দেগি ছাড়া অন্যকিছু করলে তার কুফরি হিসেবে গণ্য হবে।
সেনা অধিনায়ক আমির অভিযানের ছক আঁকলেন। ত্রিশজন বিশ্বস্ত সিপাহিসহ আয়াযের সংরক্ষিত কামরায় অভিযান চালাবেন গভীর রাতে। সিপাহিদের মনে আজ আনন্দের কোলাহল। কারণ তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলেই হীরা-জহরত যা কিছু পাবে তাদের হয়ে যাবে। অবশ্য আয়াযের প্রতি বাদশাহর মনে সন্দেহ অবিশ্বাস ছিল না। হিংসুকদের হাতেনাতে জব্দ করার জন্য তিনি এ সুযোগটি দিলেন। তারপরও আয়ায সম্পর্কে মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলে বাদশাহ তা দূর করেন আনমনে কথা বলে, আয়ায আমার, আমি আয়াযের। আয়াযের ব্যাপারে কেউ কিছু বলবে, আমি তা সহ্য করব না। আয়ায তো সাধারণ কোনো মানুষ নয়। অসাধারণ তার চলন, বলন, ব্যবহার। আয়াযের প্রশংসায় মওলানা রুমির চিন্তায় ভেসে উঠল একজন ‘ইনসানে কামেল’ এর প্রতিচ্ছবি। তার সামনে এখন ইনসানে কামেলের মহান সত্তার উদ্ভাস। সেই উদ্ভাসে প্রতিফলিত আল্লাহর গুণাবলির ঝলক। ফলে তিনি সব মানবীয় গুণ ও স্বভাবের কেন্দ্র। মহান চরিত্র সুষমায় সুবাসিত তার জীবন। তিনি আল্লাহর প্রিয়ভাজন। তার প্রশংসা করার সাধ্য মানুষের নেই। তিনি বাদশাহ নন; তবে বাদশাহর বাদশাহ, বাদশাহ নির্মাতা। তিনি সৃষ্টির সার নির্যাস। মওলানা যেন বোঝাতে চান তিনি আল্লাহর হাবিব মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। তার উপমা সাগর। তার থেকেই দুনিয়ার মানুষ পায় সজীবতা, জীবনের স্পন্দন। মওলানা আরও বলেন, এই বর্ণনায় এসে আমার মনে পড়ে গেল হাতির দেশ হিন্দুস্তানের কথা। সে এখন কবিতার ক্ষেত-খামার দুমড়ে-মুচড়ে যাবে।
কাইফা য়া-তীন নাযমু লী ওয়াল কাফিয়া
বা-দা মা যাআত উসুলুল আফিয়া
আমার কীভাবে আসবে কবিতা অন্ত্যমিল
প্রেমের তাড়ায় যেখানে পালায় মনের স্বস্তি।
আল্লাহর প্রেমে আমি আত্মহারা। পাগলামি, উন্মতত্তা, উন্মাদনায় আমি বেসামাল। আয়ায আমি তোমার কিচ্ছা বলছিলাম। এখন তুমি আমার কিচ্ছা বল। মওলানা রুমি এখানে আধ্যাত্মিক সাধনার ফানা (নির্বাণ) ও বাকা (স্থিতি) এর জটিল বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। যার অপার রহস্যের প্রান্তরে প্রবেশ করার জন্য আমাদের মসনবি পঞ্চম খ- অনুবাদ ও ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পের শুরু ১৭৬০ বয়েত থেকে আর শেষ ২১৬২ বয়েতে গিয়ে। কাজেই গল্পের ফাঁকে মওলানা কত আধ্যাত্মিক তত্ত্বরহস্য ব্যক্ত করেছেন অনুমান করাও কঠিন।
ফিরে আসি সুলতান ও আয়াযের গল্পের ধারাবাহিকতায়। আমিরের নেতৃত্বে সিপাহিরা রাতে তালা ভেঙে আয়াযের কামরায় প্রবেশ করে। সতর্ক নজরদারিতে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালায় সংরক্ষিত কক্ষে। কিন্তু একজোড়া ছেঁড়া জুতা আর জীর্ণশীর্ণ জুব্বাটি ছাড়া আর কিছু পেল না। তখন ভয়ে আতঙ্কে হলুদাভ হলো তাদের চেহারা। বাদশাহর কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না। আয়াযের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরিণাম কী হবে তারা জানে। আবার আত্মস্থ হয়ে তারা বলল, এমন তো হতে পারে না। এই জুতা-জুব্বা চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল। নিশ্চয়ই সোনা-জহরত মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছে সংগোপনে। শুরু হলো খননকার্য কামরার তলায়, এমনকি দেয়ালগাত্রে কোণায় কোণায়। কিন্তু কিছুর সন্ধান পেল না। কামরার দেয়াল, দরজা-জানালা যেন নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছিল আয়াযের সততার। তারা হতবাক। আয়াযের প্রতি সন্দেহ ও শত্রুতার জন্য লজ্জায় জড়োসড়ো। নিদারুণ হতাশা ও লজ্জা নিয়ে বেরিয়ে এলো আয়াযের কামরা থেকে। ক্ষমার আর্জির ভঙ্গিতে মাথায় দুহাত দিয়ে পরদিন হাজির হলো দরবারে।
তাদের দেখেই বাদশাহ বললেন, কী খবর তোমাদের? তোমাদের কাঁধের ঝুলি যে খালি, কী ব্যাপার? আয়াযের ধনরতœ কোথাও গোপন করে এখানে এসেছ নাকি? তারপরও তোমাদের চেহারায় আনন্দের ঝিলিক থাকার কথা। গাছের শিকড় মাটির নিচে পোঁতা হলে তার পাতা বাইরে পল্লবিত হয়। অনুরূপ যারা দুনিয়ায় ভালো কাজের সঞ্চয় গড়ে আখেরাতে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। আর যারা দুনিয়ার জীবনে মন্দের সদাই করে তাদের চেহারা হবে বিধ্বস্ত কদাকার।
বাদশাহর নিরাপত্তা বিভাগের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নির্বাক। নিজেদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বাদশাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। হামবড়া ভাব, রূঢ়-রুক্ষ স্বভাব আর মিথ্যা মামলার প্রায়শ্চিত্য ভোগার ভয়ে তারা আতঙ্কিত। এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন নিজেরা নিহত হওয়ার তলোয়ার আর কাফন এগিয়ে দিয়েছে বাদশাহর সামনে। জাঁহাপনা! আমাদের প্রাণদ- দিলে তা আমাদের প্রাপ্য। আর যদি ক্ষমা করেন, তা হবে আপনার মহানুভবতা ও দয়ার প্রকাশ। আমরা যা করেছি, তা আমাদের স্বভাবের দোষ। আপনি বাদশাহ, আপনার কাছে আমাদের আশা, আপনার দয়া, ক্ষমা ও মহানুভবতার পরশ। মওলানার চেতনা এখানে গজনীর বাদশাহকে ছেড়ে আরশপানে উঁকি দেয়। তুমি যদি আমার পাপতাপ মাফ করে দাও, তা তো তোমার শানের জন্য মানায়। দিনের ধর্ম আলো দেবে, রাতের স্বভাব আঁধারের চাদরে আবৃত্ত করবে। তোমার দয়ার স্বভাব দিয়ে যদি আমাদের মাফ করে দাও, তোমার দান বখশিশের সাগরের পানি তো এতটুকুন কমবে না।
সুলতান মাহমুদ বললেন, না আমি তোমাদের ক্ষমা করতে পারব না। এ অধিকার আমি সংরক্ষণ করি না। কারণ তোমরা দোষ করেছ আয়াযের, তার মানহানি করেছ, মানহানির মামলায় তোমরা প্রত্যেকে আসামি। তোমাদের ক্ষমা করবে নাকি প্রতিশোধ নেবে, আয়াযই সিদ্ধান্ত দেবে।
সুলতান আয়াযকে ডেকে বললেন, আয়ায তুমি নির্দোষ। এরা হিংসার বশে তোমাকে পরীক্ষা করেছে। এখন তোমার ব্যাপারে সবধরনের খারাপ ধারণা পরিহার করে অনুতপ্ত হয়ে এসেছে। তারা লজ্জিত। তাদের বিচার তোমার হাতে।
আমার প্রতি আপনার দয়া অনুগ্রহ সীমাহীন। নচেৎ আমার অবস্থা তো সেই ছেঁড়া জুতা, জীর্ণ জুব্বার চেয়ে বেশি নয়- আয়ায বললেন। মওলানা রুমি (রহ.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, আয়ায ঠিকই বলেছে, মানুষের আসল হলো এক ফোঁটা বীর্য আর তাতে রক্তের প্রবাহ। মানুষের যা কিছু আছে সব আল্লাহর দান। এই চেতনা যে মনে লালন করে অহংকার ও আত্মম্ভরিতা তাকে আক্রান্ত করতে পারে না। তবে আল্লাহর অফুরান দয়া-দানের হকিকত হলো-
বাহরে আন দা’দে আস্ত তা জুয়ী দিগর
তো মগূ কে নীস্তাশ জুয ইন কদর
তোমাকে দিয়েছে যেন আরও আরও চাও
বলো না যে, নেয়ামত এটুকুই, এর বেশি নাই।
আল্লাহ তায়ালা তোমাকে এত নেয়ামত দেওয়ার কারণ হলো, তুমি যাতে আরও নেয়ামত চাও। যেন এ কথা না বল যে, আমার জন্য এসব নেয়ামতই যথেষ্ট। তোমাকে দেওয়া বস্তুগত নেয়ামত সীমাহীন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নেয়ামত পাওয়ার পটভূমি।
আয়ায বললেন, এ ব্যাপারে বিচার করার, সিদ্ধান্ত দেওয়ার আমি কে? আকাশে যদি সূর্য দেদীপ্যমান থাকে গ্রহ-নক্ষত্রের অস্তিত্ব কি দৃশ্যমান থাকে? আপনার সামনে আমার অস্তিত্বের কী দাম আছে?
সুলতান বললেন, তুমি যে খাস কামরায় প্রতিদিন যাও তার রহস্য তাহলে বলো।
‘আমি যাই, যাতে নিজের অতীত ভুলে না যাই। আমি আগে কী ছিলাম, কত অসহায় ছিলাম, বাদশাহর দয়ায় এখন কোথায়, সেই শুকরিয়া, চেতনা যেন মনে জাগরুক থাকে। বর্তমান অবস্থার ওপর যেন মনে অহংকার না আসে। আসলে এভাবে একটি খাস কামরা রাখাই আমার ভুল হয়েছে। তাতে মানুষের মনে সন্দেহ জাগার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কামরার দরজায় যে তালা ঝুলালাম, তারও কি প্রয়োজন ছিল? হিংসুক কল্পনিকদের মাঝে এমন কাজটি করে সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।’ এমন পরিস্থিতি এড়ানোর পথ তো নীরবতা। হে সাধক! তুমি কথার ফুলঝুরিতে ব্যস্ত। নীরবে একবার চিন্তা কর, আমলনামা কীভাবে হাতে আসবে? এখানে মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের রেকর্ড হচ্ছে নীরবে নিঃশব্দে। ওখানে সে লিপি প্রকাশ হবে বাস্তবে। তবে এখানেই তুমি দেখতে পার, তোমার আমলনামা কী ডান হাতে পাবে, না বাম হাতে। তুমি এখনই যাচাই করে দেখ, তুমি যে যে কাজ করছ, তা কি ডান হাতের আমলনামার উপযুক্ত? তা না হলে বাম হাতে অবশ্যই আসবে।
>>(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৭৬০-২১৬২)
সুলতান মাহমুদ গজনভীর প্রাণপ্রিয় গোলাম আয়ায। আয়ায কৃতদাস হয়ে এসেছিল সুলতানের দরবারে। এখন ঈর্ষণীয় রাজকীয় পদে সমাসীন। সুলতানের প্রিয়ভাজন হওয়ায় চারদিকে তার জয়জয়কার। আয়ায একজোড়া পুরোনো চামড়ার সেন্ডেল আর ছেঁড়া জুব্বা ঝুলিয়ে রেখেছিল একটি নির্জন কামরায়। রোজ দরবারে আসার আগে আয়ায সে কামরায় যায়। জুব্বা আর জুতার সামনে নিজের সঙ্গে কথা বলে আয়ায! তুমি সেই লোক, যার সম্বল ছিল পরিধানের এই ছেঁড়া আলখেল্লা আর পায়ে ছিল পুরোনো চপ্পল। কাজেই নিজেকে অত বড় মনে করো না। উচ্চাভিলাষী হইও না। সাবধান!
আপন যোগ্যতায় যারা বড় হয় তাদের শত্রুর অভাব হয় না। আয়াযের বেলায়ও ব্যতিক্রম হলো না। কাছের লোকেরা বাদশাহর কাছে গিয়ে নালিশ করল, জাঁহাপনা! আয়ায তার খাস কামরায় অনেক সোনাদানা জমা করেছে। একটি মটকা তো রতœালংকার হীরা-জহরতে ভর্তি। এ কামরার দরজায় সবসময় তালা ঝুলে। কারও প্রবেশাধিকার নেই। বাদশাহ বললেন, আমার আয়াযের কথা বলছ? তার এমনকি আছে, যা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে বা আমি জানব না?
কাহিনির প্রধান চরিত্রের বাদশাহ গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদ। গজনী তখনকার বৃহত্তর ইরানের অংশ, বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্গত। তার পিতা ছিলেন গজনীর শাসক আবু মনসুর সাবুকতাগীন। ৩৮৭ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ ক্ষমতায় আরোহণ করেন। একের পর এক দেশ জয়, দরবারে জ্ঞানী মনীষীদের সমাদর আর ভারতে ইসলামের বিজেতা হিসেবে তার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ১৭তম ভারত অভিযানে তিনি সোমনাথ মন্দিরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। অসাধারণ বিচক্ষণ, জ্ঞানী, দূরদর্শী ও সাহসী যোদ্ধা সুলতান মাহমুদ গজনভী হিজরি ৪২১ সালে রাজত্বের ৩৩ বছরে ৫১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। প্রিয়ভাজন গোলাম আয়াযকে নিয়ে সুলতান মাহমুদের নানা আখ্যান ফারসি সাহিত্যের অলংকার।
আয়াযের বিরুদ্ধে সভাসদদের অভিযোগ শুনে সুলতান একজন আমিরকে নির্দেশ দিলেন, যাও, গভীর রাতে তার কামরায় অভিযান চালাও। তল্লাশিতে ধনরতœ যা পাবে, তোমাদের। একটি সুরতহাল রিপোর্ট জানিয়ে দেবে রাজসভার সবার কাছে। কারণ এত আদর, যতœ, সম্মান পেয়ে কেউ মাথায় উঠবে, সহ্য করা হবে না। গোপনে ধনরতœ জমা করার মতো হীন কাজ করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সে কি তাহলে বাইরে প্রেম, ভক্তি, বিশ্বস্ততা আর উদ্দীপনা দেখায় আর ভেতরে ভেতরে আখের গোছায়? প্রেমের বিধান হলো, প্রকৃত প্রেমের সন্ধান যে পেয়েছে বন্দেগি ছাড়া অন্যকিছু করলে তার কুফরি হিসেবে গণ্য হবে।
সেনা অধিনায়ক আমির অভিযানের ছক আঁকলেন। ত্রিশজন বিশ্বস্ত সিপাহিসহ আয়াযের সংরক্ষিত কামরায় অভিযান চালাবেন গভীর রাতে। সিপাহিদের মনে আজ আনন্দের কোলাহল। কারণ তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলেই হীরা-জহরত যা কিছু পাবে তাদের হয়ে যাবে। অবশ্য আয়াযের প্রতি বাদশাহর মনে সন্দেহ অবিশ্বাস ছিল না। হিংসুকদের হাতেনাতে জব্দ করার জন্য তিনি এ সুযোগটি দিলেন। তারপরও আয়ায সম্পর্কে মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলে বাদশাহ তা দূর করেন আনমনে কথা বলে, আয়ায আমার, আমি আয়াযের। আয়াযের ব্যাপারে কেউ কিছু বলবে, আমি তা সহ্য করব না। আয়ায তো সাধারণ কোনো মানুষ নয়। অসাধারণ তার চলন, বলন, ব্যবহার। আয়াযের প্রশংসায় মওলানা রুমির চিন্তায় ভেসে উঠল একজন ‘ইনসানে কামেল’ এর প্রতিচ্ছবি। তার সামনে এখন ইনসানে কামেলের মহান সত্তার উদ্ভাস। সেই উদ্ভাসে প্রতিফলিত আল্লাহর গুণাবলির ঝলক। ফলে তিনি সব মানবীয় গুণ ও স্বভাবের কেন্দ্র। মহান চরিত্র সুষমায় সুবাসিত তার জীবন। তিনি আল্লাহর প্রিয়ভাজন। তার প্রশংসা করার সাধ্য মানুষের নেই। তিনি বাদশাহ নন; তবে বাদশাহর বাদশাহ, বাদশাহ নির্মাতা। তিনি সৃষ্টির সার নির্যাস। মওলানা যেন বোঝাতে চান তিনি আল্লাহর হাবিব মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। তার উপমা সাগর। তার থেকেই দুনিয়ার মানুষ পায় সজীবতা, জীবনের স্পন্দন। মওলানা আরও বলেন, এই বর্ণনায় এসে আমার মনে পড়ে গেল হাতির দেশ হিন্দুস্তানের কথা। সে এখন কবিতার ক্ষেত-খামার দুমড়ে-মুচড়ে যাবে।
কাইফা য়া-তীন নাযমু লী ওয়াল কাফিয়া
বা-দা মা যাআত উসুলুল আফিয়া
আমার কীভাবে আসবে কবিতা অন্ত্যমিল
প্রেমের তাড়ায় যেখানে পালায় মনের স্বস্তি।
আল্লাহর প্রেমে আমি আত্মহারা। পাগলামি, উন্মতত্তা, উন্মাদনায় আমি বেসামাল। আয়ায আমি তোমার কিচ্ছা বলছিলাম। এখন তুমি আমার কিচ্ছা বল। মওলানা রুমি এখানে আধ্যাত্মিক সাধনার ফানা (নির্বাণ) ও বাকা (স্থিতি) এর জটিল বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। যার অপার রহস্যের প্রান্তরে প্রবেশ করার জন্য আমাদের মসনবি পঞ্চম খ- অনুবাদ ও ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই গল্পের শুরু ১৭৬০ বয়েত থেকে আর শেষ ২১৬২ বয়েতে গিয়ে। কাজেই গল্পের ফাঁকে মওলানা কত আধ্যাত্মিক তত্ত্বরহস্য ব্যক্ত করেছেন অনুমান করাও কঠিন।
ফিরে আসি সুলতান ও আয়াযের গল্পের ধারাবাহিকতায়। আমিরের নেতৃত্বে সিপাহিরা রাতে তালা ভেঙে আয়াযের কামরায় প্রবেশ করে। সতর্ক নজরদারিতে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালায় সংরক্ষিত কক্ষে। কিন্তু একজোড়া ছেঁড়া জুতা আর জীর্ণশীর্ণ জুব্বাটি ছাড়া আর কিছু পেল না। তখন ভয়ে আতঙ্কে হলুদাভ হলো তাদের চেহারা। বাদশাহর কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না। আয়াযের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে পরিণাম কী হবে তারা জানে। আবার আত্মস্থ হয়ে তারা বলল, এমন তো হতে পারে না। এই জুতা-জুব্বা চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল। নিশ্চয়ই সোনা-জহরত মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছে সংগোপনে। শুরু হলো খননকার্য কামরার তলায়, এমনকি দেয়ালগাত্রে কোণায় কোণায়। কিন্তু কিছুর সন্ধান পেল না। কামরার দেয়াল, দরজা-জানালা যেন নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছিল আয়াযের সততার। তারা হতবাক। আয়াযের প্রতি সন্দেহ ও শত্রুতার জন্য লজ্জায় জড়োসড়ো। নিদারুণ হতাশা ও লজ্জা নিয়ে বেরিয়ে এলো আয়াযের কামরা থেকে। ক্ষমার আর্জির ভঙ্গিতে মাথায় দুহাত দিয়ে পরদিন হাজির হলো দরবারে।
তাদের দেখেই বাদশাহ বললেন, কী খবর তোমাদের? তোমাদের কাঁধের ঝুলি যে খালি, কী ব্যাপার? আয়াযের ধনরতœ কোথাও গোপন করে এখানে এসেছ নাকি? তারপরও তোমাদের চেহারায় আনন্দের ঝিলিক থাকার কথা। গাছের শিকড় মাটির নিচে পোঁতা হলে তার পাতা বাইরে পল্লবিত হয়। অনুরূপ যারা দুনিয়ায় ভালো কাজের সঞ্চয় গড়ে আখেরাতে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। আর যারা দুনিয়ার জীবনে মন্দের সদাই করে তাদের চেহারা হবে বিধ্বস্ত কদাকার।
বাদশাহর নিরাপত্তা বিভাগের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নির্বাক। নিজেদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বাদশাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। হামবড়া ভাব, রূঢ়-রুক্ষ স্বভাব আর মিথ্যা মামলার প্রায়শ্চিত্য ভোগার ভয়ে তারা আতঙ্কিত। এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন নিজেরা নিহত হওয়ার তলোয়ার আর কাফন এগিয়ে দিয়েছে বাদশাহর সামনে। জাঁহাপনা! আমাদের প্রাণদ- দিলে তা আমাদের প্রাপ্য। আর যদি ক্ষমা করেন, তা হবে আপনার মহানুভবতা ও দয়ার প্রকাশ। আমরা যা করেছি, তা আমাদের স্বভাবের দোষ। আপনি বাদশাহ, আপনার কাছে আমাদের আশা, আপনার দয়া, ক্ষমা ও মহানুভবতার পরশ। মওলানার চেতনা এখানে গজনীর বাদশাহকে ছেড়ে আরশপানে উঁকি দেয়। তুমি যদি আমার পাপতাপ মাফ করে দাও, তা তো তোমার শানের জন্য মানায়। দিনের ধর্ম আলো দেবে, রাতের স্বভাব আঁধারের চাদরে আবৃত্ত করবে। তোমার দয়ার স্বভাব দিয়ে যদি আমাদের মাফ করে দাও, তোমার দান বখশিশের সাগরের পানি তো এতটুকুন কমবে না।
সুলতান মাহমুদ বললেন, না আমি তোমাদের ক্ষমা করতে পারব না। এ অধিকার আমি সংরক্ষণ করি না। কারণ তোমরা দোষ করেছ আয়াযের, তার মানহানি করেছ, মানহানির মামলায় তোমরা প্রত্যেকে আসামি। তোমাদের ক্ষমা করবে নাকি প্রতিশোধ নেবে, আয়াযই সিদ্ধান্ত দেবে।
সুলতান আয়াযকে ডেকে বললেন, আয়ায তুমি নির্দোষ। এরা হিংসার বশে তোমাকে পরীক্ষা করেছে। এখন তোমার ব্যাপারে সবধরনের খারাপ ধারণা পরিহার করে অনুতপ্ত হয়ে এসেছে। তারা লজ্জিত। তাদের বিচার তোমার হাতে।
আমার প্রতি আপনার দয়া অনুগ্রহ সীমাহীন। নচেৎ আমার অবস্থা তো সেই ছেঁড়া জুতা, জীর্ণ জুব্বার চেয়ে বেশি নয়- আয়ায বললেন। মওলানা রুমি (রহ.) এর ব্যাখ্যায় বলেন, আয়ায ঠিকই বলেছে, মানুষের আসল হলো এক ফোঁটা বীর্য আর তাতে রক্তের প্রবাহ। মানুষের যা কিছু আছে সব আল্লাহর দান। এই চেতনা যে মনে লালন করে অহংকার ও আত্মম্ভরিতা তাকে আক্রান্ত করতে পারে না। তবে আল্লাহর অফুরান দয়া-দানের হকিকত হলো-
বাহরে আন দা’দে আস্ত তা জুয়ী দিগর
তো মগূ কে নীস্তাশ জুয ইন কদর
তোমাকে দিয়েছে যেন আরও আরও চাও
বলো না যে, নেয়ামত এটুকুই, এর বেশি নাই।
আল্লাহ তায়ালা তোমাকে এত নেয়ামত দেওয়ার কারণ হলো, তুমি যাতে আরও নেয়ামত চাও। যেন এ কথা না বল যে, আমার জন্য এসব নেয়ামতই যথেষ্ট। তোমাকে দেওয়া বস্তুগত নেয়ামত সীমাহীন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নেয়ামত পাওয়ার পটভূমি।
আয়ায বললেন, এ ব্যাপারে বিচার করার, সিদ্ধান্ত দেওয়ার আমি কে? আকাশে যদি সূর্য দেদীপ্যমান থাকে গ্রহ-নক্ষত্রের অস্তিত্ব কি দৃশ্যমান থাকে? আপনার সামনে আমার অস্তিত্বের কী দাম আছে?
সুলতান বললেন, তুমি যে খাস কামরায় প্রতিদিন যাও তার রহস্য তাহলে বলো।
‘আমি যাই, যাতে নিজের অতীত ভুলে না যাই। আমি আগে কী ছিলাম, কত অসহায় ছিলাম, বাদশাহর দয়ায় এখন কোথায়, সেই শুকরিয়া, চেতনা যেন মনে জাগরুক থাকে। বর্তমান অবস্থার ওপর যেন মনে অহংকার না আসে। আসলে এভাবে একটি খাস কামরা রাখাই আমার ভুল হয়েছে। তাতে মানুষের মনে সন্দেহ জাগার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কামরার দরজায় যে তালা ঝুলালাম, তারও কি প্রয়োজন ছিল? হিংসুক কল্পনিকদের মাঝে এমন কাজটি করে সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।’ এমন পরিস্থিতি এড়ানোর পথ তো নীরবতা। হে সাধক! তুমি কথার ফুলঝুরিতে ব্যস্ত। নীরবে একবার চিন্তা কর, আমলনামা কীভাবে হাতে আসবে? এখানে মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের রেকর্ড হচ্ছে নীরবে নিঃশব্দে। ওখানে সে লিপি প্রকাশ হবে বাস্তবে। তবে এখানেই তুমি দেখতে পার, তোমার আমলনামা কী ডান হাতে পাবে, না বাম হাতে। তুমি এখনই যাচাই করে দেখ, তুমি যে যে কাজ করছ, তা কি ডান হাতের আমলনামার উপযুক্ত? তা না হলে বাম হাতে অবশ্যই আসবে।
>>(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৭৬০-২১৬২)
No comments