‘বাকিতে’ ইভিএম কিনে টাকার জন্য ঘুরছে ইসি by হারুন আল রশীদ
নির্বাচন
কমিশনের (ইসি) ৮২ হাজার ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) কেনার জন্য দরকার ১
হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সরকার এই টাকা দেবে কি না, সেটি নিশ্চিত না
হয়েই তারা ৮২ হাজার ইভিএম কেনার জন্য কার্যাদেশ দিয়ে দিয়েছে বিএমটিএফকে
(বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি)। এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয় ইসিকে দিয়েছে
মাত্র ৭৯৭ কোটি টাকা। বলেছে, এই অর্থবছরে আর কোনো টাকা দেওয়া সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে, বিএমটিএফ কার্যাদেশ পেয়ে ৮২ হাজার ইভিএম বানিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় খানিকটা চাপে ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ইসি। বাকি ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কোত্থেকে আসবে? উদ্ধার পেতে তারা এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছে।
শেষমেশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারের কমবেশি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। সেই সব ব্যর্থ প্রকল্পের টাকা ফেরত এলে তা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে দেওয়া হবে। তারপর যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তা ইসিকে দেওয়া হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসির এই প্রকল্পের অবস্থা এখন লেজেগোবরে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যে জন্য ইভিএম
২০১৮ সালের জুলাইতে ইসি দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৫ কোটির প্রকল্প গ্রহণ করে। এর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বলা হয়েছে, প্রকল্প শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, অধিকতর সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের উন্নয়ন করা। প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই নির্বাচনে এর ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকেও এর ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা শুরুতে ইভিএমের পক্ষে না থাকলেও এখন তিনি দেশব্যাপী এর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রকল্পের ঘোর বিরোধী মনোভাব দেখালেও ইভিএমসংক্রান্ত সর্বশেষ সিদ্ধান্তগুলোয় তিনি ইতিবাচক মনোভাব জানিয়েছেন বলে কমিশন সূত্র জানায়।
এমন সব তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ফল ইতিবাচক ছিল না। তবে সর্বশেষ কয়েকটি উপজেলায় কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে বলে ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে।
৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প
প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাবে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ সালে ১ হাজার ৯৯৮ কোটি, ২০১৯-২০ সালে ৮৫০ কোটি, ২০২০-২১ সালে ৮৫৪ কোটি, ২০২১-২২ সালে ৭৭ কোটি এবং ২০২২-২৩ সালে ৪৫ কোটি ব্যয় করা হবে। প্রকল্পে তিন ধাপে ইভিএম কেনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৮২ হাজার ইভিএম কেনা হবে, যার ব্যয় ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে কেনা হবে ৩৪ হাজার করে ইভিএম। আর তাতে ব্যয় ৭৯৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা করে। প্রতিটি মেশিনের দাম ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। আর এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য মেশিন ও যন্ত্রপাতির দাম ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ব্যবহারের উপযোগী প্রতিটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা।
অপরিকল্পিত প্রকল্প
প্রথম ধাপে ৮২ হাজার ইভিএম কেনার জন্য দরকার ছিল ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই টাকা পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই ইসি বিএমটিএফকে ৮২ হাজার ইভিএম কেনার কার্যাদেশ দিয়ে দেয়। ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, কার্যাদেশ পেয়ে বিএমটিএফ সমপরিমাণ ইভিএম তৈরি করে ফেলেছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছে মাত্র ৭৯৭ কোটি টাকা। দুই মাস আগে এই টাকা মহাহিসাব নিরীক্ষকের দপ্তর থেকে বিএমটিএফকে পরিশোধ করা হয়েছে। এই টাকা থেকেই বিএমটিএফ থেকে ইসিকে ইতিমধ্যে ২১ হাজার ইভিএম সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ইসির সঙ্গে বিএমটিএফের চুক্তি অনুযায়ী বাকি ১ হাজার ১২৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আগামী জুনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা কয়েক দফায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সেখানে ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এরপর গত মাসে ইসি থেকে সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়। এই মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এডিপির অব্যয়িত টাকা ফেরত এলে সেখান থেকে ইসিকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসি যেহেতু ইভিএম কিনে ফেলেছে, সেহেতু টাকা তো দিতেই হবে। তাই আমরা চেষ্টা করছি যাতে টাকাটা দেওয়া যায়।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণত এডিপির অব্যয়িত টাকা ফেরত আসার পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এই টাকা ব্যয়ের জন্য যে সুপারিশ করে, তাতে অর্থ মন্ত্রণালয় আপত্তি করে না। আর অর্থ মন্ত্রণালয় যাতে আপত্তি না করে, সে জন্য ইসি থেকেও জোরালো চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএমটিএফ মেশিন বানিয়ে ফেলেছে। এর পেছনে তাদের অনেক টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে। সে জন্যই আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যেসব টাকা অব্যয়িত থাকবে, সেগুলো আমাদের দেওয়ার অনুরোধ করেছি।’
তড়িঘড়ির কারণ
বর্তমানে যেসব নির্বাচন হচ্ছে বা সামনে যেসব নির্বাচন হবে, তা সামলানোর মতো ইভিএম ইসির কাছে রয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে দেশজুড়ে পৌরসভা নির্বাচন হবে। তার আগে দেশে বড় পরিসরে কোনো নির্বাচন নেই। যে কারণে এই অর্থবছরেই ৮২ হাজার ইভিএম কেনা এবং টাকার জন্য ‘মরিয়া’ হয়ে ছোটার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কারও মতে, ইসি সচিবালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকজন কর্মকর্তা প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ নির্বাচন শেষ। তাই তাঁরা যেকোনো সময়ে বদলি হয়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ফেরত যেতে পারেন। মূলত, তাঁদের ইচ্ছাতেই এই অর্থবছরে ৮২ হাজার কেনার কাজ শেষ করার তোড়জোড় চলছে। তাঁরা থাকা অবস্থাতেই ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার কেনাকাটার কাজ শেষ করে যেতে চান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক এম হাফিজ উদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পে ইসি সরকারি নিয়ম-নীতির কিছুই মানেনি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাস হওয়ার আগেই তারা প্রকল্পের মালামাল কিনে ফেলেছে। টাকা বরাদ্দ হওয়ার আগেই মালামাল কেনার কার্যাদেশ তারই ধারাবাহিকতা। এটা পিপিআরের (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল) পরিপন্থী।
প্রকল্পে অনিয়ম
নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী এই প্রকল্পে ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু ইসি একজন প্রকল্প পরিচালক, একজন উপপ্রকল্প পরিচালক ও একজন হিসাবরক্ষক নিয়োগ দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের কারিগরি দিক বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রোগ্রামার, একজন মেন্টেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার, দুজন পারসোনালাইজেশন অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। চলমান আইডিয়া প্রকল্পের জনবল দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে ইভিএম পরিচালনার জন্য ৩ হাজার ১১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা আছে। এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সংসদ নির্বাচনে আগেই থেকে ইভিএমের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে ব্যয় হওয়া টাকা প্রকল্প থেকে না দিয়ে ইসির নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিএমটিএফ কার্যাদেশ পেয়ে ৮২ হাজার ইভিএম বানিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় খানিকটা চাপে ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ইসি। বাকি ১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কোত্থেকে আসবে? উদ্ধার পেতে তারা এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছে।
শেষমেশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারের কমবেশি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। সেই সব ব্যর্থ প্রকল্পের টাকা ফেরত এলে তা সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে দেওয়া হবে। তারপর যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, তা ইসিকে দেওয়া হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসির এই প্রকল্পের অবস্থা এখন লেজেগোবরে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যে জন্য ইভিএম
২০১৮ সালের জুলাইতে ইসি দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৫ কোটির প্রকল্প গ্রহণ করে। এর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বলা হয়েছে, প্রকল্প শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, অধিকতর সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের উন্নয়ন করা। প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই নির্বাচনে এর ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকেও এর ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা শুরুতে ইভিএমের পক্ষে না থাকলেও এখন তিনি দেশব্যাপী এর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রকল্পের ঘোর বিরোধী মনোভাব দেখালেও ইভিএমসংক্রান্ত সর্বশেষ সিদ্ধান্তগুলোয় তিনি ইতিবাচক মনোভাব জানিয়েছেন বলে কমিশন সূত্র জানায়।
এমন সব তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ফল ইতিবাচক ছিল না। তবে সর্বশেষ কয়েকটি উপজেলায় কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে বলে ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে।
৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প
প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাবে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ সালে ১ হাজার ৯৯৮ কোটি, ২০১৯-২০ সালে ৮৫০ কোটি, ২০২০-২১ সালে ৮৫৪ কোটি, ২০২১-২২ সালে ৭৭ কোটি এবং ২০২২-২৩ সালে ৪৫ কোটি ব্যয় করা হবে। প্রকল্পে তিন ধাপে ইভিএম কেনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৮২ হাজার ইভিএম কেনা হবে, যার ব্যয় ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে কেনা হবে ৩৪ হাজার করে ইভিএম। আর তাতে ব্যয় ৭৯৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা করে। প্রতিটি মেশিনের দাম ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। আর এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য মেশিন ও যন্ত্রপাতির দাম ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ব্যবহারের উপযোগী প্রতিটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা।
অপরিকল্পিত প্রকল্প
প্রথম ধাপে ৮২ হাজার ইভিএম কেনার জন্য দরকার ছিল ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই টাকা পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই ইসি বিএমটিএফকে ৮২ হাজার ইভিএম কেনার কার্যাদেশ দিয়ে দেয়। ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, কার্যাদেশ পেয়ে বিএমটিএফ সমপরিমাণ ইভিএম তৈরি করে ফেলেছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছে মাত্র ৭৯৭ কোটি টাকা। দুই মাস আগে এই টাকা মহাহিসাব নিরীক্ষকের দপ্তর থেকে বিএমটিএফকে পরিশোধ করা হয়েছে। এই টাকা থেকেই বিএমটিএফ থেকে ইসিকে ইতিমধ্যে ২১ হাজার ইভিএম সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ইসির সঙ্গে বিএমটিএফের চুক্তি অনুযায়ী বাকি ১ হাজার ১২৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আগামী জুনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা কয়েক দফায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সেখানে ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এরপর গত মাসে ইসি থেকে সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়। এই মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এডিপির অব্যয়িত টাকা ফেরত এলে সেখান থেকে ইসিকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসি যেহেতু ইভিএম কিনে ফেলেছে, সেহেতু টাকা তো দিতেই হবে। তাই আমরা চেষ্টা করছি যাতে টাকাটা দেওয়া যায়।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণত এডিপির অব্যয়িত টাকা ফেরত আসার পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এই টাকা ব্যয়ের জন্য যে সুপারিশ করে, তাতে অর্থ মন্ত্রণালয় আপত্তি করে না। আর অর্থ মন্ত্রণালয় যাতে আপত্তি না করে, সে জন্য ইসি থেকেও জোরালো চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএমটিএফ মেশিন বানিয়ে ফেলেছে। এর পেছনে তাদের অনেক টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে। সে জন্যই আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যেসব টাকা অব্যয়িত থাকবে, সেগুলো আমাদের দেওয়ার অনুরোধ করেছি।’
তড়িঘড়ির কারণ
বর্তমানে যেসব নির্বাচন হচ্ছে বা সামনে যেসব নির্বাচন হবে, তা সামলানোর মতো ইভিএম ইসির কাছে রয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে দেশজুড়ে পৌরসভা নির্বাচন হবে। তার আগে দেশে বড় পরিসরে কোনো নির্বাচন নেই। যে কারণে এই অর্থবছরেই ৮২ হাজার ইভিএম কেনা এবং টাকার জন্য ‘মরিয়া’ হয়ে ছোটার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কারও মতে, ইসি সচিবালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকজন কর্মকর্তা প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ নির্বাচন শেষ। তাই তাঁরা যেকোনো সময়ে বদলি হয়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ফেরত যেতে পারেন। মূলত, তাঁদের ইচ্ছাতেই এই অর্থবছরে ৮২ হাজার কেনার কাজ শেষ করার তোড়জোড় চলছে। তাঁরা থাকা অবস্থাতেই ১ হাজার ৯২১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার কেনাকাটার কাজ শেষ করে যেতে চান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক এম হাফিজ উদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পে ইসি সরকারি নিয়ম-নীতির কিছুই মানেনি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাস হওয়ার আগেই তারা প্রকল্পের মালামাল কিনে ফেলেছে। টাকা বরাদ্দ হওয়ার আগেই মালামাল কেনার কার্যাদেশ তারই ধারাবাহিকতা। এটা পিপিআরের (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল) পরিপন্থী।
প্রকল্পে অনিয়ম
নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী এই প্রকল্পে ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু ইসি একজন প্রকল্প পরিচালক, একজন উপপ্রকল্প পরিচালক ও একজন হিসাবরক্ষক নিয়োগ দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের কারিগরি দিক বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রোগ্রামার, একজন মেন্টেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার, দুজন পারসোনালাইজেশন অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। চলমান আইডিয়া প্রকল্পের জনবল দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে ইভিএম পরিচালনার জন্য ৩ হাজার ১১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা আছে। এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সংসদ নির্বাচনে আগেই থেকে ইভিএমের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে ব্যয় হওয়া টাকা প্রকল্প থেকে না দিয়ে ইসির নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে।
No comments