অবিরাম হামলা টিয়ারশেল, জলকামান
টানা
তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীতে হামলার শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বাড্ডার
আফতাব নগরে এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর
হামলার ঘটনা ঘটে। শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে
টিয়ারশেল ও জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে পুলিশ। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাড্ডায় বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও
শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভাঙচুরও করে। বসুন্ধরা
আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের
শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ তাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ
করে। এসময় সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করে,
শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুরো এলাকা
রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুরের পর থেকে থেমে থেমে সন্ধ্যা পর্যন্ত
হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগের দিন পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগের দিকে গেলে তাদের ওপর টিয়ারশেল ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে পুলিশ। পরে ওই এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় রাখা হয়। এদিকে রোববার ধানমন্ডিতে সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। শনিবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে।
পুলিশের সামনেই বাড্ডায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: আফতাব নগরে পুলিশের সামনেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দফায় দফায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ, র্যাব ও আর্মড পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কোন বাধা দেয়নি। বরং ওই যুবকদের সঙ্গে তারাও শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ১০-১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। সে সঙ্গে সাতজনকে আটক করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।
নিরাপদ সড়কের দাবি এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ সেখানে একদল যুবক অতর্কিত হামলা শুরু করে। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও তাদের পাল্টা ধাওয়া করে। এ সময় পুরো আফতাব নগর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। সকাল থেকেই বেরাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা আফতাব নগরের গেটে অবস্থান নেয়। এসময় সেখানে কোনো পুলিশের উপস্থিতি ছিল না। সকাল ১০টায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে যায়। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। তারপরও বহিরাগতদের ইটপাটকেল ছোড়া থেমে ছিল না। তারা একের পর এক ঢিল ছুড়ে ক্যাম্পাসের কয়েকটি জানালার গ্লাস ভাঙচুর করে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের লোকজনের এই হামলায় পুলিশের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
বরং বেলা বারোটার দিকে যখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ঢিল ছুড়ছিল তখনই পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একজন নারী সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাকেও হেনস্থা করে স্থানীয় যুবলীগ কর্মীরা। তবে এ ব্যাপারেও পুলিশের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। সকাল ১১টার পর থেকে ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যেই থাকতে হয়। দুপুর ২টার পর রামপুরা ব্রিজের জহুরুল ইসলাম সিটির গেটে বেশ কয়েকজন অভিভাবক সন্তানদের খোঁজে আসেন। ক্যাম্পাসের ভেতরে নিজের সন্তান আটকের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বায়েজিদ আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থীর মা জানান, দুপুর ১টার পর আমার ছেলে ফোন দিয়েছিল। এরপর তার আর কোনো খবর জানি না। শুনেছি ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে। এখন ফোনও বন্ধ। বায়েজিদের মা বলেন, বায়েজিদ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। এসময় আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর খোঁজে তাদের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসের সামনে এসে ভিড় করেন। এদিকে বেলা আড়াইটার দিকে ক্যাম্পাস এলাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রায় ২শ’ শিক্ষার্থী লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে। এসময় কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ব্র্যাকের শিক্ষার্থীরা যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীদের কয়েকজনকে মারধরও করেন। পরে যুব-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে সরে যায়। ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছুড়ে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। পরে একদল যুবক হেলমেট পরিহিত অবস্থায় ক্যাম্পাসে এলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। স্থানীয় লোকজনের সূত্রে জানা যায়, তারা বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা লাঠিসোটা নিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। দেশ টিভি, বৈশাখী টিভিসহ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। বিকাল চারটার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। সোয়া চারটার দিকে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. ফরাস উদ্দিন ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেন। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ফরাস উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি এখন বেশ শান্ত।
সকাল থেকে বহিরাগতরা হামলা করেছে। এ বিষয়ে বাড্ডা জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আহমেদ হুমায়ুন বলেন, সকাল থেকে এখানকার পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এখন অনেক শান্ত। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা কেন হামলা করেছে বা পুলিশ কেন তাদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়েছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশকিছু কাচের গ্লাস ভাঙচুর হয়েছে। বহিরাগতের হামলায় কয়েকটি জানালা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
হামলা-সংষর্ষে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা রণক্ষেত্র: সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশের জেরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় দফায় দফায় হামলা সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের টিয়ারশেল ও ছাত্রলীগের হামলায় ৭ শিক্ষার্থী আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল সহকারে গ্রামীণফোনের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এগোতে থাকলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে এ সময় ফাঁকা গুলি করতেও দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
পরে শিক্ষার্থীরা আবারও সংগঠিত হয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে ধাওয়া দেয়। শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা পুলিশের টিয়ারশেলের জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের টিয়ারশেলের সঙ্গেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে ছিলেন সেইসব শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। পুলিশ রায়ট কার দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান লক্ষ্য করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। হামলা সংঘর্ষে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর পৌনে ১২টায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বসুন্ধরা গেট ও এ্যাপোলে হাসপাতালের গেটে উভয়স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সদস্যরা অবস্থান নেয়। আর এ্যাপোলো হাসপাতালের বামপাশের চৌরাস্তার মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ফেসবুকে লাইভ করতে দেখা যায়। তারা ফেসবুক লাইভে সেখানে তাদের সাহায্য করার জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে পুলিশ আবারও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। ওই সংঘর্ষ থেমে থেমে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে।
সংঘর্ষ চলাকালে আবাসিক এলাকার সড়কে যান ও জন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই বাসার মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সীমান্ত জানান, আমরা খণ্ড খণ্ড মিছিলসহকারে ক্যাম্পাস থেকে গ্রামীণ ফোনের কার্যালয়ের সামনে যাই। একপর্যায়ে সেখান থেকে বসুন্ধরা গেটের সামনে গেলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশও আমাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
রনি নামে আরেক শিক্ষার্থী জানায়, বিনা উস্কানিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গুলশান জোনের পুলিশের এডিসি আব্দুল আহাদ মানবজমিনকে জানান, শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ উপস্থিত হয়। তারা যাতে মূল সড়কে আসতে না পারে এজন্য পুলিশ তাদের বাধা দেন। শিক্ষার্থীরা আগে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
শাহবাগে পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ: শাহবাগ এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছেন। বিকাল তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগ মোড়ের দিকে আসা মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে এ সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়নি। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের টিয়ারশেল, জলকামান উপেক্ষা করে স্লোগান দিতে দিতে শাহবাগ মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। তখন লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। লাঠিচার্জ ঠেকাতে শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়। লাঠিচার্জ আর টিয়ারশেল থেকে বাঁচার জন্য দৌড়াতে গিয়ে ১০/১২ শিক্ষার্থীও আহত হতে দেখা গেছে। লাঠিচার্জের সময় পুলিশ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। বিকাল সাড়ে তিনটায় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের টিএসসির দিকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শ’ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করতে চায়। এ সময় পুলিশি বাধায় তারা ফিরে যায়। পরে তারা টিএসসি, কার্জনহল, শহীদ মিনার, কলাভবন, পাবলিক লাইব্রেরিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে মিছিল করে। বিকাল তিনটার দিকে হঠাৎ করে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে শাহবাড় মোড়ের দিকে আসতে থাকে। এ সময় তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ‘ নিরাপদ সড়ক চাই’ ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা জালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ ‘নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ নানা স্লোগান দেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ থানা পার হয়ে জাদুঘরের ঠিক উল্টোপাশে আসার পর তাদেরকে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা তখন পুলিশের ব্যারিকেড ভেদ করে শাহবাগ চত্বরের দিকে এগুতে চায়। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছুড়তে শুরু করে। সংঘর্ষের পরে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থানের কারণে এই এলাকায় কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। শাহবাগে দেশের দুইটি বড় হাসপাতালসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। যানবাহন চলাচল করতে না পেরে অনেক রোগী ও সাধারণ মানুষের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শাহবাগ মোড়ে আর কাউকে অবস্থান করতে দেব না।
শাহবাগ থানা ফটকে স্বজনদের ভিড়: এক আত্মীয়কে রক্ত দানের উদ্দেশ্যে রামপুরা থেকে সিএনজিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন রাহাত ও লিমন। পথিমধ্যে শাহবাগ এলাকায় পৌঁছালে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। রাহাত বেসরকারি চাকরি করেন এবং আরাফাত রহমান লিমন যশোরের একটি কলেজে পড়েন। সোমবার সন্ধ্যায় রাহাত ও লিমনের পরিবারের সদস্যরা থানার ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের সন্তানেরা কোনো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না। পুলিশ জোর করে থানায় নিয়ে এসেছে। শাহবাগে আসার পরই তাদের গতি রোধ করে পুলিশ। তল্লাশির কথা বলে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় শাহবাগ থানায়। তাদের নামে মামলা দেয়া হচ্ছে। এদিকে রক্ত না পেয়ে এবং আত্মীয়ের আটকের খবর শুনে থানার গেটের সামনে এসেছে অসুস্থদের স্বজনরাও। রোববার দিনভর আন্দোলনকারী সন্দেহে এরকম অনেককেই আটক করে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানার সামনে অবস্থানরত স্বজনরা অভিযোগ করেন, তাদের পরিবারের তরুণ-কিশোরদের রাস্তা থেকে ধরে এনে মামলা দেয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলায় গ্রেপ্তার নেই: নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। গুরুতর আহত অনেক সাংবাদিক রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু সাংবাদিকদের ওপরে এসব হামলার ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, সাংবাদিকদের ওপরে হামলার বিষয়ে তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে তারা গ্রেপ্তার করবেন। আহত সাংবাদিক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সচিত্র খবর থেকে জানা যায়, গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, আফতাবনগর এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীরা দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। অনেক সাংবাদিকের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন নিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অনেকের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন থেকে অনেক তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি আরো অনেককে বেধড়ক পেটানো হয়।
আওয়ামী লীগের মামলা: এদিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার ঘটানায় দুটি মামলা করা হয়েছে। দলের উপদপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় অজ্ঞাতনামা প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে গতকাল এ মামলা দুটি করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ। গত শনিবার একদল দুর্বৃত্ত আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগের দিন পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগের দিকে গেলে তাদের ওপর টিয়ারশেল ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে পুলিশ। পরে ওই এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় রাখা হয়। এদিকে রোববার ধানমন্ডিতে সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। শনিবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে।
পুলিশের সামনেই বাড্ডায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: আফতাব নগরে পুলিশের সামনেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দফায় দফায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ, র্যাব ও আর্মড পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কোন বাধা দেয়নি। বরং ওই যুবকদের সঙ্গে তারাও শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ১০-১৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। সে সঙ্গে সাতজনকে আটক করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।
নিরাপদ সড়কের দাবি এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ সেখানে একদল যুবক অতর্কিত হামলা শুরু করে। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও তাদের পাল্টা ধাওয়া করে। এ সময় পুরো আফতাব নগর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। সকাল থেকেই বেরাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা আফতাব নগরের গেটে অবস্থান নেয়। এসময় সেখানে কোনো পুলিশের উপস্থিতি ছিল না। সকাল ১০টায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে যায়। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। তারপরও বহিরাগতদের ইটপাটকেল ছোড়া থেমে ছিল না। তারা একের পর এক ঢিল ছুড়ে ক্যাম্পাসের কয়েকটি জানালার গ্লাস ভাঙচুর করে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের লোকজনের এই হামলায় পুলিশের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
বরং বেলা বারোটার দিকে যখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ঢিল ছুড়ছিল তখনই পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একজন নারী সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাকেও হেনস্থা করে স্থানীয় যুবলীগ কর্মীরা। তবে এ ব্যাপারেও পুলিশের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। সকাল ১১টার পর থেকে ক্যাম্পাসের ভেতরে শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যেই থাকতে হয়। দুপুর ২টার পর রামপুরা ব্রিজের জহুরুল ইসলাম সিটির গেটে বেশ কয়েকজন অভিভাবক সন্তানদের খোঁজে আসেন। ক্যাম্পাসের ভেতরে নিজের সন্তান আটকের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বায়েজিদ আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থীর মা জানান, দুপুর ১টার পর আমার ছেলে ফোন দিয়েছিল। এরপর তার আর কোনো খবর জানি না। শুনেছি ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে। এখন ফোনও বন্ধ। বায়েজিদের মা বলেন, বায়েজিদ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। এসময় আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর খোঁজে তাদের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসের সামনে এসে ভিড় করেন। এদিকে বেলা আড়াইটার দিকে ক্যাম্পাস এলাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রায় ২শ’ শিক্ষার্থী লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে। এসময় কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ব্র্যাকের শিক্ষার্থীরা যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীদের কয়েকজনকে মারধরও করেন। পরে যুব-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে সরে যায়। ব্র্যাকের শিক্ষার্থীদের ওপর কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছুড়ে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। পরে একদল যুবক হেলমেট পরিহিত অবস্থায় ক্যাম্পাসে এলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। স্থানীয় লোকজনের সূত্রে জানা যায়, তারা বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা লাঠিসোটা নিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। এ সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। দেশ টিভি, বৈশাখী টিভিসহ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ভিডিও সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। বিকাল চারটার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। সোয়া চারটার দিকে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. ফরাস উদ্দিন ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেন। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ফরাস উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি এখন বেশ শান্ত।
সকাল থেকে বহিরাগতরা হামলা করেছে। এ বিষয়ে বাড্ডা জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আহমেদ হুমায়ুন বলেন, সকাল থেকে এখানকার পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এখন অনেক শান্ত। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা কেন হামলা করেছে বা পুলিশ কেন তাদের ওপর টিয়ারশেল ছুড়েছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশকিছু কাচের গ্লাস ভাঙচুর হয়েছে। বহিরাগতের হামলায় কয়েকটি জানালা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
হামলা-সংষর্ষে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা রণক্ষেত্র: সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশের জেরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় দফায় দফায় হামলা সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের টিয়ারশেল ও ছাত্রলীগের হামলায় ৭ শিক্ষার্থী আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল সহকারে গ্রামীণফোনের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এগোতে থাকলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে এ সময় ফাঁকা গুলি করতেও দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
পরে শিক্ষার্থীরা আবারও সংগঠিত হয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে ধাওয়া দেয়। শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা পুলিশের টিয়ারশেলের জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের টিয়ারশেলের সঙ্গেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে ছিলেন সেইসব শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। পুলিশ রায়ট কার দিয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান লক্ষ্য করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। হামলা সংঘর্ষে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর পৌনে ১২টায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে বসুন্ধরা গেট ও এ্যাপোলে হাসপাতালের গেটে উভয়স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সদস্যরা অবস্থান নেয়। আর এ্যাপোলো হাসপাতালের বামপাশের চৌরাস্তার মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ফেসবুকে লাইভ করতে দেখা যায়। তারা ফেসবুক লাইভে সেখানে তাদের সাহায্য করার জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে পুলিশ আবারও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। ওই সংঘর্ষ থেমে থেমে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে।
সংঘর্ষ চলাকালে আবাসিক এলাকার সড়কে যান ও জন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই বাসার মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সীমান্ত জানান, আমরা খণ্ড খণ্ড মিছিলসহকারে ক্যাম্পাস থেকে গ্রামীণ ফোনের কার্যালয়ের সামনে যাই। একপর্যায়ে সেখান থেকে বসুন্ধরা গেটের সামনে গেলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশও আমাদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
রনি নামে আরেক শিক্ষার্থী জানায়, বিনা উস্কানিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গুলশান জোনের পুলিশের এডিসি আব্দুল আহাদ মানবজমিনকে জানান, শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ উপস্থিত হয়। তারা যাতে মূল সড়কে আসতে না পারে এজন্য পুলিশ তাদের বাধা দেন। শিক্ষার্থীরা আগে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
শাহবাগে পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ: শাহবাগ এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছেন। বিকাল তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগ মোড়ের দিকে আসা মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে এ সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়নি। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের টিয়ারশেল, জলকামান উপেক্ষা করে স্লোগান দিতে দিতে শাহবাগ মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। তখন লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। লাঠিচার্জ ঠেকাতে শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়। লাঠিচার্জ আর টিয়ারশেল থেকে বাঁচার জন্য দৌড়াতে গিয়ে ১০/১২ শিক্ষার্থীও আহত হতে দেখা গেছে। লাঠিচার্জের সময় পুলিশ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। বিকাল সাড়ে তিনটায় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে শিক্ষার্থীদের টিএসসির দিকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শ’ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করতে চায়। এ সময় পুলিশি বাধায় তারা ফিরে যায়। পরে তারা টিএসসি, কার্জনহল, শহীদ মিনার, কলাভবন, পাবলিক লাইব্রেরিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে মিছিল করে। বিকাল তিনটার দিকে হঠাৎ করে আনুমানিক পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে শাহবাড় মোড়ের দিকে আসতে থাকে। এ সময় তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ‘ নিরাপদ সড়ক চাই’ ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা জালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ ‘নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ নানা স্লোগান দেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ থানা পার হয়ে জাদুঘরের ঠিক উল্টোপাশে আসার পর তাদেরকে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা তখন পুলিশের ব্যারিকেড ভেদ করে শাহবাগ চত্বরের দিকে এগুতে চায়। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছুড়তে শুরু করে। সংঘর্ষের পরে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থানের কারণে এই এলাকায় কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। শাহবাগে দেশের দুইটি বড় হাসপাতালসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। যানবাহন চলাচল করতে না পেরে অনেক রোগী ও সাধারণ মানুষের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শাহবাগ মোড়ে আর কাউকে অবস্থান করতে দেব না।
শাহবাগ থানা ফটকে স্বজনদের ভিড়: এক আত্মীয়কে রক্ত দানের উদ্দেশ্যে রামপুরা থেকে সিএনজিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন রাহাত ও লিমন। পথিমধ্যে শাহবাগ এলাকায় পৌঁছালে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। রাহাত বেসরকারি চাকরি করেন এবং আরাফাত রহমান লিমন যশোরের একটি কলেজে পড়েন। সোমবার সন্ধ্যায় রাহাত ও লিমনের পরিবারের সদস্যরা থানার ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, তাদের সন্তানেরা কোনো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না। পুলিশ জোর করে থানায় নিয়ে এসেছে। শাহবাগে আসার পরই তাদের গতি রোধ করে পুলিশ। তল্লাশির কথা বলে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় শাহবাগ থানায়। তাদের নামে মামলা দেয়া হচ্ছে। এদিকে রক্ত না পেয়ে এবং আত্মীয়ের আটকের খবর শুনে থানার গেটের সামনে এসেছে অসুস্থদের স্বজনরাও। রোববার দিনভর আন্দোলনকারী সন্দেহে এরকম অনেককেই আটক করে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানার সামনে অবস্থানরত স্বজনরা অভিযোগ করেন, তাদের পরিবারের তরুণ-কিশোরদের রাস্তা থেকে ধরে এনে মামলা দেয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলায় গ্রেপ্তার নেই: নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। গুরুতর আহত অনেক সাংবাদিক রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু সাংবাদিকদের ওপরে এসব হামলার ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, সাংবাদিকদের ওপরে হামলার বিষয়ে তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে তারা গ্রেপ্তার করবেন। আহত সাংবাদিক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সচিত্র খবর থেকে জানা যায়, গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, আফতাবনগর এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীরা দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। অনেক সাংবাদিকের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন নিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। অনেকের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন থেকে অনেক তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি আরো অনেককে বেধড়ক পেটানো হয়।
আওয়ামী লীগের মামলা: এদিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার ঘটানায় দুটি মামলা করা হয়েছে। দলের উপদপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় অজ্ঞাতনামা প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে গতকাল এ মামলা দুটি করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ। গত শনিবার একদল দুর্বৃত্ত আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়।
No comments