ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ কেন এই নির্মমতা by শুভ্র দেব
ট্রেনের
যাত্রীদের জন্য এক আতঙ্ক ‘পাথর নিক্ষেপ’। দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে নিহত
হচ্ছেন যাত্রীরা। আর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি অনেক যাত্রীর
অঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটেছে। পাথর নিক্ষেপে প্রতি বছর রেলওয়ের ক্ষতি হচ্ছে
কোটি কোটি টাকা। পাথরের আঘাতে দরজা-জানালার ভাঙা কাচসহ অন্যান্য সামগ্রী
মেরামত করতে রেলওয়ের বছরে পৌনে দুই কোটি টাকা খরচ হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বছরে অন্তত দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে সারা দেশে দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রেলওয়ের ১৪জন কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ২০টি জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলা রয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসাবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯টি। রেলওয়ের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাথর ছুড়ে ট্রেনের জানালা-দরজার কাচ ভাঙার ঘটনা ঘটেছে দুই হাজারের বেশি।
চলতি বছরের ৩০শে এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শক বায়োজিদ শিকদার। বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। এতে আহত হন বায়োজিদ শিকদার। পরে তাকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকায় এনে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর কিছুদিন পর তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪১দিন পর ১২ই জুন বায়োজিদ মারা যান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ২০১৭ সালের পহেলা অক্টোবর রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাত আরেক যুুবক। ওই দিন দুবৃত্তদের ছোড়া পাথরে ট্রেনের গ্লাস ভেঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর চোখের নিচে জখম হয় আর অজ্ঞাত যুবকের মাথায় লেগে রক্তাক্ত হয়। ২০১৬ সালের ২৭শে মার্চ ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। রাত ৭টার দিকে ট্রেনটি যখন ফেনি স্টেশন অতিক্রম করে যায় তখনই এই ঘটনা ঘটে। হঠাৎ করে বিকট শব্দে ট্রেনের গ্লাস ভেঙ্গে সরওয়ার জামান শাওন (২৭) নামের এক যাত্রীর ঘাড়ে আঘাত লাগে। এতে করে রক্তাক্ত হয় শাওন। ওই সময় ট্রেনে ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা ছিল না। তাই রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। শাওন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের কশুয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ সৈয়দের ছেলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে গুরুতর আহত হন ট্রেনের গার্ড আবদুল কাইয়ুম। মালবাহী খালি ট্রেন ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে যাচ্ছিল। ওই ট্রেনে গার্ডের দায়িত্ব পালন করছিলেন কাইয়ুম। ট্রেনটি রাত পৌনে ১১টার দিকে শমসেরনগর স্টেশন ও মনু স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে। একটি পাথরের টুকরা কাইয়ুমের কপালে লাগলে তিনি গুরুতর জখম হন। ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ প্রাণ হারান। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামের বাসায় ফিরছিলেন। ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণা নিশীথা ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলেন প্রীতি। সাড়ে ১১টার দিকে ট্রেনটি ভাটিয়ারীর ভাঙা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছানোর পর বাইরে থেকে জানালা বরাবর উপর্যুপরি পাথর ছোড়া হয়। এর একটি পাথর এসে প্রীতির মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হন তিনি। ঘটনার পর সীতাকুন্ড রেলস্টেশনে তাদের নামিয়ে দেয়া হয়। প্রথমে প্রীতিকে সীতাকুন্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চলতি বছরের ২রা এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেনে পাথরের আঘাত লেগে আহত হন বোয়ালখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী। পাথরের আঘাতে তার চোখের উপরের অংশ ফেটে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে ট্রেনটি চট্টগ্রাম পৌঁছালে তার চিকিৎসা করানো হয়। ওই দিন জহিরুল ইসলাম ট্রেনের ভেতরে জানালার পাশে বসায় বাহির থেকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে তার চোখে সরাসরি আঘাত লাগে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ জেলার ওপর দিয়ে চলার সময় ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলায়। পাথর ছোড়ার বেশি ঘটনা ঘটছে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থেকে সীতাকুন্ড অংশে। এ ছাড়া, নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেজগাঁও, কাওরানবাজার, ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতৈল কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর, ফৌজদারহাট, সীতাকুন্ড, চৌমুহনী, কুমিল্লার শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা এলাকায়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মানুষকে হত্যা ও আহত করার বিষয়টি আমানবিক। বছরের পর বছর থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কারণ প্রতিটা রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে অপরাধীরা ওঁৎ পেতে থাকে। স্টেশন থেকেই নানা অপরাধের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক ভেবে রেলপথকে অনেক অপরাধী নির্বিঘ্নে ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে রেলওয়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত রয়েছেন। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য নিরাপদে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ঢিল ছোড়া দুষ্কৃতকারীদের এমন দৌরাত্ম্যের পরও রেলওয়ের পক্ষ থেকে এই অপরাধ বন্ধে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই। একের পর এক দুর্বৃত্তদের ছোড়া ঢিলের আঘাতে ট্রেনের যাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আহত হওয়ার পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা পর্যন্ত হয় না। কিছু ক্ষেত্রে রেলওয়ে পুলিশ সাধারণ ডায়েরি করেই দায়িত্ব শেষ করে। বিশেষজ্ঞরা এই অপরাধ বন্ধে জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তি বাড়িয়ে বিদ্যমান আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি মো. শামসুদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, বেশ কিছু কারণে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় ভবঘুরে ও রেললাইনের আশপাশে মাদকাসক্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। স্টপেজ ছাড়া গাড়ি থামানোর জন্যও দুর্বৃত্তরা এই কাজ করে থাকে। এর বাইরে সরকারি মালামাল নষ্ট করার মনমানসিকতা ও মাদক বা চোরাচালান পণ্য কিছু চিহ্নিত স্থানে নামাতে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও এ ধরনের কোনো প্রমাণ হাতেনাতে এখনও পাওয়া যায়নি। ডিআইজি বলেন, আমাদের কিছু চিহ্নিত স্পট রয়েছে। এসব স্পটের আশপাশের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করা হয়। মসজিদ, স্কুলসহ অন্যান্য শিক্ষণীয় স্থানে এসব বিষয়ে বুঝানো হয়। আবার অনেক সময় যখন অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা যায় তখন মামলা জিডি করা হয়। আর ছোট শিশু হলে তাদের অভিভাবকের মুচলেকা নেয়া হয়। মামলার আসামিদের জেল-জরিমানা করা হয়।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, পাথর নিক্ষেপ একটি বড় ধরনের অপরাধ। এর কারণে মানুষ মারাও যাচ্ছে। তাই এই অপরাধ বন্ধে আমরা কাজ করছি। ঘটনাপ্রবণ এলাকায় মানুষকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। তিনি বলেন, পাথর নিক্ষেপের কারণে যে শুধু যাত্রীরা আহত-নিহত হচ্ছেন এমন না। সরকারি মালামালের ক্ষয়ক্ষতিসহ কর্মচারীরাও আহত নিহত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বছরে অন্তত দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে সারা দেশে দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রেলওয়ের ১৪জন কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ২০টি জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলা রয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসাবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯টি। রেলওয়ের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে পাথর ছুড়ে ট্রেনের জানালা-দরজার কাচ ভাঙার ঘটনা ঘটেছে দুই হাজারের বেশি।
চলতি বছরের ৩০শে এপ্রিল খুলনা-বেনাপোল রুটের বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিদর্শক বায়োজিদ শিকদার। বেনাপোল থেকে খুলনা যাওয়ার পথে দৌলতপুর স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। এতে আহত হন বায়োজিদ শিকদার। পরে তাকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকায় এনে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর কিছুদিন পর তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪১দিন পর ১২ই জুন বায়োজিদ মারা যান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ২০১৭ সালের পহেলা অক্টোবর রাজশাহী থেকে খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও অজ্ঞাত আরেক যুুবক। ওই দিন দুবৃত্তদের ছোড়া পাথরে ট্রেনের গ্লাস ভেঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর চোখের নিচে জখম হয় আর অজ্ঞাত যুবকের মাথায় লেগে রক্তাক্ত হয়। ২০১৬ সালের ২৭শে মার্চ ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তরা পাথর ছুড়ে মারে। রাত ৭টার দিকে ট্রেনটি যখন ফেনি স্টেশন অতিক্রম করে যায় তখনই এই ঘটনা ঘটে। হঠাৎ করে বিকট শব্দে ট্রেনের গ্লাস ভেঙ্গে সরওয়ার জামান শাওন (২৭) নামের এক যাত্রীর ঘাড়ে আঘাত লাগে। এতে করে রক্তাক্ত হয় শাওন। ওই সময় ট্রেনে ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা ছিল না। তাই রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। শাওন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের কশুয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ সৈয়দের ছেলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে গুরুতর আহত হন ট্রেনের গার্ড আবদুল কাইয়ুম। মালবাহী খালি ট্রেন ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে যাচ্ছিল। ওই ট্রেনে গার্ডের দায়িত্ব পালন করছিলেন কাইয়ুম। ট্রেনটি রাত পৌনে ১১টার দিকে শমসেরনগর স্টেশন ও মনু স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে। একটি পাথরের টুকরা কাইয়ুমের কপালে লাগলে তিনি গুরুতর জখম হন। ২০১৩ সালের ১০ই আগস্ট চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ প্রাণ হারান। তিনি তার স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামের বাসায় ফিরছিলেন। ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণা নিশীথা ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলেন প্রীতি। সাড়ে ১১টার দিকে ট্রেনটি ভাটিয়ারীর ভাঙা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছানোর পর বাইরে থেকে জানালা বরাবর উপর্যুপরি পাথর ছোড়া হয়। এর একটি পাথর এসে প্রীতির মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হন তিনি। ঘটনার পর সীতাকুন্ড রেলস্টেশনে তাদের নামিয়ে দেয়া হয়। প্রথমে প্রীতিকে সীতাকুন্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চলতি বছরের ২রা এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেনে পাথরের আঘাত লেগে আহত হন বোয়ালখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী। পাথরের আঘাতে তার চোখের উপরের অংশ ফেটে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে ট্রেনটি চট্টগ্রাম পৌঁছালে তার চিকিৎসা করানো হয়। ওই দিন জহিরুল ইসলাম ট্রেনের ভেতরে জানালার পাশে বসায় বাহির থেকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে তার চোখে সরাসরি আঘাত লাগে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ জেলার ওপর দিয়ে চলার সময় ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলায়। পাথর ছোড়ার বেশি ঘটনা ঘটছে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থেকে সীতাকুন্ড অংশে। এ ছাড়া, নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেজগাঁও, কাওরানবাজার, ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতৈল কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর, ফৌজদারহাট, সীতাকুন্ড, চৌমুহনী, কুমিল্লার শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা এলাকায়।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মানুষকে হত্যা ও আহত করার বিষয়টি আমানবিক। বছরের পর বছর থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কারণ প্রতিটা রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে অপরাধীরা ওঁৎ পেতে থাকে। স্টেশন থেকেই নানা অপরাধের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক ভেবে রেলপথকে অনেক অপরাধী নির্বিঘ্নে ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে রেলওয়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত রয়েছেন। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য নিরাপদে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ঢিল ছোড়া দুষ্কৃতকারীদের এমন দৌরাত্ম্যের পরও রেলওয়ের পক্ষ থেকে এই অপরাধ বন্ধে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই। একের পর এক দুর্বৃত্তদের ছোড়া ঢিলের আঘাতে ট্রেনের যাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আহত হওয়ার পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা পর্যন্ত হয় না। কিছু ক্ষেত্রে রেলওয়ে পুলিশ সাধারণ ডায়েরি করেই দায়িত্ব শেষ করে। বিশেষজ্ঞরা এই অপরাধ বন্ধে জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তি বাড়িয়ে বিদ্যমান আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি মো. শামসুদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, বেশ কিছু কারণে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় ভবঘুরে ও রেললাইনের আশপাশে মাদকাসক্তরা ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। স্টপেজ ছাড়া গাড়ি থামানোর জন্যও দুর্বৃত্তরা এই কাজ করে থাকে। এর বাইরে সরকারি মালামাল নষ্ট করার মনমানসিকতা ও মাদক বা চোরাচালান পণ্য কিছু চিহ্নিত স্থানে নামাতে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও এ ধরনের কোনো প্রমাণ হাতেনাতে এখনও পাওয়া যায়নি। ডিআইজি বলেন, আমাদের কিছু চিহ্নিত স্পট রয়েছে। এসব স্পটের আশপাশের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করা হয়। মসজিদ, স্কুলসহ অন্যান্য শিক্ষণীয় স্থানে এসব বিষয়ে বুঝানো হয়। আবার অনেক সময় যখন অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা যায় তখন মামলা জিডি করা হয়। আর ছোট শিশু হলে তাদের অভিভাবকের মুচলেকা নেয়া হয়। মামলার আসামিদের জেল-জরিমানা করা হয়।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, পাথর নিক্ষেপ একটি বড় ধরনের অপরাধ। এর কারণে মানুষ মারাও যাচ্ছে। তাই এই অপরাধ বন্ধে আমরা কাজ করছি। ঘটনাপ্রবণ এলাকায় মানুষকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। তিনি বলেন, পাথর নিক্ষেপের কারণে যে শুধু যাত্রীরা আহত-নিহত হচ্ছেন এমন না। সরকারি মালামালের ক্ষয়ক্ষতিসহ কর্মচারীরাও আহত নিহত হচ্ছেন।
No comments