মায়ের করজোড় হাত, পিতার কান্না by সাজেদুল হক
একটি
পা। ছবি। এক্সরে রিপোর্ট। হাতুড়ির পিটুনি। শিক্ষকের পা ধরে ছাত্রের বাঁচার
আকুতি। এক মায়ের করজোড় হাত। দরিদ্র, অসহায় পিতা-মাতার কান্না। অভিশাপ।
কারো সন্তান রিমান্ডে। কেউ হাসপাতালে। যদিও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা
তাদের জন্য নিষিদ্ধ।
বিশ্বাস হচ্ছে না! এটাই সমকালের চিত্র। আলাদা। তবে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি কাহিনীই এক। ওরা কোটা সংস্কার চেয়েছিল; যা আজ বিপন্ন করে তুলেছে ওদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ। গরিব, নিম্নবিত্ত। এরা অবশ্য বাংলাদেশে এমনিতে তেমন খবর হয় না। কখনো দুই বাসের মাঝখানে ওদের হাত আটকা পড়ে। পত্রিকায় বড় করে ছবি ছাপা হয়। রানা প্লাজার মেয়েটির কথা মনে আছে। মুখ দেখা যায়নি। শরীরের অন্য কোনো অংশও নয়। শুধু দেখা গেছে একটি পা। হয়তো যা উদ্ধত ছিল সভ্যতার দিকে।
গত কয়দিনে ফেসবুকের দেয়ালে আরেকটি পায়ের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। তরিকুল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন নেতার ভূমিকায়। এত বড় অন্যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মেনে নেননি। হাতুড়ি আর রড দিয়ে তার পা ভেঙে দিয়েছেন তারা। ছেলেটি প্রথমে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে অবশ্য বেশি দিন থাকার সুযোগ হয়নি। এখন অনেকটা গোপনে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দুই ভাই ও এক বোন লেখাপড়ে করে। বাবা কৃষক। তরিকুলের স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল দুঃস্বপ্নের দিন শেষ হবে। কিন্তু না, তা আর হলো কই! হাতুড়ি সন্ত্রাসের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষায় আকুতি জানিয়েছিলেন। তার ভাষায়- ওদেরকে বলেছিলাম আর যেন না মারে। কেউ কথা শুনলো না। কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে পেটাতে পারে কল্পনাও করিনি। একপর্যায়ে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তরিকুল প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কি নিদারুণ অনিশ্চয়তায়ই না পড়েছে একটি পরিবারের স্বপ্ন। ছেলেটি কি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এই রাষ্ট্র কী তা হতে দেবে। তরিকুলের মতোই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে পিটুনির শিকার হন কোটা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল হক নুরু। এক কৃষকের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরু হয়তো এমনিতেই একটি ভালো চাকরি পেতেন। এখন জীবন আর স্বপ্ন দুটোই হুমকির মুখে। নুরুর ভাবি বর্ণনা দিচ্ছিলেন, কী কষ্টেই না পরিবারটির জীবন কাটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে তার চিকিৎসা জোটেনি। পরে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতেও মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বিড়ম্বনার। বাবা জমি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে এসেছেন ছেলের চিকিৎসা করাতে। কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এই অসহায় পিতার মুখেই শোনা যায় এক অসাধারণ উচ্চারণ। হয়তো তিনি অভিশাপও দেন। নুরুর পিতা ইদরিস হাওলাদার বলেন, সচেতন নাগরিক হিসেবেই আমার ছেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পেটানো হয়েছে। আজকে আমার ছেলে, কালকে আপনার ছেলে, পরশু দিন তার ছেলে-এভাবেই দেশটা চলবে। আমরা মরে যাবো তারাই বেঁচে থাকবে।
রাশেদ খান। কোটা আন্দোলনের আরেক নেতা। পাঁচ দিন রিমান্ড শেষে এখন রয়েছেন ১০ দিনের রিমান্ডে। তার অসহায় পিতা-মাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঢাকায়। রাশেদের মা সালেহা বেগমের আর্তি রাষ্ট্রের দরবারে পৌঁছাবে কি-না কে জানে? তার আহাজারি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে- ‘আমার মণিকে তোমরা মাফ করে দাও। ভিক্ষা দাও। আমার মণিকে আমি ঢাকায় আর রাখব না গো। গ্রামে নিয়ে চলে যাব। শুধু মুক্তি দাও। সেও বাঁচুক। আমিও বাঁচি।’ এক মায়ের করজোড় হাত- এর চেয়ে অসহায় আর যন্ত্রণার ছবি আর হয় না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। বড় বড় সেতু, ইমারত হচ্ছে। মানুষের ভাগ্য বদলাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না চাকরি। কান পাতলেই শিক্ষিত তরুণদের হাহাকার শোনা যায়। অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা হয়তো কখনো শোনাও হয় না। দুর্নীতি আর ক্ষমতার প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে ইনসাফ বঞ্চনার শিকার হন মানুষ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন মূলত চাকরি আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতেই হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা তাদের কথা বলতে এসেছিল। তাদের সব কথাই হয়তো ন্যায্য নয়, সব কথাই হয়তো অন্যায্য নয়। কিন্তু দাবি জানাতে এসে এখন কী নিদারুণ যন্ত্রণারই না শিকার হচ্ছে তারা। তাদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই অন্ধকার। এ দুঃসহ সময় তাদের কোনো দিন শেষ হবে কি না কে জানে? কিন্তু রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো তাদের সন্তানদের প্রতি আরো সদয় হতে পারে। এতটা হয়তো এই তরুণদের পাওনা নয়।
বিশ্বাস হচ্ছে না! এটাই সমকালের চিত্র। আলাদা। তবে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি কাহিনীই এক। ওরা কোটা সংস্কার চেয়েছিল; যা আজ বিপন্ন করে তুলেছে ওদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ। গরিব, নিম্নবিত্ত। এরা অবশ্য বাংলাদেশে এমনিতে তেমন খবর হয় না। কখনো দুই বাসের মাঝখানে ওদের হাত আটকা পড়ে। পত্রিকায় বড় করে ছবি ছাপা হয়। রানা প্লাজার মেয়েটির কথা মনে আছে। মুখ দেখা যায়নি। শরীরের অন্য কোনো অংশও নয়। শুধু দেখা গেছে একটি পা। হয়তো যা উদ্ধত ছিল সভ্যতার দিকে।
গত কয়দিনে ফেসবুকের দেয়ালে আরেকটি পায়ের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। তরিকুল ইসলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ছিলেন নেতার ভূমিকায়। এত বড় অন্যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মেনে নেননি। হাতুড়ি আর রড দিয়ে তার পা ভেঙে দিয়েছেন তারা। ছেলেটি প্রথমে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে অবশ্য বেশি দিন থাকার সুযোগ হয়নি। এখন অনেকটা গোপনে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দুই ভাই ও এক বোন লেখাপড়ে করে। বাবা কৃষক। তরিকুলের স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল দুঃস্বপ্নের দিন শেষ হবে। কিন্তু না, তা আর হলো কই! হাতুড়ি সন্ত্রাসের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষায় আকুতি জানিয়েছিলেন। তার ভাষায়- ওদেরকে বলেছিলাম আর যেন না মারে। কেউ কথা শুনলো না। কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে পেটাতে পারে কল্পনাও করিনি। একপর্যায়ে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তরিকুল প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কি নিদারুণ অনিশ্চয়তায়ই না পড়েছে একটি পরিবারের স্বপ্ন। ছেলেটি কি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এই রাষ্ট্র কী তা হতে দেবে। তরিকুলের মতোই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে পিটুনির শিকার হন কোটা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল হক নুরু। এক কৃষকের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরু হয়তো এমনিতেই একটি ভালো চাকরি পেতেন। এখন জীবন আর স্বপ্ন দুটোই হুমকির মুখে। নুরুর ভাবি বর্ণনা দিচ্ছিলেন, কী কষ্টেই না পরিবারটির জীবন কাটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে তার চিকিৎসা জোটেনি। পরে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতেও মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বিড়ম্বনার। বাবা জমি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে এসেছেন ছেলের চিকিৎসা করাতে। কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এই অসহায় পিতার মুখেই শোনা যায় এক অসাধারণ উচ্চারণ। হয়তো তিনি অভিশাপও দেন। নুরুর পিতা ইদরিস হাওলাদার বলেন, সচেতন নাগরিক হিসেবেই আমার ছেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পেটানো হয়েছে। আজকে আমার ছেলে, কালকে আপনার ছেলে, পরশু দিন তার ছেলে-এভাবেই দেশটা চলবে। আমরা মরে যাবো তারাই বেঁচে থাকবে।
রাশেদ খান। কোটা আন্দোলনের আরেক নেতা। পাঁচ দিন রিমান্ড শেষে এখন রয়েছেন ১০ দিনের রিমান্ডে। তার অসহায় পিতা-মাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঢাকায়। রাশেদের মা সালেহা বেগমের আর্তি রাষ্ট্রের দরবারে পৌঁছাবে কি-না কে জানে? তার আহাজারি এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে- ‘আমার মণিকে তোমরা মাফ করে দাও। ভিক্ষা দাও। আমার মণিকে আমি ঢাকায় আর রাখব না গো। গ্রামে নিয়ে চলে যাব। শুধু মুক্তি দাও। সেও বাঁচুক। আমিও বাঁচি।’ এক মায়ের করজোড় হাত- এর চেয়ে অসহায় আর যন্ত্রণার ছবি আর হয় না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। বড় বড় সেতু, ইমারত হচ্ছে। মানুষের ভাগ্য বদলাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না চাকরি। কান পাতলেই শিক্ষিত তরুণদের হাহাকার শোনা যায়। অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা হয়তো কখনো শোনাও হয় না। দুর্নীতি আর ক্ষমতার প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে ইনসাফ বঞ্চনার শিকার হন মানুষ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন মূলত চাকরি আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতেই হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা তাদের কথা বলতে এসেছিল। তাদের সব কথাই হয়তো ন্যায্য নয়, সব কথাই হয়তো অন্যায্য নয়। কিন্তু দাবি জানাতে এসে এখন কী নিদারুণ যন্ত্রণারই না শিকার হচ্ছে তারা। তাদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই অন্ধকার। এ দুঃসহ সময় তাদের কোনো দিন শেষ হবে কি না কে জানে? কিন্তু রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো তাদের সন্তানদের প্রতি আরো সদয় হতে পারে। এতটা হয়তো এই তরুণদের পাওনা নয়।
No comments