প্রহরী এসে জানান, মাহাথির একটি অনুরোধ করেছেন
রাজনীতিতে
যা যা দেখার আছে আনোয়ার ইব্রাহিম তার সবই দেখেছেন। কারাগার দেখেছেন,
প্রতারণা দেখেছেন, আদালত দেখেছেন, সবচেয়ে উঁচু কার্যালয় দেখেছেন, আবার
নির্বাসনও দেখেছেন। আর গত সপ্তাহে সমকামিতার দায়ে দণ্ডিত এই রাজনীতিবিদ
কারাগার বিজয়ীর বেশে থেকে ছাড়া পেয়ে একেবারে নতুন আলোতে স্বাধীনতার মুখও
দেখেছেন। আনোয়ার বলেন, আমি সবসময় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও উদারমনা
ধ্যান-ধারণা সমপর্কে কথা বলেছি। কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা অর্জন করা সমপূর্ণ
ভিন্ন এক বিষয়। এতে করে আপনি আপনার আদর্শগুলোকে আরো মূল্যায়ন করতে শিখবেন।
তিনি বলেন, আপনার কাছ থেকে যখন স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হবে, তখন সেটা হবে
নির্যাতন। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের
রোববারের সংস্করণ অবজারভারে আনোয়ার ইব্রাহিমের এক বিশেষ সাক্ষাৎকার
প্রকাশিত হয়েছে। তাতে এসব কথা বলেছেন দেশটির সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী।
বহুদিন ধরে মালয়েশিয়ায় সংস্কার ও আশার মুখ হয়ে আছেন ইব্রাহিম। বর্তমানে নতুন অর্জিত স্বাধীনতা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছেন তিনি। রাজার কাছ থেকে রাজ ক্ষমাতো পেয়েছেনই, তার সঙ্গে এই প্রথমবারের মতন তার সংস্কারবাদী চিন্তাধারাকে সমর্থন জানিয়েছে মালয়েশিয়ার জনগণ। স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথমবারের মত দেশটিতে ক্ষমতায় এসেছে বিরোধীদলীয় সরকার।
বিষয়টি আরো অসাধারণ করে তুলেছে ৯২ বছর বয়সী ঝানু রাজনীতিবিদ, মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মাহাথির মোহাম্মদের আগমন। ইব্রাহিমের বদলে তার দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহাথির। অথচ এককালে এই মাহাথিরই ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রথমবার নিজ দল বারিসান ন্যাসিওনাল নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে লড়েছেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল নিজের শিষ্য নাজিব রাজাককে পরাজিত করা। সফলও হয়েছেন মাহাথির। গড়েছেন ইতিহাস। প্রয়োজনের খাতিরে শত্রুকে বন্ধু বানিয়েছেন। সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছেন ইব্রাহিমও।
১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহাথির। তখন বারিসান ন্যাসিওনাল জোটের অংশ ইউএমএনও দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচনে লড়েন তিনি। আনোয়ার তখন তার প্রিয় শিষ্য। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু আনোয়ার যেই একবার সাহস করে মাহাথিরের বিরোধিতা করলেন, তৎক্ষণাৎ তাকে বরখাস্ত করা হলো। কারাগারে পাঠানো হলো সমকামিতার অভিযোগ এনে। ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন আনোয়ার। তবে ছয় বছর পরে ২০০৪ সালে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। এই ছয় বছর তার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হয়নি তাকে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নতুন দল গঠন করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। নাম দেন পাকাতন হারাপান (পিকেআর)। পুনরায় যখন রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেলেন তখন ক্ষমতায় নাজিব রাজাক। ২০১৩ সালের নির্বাচনে নাজিবের কাছে হারলেন। কিন্তু জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা আরো বাড়লো। নাজিব আতঙ্কিত হয়ে তাকে আবার সমকামিতার অভিযোগ এনে কারাগারে পাঠালেন। আনোয়ারের ভাষ্যমতে, আমি তাকে কখনোই সমর্থন করিনি। তার বিরুদ্ধে আমার শক্ত অবস্থান ছিল। তৎকালীন সময়ে সে এই বিষয়টি বেশ ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিল। একারণেই সে আমায় শেষ করে দিতে চেয়েছিল।
দ্বিতীয়বার কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আনোয়ার বলেন, এটা জেনে কারাগারে থাকা সহজ ছিল না যে, ২০১৩ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে আমরা জিততাম আর আমি কারাগারে থাকতাম না। দেশের রাজনৈতিক সিস্টেমের ওপর ক্ষোভ জন্মায়নি? এমন প্রশ্নের সোজা জবাব দিয়ে আনোয়ার বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর পর, এত বছর পার হওয়ার পর, আপনার ভেতরে আসলে সেই তিক্ততাটা থাকে না। আমি কোনো মহান মানবহিতৈষী, দরদি মানুষ হওয়ার ভান করছি না। কিন্তু সত্যিই আমার মধ্যে আর সেই তিক্ততা নেই। সবশেষে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন আর খুলতে থাকা নাটক মেনে নেবেন।
এইবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বিস্ময়কর উপাদান ছিল মাহাথির-আনোয়ার জোট। আর এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হতবাক হয়েছিলেন আনোয়ার নিজে। কেননা, যতকিছুই ঘটুক, এইবার মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে উত্থান-পতনের ঘটনা যতটা না রাজনৈতিক ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিগত আর প্রতিশোধমূলক।
১৯৯৮ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর আনোয়ারকে তার সরকারি বাসভবন ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। আনোয়ারের তখন ছোট একটি পরিবার। ছোট ছোট সন্তান। সন্তানদের জন্য মাহাথিরের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়েছিলেন আনোয়ার। জবাবে আনোয়ারের বাসভবনের পানির ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছিলেন মাহাথির। সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আনোয়ার আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে মাহাথিরকে এমনভাবে বর্ণনা করেছিলেন: মাহাথির একজন ভীতু, যিনি নিজের অপকর্মের দায়ভার নিতে রাজি নন। তার ক্ষমতার লালসা অনিবারণীয়। প্রতিক্রিয়ায় কারাগারে আনোয়ারকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেননি মাহাথির। এমনকি ২০০৪ সালে আনোয়ার ছাড়া পাওয়ার পরও মাহাথির তার প্রতিশোধ অব্যাহত রাখেন। ২০০৫ সালে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, একজন সমকামী প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা চিন্তা করুন। কেউ নিরাপদ থাকবে না। প্রতিক্রিয়ায় মাহাথিরের বিরুদ্ধে অপবাদের অভিযোগে মামলা করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান আনোয়ার।
এই বছরের জানুয়ারিতে আনোয়ারের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে যান মাহাথির। পুনর্মিলনের ও সহযোগিতার প্রস্তাব রাখেন মাহাথির। আনোয়ার জানান, মাহাথিরের আগমন নিয়ে বেশ সন্দেহপ্রবণ ছিলেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে মাহাথিরকে তিনি বলেন, কি কারণে আমি আপনার সঙ্গে হাত মেলাতে যাবো? আমি আপনাকে ক্ষমা করে দেবো। বিদায়। ব্যাস এটুকুই। আনোয়ার বলেন, কিন্তু তার সঙ্গে আলোচনার পরও আমি লোকটাকে যেভাবে চিনি- আত্মবিশ্বাসে ভরা, কিছুটা অসংযত একজন মানুষ- হঠাৎ করে আমায়, তার চিরশত্রুকে কারাগারে দেখতে আসার মানে হচ্ছে হয়তো তিনি মরিয়া বা আসলেই তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আর ঠিক তাই ঘটেছে।
আনোয়ার সম্মতি দিলেও তার সন্তানরা মাহাথিরকে মেনে নিতে চায়নি। তিনি বলেন, আমার সন্তানেরা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়নি। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তারা বুঝতে পারছিলো না, কেন আমি এই মানুষটার সঙ্গে দেখা করেছি যে আমাদের জীবনগুলো নরক বানিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, আনোয়ারের মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ বর্তমানে নিজ যোগ্যতায় বিরোধী দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
আনোয়ার বলেন, তারা আমার সঙ্গে সম্মত হতে চায়নি। আমায় বলেছিল, আমার মাহাথিরের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়া উচিত নয়। বলেছিল, আপনি নির্যাতিত হয়েছেন, আমরা সবাই নির্যাতিত হয়েছি, তার কারণে। কিন্তু আমি তাদের বললাম, যখন তোমার পুরনো কথিত শত্রু এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, চলো অতীত ভুলে বন্ধু হয়ে যাই, তখন তুমি কিইবা করতে পারো? এমন প্রস্তাবে না বলা কঠিন।
যাই হোক, মাহাথির তার কর্মের জন্য আনোয়ারের কাছে সঠিকভাবে ক্ষমা চাইতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন, আনোয়ারকে বরখাস্ত করা তার ঠিক হয়নি। আনোয়ারের ভাষ্যমতে, মাহাথিরের কাছ থেকে এটুকুই যথেষ্ট।
কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায়ই বাইরের পরিস্থিতি টের পাচ্ছিলেন আনোয়ার। একসময়কার শত্রুতাপরায়ণ প্রহরীরা আচানক ভালো ব্যবহার করা শুরু করলো। বাইরে যে বিরোধী দলের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা নিশ্চিত বুঝেছিলেন তিনি। এমনকি নির্বাচনের দিন প্রহরীরা চুপিচুপি এসে এটাও বললো যে, তারা আনোয়ারের দলকে ভোট দিয়েছেন। তবে সবশেষে আরো একটি চমক বাকি ছিল আনোয়ারের জন্য। নির্বাচনের রাতে এক প্রহরী এসে তাকে একটি ফোন ধরিয়ে দেয়। প্রহরী জানায়, প্রধানমন্ত্রী (মাহাথির) তাকে একটি অনুরোধ করেছেন। নাজিব এটা মানতে চাননি যে, তিনি নির্বাচনে হেরে গেছেন। আনোয়ার কি তাকে বোঝাবে যাতে তিনি পরাজয় মেনে নেন?
নাজিবের সঙ্গে তিক্ত ইতিহাস সত্ত্বেও আনোয়ার কথা বলতে রাজি হন। আনোয়ার জানান, নাজিবের সঙ্গে ফোনালাপের সময় তিনি যা পেয়েছিলেন তা হচ্ছে, অপরপ্রান্তে একজন প্রচণ্ড ভীতু মানুষ কথা বলছেন। নাজিব প্রত্যাখ্যানের ভারে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। আনোয়ার জানান, দ্বিতীয় ফোনকলের পরও নাজিব পরাজয় মেনে নিতে চাননি। তিনি বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
পরিহাস হচ্ছে একদিকে আনোয়ার যখন জেল থেকে ছাড়া পেলেন, নাজিব তখন জেলে যাওয়ার পথে আছেন। কারাগার নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোনো উপদেশ দিবেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার মুচকি হেসে বলেন: ভালো আইনজীবী রাখা আর অনুশোচনা প্রকাশ করা দরকার।
বহুদিন ধরে মালয়েশিয়ায় সংস্কার ও আশার মুখ হয়ে আছেন ইব্রাহিম। বর্তমানে নতুন অর্জিত স্বাধীনতা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছেন তিনি। রাজার কাছ থেকে রাজ ক্ষমাতো পেয়েছেনই, তার সঙ্গে এই প্রথমবারের মতন তার সংস্কারবাদী চিন্তাধারাকে সমর্থন জানিয়েছে মালয়েশিয়ার জনগণ। স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথমবারের মত দেশটিতে ক্ষমতায় এসেছে বিরোধীদলীয় সরকার।
বিষয়টি আরো অসাধারণ করে তুলেছে ৯২ বছর বয়সী ঝানু রাজনীতিবিদ, মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মাহাথির মোহাম্মদের আগমন। ইব্রাহিমের বদলে তার দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাহাথির। অথচ এককালে এই মাহাথিরই ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রথমবার নিজ দল বারিসান ন্যাসিওনাল নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে লড়েছেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল নিজের শিষ্য নাজিব রাজাককে পরাজিত করা। সফলও হয়েছেন মাহাথির। গড়েছেন ইতিহাস। প্রয়োজনের খাতিরে শত্রুকে বন্ধু বানিয়েছেন। সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছেন ইব্রাহিমও।
১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহাথির। তখন বারিসান ন্যাসিওনাল জোটের অংশ ইউএমএনও দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচনে লড়েন তিনি। আনোয়ার তখন তার প্রিয় শিষ্য। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু আনোয়ার যেই একবার সাহস করে মাহাথিরের বিরোধিতা করলেন, তৎক্ষণাৎ তাকে বরখাস্ত করা হলো। কারাগারে পাঠানো হলো সমকামিতার অভিযোগ এনে। ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন আনোয়ার। তবে ছয় বছর পরে ২০০৪ সালে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। এই ছয় বছর তার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হয়নি তাকে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নতুন দল গঠন করেন আনোয়ার ইব্রাহিম। নাম দেন পাকাতন হারাপান (পিকেআর)। পুনরায় যখন রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পেলেন তখন ক্ষমতায় নাজিব রাজাক। ২০১৩ সালের নির্বাচনে নাজিবের কাছে হারলেন। কিন্তু জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা আরো বাড়লো। নাজিব আতঙ্কিত হয়ে তাকে আবার সমকামিতার অভিযোগ এনে কারাগারে পাঠালেন। আনোয়ারের ভাষ্যমতে, আমি তাকে কখনোই সমর্থন করিনি। তার বিরুদ্ধে আমার শক্ত অবস্থান ছিল। তৎকালীন সময়ে সে এই বিষয়টি বেশ ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিল। একারণেই সে আমায় শেষ করে দিতে চেয়েছিল।
দ্বিতীয়বার কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আনোয়ার বলেন, এটা জেনে কারাগারে থাকা সহজ ছিল না যে, ২০১৩ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে আমরা জিততাম আর আমি কারাগারে থাকতাম না। দেশের রাজনৈতিক সিস্টেমের ওপর ক্ষোভ জন্মায়নি? এমন প্রশ্নের সোজা জবাব দিয়ে আনোয়ার বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর পর, এত বছর পার হওয়ার পর, আপনার ভেতরে আসলে সেই তিক্ততাটা থাকে না। আমি কোনো মহান মানবহিতৈষী, দরদি মানুষ হওয়ার ভান করছি না। কিন্তু সত্যিই আমার মধ্যে আর সেই তিক্ততা নেই। সবশেষে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন আর খুলতে থাকা নাটক মেনে নেবেন।
এইবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বিস্ময়কর উপাদান ছিল মাহাথির-আনোয়ার জোট। আর এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হতবাক হয়েছিলেন আনোয়ার নিজে। কেননা, যতকিছুই ঘটুক, এইবার মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে উত্থান-পতনের ঘটনা যতটা না রাজনৈতিক ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিগত আর প্রতিশোধমূলক।
১৯৯৮ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর আনোয়ারকে তার সরকারি বাসভবন ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। আনোয়ারের তখন ছোট একটি পরিবার। ছোট ছোট সন্তান। সন্তানদের জন্য মাহাথিরের কাছে কয়েকদিন সময় চেয়েছিলেন আনোয়ার। জবাবে আনোয়ারের বাসভবনের পানির ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিয়েছিলেন মাহাথির। সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আনোয়ার আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে মাহাথিরকে এমনভাবে বর্ণনা করেছিলেন: মাহাথির একজন ভীতু, যিনি নিজের অপকর্মের দায়ভার নিতে রাজি নন। তার ক্ষমতার লালসা অনিবারণীয়। প্রতিক্রিয়ায় কারাগারে আনোয়ারকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেননি মাহাথির। এমনকি ২০০৪ সালে আনোয়ার ছাড়া পাওয়ার পরও মাহাথির তার প্রতিশোধ অব্যাহত রাখেন। ২০০৫ সালে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, একজন সমকামী প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা চিন্তা করুন। কেউ নিরাপদ থাকবে না। প্রতিক্রিয়ায় মাহাথিরের বিরুদ্ধে অপবাদের অভিযোগে মামলা করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান আনোয়ার।
এই বছরের জানুয়ারিতে আনোয়ারের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে যান মাহাথির। পুনর্মিলনের ও সহযোগিতার প্রস্তাব রাখেন মাহাথির। আনোয়ার জানান, মাহাথিরের আগমন নিয়ে বেশ সন্দেহপ্রবণ ছিলেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে মাহাথিরকে তিনি বলেন, কি কারণে আমি আপনার সঙ্গে হাত মেলাতে যাবো? আমি আপনাকে ক্ষমা করে দেবো। বিদায়। ব্যাস এটুকুই। আনোয়ার বলেন, কিন্তু তার সঙ্গে আলোচনার পরও আমি লোকটাকে যেভাবে চিনি- আত্মবিশ্বাসে ভরা, কিছুটা অসংযত একজন মানুষ- হঠাৎ করে আমায়, তার চিরশত্রুকে কারাগারে দেখতে আসার মানে হচ্ছে হয়তো তিনি মরিয়া বা আসলেই তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আর ঠিক তাই ঘটেছে।
আনোয়ার সম্মতি দিলেও তার সন্তানরা মাহাথিরকে মেনে নিতে চায়নি। তিনি বলেন, আমার সন্তানেরা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়নি। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তারা বুঝতে পারছিলো না, কেন আমি এই মানুষটার সঙ্গে দেখা করেছি যে আমাদের জীবনগুলো নরক বানিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, আনোয়ারের মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ বর্তমানে নিজ যোগ্যতায় বিরোধী দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
আনোয়ার বলেন, তারা আমার সঙ্গে সম্মত হতে চায়নি। আমায় বলেছিল, আমার মাহাথিরের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়া উচিত নয়। বলেছিল, আপনি নির্যাতিত হয়েছেন, আমরা সবাই নির্যাতিত হয়েছি, তার কারণে। কিন্তু আমি তাদের বললাম, যখন তোমার পুরনো কথিত শত্রু এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, চলো অতীত ভুলে বন্ধু হয়ে যাই, তখন তুমি কিইবা করতে পারো? এমন প্রস্তাবে না বলা কঠিন।
যাই হোক, মাহাথির তার কর্মের জন্য আনোয়ারের কাছে সঠিকভাবে ক্ষমা চাইতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন, আনোয়ারকে বরখাস্ত করা তার ঠিক হয়নি। আনোয়ারের ভাষ্যমতে, মাহাথিরের কাছ থেকে এটুকুই যথেষ্ট।
কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায়ই বাইরের পরিস্থিতি টের পাচ্ছিলেন আনোয়ার। একসময়কার শত্রুতাপরায়ণ প্রহরীরা আচানক ভালো ব্যবহার করা শুরু করলো। বাইরে যে বিরোধী দলের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা নিশ্চিত বুঝেছিলেন তিনি। এমনকি নির্বাচনের দিন প্রহরীরা চুপিচুপি এসে এটাও বললো যে, তারা আনোয়ারের দলকে ভোট দিয়েছেন। তবে সবশেষে আরো একটি চমক বাকি ছিল আনোয়ারের জন্য। নির্বাচনের রাতে এক প্রহরী এসে তাকে একটি ফোন ধরিয়ে দেয়। প্রহরী জানায়, প্রধানমন্ত্রী (মাহাথির) তাকে একটি অনুরোধ করেছেন। নাজিব এটা মানতে চাননি যে, তিনি নির্বাচনে হেরে গেছেন। আনোয়ার কি তাকে বোঝাবে যাতে তিনি পরাজয় মেনে নেন?
নাজিবের সঙ্গে তিক্ত ইতিহাস সত্ত্বেও আনোয়ার কথা বলতে রাজি হন। আনোয়ার জানান, নাজিবের সঙ্গে ফোনালাপের সময় তিনি যা পেয়েছিলেন তা হচ্ছে, অপরপ্রান্তে একজন প্রচণ্ড ভীতু মানুষ কথা বলছেন। নাজিব প্রত্যাখ্যানের ভারে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। আনোয়ার জানান, দ্বিতীয় ফোনকলের পরও নাজিব পরাজয় মেনে নিতে চাননি। তিনি বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
পরিহাস হচ্ছে একদিকে আনোয়ার যখন জেল থেকে ছাড়া পেলেন, নাজিব তখন জেলে যাওয়ার পথে আছেন। কারাগার নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোনো উপদেশ দিবেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার মুচকি হেসে বলেন: ভালো আইনজীবী রাখা আর অনুশোচনা প্রকাশ করা দরকার।
No comments