আশরাফের যাওয়া, কাদেরের আসা
সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল এসেছে। সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বিদায় নিয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হলেন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনীতিক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। অন্যদিকে যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে মাঠঘাটে ছুটে বেড়ানো নেতা ওবায়দুল কাদের পেলেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব।
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক পদটিতে কে আসছেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও বিভিন্ন মহলের আগ্রহ ছিল। এরই মধ্যে ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন—এ খবর সংবাদমাধ্যমে বের হয়। এরপর কয়েক দিন ধরেই সৈয়দ আশরাফ ও ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনের টক শোতে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের একটি অংশ চেয়েছে নেতৃত্বে পরিবর্তন, আরেকটি অংশ চেয়েছে সৈয়দ আশরাফ যেন বহাল থাকেন। তবে প্রধানমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেই চেয়েছেন, যা গণমাধ্যমে কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। দলের নেতারা মনে করেন, নানা হিসাব-নিকাশ করেই ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একজন প্রবীণ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতাকে আরেকটু সুন্দরভাবে বিদায় দেওয়া যেত। নেতাদের মুখে, গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে বিষয়টি আগেভাগে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাতে আশরাফ কিছুটা বিব্রত হয়েছেন। তবে এ বিষয়টিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। দলের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলনস্থলে বিষয়টি নিয়ে যাতে নতুন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আগে থেকে বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে খোদ সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় থাকা ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেরিয়ে আসাটা উচিত হয়নি বলে মত দেন এই নেতা। ১৪ দলের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে যে কমিটি হয়েছে, তা দলটিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। সৈয়দ আশরাফ দীর্ঘ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গেলেন। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের ভালো সংগঠক, তৃণমূলে যোগাযোগ আছে। ছাত্ররাজনীতি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি দলকে এগিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা রাখি।’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী এবং নতুন সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক জীবনে বেশ কিছু ভালোমন্দ দিক রয়েছে।
এক-এগারোর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই জাতীয় সম্মেলন করে। ওই সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন। এর আগে তিনি এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলের সংকটময় সময়ে বিশ্বস্ততা ও নেতৃত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বলে জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করেন। এরপর টানা সাত বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বজায় রাখার অভিযোগ থাকলেও তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। গত শনিবার আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে আশরাফের আবেগঘন বক্তৃতা নেতা-কর্মীদের মন ছুঁয়ে যায়। মাঠের রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফের তেমন ভূমিকা নেই। তবে এক-এগারোর সময় জিল্লুর রহমানের পাশে সৈয়দ আশরাফের ভূমিকা অনেক বিপর্যয় থেকে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করে। ২০১২ সালের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফের পাশে উঠে আসে ওবায়দুল কাদেরের নাম। তবে আশরাফই টানা দ্বিতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হন। এ ছাড়া রাজনীতির সংকটময় বিভিন্ন মুহূর্তে ভূমিকা রাখেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র সৈয়দ আশরাফ। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়া হেফাজতে ইসলামের উদ্দেশে ঘোষণা দেন, ‘এই হেফাজতিদের কোনোভাবেই ওখানে থাকতে দেওয়া হবে না।’ ৬ মে ভোররাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপারেশন চালিয়ে হেফাজতে ইসলামকে উৎখাত করে। যদিও মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে দুই আনার মন্ত্রী বলে উপহাস করে সমালোচনার মুখে পড়েন।
এ ছাড়া সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকেও সৈয়দ আশরাফ ‘কাজের বুয়া মর্জিনা’ বলে উপহাস করেন। আবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে এবং এবারের সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের অতিথিদের আনার বিষয়ে তাঁরও ভূমিকা ছিল বলে আলোচনা আছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদের ভূমিকা নিয়ে গত আগস্টে দেওয়া সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। তিনি বলেছিলেন, জাসদ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরিবেশ তৈরি না করলে দেশ অনেক আগেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো। জাসদ থেকে মন্ত্রী করায় আওয়ামী লীগকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বলেও মত দেন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে আয়কর বিবরণী প্রকাশ করেন। গত বছরের ৯ জুলাই স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর পদ থেকে বাদ পড়েন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যতম সমালোচনা হচ্ছে, তাঁকে দলের কাজকর্মে সচরাচর পাওয়া যায় না। দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেও অনেক সময় তিনি সাক্ষাৎ দেন না। মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত যান না। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ আশরাফ সজ্জন, মিষ্টভাষী ও সৃজনশীল মানুষ। নির্লোভ ও নিরহংকার এই নেতা মানুষ হিসেবে তুলনাহীন। তাঁকে নেতা-কর্মীরা মিস করবেন। তারপরও প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা দলকে গতিশীল করতে ও এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। আর নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রসঙ্গে হানিফ বলেন, ‘উনি কর্মীবান্ধব নেতা। তৃণমূলে গ্রহণযোগ্যতা আছে। ওনার সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন করতে গিয়ে তৃণমূলে তাঁর যোগাযোগ যে অনেক নেতার তুলনায় অনেক বেশি, তা জানতে পেরেছি।’ এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ‘গুডবুকে’ স্থান পান। তিনি মাঠেঘাটে ছুটে বেড়ান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওবায়দুল কাদের কলেজজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনি কারাবরণ করেন। কারাগারে থাকতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ওবায়দুল কাদের দৈনিক বাংলার বাণীর সহকারী সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘ সময়। ১৯৯৬ সালে নোয়াখালী-৫ আসন থেকে ওবায়দুল কাদের সাংসদ নির্বাচিত হন। তখন যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০৭ সালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর জেলে ছিলেন। ওই সময় গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তাঁর দেওয়া কথিত জবানবন্দিকে কেন্দ্র করে তিনি দলে কিছুটা বিতর্কিত হন। এরপর ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো যোগাযোগমন্ত্রী হন তিনি। জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো পরিবর্তনে দলের মধ্যে গতির সঞ্চার হয়। সাধারণ সম্পাদকসহ নেতৃত্বের এই পরিবর্তন দলকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, সাবেক ও বর্তমান—দুই সাধারণ সম্পাদকই যোগ্য ও দক্ষ। সৈয়দ আশরাফ ক্লিন ইমেজ নিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর করলেন। ওবায়দুল কাদের আগামী দিনগুলোতে তাঁর দক্ষতার পরিচয় রাখবেন, এটা খুবই প্রত্যাশিত।
No comments