মানসিক স্বাস্থ্য এখনো অবহেলিত
গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘মনোরোগ: বাস্তবতা ও চিকিৎসা সহায়তা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় আলোচকেরা। ছবি: প্রথম আলো |
জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৬ শতাংশ এবং ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের ১৮ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। তবে দেশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র ২২০ জন। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অন্য জনবলও অপ্রতুল। গতকাল রোববার প্রথম আলো আয়োজিত ‘মনোরোগ: বাস্তবতা ও চিকিৎসা সহায়তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা সরকারের এ জরিপের তথ্য ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি এখন পর্যন্ত অবহেলিত।
তাঁরা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের নজর বাড়ানোর তাগিদ দেন। তাঁরা দক্ষ জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণ, সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে তোলা, প্রতিটি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ ইউনিট ও শয্যার ব্যবস্থা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহায়তায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা আলোচক হিসেবে অংশ নেন। তাঁরা বলেন, আত্মমর্যাদাবোধ, অন্যের প্রতি আস্থাবান, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি, গভীর অনুভূতি, অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়ার শক্তিসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো মানসিক স্বাস্থ্যের বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর অনুপস্থিতি মানসিক সমস্যা তৈরি করে। এর ফলে জঙ্গিবাদের বিস্তারসহ নানা ঘটনা ঘটছে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আলোচকেরা বলেন, সমাজে মানসিক রোগী ও তার পরিবারের কোনো মর্যাদা নেই। মানসিক রোগের কারণে জনগণের কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছে, ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। দরিদ্র জনগণ মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আলোচনায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সভাপতি অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী বলেন,
গুরুত্বের তালিকায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেক পরে এসেছে। তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশেও এই স্বাস্থ্যের মর্যাদা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। বর্তমানে মানসিক রোগের চিকিৎসায় যে জনবল আছে, তা অত্যন্ত অপ্রতুল। মানসিক সব রোগ বংশপরম্পরায় হয় না। আবার যেসব রোগ বংশপরম্পরায় হয়, তারও প্রতিকার আছে। যেকোনো মানসিক সংকটে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য-সহায়তা একটি জরুরি সেবা। দেশে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন কোনো-না-কোনো সময়ে মানসিক সংকটকাল অতিক্রম করছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, অজ্ঞতা, মানসিক রোগীর প্রতি বৈষম্য, স্টিগমাসহ বিভিন্ন কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বে আনা হয় না। বাস্তবতাকে স্বীকার করে সাধারণ জনগণকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা বাড়ানো, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রোগীদের প্রবেশগম্যতা বাড়ানো, রোগী সুস্থ হলে তাদের মূলধারার কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা, সর্বোপরি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সুপারিশ করেন তিনি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. আব্দুল হালিম বলেন, সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবলের সংখ্যা বাড়েনি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে জনবলের অভাবে রোগীর সঙ্গে পরিবারের একজনকে থাকতে হচ্ছে। ভালো খবর হলো, ১৯৯টি পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তা প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, উচ্চশিক্ষিত ও ধনী পরিবারের কোনো সদস্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে তা গোপন রাখা হয়। রোগীকে সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে নেওয়া হয় না।
এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. আহসানুল হাবীব ২০০৭ সালে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন। তিনি বলেন, পাবনা মানসিক হাসপাতালে ২০ থেকে ২২ বছর পুরোনো রোগীরাও ছিলেন। কেননা, পরিবার তাঁদের নিতে চায় না। হাসপাতালে রোগীরা কম থাকবে, তারা ফিরে যাবে নিজের কমিউনিটিতে। উন্নত বিশ্বের মতো দেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, একসময় সব উপজেলায় স্বাস্থ্যসহকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বর্তমানে এ কর্মসূচি বন্ধ। এটি আবার চালু করা জরুরি। বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিম বলেন, ব্যথার ওষুধ খেলে ব্যথা ভালো হয়, সবাই তা বুঝতে পারে। কিন্তু মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বুঝতে বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। রোগীর অবস্থা তত দিনে মারাত্মক আকার ধারণ করে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের বেশির ভাগই পরিবারের কাছ থেকে সহায়তা পায় না। সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম বলেন, মানসিক রোগের চিকিৎসাব্যয় অনেক বেড়েছে। এ রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। ফলে অনেকেই একটানা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। সরকারের উচিত এ রোগের চিকিৎসাব্যয় কমানোর দিকে নজর দেওয়া। নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন। তিনি বলেন, গর্ভাবস্থা ও প্রসবের পর নারীদের হরমোনসংক্রান্ত কারণসহ বিভিন্ন কারণে মানসিক সংকট দেখা দেয়। প্রথম গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে পরবর্তী সময়ে আবার সন্তান নিলে ওই মায়ের মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন বলেন,
গত বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১৫ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। কিন্তু সেই অর্থে জনবল বাড়েনি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি। তিনি মানসিক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রচারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘পাগল’ শব্দটি সাহিত্যে আছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ শব্দ নেই। কিন্তু মানসিক রোগীদের এখন পর্যন্ত পাগল বলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এস আই মল্লিক বলেন, দেশের প্রায় ২ কোটি ৮৮ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার মানসিক রোগে ভুগছে। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছে এমন রোগীদের কথা বেশি করে প্রচার করতে হবে। কেননা, সুস্থ রোগীদের দেখে অন্যরা চিকিৎসকের কাছে আসে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মামুন হুসাইন মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পেছনে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেন। বর্তমানে এ খাতে যে বাজেট বরাদ্দ, তা অত্যন্ত অপ্রতুল। তিনি এ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা জরুরি বলে উল্লেখ করেন। রংপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জ্যোতির্ময় রায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এমবিবিএস পরীক্ষায় এ বিষয়ে আলাদা বোর্ড গঠনের সুপারিশ করেন। খুলনা মেডিকেল কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ধীরাজ মোহন বিশ্বাস বলেন, মানসিক সমস্যা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবার হতে পারে। প্রকাশভঙ্গিটা শুধু ভিন্ন হয়। বড় কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হলে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। কারণ সে ভাবছে, সে যা করবে তা সবাই মেনে নেবে। উচ্চবিত্তের সন্তান হাল আমলের মোটরসাইকেল না দেওয়ায় বাবাকে হত্যা করছে। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে এ রোগের জন্য ওষুধ পাওয়া যায় না। তিনি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের আচরণগত বিজ্ঞান বিষয়টি পড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক শফিউল হাসান বলেন, বর্তমানে ইন্টারনেটসহ যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তিনি এ রোগ সম্পর্কে চিকিৎসক সমাজের সচেতনতা বাড়ানো এবং রোগীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করার আহ্বান জানান।
No comments