প্রতিকূলতায় স্বকীয়তা by ওয়ালিউর রহমান
বহুদিন
ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা
ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু...।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রানাথের অমর কীর্তির বিশাল সাম্রাজ্য বাদ দিয়েও শুধুমাত্র এই একটি কবিতার জন্য তিনি সকল প্রবাসীর হৃদয়ে আবেগী আসনে আসীন হয়ে থাকবেন চিরজীবন। কিংবা তারও আগে মধু কবি আক্ষেপ করে বলেছিলেন: সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে..। কিংবা তারও অনেক পরে রূপসী বাংলার কবি দরদি প্রাণের আকুলতায় বলেছিলেন: আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়...।
যদিও প্রেক্ষাপট সবার ভিন্ন ভিন্ন ছিল কিন্তু মনের আকুতি তো ছিল একই। এই কবিতাগুলো কিন্তু শুধুমাত্র কবিতার জন্য কিংবা ছন্দমিলের জন্য লেখা হয়নি! কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দে শব্দে গেঁথে আছে আপন সত্তার অকৃত্রিম টানের প্রতি সরল স্বীকারোক্তি। আমরা যারা প্রবাসে স্থায়ীভাবে ঠিকানা করে ফেলেছি, তারা তো আর সবাই কবি কিংবা তুখোড় সাহিত্যিক নই। তাই মনের ভাবাবেগের এই ব্যাকুলতাকে অবদমিত রেখে পারিপার্শ্বিকতার জটিল নিষ্পেষণে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে নিজেদের ডুবিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ব্যস্ত রাখি। তবে তীব্র মনের টানে সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কিছু সুহৃদ আছেন, পিপাসার্ত চাতক পাখির মুখে দুফোঁটা পানি দেবার মতো করে হলেও দেশের আমেজ ফুটিয়ে তোলার অসাধ্যসাধন করে চলেছেন। তাদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো উষ্ণ ভালোবাসা থাকবে অহর্নিশ। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের শত প্রতিকূলতা ঠেলেও এতে কেউ কেউ কিছুটা হলেও প্রশান্তির শীতল ছায়া খুঁজে পান। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের বড় বড় শহরগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমাদের বাঙালিদেরও নিজস্ব কমিউনিটিভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন (রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না) গড়ে উঠেছে। তেমনি কানাডার বৃহত্তম শহর টরন্টোতে ড্যানফোর্থ-ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা হচ্ছে একটি খুদে বাংলাদেশ। আমার অবস্থান যদিও পাশের একটি শহরে—আসা যাওয়ার দূরত্বের থেকেও আনুসাঙ্গিকতার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে সেখানে যাওয়া হয়ে উঠে কদাচিৎ। কিন্তু দেশের কিছুটা পরশ পাওয়ার লোভেই খুদে বাঙালি পাড়ায় যাওয়ার জন্য তাই প্রাণ উচাটন হয়ে থাকে নিরন্তর। উপভোগ করতে ইচ্ছা করে দেশ থেকে আসা নামকরা শিল্পীদের গানের মূর্ছনা অথবা আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলো। সর্বোপরি সেখানকার দেশি দোকান পাটগুলোতে ভিড় করা দেশি মানুষগুলোর মুখরিত পদচারণা, দেশীয় জিনিসপত্র পরিপূর্ণ গ্রোসারি দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে ঢাকার কাঁচাবাজারের ঘ্রাণ বুক ভরে উপভোগ করা, প্রাণ ভরে তাদের বাংলা ভাষায় কথা বলতে শোনা। যখনই ওদিকটায় যাওয়া হয়, তখনই প্রায় সময়ই আমি দোকানগুলোতে কিনতে আসা লোকজন, যাদের সঙ্গে চেনা নেই জানা নেই সম্পূর্ণ অপরিচিত, তাদের সঙ্গে কথা জুড়ে দিই, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার তৃপ্তিতে। এটা একটু বাড়াবাড়ি কি না জানি না, তবে এ ক্ষেত্রে আমার মনকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
এই যে দেশের প্রতি এত আকুলতা, এত হৃদয়ক্ষরণ এটা কিন্তু দেশে থাকতে কোনো দিন অনুভব তো দূরের কথা ভুল করেও মনের কোণে উঁকি পর্যন্ত দিত না। দেশছাড়ার পর বুঝতে পারছি আসলেই ঘরের আঙিনায় শিশিরসিক্ত স্বর্ণালি আলোকছটার দূর্বা ঘাস কিংবা ধানের শিষ কত নয়নাভিরাম হতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, সমাজ ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ, সর্বোপরি অচিন্তনীয় প্রতিকূল আবহাওয়ায় এসে নিজস্ব চিন্তা চেতনা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ এসব সামাজিক ইস্যুগুলোকে সমুন্নত রেখে এ দেশীয় মূল প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা ও বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের জীবন গঠনে কঠিন শাসনের মধ্য দিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেও নির্বিঘ্নে পার পেয়ে গেছেন। আমরা যখন বাবা-মার আসনে আসীন হলাম তখন কিন্তু তাঁদের মতো করে আমাদের সন্তানদের শাসন করার ক্ষমতা আর খুঁজে পাচ্ছি না। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের লালন পালন করতে হবে। বাচ্চা ছেলেমেয়ে যতই দুষ্টামি করুক কিংবা কথাবার্তা না শুনুক গায়ে হাত তোলা যাবে না কোনো অবস্থাতেই। যদিও এ দেশীয় যুব বাবা-মার মধ্যে সন্তানকে নারকীয় অত্যাচারের প্রচুর নজির আছে তথাপি আমাদের উপমহাদেশ ও আফ্রিকার মানুষদের পশ্চিমারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এরা বাসায় বাচ্চাদের শারীরিক শাস্তি দিচ্ছে না। ফলে, এখানকার অভিবাসী অধ্যুষিত প্রতিটি এলিমেন্টারি ও জুনিয়র স্কুলে শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের একান্তে ডেকে নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বাসায় তাদের সঙ্গে বাবা-মা কেমন আচরণ করে। গায়ে হাত তোলে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদি কোনো কারণে কোনো বাচ্চার কাছ থেকে হ্যাঁ সূচক উত্তর বের করতে পারে তা হলেই সেরেছে। সেই বাবা-মার জীবনটা হেল হয়ে গেল। স্কুল থেকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও চাইল্ড কেয়ার সেন্টারকে জানানো হবে। পরের চিত্রটি হচ্ছে বাচ্চার বাসায় পুলিশ আর চাইল্ড কেয়ার কর্মীর যুগপৎ প্রবেশ। পুলিশ রিপোর্ট হবে এবং তিন বছর পর্যন্ত এই রিপোর্ট অ্যাকটিভ থাকবে। তারপর শুরু হবে আসল খেলা। ঘরে যদি আরও ছেলেমেয়ে থাকে তা হলে চাইল্ড কেয়ার কর্মী দফায় দফায় এক একজনকে আলাদা আলাদা করে দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিতে থাকবে এবং ভাব ভঙ্গিতে বাবা-মার চেয়েও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে পেয়েছি একটা কেস, চাকরি বাঁচাই আগে এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে প্রতি মাসে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে—তিন বছর যাবৎ নিরলসভাবে। যদি পরবর্তীতে কোনো অঘটন না ঘটে তা হলে তিন বছর পর এরা ফাইল ক্লোজ করে ফেলবে। কিন্তু এই তিন বছরে বাবা-মার জীবনটা তেজপাতা করে ছেড়ে দেবে। আর চাইল্ড কেয়ার কর্মীরা যদি বাচ্চার কথার বিন্দুমাত্র সত্যতা খুঁজে পায় তা হলে সেই বাচ্চাকে বাবা-মার থেকে তাৎক্ষণিক আল বিদা জানিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে আসবে। কে জানে! তীব্র শোকের মাঝে কারও মনে তখন নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সুরটি বেজে ওঠে কি না? আমারই বধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া।
এত যে ঘটনা, এত যে কাহিনি, অথচ বাস্তবে হয়তো দেখা যাবে বাচ্চার প্রচণ্ড দুষ্টামিতে অসহ্য হয়ে বাবা মা তাকে ধমক অথবা আস্তে একটি কানমলা কিংবা মৃদুভাবে একটি থাপড় মেরে থাকতে পারে। বাচ্চাটি তার শিশুসুলভ সরল স্বীকারোক্তিতে হয়তো এটিই বলেছিল আমার বাবা অথবা মা আমাকে মেরেছে। ব্যস ওতেই সমস্ত কিছু প্রমাণ হয়ে গেল বাচ্চার বাবা-মা কত খারাপ। বাচ্চা পালনে একেবারেই অনুপযুক্ত ও বিপদজনক! এটা কোনো কথা হতে পারে? চিন্তা করুন, এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের জোরে একটি ধমক দিতেও তো ভয় করে। বাচ্চারা তো আর রোবট না কিংবা তাদের কাছ থেকে রোবটের আচরণ আশা করাটাও ঠিক না। সে ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টামিতে সব বাবা-মারই একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
এই যখন হলো অবস্থা তখন এর সঙ্গে আবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রনালয় কর্তৃক সদ্য আরোপিত এক্সট্রা কারিকুলার হিসেবে ক্লাস থ্রি থেকে আবশ্যিক ভাবে ছেলেমেয়েদের যৌন শিক্ষার প্রবর্তন। টরন্টোতে বসবাসরত সমগ্র জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও প্রাদেশিক সরকার এর থেকে একচুলও নড়েনি। কয়েক হাজার অভিভাবক টরন্টোর কুইন্স পার্ক (প্রাদেশিক সংসদ ভবন) ঘেরাও করে সন্তানদের স্কুল থেকে প্রত্যাহারের হুমকিতেও সরকার আপাত ভাবলেশহীন। একমাত্র যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে নিরাপদ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সকল অভিভাবকদের কথা হচ্ছে সন্তান আমার সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার সন্তান ক্লাসে এই শিক্ষা গ্রহণ করবে কি করবে না। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নতুন এই ব্যবস্থাটি যে রক্ষণশীল পরিবারের পিতামাতার জন্য কত বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে তা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সেই দেশীয় প্রবাদটির মতো, ভিক্ষার কাজ নেই, কুত্তা সামলা। তাই দেখা যাচ্ছে, যাদেরই সামর্থ্য আছে এবং নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে আপসহীন মনোভাব পোষণ করেন তারাই ব্যয়বহুল হলেও বাধ্য হয়ে সন্তানের বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
এ তো গেল একটি দিকের কথা। এখানেই যদি উজান গাঙে গুণ টানার কাজটি শেষ হতো তা হলেতো সব বাবা-মাই নিদারুণ প্রশান্তিতে দিন গুজরান করতে পারতেন। কিন্তু অপর দিকটিতে যে রয়েছে আরও ভয়াবহ জটিল সমীকরণের সরল অঙ্ক! সে দিকটি আর কিছুই নয়, সেটি হচ্ছে ছেলেমেয়েরা যখন হাইস্কুলে ওঠে তখন থেকে যত দিন তাদের শিক্ষাজীবন থাকে তত দিন। এই সময়টা হচ্ছে সন্তান ও বাবা-মার জন্য সবচেয়ে ক্রুশিয়াল সময়। আমরা যারা প্রথম জেনারেশনের অভিবাসী, তাদের সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে থাকে বাঙালি মন মানসিকতা ও আচার আচরণ। অন্যদিকে আমাদের সন্তানরা স্কুল ও সহপাঠী বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরার কারণে এ দেশীয় মানসিকতা ধারণ করে বেড়ে উঠতে থাকে, যা খুবই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় অনেক পরিবারেই একটা চাপা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। অনেকটা না ঘরকা না ঘাটকার মতো অবস্থা। আমরা আমাদের বয়ঃসন্ধিকালে বাবা-মার কঠিন শাসনকে অনেক সময় বাড়াবাড়ি মনে করলেও মুখের ওপর কোনো কথা বলতে সাহস পাইনি। কিন্তু এই তরীকা আমাদের ছেলেমেয়েদের ওপর এপ্লাই করতে গেলে মুখের ওপর হয়তো বলে বসবে, আমাকে আমার মতো করে চলতে দাও। আমার জীবন আমি নিয়ন্ত্রণ করব, তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না দয়া করে। অসহায় বাবা-মা তখন সন্তানের মূল্যবোধ পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ কল্পনায় চিন্তিত হলেও সঙ্গে সঙ্গে চাইল্ড কেয়ারের দুঃসহ পেরেশানির কথা চিন্তা করে চুপসে যেতে বাধ্য হন।
বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের সেই আত্মীয়ের আরেক আত্মীয় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে বছর দুয়েক হলো ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এখানে এসেছেন তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে। দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের বয়স হবে ১৭ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে আর মেয়েটির বয়স হবে ১৪ থেকে ১৫। ছেলে দুটিকে দেখি হাতে লোহার বালা আর চোখ–ঠোঁট–নাক–কান–ভ্রু, সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুঁড়িয়ে রিং পরে মাথায় মি. টি কাট দিয়ে চুল কেটে হাফপ্যান্ট পরে পুরাই ইয়ো ইয়ো অবস্থা হয়ে আছে। যারাই সেদিন সেই দাওয়াতে গিয়েছিল, প্রথম দর্শনে থতমত খেয়ে সবারই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল।
এর পাশাপাশি আরেকটি পরিবার এসেছিল যাদেরও একই বয়সী দুটি ছেলেমেয়ে ছিল এবং বাচ্চাগুলো কানাডাতেই জন্মগ্রহণ করে। ছেলেমেয়ে দুটিই খুবই সপ্রতিভ ও মিশুক। সবার সঙ্গে খুব সাবলীল ভাবে কথা বলছে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করছে। অর্থাৎ এরা কানাডায় জন্মগ্রহণ করেও দুই সংস্কৃতিই সার্থক ভাবে ব্যালেন্স করে চলছে। তাদের পোশাক আশাকেও ছিল যথেষ্ট মার্জিতের ছাপ। সর্বোপরি মাগরিবের নামাজের সময় ছেলেটি অন্যান্য বয়স্কদের সঙ্গে এসে নামাজ পড়ল। আলাপের একপর্যায়ে জানতে পারলাম ছেলেটি ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ডাক্তারি পড়ছে আর তার বোন আগামী বছর ইউনিভার্সিটিতে যাবে। শুধু তাই নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি সে কমিউনিটি ভলান্টারি কাজের সঙ্গেও সক্রিয় ভাবে জড়িত। স্থানীয় আইস হকি ক্লাবের সদস্য ও নিয়মিত হকি খেলে থাকে।
অন্যদিকে অঙ্গবিদ্ধ ছেলেগুলোর সঙ্গে তো কথা বলারই ফুসরত পেলাম না। সারাক্ষণ দুই কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সেল ফোনে টেক্সটিং না কি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে মাথা তোলার সময় কোথায়? এই দুই পরিবারের দুই মেরুর অবস্থান দেখে আমার মনে এমন দাগ কাটল যে কেউ যেন আমাকে এসে বলতে লাগল চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে তুমি কীভাবে তোমার পরবর্তী প্রজন্মকে আলোকিত করবে? এটাকে কি স্বর্গীয় নূরের আলোকে আলোকিত করে মহিমান্বিত করে তুলবে নাকি নরকের লেলিহান শিখার আগুন জ্বালিয়ে অন্তর দহনের অঙ্গারে আলোকিত করবে? আমার কাদামাটির ঢেলাগুলোকে তাই আমি সুন্দর, মঙ্গল ও প্রশান্তির সমন্বয়ে যুগোপযোগী চিত্তাকর্ষক আদলে গড়ার প্রচেষ্টায় আছি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের কচিমনে ঘরে যে ভিত্তিটা তৈরি করে দেব। বড় হলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সেই ভিত্তিটা আলোক বর্তিকা হয়ে নিজেকে সামনে চালিত করবে। অন্তত ওই দুই পরিবার আমার কাছে আমার করণীয় সম্পর্কে একটা মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে।
(লেখকের ইমেইল: Waliur97@yahoo.ca)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রানাথের অমর কীর্তির বিশাল সাম্রাজ্য বাদ দিয়েও শুধুমাত্র এই একটি কবিতার জন্য তিনি সকল প্রবাসীর হৃদয়ে আবেগী আসনে আসীন হয়ে থাকবেন চিরজীবন। কিংবা তারও আগে মধু কবি আক্ষেপ করে বলেছিলেন: সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে..। কিংবা তারও অনেক পরে রূপসী বাংলার কবি দরদি প্রাণের আকুলতায় বলেছিলেন: আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়...।
যদিও প্রেক্ষাপট সবার ভিন্ন ভিন্ন ছিল কিন্তু মনের আকুতি তো ছিল একই। এই কবিতাগুলো কিন্তু শুধুমাত্র কবিতার জন্য কিংবা ছন্দমিলের জন্য লেখা হয়নি! কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দে শব্দে গেঁথে আছে আপন সত্তার অকৃত্রিম টানের প্রতি সরল স্বীকারোক্তি। আমরা যারা প্রবাসে স্থায়ীভাবে ঠিকানা করে ফেলেছি, তারা তো আর সবাই কবি কিংবা তুখোড় সাহিত্যিক নই। তাই মনের ভাবাবেগের এই ব্যাকুলতাকে অবদমিত রেখে পারিপার্শ্বিকতার জটিল নিষ্পেষণে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে নিজেদের ডুবিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ব্যস্ত রাখি। তবে তীব্র মনের টানে সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কিছু সুহৃদ আছেন, পিপাসার্ত চাতক পাখির মুখে দুফোঁটা পানি দেবার মতো করে হলেও দেশের আমেজ ফুটিয়ে তোলার অসাধ্যসাধন করে চলেছেন। তাদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো উষ্ণ ভালোবাসা থাকবে অহর্নিশ। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের শত প্রতিকূলতা ঠেলেও এতে কেউ কেউ কিছুটা হলেও প্রশান্তির শীতল ছায়া খুঁজে পান। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের বড় বড় শহরগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমাদের বাঙালিদেরও নিজস্ব কমিউনিটিভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন (রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না) গড়ে উঠেছে। তেমনি কানাডার বৃহত্তম শহর টরন্টোতে ড্যানফোর্থ-ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা হচ্ছে একটি খুদে বাংলাদেশ। আমার অবস্থান যদিও পাশের একটি শহরে—আসা যাওয়ার দূরত্বের থেকেও আনুসাঙ্গিকতার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে সেখানে যাওয়া হয়ে উঠে কদাচিৎ। কিন্তু দেশের কিছুটা পরশ পাওয়ার লোভেই খুদে বাঙালি পাড়ায় যাওয়ার জন্য তাই প্রাণ উচাটন হয়ে থাকে নিরন্তর। উপভোগ করতে ইচ্ছা করে দেশ থেকে আসা নামকরা শিল্পীদের গানের মূর্ছনা অথবা আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলো। সর্বোপরি সেখানকার দেশি দোকান পাটগুলোতে ভিড় করা দেশি মানুষগুলোর মুখরিত পদচারণা, দেশীয় জিনিসপত্র পরিপূর্ণ গ্রোসারি দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে ঢাকার কাঁচাবাজারের ঘ্রাণ বুক ভরে উপভোগ করা, প্রাণ ভরে তাদের বাংলা ভাষায় কথা বলতে শোনা। যখনই ওদিকটায় যাওয়া হয়, তখনই প্রায় সময়ই আমি দোকানগুলোতে কিনতে আসা লোকজন, যাদের সঙ্গে চেনা নেই জানা নেই সম্পূর্ণ অপরিচিত, তাদের সঙ্গে কথা জুড়ে দিই, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার তৃপ্তিতে। এটা একটু বাড়াবাড়ি কি না জানি না, তবে এ ক্ষেত্রে আমার মনকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
এই যে দেশের প্রতি এত আকুলতা, এত হৃদয়ক্ষরণ এটা কিন্তু দেশে থাকতে কোনো দিন অনুভব তো দূরের কথা ভুল করেও মনের কোণে উঁকি পর্যন্ত দিত না। দেশছাড়ার পর বুঝতে পারছি আসলেই ঘরের আঙিনায় শিশিরসিক্ত স্বর্ণালি আলোকছটার দূর্বা ঘাস কিংবা ধানের শিষ কত নয়নাভিরাম হতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, সমাজ ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ, সর্বোপরি অচিন্তনীয় প্রতিকূল আবহাওয়ায় এসে নিজস্ব চিন্তা চেতনা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ এসব সামাজিক ইস্যুগুলোকে সমুন্নত রেখে এ দেশীয় মূল প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা ও বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের জীবন গঠনে কঠিন শাসনের মধ্য দিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেও নির্বিঘ্নে পার পেয়ে গেছেন। আমরা যখন বাবা-মার আসনে আসীন হলাম তখন কিন্তু তাঁদের মতো করে আমাদের সন্তানদের শাসন করার ক্ষমতা আর খুঁজে পাচ্ছি না। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের লালন পালন করতে হবে। বাচ্চা ছেলেমেয়ে যতই দুষ্টামি করুক কিংবা কথাবার্তা না শুনুক গায়ে হাত তোলা যাবে না কোনো অবস্থাতেই। যদিও এ দেশীয় যুব বাবা-মার মধ্যে সন্তানকে নারকীয় অত্যাচারের প্রচুর নজির আছে তথাপি আমাদের উপমহাদেশ ও আফ্রিকার মানুষদের পশ্চিমারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এরা বাসায় বাচ্চাদের শারীরিক শাস্তি দিচ্ছে না। ফলে, এখানকার অভিবাসী অধ্যুষিত প্রতিটি এলিমেন্টারি ও জুনিয়র স্কুলে শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের একান্তে ডেকে নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বাসায় তাদের সঙ্গে বাবা-মা কেমন আচরণ করে। গায়ে হাত তোলে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদি কোনো কারণে কোনো বাচ্চার কাছ থেকে হ্যাঁ সূচক উত্তর বের করতে পারে তা হলেই সেরেছে। সেই বাবা-মার জীবনটা হেল হয়ে গেল। স্কুল থেকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও চাইল্ড কেয়ার সেন্টারকে জানানো হবে। পরের চিত্রটি হচ্ছে বাচ্চার বাসায় পুলিশ আর চাইল্ড কেয়ার কর্মীর যুগপৎ প্রবেশ। পুলিশ রিপোর্ট হবে এবং তিন বছর পর্যন্ত এই রিপোর্ট অ্যাকটিভ থাকবে। তারপর শুরু হবে আসল খেলা। ঘরে যদি আরও ছেলেমেয়ে থাকে তা হলে চাইল্ড কেয়ার কর্মী দফায় দফায় এক একজনকে আলাদা আলাদা করে দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিতে থাকবে এবং ভাব ভঙ্গিতে বাবা-মার চেয়েও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে পেয়েছি একটা কেস, চাকরি বাঁচাই আগে এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে প্রতি মাসে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে—তিন বছর যাবৎ নিরলসভাবে। যদি পরবর্তীতে কোনো অঘটন না ঘটে তা হলে তিন বছর পর এরা ফাইল ক্লোজ করে ফেলবে। কিন্তু এই তিন বছরে বাবা-মার জীবনটা তেজপাতা করে ছেড়ে দেবে। আর চাইল্ড কেয়ার কর্মীরা যদি বাচ্চার কথার বিন্দুমাত্র সত্যতা খুঁজে পায় তা হলে সেই বাচ্চাকে বাবা-মার থেকে তাৎক্ষণিক আল বিদা জানিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে আসবে। কে জানে! তীব্র শোকের মাঝে কারও মনে তখন নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সুরটি বেজে ওঠে কি না? আমারই বধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া।
এত যে ঘটনা, এত যে কাহিনি, অথচ বাস্তবে হয়তো দেখা যাবে বাচ্চার প্রচণ্ড দুষ্টামিতে অসহ্য হয়ে বাবা মা তাকে ধমক অথবা আস্তে একটি কানমলা কিংবা মৃদুভাবে একটি থাপড় মেরে থাকতে পারে। বাচ্চাটি তার শিশুসুলভ সরল স্বীকারোক্তিতে হয়তো এটিই বলেছিল আমার বাবা অথবা মা আমাকে মেরেছে। ব্যস ওতেই সমস্ত কিছু প্রমাণ হয়ে গেল বাচ্চার বাবা-মা কত খারাপ। বাচ্চা পালনে একেবারেই অনুপযুক্ত ও বিপদজনক! এটা কোনো কথা হতে পারে? চিন্তা করুন, এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের জোরে একটি ধমক দিতেও তো ভয় করে। বাচ্চারা তো আর রোবট না কিংবা তাদের কাছ থেকে রোবটের আচরণ আশা করাটাও ঠিক না। সে ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টামিতে সব বাবা-মারই একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
এই যখন হলো অবস্থা তখন এর সঙ্গে আবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রনালয় কর্তৃক সদ্য আরোপিত এক্সট্রা কারিকুলার হিসেবে ক্লাস থ্রি থেকে আবশ্যিক ভাবে ছেলেমেয়েদের যৌন শিক্ষার প্রবর্তন। টরন্টোতে বসবাসরত সমগ্র জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও প্রাদেশিক সরকার এর থেকে একচুলও নড়েনি। কয়েক হাজার অভিভাবক টরন্টোর কুইন্স পার্ক (প্রাদেশিক সংসদ ভবন) ঘেরাও করে সন্তানদের স্কুল থেকে প্রত্যাহারের হুমকিতেও সরকার আপাত ভাবলেশহীন। একমাত্র যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে নিরাপদ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সকল অভিভাবকদের কথা হচ্ছে সন্তান আমার সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নেব আমার সন্তান ক্লাসে এই শিক্ষা গ্রহণ করবে কি করবে না। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নতুন এই ব্যবস্থাটি যে রক্ষণশীল পরিবারের পিতামাতার জন্য কত বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে তা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সেই দেশীয় প্রবাদটির মতো, ভিক্ষার কাজ নেই, কুত্তা সামলা। তাই দেখা যাচ্ছে, যাদেরই সামর্থ্য আছে এবং নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে আপসহীন মনোভাব পোষণ করেন তারাই ব্যয়বহুল হলেও বাধ্য হয়ে সন্তানের বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
এ তো গেল একটি দিকের কথা। এখানেই যদি উজান গাঙে গুণ টানার কাজটি শেষ হতো তা হলেতো সব বাবা-মাই নিদারুণ প্রশান্তিতে দিন গুজরান করতে পারতেন। কিন্তু অপর দিকটিতে যে রয়েছে আরও ভয়াবহ জটিল সমীকরণের সরল অঙ্ক! সে দিকটি আর কিছুই নয়, সেটি হচ্ছে ছেলেমেয়েরা যখন হাইস্কুলে ওঠে তখন থেকে যত দিন তাদের শিক্ষাজীবন থাকে তত দিন। এই সময়টা হচ্ছে সন্তান ও বাবা-মার জন্য সবচেয়ে ক্রুশিয়াল সময়। আমরা যারা প্রথম জেনারেশনের অভিবাসী, তাদের সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে থাকে বাঙালি মন মানসিকতা ও আচার আচরণ। অন্যদিকে আমাদের সন্তানরা স্কুল ও সহপাঠী বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরার কারণে এ দেশীয় মানসিকতা ধারণ করে বেড়ে উঠতে থাকে, যা খুবই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় অনেক পরিবারেই একটা চাপা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাইচাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। অনেকটা না ঘরকা না ঘাটকার মতো অবস্থা। আমরা আমাদের বয়ঃসন্ধিকালে বাবা-মার কঠিন শাসনকে অনেক সময় বাড়াবাড়ি মনে করলেও মুখের ওপর কোনো কথা বলতে সাহস পাইনি। কিন্তু এই তরীকা আমাদের ছেলেমেয়েদের ওপর এপ্লাই করতে গেলে মুখের ওপর হয়তো বলে বসবে, আমাকে আমার মতো করে চলতে দাও। আমার জীবন আমি নিয়ন্ত্রণ করব, তোমরা আমাকে বিরক্ত করবে না দয়া করে। অসহায় বাবা-মা তখন সন্তানের মূল্যবোধ পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ কল্পনায় চিন্তিত হলেও সঙ্গে সঙ্গে চাইল্ড কেয়ারের দুঃসহ পেরেশানির কথা চিন্তা করে চুপসে যেতে বাধ্য হন।
বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের সেই আত্মীয়ের আরেক আত্মীয় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে বছর দুয়েক হলো ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এখানে এসেছেন তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে। দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের বয়স হবে ১৭ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে আর মেয়েটির বয়স হবে ১৪ থেকে ১৫। ছেলে দুটিকে দেখি হাতে লোহার বালা আর চোখ–ঠোঁট–নাক–কান–ভ্রু, সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুঁড়িয়ে রিং পরে মাথায় মি. টি কাট দিয়ে চুল কেটে হাফপ্যান্ট পরে পুরাই ইয়ো ইয়ো অবস্থা হয়ে আছে। যারাই সেদিন সেই দাওয়াতে গিয়েছিল, প্রথম দর্শনে থতমত খেয়ে সবারই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল।
এর পাশাপাশি আরেকটি পরিবার এসেছিল যাদেরও একই বয়সী দুটি ছেলেমেয়ে ছিল এবং বাচ্চাগুলো কানাডাতেই জন্মগ্রহণ করে। ছেলেমেয়ে দুটিই খুবই সপ্রতিভ ও মিশুক। সবার সঙ্গে খুব সাবলীল ভাবে কথা বলছে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করছে। অর্থাৎ এরা কানাডায় জন্মগ্রহণ করেও দুই সংস্কৃতিই সার্থক ভাবে ব্যালেন্স করে চলছে। তাদের পোশাক আশাকেও ছিল যথেষ্ট মার্জিতের ছাপ। সর্বোপরি মাগরিবের নামাজের সময় ছেলেটি অন্যান্য বয়স্কদের সঙ্গে এসে নামাজ পড়ল। আলাপের একপর্যায়ে জানতে পারলাম ছেলেটি ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ডাক্তারি পড়ছে আর তার বোন আগামী বছর ইউনিভার্সিটিতে যাবে। শুধু তাই নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি সে কমিউনিটি ভলান্টারি কাজের সঙ্গেও সক্রিয় ভাবে জড়িত। স্থানীয় আইস হকি ক্লাবের সদস্য ও নিয়মিত হকি খেলে থাকে।
অন্যদিকে অঙ্গবিদ্ধ ছেলেগুলোর সঙ্গে তো কথা বলারই ফুসরত পেলাম না। সারাক্ষণ দুই কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সেল ফোনে টেক্সটিং না কি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে মাথা তোলার সময় কোথায়? এই দুই পরিবারের দুই মেরুর অবস্থান দেখে আমার মনে এমন দাগ কাটল যে কেউ যেন আমাকে এসে বলতে লাগল চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে তুমি কীভাবে তোমার পরবর্তী প্রজন্মকে আলোকিত করবে? এটাকে কি স্বর্গীয় নূরের আলোকে আলোকিত করে মহিমান্বিত করে তুলবে নাকি নরকের লেলিহান শিখার আগুন জ্বালিয়ে অন্তর দহনের অঙ্গারে আলোকিত করবে? আমার কাদামাটির ঢেলাগুলোকে তাই আমি সুন্দর, মঙ্গল ও প্রশান্তির সমন্বয়ে যুগোপযোগী চিত্তাকর্ষক আদলে গড়ার প্রচেষ্টায় আছি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের কচিমনে ঘরে যে ভিত্তিটা তৈরি করে দেব। বড় হলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সেই ভিত্তিটা আলোক বর্তিকা হয়ে নিজেকে সামনে চালিত করবে। অন্তত ওই দুই পরিবার আমার কাছে আমার করণীয় সম্পর্কে একটা মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে।
(লেখকের ইমেইল: Waliur97@yahoo.ca)
No comments