নিঃশর্ত আনুগত্যের পরিণাম by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আধ্যাত্মিক
নেতা হোন, ধর্মীয় নেতা হোন বা রাজনৈতিক নেতা হোন, নেতা নেতাই। ভয়বশত
হোক বা ভক্তিবশত হোক, অন্ধভক্তি ও প্রশ্নহীন আনুগত্য না থাকলে নেতার
অনুসারীর তালিকা থেকে খারিজ হতে হয়। নেতার নির্দেশে অনুসারী ও ভক্তেরা
অকাতরে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেন। আনুগত্য এমনই জিনিস। প্রশ্নহীন আনুগত্যের
বহু দৃষ্টান্ত অতীতে দেখা গেছে। এখন আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।
নেতার নির্দেশে পুরুষ থেকে নপুংসকে পরিণত হয়েছে ভরাযৌবনে একদল বলিষ্ঠ
যুবক। এখন তারা নিঃস্ব—খোজা। কোনো যুবতীর কাছে এখন তাদের এক পয়সা দাম
নেই।
উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় গুরুর অভাব নেই। তেমনই এক মহাগুরু কয়েক বছর ধরে জুটিয়েছেন তাঁর বহু অনুসারী ও শিষ্য। দ্য ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদনে জানা গেল বিস্ময়কর ঘটনার কথা। যেকোনো আধ্যাত্মিক গুরুর ক্ষেত্রে যা, এই গুরুজিও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর অনুসারী ও শিষ্যদের মধ্যে যুবক-যুবতীই বেশি।
তারা আধ্যাত্মিক মুক্তি চায়। স্রষ্টার করুণা তাদের কাম্য। রাজনৈতিক নেতার যেমন কাম্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়া। আধ্যাত্মিক সাধনা যারা করে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ। আলোচ্য গুরুজি তাঁর যুবক ভক্তদের নির্দেশ দিতেন, ঈশ্বরের সর্বোচ্চ করুণা যদি চাও তো আমার নিয়োজিত ডাক্তারের কাছে যাও, গিয়ে তোমার এক জোড়া অণ্ডকোষের দুটোই ফেলে দাও।
বান্ধবীদের সঙ্গে কিছুমাত্র পরামর্শ না করে যুবকেরা ডাক্তারখানায় গিয়ে বিচি দুটোই ফেলে দিয়ে আসে। আহাম্মক যাকে বলে! কয়েক দিন পরেই তারা বুঝতে পারে, কী জিনিস তারা খুইয়েছে। বিচি ফেলে দেওয়ার পর গুরুজির প্রতিশ্রুত ঈশ্বরের সান্নিধ্য তো দূরের কথা, বান্ধবীদের সান্নিধ্য থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে।
মানুষের মধ্যে যেমন অন্ধ ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের প্রবণতা রয়েছে, তেমনি প্রতিবাদী চেতনাও রয়েছে। অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়ার পর ষাঁড় হয় বলদ, পাঁঠা হয় খাসি, মানুষ হয় পুরুষত্বহীন। তাতে তার প্রতিবাদী চেতনা যে শেষ হয়ে যায়, তা নয়। যখন ওই যুবকেরা দেখেছে যে তারা সর্বস্ব খুইয়েছে, আর হারানোর কিছু নেই, তখন তারা সোজা চলে গেছে থানায় ও আদালতে। গুরুজির কোমরে পড়েছে দড়ি। এখন তিনি শ্রীঘরের অতিথি। প্রতিবেদনে যা জানা গেল, তাতে অবশিষ্ট জীবন গুরু বাবাজিকে জেলখানার ভাত-রুটিই খেতে হবে।
আধ্যাত্মিক জগতের বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও প্রশ্নহীন আনুগত্যের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে দেশে দেশে। দেশগুলোর নাম উল্লেখ না করাই ভালো। রাজনৈতিক পরিভাষায় এখন নতুন সংযোজন ‘অনির্দিষ্টকাল’। অনন্ত অসীম মহাকালের কথা আমরা জানতাম, এখন তার সঙ্গে যোগ হলো ‘অনির্দিষ্টকাল’ পদটি। জানুয়ারির প্রথম হপ্তায় যদি কোনো নেতা তাঁর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নির্দেশ দিতেন যে গুলশান ২ নম্বর থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল দৌড়াতে হবে, তার বিরোধিতা করতেন না কেউ।
অতি চালাক যাঁরা, তাঁরা বুকের ব্যথা নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনো ক্লিনিকে ভর্তি হতেন। তারপর পাড়ি দিতেন সিঙ্গাপুর। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল দৌড়ের নির্দেশের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাতেন না। প্রেসক্লাবের সভাকক্ষে বসে অথবা তার সামনের সড়কে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকাল ধরে প্রতিদিন প্রতিপক্ষ নেতাকে অসুন্দর ভাষায় গালাগালের নির্দেশ আছে বলেই জনগণ মনে করে। প্রশ্নহীনভাবে যেকোনো নির্দেশ পালন করা নপুংসকতার পরিচয়।
দলীয় আদর্শ ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে স্বাধীন মত প্রকাশের মধ্যেই পৌরুষের পরিচয়। এই জিনিসটির অভাব দেখা যায় কোনো কোনো সময় কোনো কোনো রাষ্ট্রে পর্যন্ত। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য প্রয়োজন মোটামুটি শক্ত মেরুদণ্ড। অনেক সমাজে দেখা যায়, আলোচ্য গুরুর শিষ্যদের মতো প্রশ্নহীনভাবে নেতার নির্দেশ মেনে চলেন নেতার অনুসারীরা। প্রশ্নহীন আনুগত্য একধরনের পুরুষত্বহীনতা। সে ক্ষেত্রে অমূল্য দেহযন্ত্র না ফেলে দিয়েও অনেকে পরিণত হন নপুংসকে।
পরিবার হোক, আধ্যাত্মিক গুরুর আশ্রম হোক, কোনো রাষ্ট্র হোক বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন হোক—এক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক। কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতি শুভ হয় না।
বিশেষ করে যাঁদের মতামত দেওয়ার অধিকার আছে, তাঁরা যদি নির্বীর্যতাবশত প্রশ্নহীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেন, তা আরও বিপদের কারণ। তাতে ক্ষতি এতটাই হতে পারে, যা সংশোধনের অযোগ্য বা অপূরণীয় অর্থাৎ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো পথই থাকে না। যেমন আলোচ্য গুরুর হতভাগ্য শিষ্যরা আর জোড়া লাগাতে পারবে না তাদের অণ্ডকোষ। গুরু যদি আমৃত্যু জেলেও থাকেন, তাতে তাদের কী লাভ? তারা তাদের প্রত্যঙ্গ আর ফিরে পাবে না। অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে জনগণ একবার যা হারায়, তা আর ফিরে পায় না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় গুরুর অভাব নেই। তেমনই এক মহাগুরু কয়েক বছর ধরে জুটিয়েছেন তাঁর বহু অনুসারী ও শিষ্য। দ্য ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদনে জানা গেল বিস্ময়কর ঘটনার কথা। যেকোনো আধ্যাত্মিক গুরুর ক্ষেত্রে যা, এই গুরুজিও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর অনুসারী ও শিষ্যদের মধ্যে যুবক-যুবতীই বেশি।
তারা আধ্যাত্মিক মুক্তি চায়। স্রষ্টার করুণা তাদের কাম্য। রাজনৈতিক নেতার যেমন কাম্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়া। আধ্যাত্মিক সাধনা যারা করে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ। আলোচ্য গুরুজি তাঁর যুবক ভক্তদের নির্দেশ দিতেন, ঈশ্বরের সর্বোচ্চ করুণা যদি চাও তো আমার নিয়োজিত ডাক্তারের কাছে যাও, গিয়ে তোমার এক জোড়া অণ্ডকোষের দুটোই ফেলে দাও।
বান্ধবীদের সঙ্গে কিছুমাত্র পরামর্শ না করে যুবকেরা ডাক্তারখানায় গিয়ে বিচি দুটোই ফেলে দিয়ে আসে। আহাম্মক যাকে বলে! কয়েক দিন পরেই তারা বুঝতে পারে, কী জিনিস তারা খুইয়েছে। বিচি ফেলে দেওয়ার পর গুরুজির প্রতিশ্রুত ঈশ্বরের সান্নিধ্য তো দূরের কথা, বান্ধবীদের সান্নিধ্য থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে।
মানুষের মধ্যে যেমন অন্ধ ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের প্রবণতা রয়েছে, তেমনি প্রতিবাদী চেতনাও রয়েছে। অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়ার পর ষাঁড় হয় বলদ, পাঁঠা হয় খাসি, মানুষ হয় পুরুষত্বহীন। তাতে তার প্রতিবাদী চেতনা যে শেষ হয়ে যায়, তা নয়। যখন ওই যুবকেরা দেখেছে যে তারা সর্বস্ব খুইয়েছে, আর হারানোর কিছু নেই, তখন তারা সোজা চলে গেছে থানায় ও আদালতে। গুরুজির কোমরে পড়েছে দড়ি। এখন তিনি শ্রীঘরের অতিথি। প্রতিবেদনে যা জানা গেল, তাতে অবশিষ্ট জীবন গুরু বাবাজিকে জেলখানার ভাত-রুটিই খেতে হবে।
আধ্যাত্মিক জগতের বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও প্রশ্নহীন আনুগত্যের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে দেশে দেশে। দেশগুলোর নাম উল্লেখ না করাই ভালো। রাজনৈতিক পরিভাষায় এখন নতুন সংযোজন ‘অনির্দিষ্টকাল’। অনন্ত অসীম মহাকালের কথা আমরা জানতাম, এখন তার সঙ্গে যোগ হলো ‘অনির্দিষ্টকাল’ পদটি। জানুয়ারির প্রথম হপ্তায় যদি কোনো নেতা তাঁর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নির্দেশ দিতেন যে গুলশান ২ নম্বর থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল দৌড়াতে হবে, তার বিরোধিতা করতেন না কেউ।
অতি চালাক যাঁরা, তাঁরা বুকের ব্যথা নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনো ক্লিনিকে ভর্তি হতেন। তারপর পাড়ি দিতেন সিঙ্গাপুর। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল দৌড়ের নির্দেশের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাতেন না। প্রেসক্লাবের সভাকক্ষে বসে অথবা তার সামনের সড়কে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকাল ধরে প্রতিদিন প্রতিপক্ষ নেতাকে অসুন্দর ভাষায় গালাগালের নির্দেশ আছে বলেই জনগণ মনে করে। প্রশ্নহীনভাবে যেকোনো নির্দেশ পালন করা নপুংসকতার পরিচয়।
দলীয় আদর্শ ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা করে স্বাধীন মত প্রকাশের মধ্যেই পৌরুষের পরিচয়। এই জিনিসটির অভাব দেখা যায় কোনো কোনো সময় কোনো কোনো রাষ্ট্রে পর্যন্ত। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য প্রয়োজন মোটামুটি শক্ত মেরুদণ্ড। অনেক সমাজে দেখা যায়, আলোচ্য গুরুর শিষ্যদের মতো প্রশ্নহীনভাবে নেতার নির্দেশ মেনে চলেন নেতার অনুসারীরা। প্রশ্নহীন আনুগত্য একধরনের পুরুষত্বহীনতা। সে ক্ষেত্রে অমূল্য দেহযন্ত্র না ফেলে দিয়েও অনেকে পরিণত হন নপুংসকে।
পরিবার হোক, আধ্যাত্মিক গুরুর আশ্রম হোক, কোনো রাষ্ট্র হোক বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন হোক—এক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক। কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার পরিণতি শুভ হয় না।
বিশেষ করে যাঁদের মতামত দেওয়ার অধিকার আছে, তাঁরা যদি নির্বীর্যতাবশত প্রশ্নহীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেন, তা আরও বিপদের কারণ। তাতে ক্ষতি এতটাই হতে পারে, যা সংশোধনের অযোগ্য বা অপূরণীয় অর্থাৎ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো পথই থাকে না। যেমন আলোচ্য গুরুর হতভাগ্য শিষ্যরা আর জোড়া লাগাতে পারবে না তাদের অণ্ডকোষ। গুরু যদি আমৃত্যু জেলেও থাকেন, তাতে তাদের কী লাভ? তারা তাদের প্রত্যঙ্গ আর ফিরে পাবে না। অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে জনগণ একবার যা হারায়, তা আর ফিরে পায় না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments