বেসিক ব্যাংকে ৭৩১ কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম by শরিফুল হাসান
ব্যাংক
বা সরকারের কোনো নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ না করেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন
বেসিক ব্যাংকে ৭৩১ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের
বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা না নিয়েই এ নিয়োগ দেওয়া
হয়েছে। নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে ২৪২ জনেরই বাড়ি বাগেরহাটে। ব্যাংকটির
পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর বাড়ি
বাগেরহাটে।
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকটির নিয়োগ-সংক্রান্ত কাগজপত্র ও নিয়োগপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গড়ে ৩০ হাজার টাকা করে বেতন ধরলেও এই কর্মকর্তাদের বেতন দিতে প্রতি মাসে বেসিক ব্যাংককে প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
এর বাইরে বেসিক ব্যাংক নিজেও নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার কাজ ও দায়িত্ব যাচাই করেছে। ব্যাংকটি বলছে, তাদের মোট জনবল এখন ২ হাজার ২৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে ৭০০ জনই অযোগ্য এবং তাঁদের আসলে কোনো কাজ নেই; অথচ বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে।
সিএজি কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের যেমন প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, তেমনি আবার অনেকের চাকরির বয়সও ছিল না। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মনজুর মোরশেদ, ডিএমডি ফজলুস সোবহান, মোনায়েম খান, রুহুল আলম, মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনিসুজ্জামান এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।
তবে অভিযুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের বর্তমান একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবল নিয়োগের পুরো বিষয়টি ঠিক করেছে মূলত পরিচালনা পর্ষদ। নিয়ম অনুযায়ী, মহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত পদগুলোয় নিয়োগ দেবে ব্যাংক নিজে এবং এ-সংক্রান্ত নীতিমালা পর্ষদই ঠিক করে দেবে। বেসিক ব্যাংকেও তাই হয়েছে। আর ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে আপত্তি তোলা হলেও বোর্ড সেগুলো আমলে নেয়নি।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে নিয়োগ দেওয়া তো নীতিবিবর্জিত কাজ। টাকা লুটপাটের মতোই এটা দুর্নীতি। আর অযোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে তারা তো ব্যাংকে সেবা দিতে পারবে না। যারা এ নিয়োগের সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডি পদ বাদে বাকি সব নিয়োগ করার কাজ ব্যাংকের। কিন্তু পিয়ন থেকে শুরু করে কর্মকর্তাসহ সবই নিয়োগ দিত পরিচালনা পর্ষদ। শুরুতে নিয়ম ছিল সব কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। কিন্তু পরে পরিচালনা পর্ষদই নীতি পরিবর্তন করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একজনকে নেওয়া হলে এর বিপরীতে আরেকজনকে সরাসরি সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম করা হয়। পরবর্তী সময়ে এভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বেসিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একসময় অবস্থা এমন হলো যে নতুন শাখা খোলার আগেই কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে দিত পরিচালনা পর্ষদ। আত্মীয় ও পরিচিতরা ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের তদবির অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ছাড়াও আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগেই বেসিক ব্যাংকের নানা ধরনের অনিয়ম নিয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখন তৈরি করল সিএজি কার্যালয়। অথচ বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ও এর চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর কোনো ধরনের অনিয়ম খুঁজে পায়নি দুদক। বেসিক ব্যাংকের ওই পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। তাঁর এলাকা বাগেরহাট থেকেই নিয়োগ পেয়েছেন ২৪২ জন।
১৯৮৮ সালে বাগেরহাট-১ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল হাই। বর্তমানে ওই আসনের সাংসদ শেখ হেলাল। বাগেরহাটের ২৪২ জন কার সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন, জানতে শেখ হেলালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। শেখ আবদুল হাইকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নিয়োগের এই বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান ও মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনিসুজ্জামান বলেন, তিনি তখন মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হলেও নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন না।
নিয়োগের এই বিষয়টি জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে বেসিক ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, নিয়োগের অনিয়ম ধরে এখন যাচাই-বাছাই চলছে। ইতিমধ্যে ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর পর্ষদ এর জন্য দায়ী হলেও ব্যাংকের কিছু করার নেই। সরকারকেই এ জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রথম আলোর হাতে রয়েছে। ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে চাকরির বয়সসীমা ৩০ বছর থাকলেও এ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। দেড় শতাধিক কর্মকর্তা আছেন, যাঁদের বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে। তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জুবিলি রোড শাখায় ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এমন একজন যোগদান করেছেন, যাঁর বয়স ৫১ বছর ১১ মাস। এ ছাড়া ৪৯ বছরের দুজন, ৪৮ বছরের দুজন, ৪৭ বছর বয়সী তিনজন, ৪৬ বছর বয়সী একজন, ৪৫ বছর বয়সী দুজন, ৪২ বছর বয়সী পাঁচজন, ৪১ বছর বয়সী তিনজন এবং ৪০ বছর বয়সী নিয়োগ পেয়েছেন চারজন।
বেসিক ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বয়স না থাকার পরেও যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই পরিচালনা পর্ষদ বা প্রভাবশালী মহলের কারও না কারও আত্মীয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেলে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি আবেদনের যোগ্য নন। কিন্তু এই একাধিক তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া লোককেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেকে কোন পদে চাকরি করবেন, আবেদনে সেটিও লেখেননি। অনেকে আবার কোনো ধরনের আবেদন বা জীবনবৃত্তান্ত না দিয়েই চাকরি পেয়েছেন। জীবনবৃত্তান্ত জমার আগেই নিয়োগ দেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির লোকজনের যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে তা করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, জেলা কোটা—কোনো কিছুই মানা হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২৮ জন কর্মকর্তাকে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম নিয়োগের সুপারিশ করেন। কোনো ধরনের পরীক্ষা না নিয়েই মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক তাঁদের নিয়োগপত্র দেন। ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এই নিয়োগ প্রদান করায় তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ফৌজদারি মামলা হয়নি। অথচ এই নিয়োগের কারণে গত ছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৯ টাকা অপচয় হয়েছে।
এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলমের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জনসংযোগ শাখার অনুমতি ছাড়া আমি কথা বলতে পারব না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ন্যূনতম মানদণ্ড না মেনে ৭৩১ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার। এর আরেক নাম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। আইন পরিপন্থী যা যা হতে পারে, সবই এখানে হয়েছে। যাঁরা এ ঘটনায় দায়ী, তাঁরা যেই হোক, সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে তাঁদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকটির নিয়োগ-সংক্রান্ত কাগজপত্র ও নিয়োগপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গড়ে ৩০ হাজার টাকা করে বেতন ধরলেও এই কর্মকর্তাদের বেতন দিতে প্রতি মাসে বেসিক ব্যাংককে প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
এর বাইরে বেসিক ব্যাংক নিজেও নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার কাজ ও দায়িত্ব যাচাই করেছে। ব্যাংকটি বলছে, তাদের মোট জনবল এখন ২ হাজার ২৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে ৭০০ জনই অযোগ্য এবং তাঁদের আসলে কোনো কাজ নেই; অথচ বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে।
সিএজি কার্যালয়ের করা নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের যেমন প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, তেমনি আবার অনেকের চাকরির বয়সও ছিল না। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মনজুর মোরশেদ, ডিএমডি ফজলুস সোবহান, মোনায়েম খান, রুহুল আলম, মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনিসুজ্জামান এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।
তবে অভিযুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের বর্তমান একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবল নিয়োগের পুরো বিষয়টি ঠিক করেছে মূলত পরিচালনা পর্ষদ। নিয়ম অনুযায়ী, মহাব্যবস্থাপক পর্যন্ত পদগুলোয় নিয়োগ দেবে ব্যাংক নিজে এবং এ-সংক্রান্ত নীতিমালা পর্ষদই ঠিক করে দেবে। বেসিক ব্যাংকেও তাই হয়েছে। আর ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে আপত্তি তোলা হলেও বোর্ড সেগুলো আমলে নেয়নি।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে নিয়োগ দেওয়া তো নীতিবিবর্জিত কাজ। টাকা লুটপাটের মতোই এটা দুর্নীতি। আর অযোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে তারা তো ব্যাংকে সেবা দিতে পারবে না। যারা এ নিয়োগের সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকের এমডি ও ডিএমডি পদ বাদে বাকি সব নিয়োগ করার কাজ ব্যাংকের। কিন্তু পিয়ন থেকে শুরু করে কর্মকর্তাসহ সবই নিয়োগ দিত পরিচালনা পর্ষদ। শুরুতে নিয়ম ছিল সব কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। কিন্তু পরে পরিচালনা পর্ষদই নীতি পরিবর্তন করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একজনকে নেওয়া হলে এর বিপরীতে আরেকজনকে সরাসরি সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম করা হয়। পরবর্তী সময়ে এভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বেসিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একসময় অবস্থা এমন হলো যে নতুন শাখা খোলার আগেই কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে দিত পরিচালনা পর্ষদ। আত্মীয় ও পরিচিতরা ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের তদবির অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ছাড়াও আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগেই বেসিক ব্যাংকের নানা ধরনের অনিয়ম নিয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখন তৈরি করল সিএজি কার্যালয়। অথচ বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ও এর চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর কোনো ধরনের অনিয়ম খুঁজে পায়নি দুদক। বেসিক ব্যাংকের ওই পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। তাঁর এলাকা বাগেরহাট থেকেই নিয়োগ পেয়েছেন ২৪২ জন।
১৯৮৮ সালে বাগেরহাট-১ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল হাই। বর্তমানে ওই আসনের সাংসদ শেখ হেলাল। বাগেরহাটের ২৪২ জন কার সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন, জানতে শেখ হেলালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। শেখ আবদুল হাইকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নিয়োগের এই বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান ও মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনিসুজ্জামান বলেন, তিনি তখন মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হলেও নিয়োগ কমিটিতে ছিলেন না।
নিয়োগের এই বিষয়টি জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে বেসিক ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, নিয়োগের অনিয়ম ধরে এখন যাচাই-বাছাই চলছে। ইতিমধ্যে ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর পর্ষদ এর জন্য দায়ী হলেও ব্যাংকের কিছু করার নেই। সরকারকেই এ জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রথম আলোর হাতে রয়েছে। ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে চাকরির বয়সসীমা ৩০ বছর থাকলেও এ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। দেড় শতাধিক কর্মকর্তা আছেন, যাঁদের বয়স ৩০ পেরিয়ে গেছে। তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জুবিলি রোড শাখায় ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এমন একজন যোগদান করেছেন, যাঁর বয়স ৫১ বছর ১১ মাস। এ ছাড়া ৪৯ বছরের দুজন, ৪৮ বছরের দুজন, ৪৭ বছর বয়সী তিনজন, ৪৬ বছর বয়সী একজন, ৪৫ বছর বয়সী দুজন, ৪২ বছর বয়সী পাঁচজন, ৪১ বছর বয়সী তিনজন এবং ৪০ বছর বয়সী নিয়োগ পেয়েছেন চারজন।
বেসিক ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বয়স না থাকার পরেও যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই পরিচালনা পর্ষদ বা প্রভাবশালী মহলের কারও না কারও আত্মীয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেলে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি আবেদনের যোগ্য নন। কিন্তু এই একাধিক তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া লোককেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেকে কোন পদে চাকরি করবেন, আবেদনে সেটিও লেখেননি। অনেকে আবার কোনো ধরনের আবেদন বা জীবনবৃত্তান্ত না দিয়েই চাকরি পেয়েছেন। জীবনবৃত্তান্ত জমার আগেই নিয়োগ দেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির লোকজনের যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে তা করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, জেলা কোটা—কোনো কিছুই মানা হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২৮ জন কর্মকর্তাকে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম নিয়োগের সুপারিশ করেন। কোনো ধরনের পরীক্ষা না নিয়েই মহাব্যবস্থাপক এস এম রওশানুল হক তাঁদের নিয়োগপত্র দেন। ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এই নিয়োগ প্রদান করায় তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ফৌজদারি মামলা হয়নি। অথচ এই নিয়োগের কারণে গত ছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৯ টাকা অপচয় হয়েছে।
এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলমের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জনসংযোগ শাখার অনুমতি ছাড়া আমি কথা বলতে পারব না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ন্যূনতম মানদণ্ড না মেনে ৭৩১ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার। এর আরেক নাম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। আইন পরিপন্থী যা যা হতে পারে, সবই এখানে হয়েছে। যাঁরা এ ঘটনায় দায়ী, তাঁরা যেই হোক, সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে তাঁদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
No comments