ভূরাজনীতি- বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিকসকে জায়গা দিতে হবে by শশী থারুর
শশী থারুর |
এ
মাসের শুরুর দিকে এক শীতল সন্ধ্যায় মস্কো নদীতে বিহার করার সময় আমি
চায়নিজ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের (এনপিসি) ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির
চেয়ারম্যানের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মেতে উঠি। ওদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও
ব্রাজিলের এমপিরা রুশ সংগীতের তালে তালে নাচছিলেন, আর একজন গাইড তাঁদের
বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন। এভাবে ব্রিকস দেশগুলোর প্রথম
সংসদীয় ফোরাম বেশ আনন্দ-উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এই দেশগুলোর মধ্যে
আছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
বৈঠক শুরু হওয়ার আগে অনেকেই কৌতূহলী ছিলেন, এই পাঁচটি সংসদ কোনো অভিন্ন জায়গায় আসতে পারবে কি না। কথা হচ্ছে, ভারতের লোকসভা খুব হইচইপূর্ণ, সেখানে বিদ্বেষও কম দেখা যায় না। সেখানে খুবই আবেগপ্রবণ তর্ক-বিতর্ক হয়, তার কার্যক্রমও প্রায়ই ব্যাহত হয়। এই লোকসভার সঙ্গে চীনের আলংকারিক এনপিসির কী মিল রয়েছে? এনপিসি তো বাস্তবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, তার কাজ হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটানো। অনেকেই মনে করেন, ব্রিকসের নতুন দলে সদস্যপদ পাওয়া মানেই সহযোগিতার যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি পাওয়া নয়।
সেই শুরুতে ব্রিকসের দল গঠনের সময়ই এমন আশঙ্কা দূরীভূত হয়েছিল। কারণ, অনেকেই এটা খারিজ করেছিলেন এ কথা বলে যে এটি একমাত্র আন্তর্জাতিক সংগঠন, যা সৃষ্টি করেছে একটি বিনিয়োগ ব্যাংক। বিশেষ করে, ব্রিক শব্দটি এক দশকের বেশি আগে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষক জিম ও’নিল। প্রথম দিকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রধান উদীয়মান দেশগুলোর কাতারে গণ্য করেননি।
তবে এই চিন্তা শুরু থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পছন্দ হয়, এবং তিনি ২০০৬ সালে পরামর্শ দেন, চারটি দেশকে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। শিগগিরই এই গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়, তারপর বার্ষিক সম্মেলনের পরিকল্পনাও করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১১ সালে এতে যোগ দেয়, এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণে ব্রিকসের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী হয়, উত্তরের দেশগুলোর মধ্যে ছিল শুধু রাশিয়া। বস্তুত, এ কারণেই এই উদ্যোগে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূমিকার ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কিছুদিন আগ পর্যন্ত রাশিয়া পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী জি-৮-এর সদস্য ছিল। ফলে ধারণা ছিল, রাশিয়া ব্রিকসের অন্য চারটি দেশের সঙ্গে তেমন নৈকট্য বোধ করবে না। বৈশ্বিক ফোরামে এই চার দেশকে ঐতিহ্যগতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ব্রিকসের চিন্তা আঁকড়ে ধরে পুতিন একটি বিকল্প বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন, একই সঙ্গে তিনি বিকল্প বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করেন।
ব্রিকসের উদ্যোগ বিস্তৃত হতে শুরু করলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বিস্মিত হন। বার্ষিক সম্মেলন ছাড়াও ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়, নতুন চিন্তা সৃষ্টিতেও তারা কাজ করেছে। ব্রিকসের বার্ষিক সফরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেখানে শান্তি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও জাতিসংঘের সংস্কার পর্যন্ত নানা বিষয়ই উঠে এসেছে। তারপরও ব্রিকস নতুন উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার প্রধান কার্যালয় সাংহাইয়ে অবস্থিত। এর নেতৃত্বে রয়েছেন একজন প্রথিতযশা ভারতীয় ব্যাংকার।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই সংসদীয় ফোরাম ব্রিকসের অধীনে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশেষ। কর্মসম্পাদন-পদ্ধতি হিসেবেও এটি সবচেয়ে নতুন। এর মধ্য দিয়ে ব্রিকস এমন একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, যাকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ব্রিকস এমন একটা সময়ে উঠে আসছে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক নিপীড়ন, বিপুল প্রাণহানি ও হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সে সময়ের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জাতিসংঘের সনদের ভিত্তিতে প্রণীত উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মৈত্রীর প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে আরও হত্যাযজ্ঞ এড়ানোর একমাত্র পথ। পরবর্তী সাত দশকে সেই ব্যবস্থা তার লক্ষ্য অনেকাংশে অর্জন করেছে। বৃহৎ পরিসরে এটি বৈশ্বিক শান্তি নিশ্চিত করেছে। যদিও এর বিনিময়ে অনেক যুদ্ধই প্রান্তিক দেশগুলোতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এতে শুধু উন্নত বিশ্বই লাভবান হয়নি, এতে উপনিবেশ-মোচন সম্ভব হয়েছে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। আর নতুন ও উদীয়মান দেশগুলোর দাবি আমলে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থা আর কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়। নিজেদের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চীন ও ভারত বিশ্ব পরিসরে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। ওদিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশীয় পরাশক্তি হয়ে উঠছে। আর হাইড্রোকার্বন-চালিত রাশিয়া পশ্চিমা ব্যবস্থার প্রান্তে বসে বসে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে অনেকেই মনে করেন, বিদ্যমান ব্যবস্থা রূপান্তরের অপেক্ষায় আছে।
অন্য পরাশক্তিগুলো এত সহজে নিজেদের আধিপত্য ছেড়ে দেবে না। এটা ভাবা অযৌক্তিক যে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে চীনের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আর বেলজিয়ামের ভোট দেওয়ার ক্ষমতার বিষয়টি একই ব্যাপার। কিন্তু জি-২০ যে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নত, উদীয়মান ও ক্রান্তিকালীন দেশগুলোর মধ্যে সমতা আনার চেষ্টা করছিল, সেটা থেমে গেছে। বটেই, মার্কিন নেতারা কৌশলগতভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভোট প্রদানের সংস্কারে একমত হয়েছেন। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস এখন পর্যন্ত তা অনুসমর্থনে রাজি হয়নি।
এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ, ভারত ও ব্রাজিল বিশ্বব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার কথা ভাবছে না, এক শতক আগে জার্মানি ও জাপান যেটা ভেবেছিল। তারা সবাই চায়, উঁচু মহলে তাদের স্থান দেওয়া হোক। এটা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। যদিও চীনা নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠলে তা বিদ্যমান ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত হবে কি না তা নিয়ে ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার কৌতূহলী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
ব্রিকসের অবস্থান একই সঙ্গে বোধগম্য ও চিন্তা উদ্রেককারী। কোনো দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করলে সে ভূরাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করে। বিশ্বব্যবস্থার প্রবক্তাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একটি সর্বজনীন ও বোধগম্য বিধিবিধান ও বৈশ্বিক কাঠামোর মধ্যে উদীয়মান শক্তিগুলোকে ধারণ করা। যেখানে প্রতিটি দেশ আকৃতি, সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তার অবদানের নিরিখে ন্যায্য পাওনা পাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বনেতারা যে রাষ্ট্রনায়কোচিত বৈশিষ্ট্য, দূরদৃষ্টি ও মননের উদারতা দেখিয়েছিলেন, আজকের নেতাদের মধ্যে তার ঘাটতি আছে। তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় একগুঁয়ের মতো আঁকড়ে থাকেন এবং নতুনদের আসার দরজা রুদ্ধ করে রাখেন বলে যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁদের জন্য তেমন বিকল্প থাকে না।
ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ ব্যাপার আছে। তারা সবাই মনে করে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যে স্থান তাদের প্রাপ্য সেটা তাদের দেওয়া হয়নি। নতুন একটা গ্রহণযোগ্য বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে তাদের এই বিশ্বাস হয়তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের অর্থনীতির জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটি প্রতারণামূলক হতে পারে।
আসল ব্যাপার হলো, ব্রিকসকে যদি বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রদানে সহায়কের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া না হয়, তাহলে তারা অনিবার্যভাবে নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা তৈরি করে নেবে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যবস্থার জন্য তার মানে কী হতে পারে, তা কেউ জানে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: কংগ্রেসের সাংসদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী।
বৈঠক শুরু হওয়ার আগে অনেকেই কৌতূহলী ছিলেন, এই পাঁচটি সংসদ কোনো অভিন্ন জায়গায় আসতে পারবে কি না। কথা হচ্ছে, ভারতের লোকসভা খুব হইচইপূর্ণ, সেখানে বিদ্বেষও কম দেখা যায় না। সেখানে খুবই আবেগপ্রবণ তর্ক-বিতর্ক হয়, তার কার্যক্রমও প্রায়ই ব্যাহত হয়। এই লোকসভার সঙ্গে চীনের আলংকারিক এনপিসির কী মিল রয়েছে? এনপিসি তো বাস্তবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, তার কাজ হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটানো। অনেকেই মনে করেন, ব্রিকসের নতুন দলে সদস্যপদ পাওয়া মানেই সহযোগিতার যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি পাওয়া নয়।
সেই শুরুতে ব্রিকসের দল গঠনের সময়ই এমন আশঙ্কা দূরীভূত হয়েছিল। কারণ, অনেকেই এটা খারিজ করেছিলেন এ কথা বলে যে এটি একমাত্র আন্তর্জাতিক সংগঠন, যা সৃষ্টি করেছে একটি বিনিয়োগ ব্যাংক। বিশেষ করে, ব্রিক শব্দটি এক দশকের বেশি আগে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষক জিম ও’নিল। প্রথম দিকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রধান উদীয়মান দেশগুলোর কাতারে গণ্য করেননি।
তবে এই চিন্তা শুরু থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পছন্দ হয়, এবং তিনি ২০০৬ সালে পরামর্শ দেন, চারটি দেশকে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। শিগগিরই এই গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়, তারপর বার্ষিক সম্মেলনের পরিকল্পনাও করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১১ সালে এতে যোগ দেয়, এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণে ব্রিকসের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী হয়, উত্তরের দেশগুলোর মধ্যে ছিল শুধু রাশিয়া। বস্তুত, এ কারণেই এই উদ্যোগে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূমিকার ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কিছুদিন আগ পর্যন্ত রাশিয়া পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী জি-৮-এর সদস্য ছিল। ফলে ধারণা ছিল, রাশিয়া ব্রিকসের অন্য চারটি দেশের সঙ্গে তেমন নৈকট্য বোধ করবে না। বৈশ্বিক ফোরামে এই চার দেশকে ঐতিহ্যগতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ব্রিকসের চিন্তা আঁকড়ে ধরে পুতিন একটি বিকল্প বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন, একই সঙ্গে তিনি বিকল্প বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করেন।
ব্রিকসের উদ্যোগ বিস্তৃত হতে শুরু করলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বিস্মিত হন। বার্ষিক সম্মেলন ছাড়াও ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়, নতুন চিন্তা সৃষ্টিতেও তারা কাজ করেছে। ব্রিকসের বার্ষিক সফরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যুতে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেখানে শান্তি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও জাতিসংঘের সংস্কার পর্যন্ত নানা বিষয়ই উঠে এসেছে। তারপরও ব্রিকস নতুন উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার প্রধান কার্যালয় সাংহাইয়ে অবস্থিত। এর নেতৃত্বে রয়েছেন একজন প্রথিতযশা ভারতীয় ব্যাংকার।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই সংসদীয় ফোরাম ব্রিকসের অধীনে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশেষ। কর্মসম্পাদন-পদ্ধতি হিসেবেও এটি সবচেয়ে নতুন। এর মধ্য দিয়ে ব্রিকস এমন একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, যাকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ব্রিকস এমন একটা সময়ে উঠে আসছে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক নিপীড়ন, বিপুল প্রাণহানি ও হিরোশিমার ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সে সময়ের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জাতিসংঘের সনদের ভিত্তিতে প্রণীত উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মৈত্রীর প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে আরও হত্যাযজ্ঞ এড়ানোর একমাত্র পথ। পরবর্তী সাত দশকে সেই ব্যবস্থা তার লক্ষ্য অনেকাংশে অর্জন করেছে। বৃহৎ পরিসরে এটি বৈশ্বিক শান্তি নিশ্চিত করেছে। যদিও এর বিনিময়ে অনেক যুদ্ধই প্রান্তিক দেশগুলোতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এতে শুধু উন্নত বিশ্বই লাভবান হয়নি, এতে উপনিবেশ-মোচন সম্ভব হয়েছে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। আর নতুন ও উদীয়মান দেশগুলোর দাবি আমলে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থা আর কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়। নিজেদের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চীন ও ভারত বিশ্ব পরিসরে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। ওদিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশীয় পরাশক্তি হয়ে উঠছে। আর হাইড্রোকার্বন-চালিত রাশিয়া পশ্চিমা ব্যবস্থার প্রান্তে বসে বসে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে অনেকেই মনে করেন, বিদ্যমান ব্যবস্থা রূপান্তরের অপেক্ষায় আছে।
অন্য পরাশক্তিগুলো এত সহজে নিজেদের আধিপত্য ছেড়ে দেবে না। এটা ভাবা অযৌক্তিক যে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে চীনের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আর বেলজিয়ামের ভোট দেওয়ার ক্ষমতার বিষয়টি একই ব্যাপার। কিন্তু জি-২০ যে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নত, উদীয়মান ও ক্রান্তিকালীন দেশগুলোর মধ্যে সমতা আনার চেষ্টা করছিল, সেটা থেমে গেছে। বটেই, মার্কিন নেতারা কৌশলগতভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভোট প্রদানের সংস্কারে একমত হয়েছেন। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস এখন পর্যন্ত তা অনুসমর্থনে রাজি হয়নি।
এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ, ভারত ও ব্রাজিল বিশ্বব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার কথা ভাবছে না, এক শতক আগে জার্মানি ও জাপান যেটা ভেবেছিল। তারা সবাই চায়, উঁচু মহলে তাদের স্থান দেওয়া হোক। এটা ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। যদিও চীনা নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠলে তা বিদ্যমান ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত হবে কি না তা নিয়ে ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার কৌতূহলী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
ব্রিকসের অবস্থান একই সঙ্গে বোধগম্য ও চিন্তা উদ্রেককারী। কোনো দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করলে সে ভূরাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করে। বিশ্বব্যবস্থার প্রবক্তাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একটি সর্বজনীন ও বোধগম্য বিধিবিধান ও বৈশ্বিক কাঠামোর মধ্যে উদীয়মান শক্তিগুলোকে ধারণ করা। যেখানে প্রতিটি দেশ আকৃতি, সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তার অবদানের নিরিখে ন্যায্য পাওনা পাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্বনেতারা যে রাষ্ট্রনায়কোচিত বৈশিষ্ট্য, দূরদৃষ্টি ও মননের উদারতা দেখিয়েছিলেন, আজকের নেতাদের মধ্যে তার ঘাটতি আছে। তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় একগুঁয়ের মতো আঁকড়ে থাকেন এবং নতুনদের আসার দরজা রুদ্ধ করে রাখেন বলে যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁদের জন্য তেমন বিকল্প থাকে না।
ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ ব্যাপার আছে। তারা সবাই মনে করে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যে স্থান তাদের প্রাপ্য সেটা তাদের দেওয়া হয়নি। নতুন একটা গ্রহণযোগ্য বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি হিসেবে তাদের এই বিশ্বাস হয়তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু যেহেতু ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের অর্থনীতির জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটি প্রতারণামূলক হতে পারে।
আসল ব্যাপার হলো, ব্রিকসকে যদি বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব প্রদানে সহায়কের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া না হয়, তাহলে তারা অনিবার্যভাবে নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা তৈরি করে নেবে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যবস্থার জন্য তার মানে কী হতে পারে, তা কেউ জানে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: কংগ্রেসের সাংসদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী।
No comments