অনন্য এক জাদুকর by মোশাররফ রুমী
নির্দিষ্ট
কোন বিশেষণের মোড়কে বাধা তাকে অসম্ভব। কারণ, অন্যকে আকৃষ্ট করে এমন অসংখ্য
গুণ তাকে ছুঁয়ে আছে নিবিড়ভাবে। সদালাপী, সজ্জন, বন্ধুবৎসল, দারুণ
হাস্যোজ্জ্বল, মোহনীয় ব্যবহার আর অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার দুর্দান্ত
পারদর্শিতা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার সুবাদে দেশের সীমা ছাড়িয়ে গোটা
বিশ্বে তার নাম উচ্চারিত হয় বেশ প্রশংসার সঙ্গে। তিনি জুয়েল আইচ। জাদুর
দুনিয়ার এক অনন্য মানুষ। দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ন। বাংলাদেশের জাদুশিল্পের
পথিকৃত। বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশের নামিদামি জাদুশিল্পীও তার মায়াবী জাদুতে
কুপোকাত। তাদের কাছে তিনি সমীহের পাত্র। দেশ-বিদেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জুয়েল
আইচ যখন কথা বলেন তখন দর্শকের আসনে বসে থাকা হাজারও মানুষ পিনপতন নীরবতায়
গোগ্রাসে স্বাদ আস্বাদন করে সে কথার। তার ঐন্দ্রজালিক নানা কারিশমা তিনি
যখন একের পর এক দেখিয়ে চলেন তখন হলজুড়ে স্বর্গীয় এক আবেশ ভর করে। সদা বিনয়ী
এ জাদুশিল্পীর একেকটি জাদু যেন নয়নজুড়ানো একেকটি রঙিন ক্যানভাস। যে
ক্যানভাসে চোখ রেখে দর্শক নিজেদের নিয়ে যায় ভিন্ন এক ভাললাগার জগতে। তার
এমন অনেক জাদু আছে যেসবের প্রেক্ষাপট সোনার বাংলাদেশ। যা দেখে দেশের দর্শক
অনুপ্রাণিত হয় দুর্দান্ত দেশপ্রেমে এবং ভিনদেশী দর্শক চিনে নেয় সুজলা সুফলা
শস্য শ্যামলা বাংলাকে। আর সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, জীব ও প্রকৃতিপ্রেম এবং
নানা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়গুলো তো তার সব জাদুকে জড়িয়ে আছে
দারুণভাবে। জুয়েল আইচ শুধু একজন জাদুশিল্পীই নন, তিনি একজন ধ্রুপদী
বাঁশিবাদক। অনেক শোতেই দেখা যায় তিনি বাঁশি বাজাচ্ছেন। পাশে দাঁড়ানো তার
স্ত্রী বিপাশা আইচ বাঁশির সুরে তন্ময়। ধীরে ধীরে তার চোখ বুঁজে এলো। বাঁশির
সুর ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠলো। আর কী আশ্চর্য, বাঁশির সুরে ধীরে
ধীরে শূন্যে ভাসলেন বিপাশা। শুধু কী তাই! গিলোটিনের ভেতর ঘাড় পেতে দিলেন
তিনি। জুয়েল আইচের হাতে ঝকঝকে বৈদ্যুতিক করাত। এরপর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না
করে প্রিয়তমা স্ত্রীর ঘাড় বরাবর নামিয়ে আনলেন ধারালো করাত। আতঙ্কে শিউরে
উঠলো দর্শক। কিন্তু না, কোন দুর্ঘটনাই ঘটলো না। অক্ষতই রইলেন বিপাশা।
হাসিমুখে গিলোটিন থেকে ঘাড় সরিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ালেন। অভিভূত
দর্শক দেখলো গিলোটিনের ওপর আর নিচের ফুটোয় রাখা গাজরগুলো করাত-কাটা হয়ে
ছড়িয়ে পড়েছে। এই হলেন আমাদের প্রিয় জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, যিনি বিনোদন থেকে
জাদুকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সুপরিচিত ও
সম্মানিত করেছেন। তিনি কেবল জাদুশিল্পী বা বাঁশিবাদকই নন, একাধারে
চিত্রশিল্পী-সমাজসেবী এবং একাত্তরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যার বিভিন্ন
কর্মকা- আমাদের দেশের সবক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক প্রভাব রেখে চলেছে অনেক দিন
ধরেই। জুয়েল আইচের জন্ম পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সমদেকাঠি গ্রামে।
তার বাবা বি. কে আইচ। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা ছিলেন গৃহিণী। তারা ৬
বোন ৩ ভাই। মেধাবী জুয়েল আইচ স্কুল জীবন থেকে সব সময় ভাল ফলাফল করায় সচেষ্ট
থাকতেন। আর ভাল ফলাফল করেছেনও সব সময়। তার মতে, এর পেছনের কারণটা হলো,
ছোটবেলা থেকেই তিনি আশপাশের মানুষের হাসিমুখ দেখতে ভালবাসেন। ভাল ফলাফল
করলে সবাই খুব খুশি হবে, এটাই ছিল তার ভাল ফলাফল করার চেষ্টার আসল কারণ।
ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষকে মুগ্ধ করতে চাইতেন, এখনও তাই চান। জাদু দেখিয়ে
মানুষকে মুগ্ধ করা যায়। মানুষ মুগ্ধ হবে তার জাদু দেখে। তাই জাদুর প্রতি
তার মারাত্মক ঝোঁক তৈরি হয়। তবে এর আগে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন জুয়েল
আইচ। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ তৈরি হয় ছবি আঁকার প্রতি। তার বাবার শখ ছিল
ছবি আঁকা। বাবার দেখাদেখি তিনিও ছবি আঁকা শুরু করেন। গ্রামের মেলায় তিনি
দেখেন এক বাঁশিওয়ালাকে, বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে বাঁশি বিক্রি করছেন। তারও
ইচ্ছা হলো বাঁশিওয়ালা হওয়ার। শুরু হয় তার বাঁশি বাজানোর কসরত। একবার তাদের
গ্রামে বেদেবহর এসেছিল। বেদে দলের কাছ থেকেই তিনি প্রথম জাদু দেখেন। দারুণ
চমৎকৃত হয়েছিলেন। জাদুর প্রতি তার আকর্ষণটা তৈরি হয় আরও অনেক পরে। সে সময়
বানারীপাড়া সার্কাস দলের এক জাদুকরের জাদু দেখে তিনি ব্যাপক বিস্মিত
হয়েছিলেন। সেই জাদুকর একটা ছেলের গলা কেটে ফেলছে, আবার জাদু দিয়ে তা জোড়া
লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই জাদু দেখেই ঠিক করেন, তিনিও জাদু শিখবেন। ছোটবেলায়
রূপকথা পড়তে খুব পছন্দ করতেন তিনি। বন্দে আলী মিয়ার রূপকথা ছিল তার খুব
প্রিয়। স্বপ্নে প্রায় দেখতেন, তিনি বন্দে আলী মিয়ার রূপকথার জাদুর দেশে চলে
গেছেন। জাদু দিয়ে পাল্টে দিচ্ছেন সবকিছু। জাদুর প্রতি তার আকর্ষণটা
উন্মাদনায় পরিণত হয় কলেজে ওঠার পর, সিরাজগঞ্জের জাদুকর আবদুর রশিদের জাদু
দেখে। সচেতনভাবে একজন জাদুশিল্পী হওয়ার স্বপ্নটা তখন থেকেই দেখতে শুরু
করেন। জাদু সম্পর্কিত অসংখ্য বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে শুরু করেন জাদুর চর্চা।
তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে সেই স্বপ্ন নিয়ে তখন বেশি দূর যেতে
দেয়নি। একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে
দিয়েছিল। জুয়েল আইচের পরিবারের সদস্যরা প্রাণ নিয়ে কোনভাবে পালিয়ে বাঁচেন।
জাদুর যেসব যন্ত্রপাতি তিনি তৈরি করেছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা সেসব পুড়িয়ে
ছারখার করে দেয়। এরপর জুয়েল আইচ চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। তিনি ৯ নম্বর
সেক্টরের হয়ে যুদ্ধ করেন। তার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। ছোট বড়
অনেক অপারেশনেই অংশ নিয়েছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেশা হিসেবে তিনি
শিক্ষকতা বেছে নেন। পিরোজপুরেরই একটি স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু
হয়েছিল তার। শিক্ষকতার পাশাপাশি আবার টুকটাক করে জাদুর যন্ত্রপাতি তৈরি করা
শুরু করেন তিনি। স্বাধীনতার বছর দুয়েক পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের
একটা হকি ম্যাচ হয়েছিল। খেলায় পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ ১৭ গোলে হারে। এই
ঘটনাটি জুয়েল আইচকে প্রচ- নাড়া দেয়। যাদের আমরা যুদ্ধ করে হারিয়েছি, তাদের
কাছে এত বড় পরাজয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। তখনই তার মনের
মধ্যে একটা আলাদা জেদ তৈরি হয়। তিনি ঠিক করেন তাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে
বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ে। আমাদের যে হাজার বছরের ঝলমলে ঐতিহ্য আছে,
তা পৃথিবীর মানুষকে জানাতে হবে। আমাদের বাংলা অঞ্চলে জাদু এমন একটি শিল্প,
যা হাজার বছরের পুরনো। এ ভাবনা থেকেই জুয়েল আইচ পেশাদার জাদুশিল্পী হওয়ার
প্রেরণা পান। ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে জাদু দেখালেও তিনি প্রথম
আনুষ্ঠানিকভাবে পাবলিক শো করেন ১৯৭৩ সালে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি থানার
স্বরূপা সিনেমা হলে। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় শো করা শুরু করেন। ঢাকায়
প্রথম শো করেন ১৯৭৬ সালে। এর বছরখানেক পরই শুর হয় বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে
নিয়মিত জাদু দেখানো। আর এরপরের গল্প শুধুই সাফল্যের পথ ধরে সামনে এগিয়ে
যাওয়া। সেই পথে হেঁটেই দেশ-বিদেশে চমকে ভরা অসাধারণ সব জাদু দেখিয়ে জুয়েল
আইচ আজ তাবৎ বিশ্বের এক নন্দিত মানুষ, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। কোটি মানুষের
ভালবাসায় সিক্ত হয়ে যিনি তার জাদুর পসরা নিয়ে এখনও দাপটের সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে
প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন নিজের দেশমাতৃকার।
No comments