অটোরিকশা বরাদ্দ নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য: দাম ৪ লাখ, নিবন্ধন খরচ ১০ লাখ টাকা by আনোয়ার হোসেন
রাজধানী
ঢাকায় নতুন সিএনজিচালিত অটোরিকশা বরাদ্দ দিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন
কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে এই বরাদ্দ নিয়ে অবৈধ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অটোরিকশা বরাদ্দ পেয়ে অনেকেই প্রতিটি ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি করছেন। অথচ শোরুমে আমদানি করা একটি অটোরিকশার দাম ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এই বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে শুধু একটি ‘নিবন্ধন নম্বর’ যুক্ত করার জন্য। কিন্তু নিবন্ধন নম্বরের জন্য সরকারিভাবে দিতে হয় মাত্র ১৩ হাজার টাকা।
অটোরিকশার নীতিমালা অনুযায়ী, একজনের নামে নিবন্ধন নেওয়ার পর তা বিক্রি করা যায় না। এভাবে হাত বদল হয়ে দাম বাড়ার কারণে ২০০২ সাল থেকে অটোরিকশা খাতে নৈরাজ্য চলছে। সে সময় পৌনে দুই লাখ টাকার অটোরিকশা নিবন্ধন নম্বর যুক্ত হওয়ার পর পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এই বাণিজ্য ঠেকাতে নিবন্ধনের অন্তত দুই বছর আগে হাতবদল নিষিদ্ধ করার শর্ত নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০০৪ সালে ঢাকায় নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বিআরটিএ। এর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুকের ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের মধ্যে নতুন অটোরিকশা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ যিনি একটি মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুকের প্রকৃত মালিক, তিনি একটি নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন পাবেন।
অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম ভেঙে হাতবদলের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মালিক নির্ধারণ এবং মিশুকের পরিবর্তে অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়ায়ও মোটরযান বিধির লঙ্ঘন করা হয়েছে। যানবাহন বিক্রি হলে ১৪ দিনের মধ্যে মালিকানা বদলের লক্ষ্যে যাবতীয় ফিসহ দলিলাদি বিআরটিএতে জমা দিতে হয়। ফিটনেস সনদ হালনাগাদ থাকলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা বদলি সম্পন্ন হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে নতুন অটোরিকশা দেওয়া হচ্ছে ১৫ বছরের পুরোনো দলিলের ওপর ভিত্তি করে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয়েছে গত মার্চ থেকে। এ পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রায় সাড়ে ৩০০ নিবন্ধন হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই গেছে ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতাদের নামে। বর্তমানে ঢাকায় যে ১১ হাজার অটোরিকশা চলে, সেগুলোর মালিকদের একাধিক সংগঠনের মধ্যে এটি অন্যতম। মগবাজার এলাকার কিছু অটোরিকশার শোরুম মালিকও পেয়েছেন কিছু নতুন অটোরিকশা।
১৯৯৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এমন মিশুকের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অটোরিকশা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই করে দেড় হাজার আবেদনকারীর তালিকা তৈরি করে বিআরটিএ। অবশ্য এই তালিকায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন মাত্র ৭৭ জন। বাকিরা সবাই ১৫ বছরের পুরোনো দলিলে অ্যাফিডেভিট মূলে মালিকানা দাবি করে আবেদন করেছিলেন।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০২টি অটোরিকশা বরাদ্দের লক্ষ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এভাবে নীতিমালা ভেঙে অটোরিকশা বরাদ্দ এবং তা আইন অমান্য করে বিক্রির মাধ্যমে দেড় হাজার অটোরিকশা থেকে ১৩৫ থেকে ১৫০ কোটি টাকা বাণিজ্যের পরিকল্পনা নিয়েছে চক্রটি। এই চক্রে বিআরটিএর কর্মকর্তা, অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা দালাল চক্র জড়িয়ে পড়েছে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন যে অটোচালকেরা ইচ্ছেমতো গন্তব্যে যাত্রী বহন ও ভাড়া আদায় করছেন, এর মূল কারণ বরাদ্দ-প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও বেশি দামে হাতবদল। এবার একই পথে চলছে সবকিছু।
সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্যই নতুন অটোরিকশা নামানো হচ্ছে। কিন্তু বেশি দামে হাত বদল করলে তো যাত্রীরা সেই সেবা পাবে না। হাতবদল এবং ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে কি না, তা তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
কীভাবে হাতবদল: বিআরটিএতে রক্ষিত দলিল অনুসারে ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৭৫ অটোরিকশার মালিক ভাটারার জসিম উদ্দিন। কিন্তু এখন এটি চালাচ্ছেন মোহাম্মদপুরের জাবেদ নামের এক ব্যক্তি। গত মাসে ১৩ লাখ টাকায় মগবাজারের দিগন্ত অটো নামে একটি শোরুম থেকে তিনি এটি কিনেছেন। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করেছে দিগন্ত অটো।
নতুন অটোরিকশা কেনার আগ্রহ দেখিয়ে জাবেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বিক্রেতা মালিকানা বদলির দলিলে সই দিয়ে রেখেছেন। তবে বিআরটিএতে জমা দেওয়ার শর্ত দিয়েছেন দুই বছর পর।
জানতে চাইলে দিগন্ত অটোর মালিক গৌতম দাস বলেন, অন্যের অটোরিকশা বিক্রির মধ্যস্থতা করে তিনি দুই থেকে চার হাজার টাকা পান।
একাধিক ক্রেতা জানান, নতুন অটোরিকশা বিক্রি হচ্ছে দুই পদ্ধতিতে। কিছু মালিক নিজে করছেন। তবে তা পরিচিত জন ও আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর অপরিচিতদের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে শোরুমের মাধ্যমে।
ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৮০ নম্বরের অটোরিকশাটির নিবন্ধন হয় আবদুল কুদ্দুস মণ্ডলের নামে। গত মাসে সেটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনে নেন মোহাম্মদপুরের আবদুল কাদির। এখানেও মালিকানা বদলির দলিলে বিক্রেতার সই রেখে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আবদুল কাদিরের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, তাঁর পুরোনো ১০টা অটোরিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচল করছে। মগবাজারের হৃদয় অটো থেকে তিনি নতুনটি কিনেছেন। হৃদয় অটোই বিক্রেতার সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
আর হৃদয় অটোর মালিক জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তিনি এভাবে বিক্রি করেননি। আশায় আছেন, ভবিষ্যতে নিজেই অটোরিকশার নিবন্ধন পাবেন এবং বিক্রি করবেন।
যাত্রাবাড়ী এলাকার শামীম ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৩৮ নম্বরের অটোরিকশা চালাচ্ছেন। অথচ বিআরটিএর নথি বলছে, এটির মালিক জিগাতলার এস এম জিয়া উদ্দিন কায়সার।
পরিচয় গোপন করে জানতে চাইলে শামীম বলেন, পুরোনো অটোরিকশা তাঁরও আছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি বলে নতুন অটোরিকশাটি এক দালালের মাধ্যমে গত মাসে কিনেছেন ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।
মূল সুবিধাভোগী চার পক্ষ: বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মিশুকের বয়স হবে নয় বছর। এই সিদ্ধান্তের কারণে ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় তিন হাজার মিশুকের প্রায় সব কটিই ঢাকার বাইরে চলে যায়। নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে মিশুক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নাম দিয়ে নতুন অটোরিকশা দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে একটি পক্ষ। এ পরিস্থিতিতে সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতাসহ অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুক ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করা শুরু করে। নতুন অটোরিকশা পেয়ে বিক্রি করে দেওয়ার মূল সুবিধাভোগী এসব মালিকই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নিবন্ধন হওয়া অটোরিকশার মধ্যে মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক মোশাররফ হোসেনসহ সমিতির নেতা ও তাঁদের মনোনীতরা ১৫০টি অটোরিকশা পেয়েছেন। পরের ধাপে অটোরিকশার নিবন্ধনের যে তালিকা হয়েছে, সেখানেও এই নেতাদের নামেই বেশি।
জানতে চাইলে বরকত উল্লাহ দাবি করেন, তিনি ছয়টি অটোরিকশা পেয়েছেন, সেগুলো রাস্তায় নেমেছে। তবে কেউ কেউ বেচা-বিক্রি করছে। ঘুষ-কমিশন দেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আংশিক সত্য থাকতে পারে। সবকিছু যদি আইনে চলত, তাহলে দেশ অনেক এগিয়ে থাকত।’
আর মিশুকের বদলে অটোরিকশা বরাদ্দের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ভূমিকা রাখে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান ও সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএতে অনুষ্ঠিত অটোরিকশা বরাদ্দ-সংক্রান্ত একাধিক বৈঠকে ওসমান আলীকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এ জন্যই ফেডারেশনকে প্রতিটি অটোরিকশার বিপরীতে ৬০ হাজার টাকা কমিশন দেওয়া হচ্ছে বলে একাধিক মালিক জানান।
জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মিশুকের চালকদের স্বার্থে ফেডারেশন যুক্ত হয়েছিল। অটোরিকশা বরাদ্দ-প্রক্রিয়া নিয়মানুযায়ী হওয়া উচিত। আর ফেডারেশনের আয়ের উৎস শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা। অটোরিকশা বরাদ্দ থেকে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ নাম ভাঙিয়ে করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী হওয়ার পর বহু লোক ভুয়া পরিচয় দিয়ে সুযোগ নিতে আসে। কয়েকটা ঘটনা তাঁর কাছে ধরাও পড়েছে। এখানেও এমন কিছু ঘটছে কি না, খতিয়ে দেখা হবে।
ওসমান আলী বলেন, অটোরিকশা খাতে দুর্নীতি হয় না, সেটা বলা যাবে না। তবে তিনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। ফেডারেশনের নাম ভেঙে কেউ কমিশন নিতে পারে। এমন উদাহরণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিআরটিএর কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকা দুই ভাগ হচ্ছে। মালিকানা বদলি এবং অটোরিকশার নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ভাগ ৪০ হাজার। আর মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুক কেটে অকেজো করার জন্য বিআরটিএর আরেকটি কমিটি আছে। তাদেরও ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। কারণ, কমিটি পুরোনো মিশুক কেটে অকেজো না করেই প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, শ্রমিক ফেডারেশনের কমিশন এবং বিআরটিএর কর্মকর্তা ও অকেজো করার কমিটির ঘুষের ভাগ সংগ্রহ করেন মিশুক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি সারোয়ার হোসেন। এই কমিটির নেতারাও কমিশন পান।
জানতে চাইলে সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘সরকারি ফি ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দেওয়া হচ্ছে। তবে অদৃশ্য কিছু টাকা বিআরটিএর কর্মকর্তাসহ অন্যদের দিতে হচ্ছে। তবে তা পাঁচ-দশ হাজারের বেশি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অটোরিকশা বরাদ্দ পেয়ে অনেকেই প্রতিটি ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকায় বিক্রি করছেন। অথচ শোরুমে আমদানি করা একটি অটোরিকশার দাম ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এই বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে শুধু একটি ‘নিবন্ধন নম্বর’ যুক্ত করার জন্য। কিন্তু নিবন্ধন নম্বরের জন্য সরকারিভাবে দিতে হয় মাত্র ১৩ হাজার টাকা।
অটোরিকশার নীতিমালা অনুযায়ী, একজনের নামে নিবন্ধন নেওয়ার পর তা বিক্রি করা যায় না। এভাবে হাত বদল হয়ে দাম বাড়ার কারণে ২০০২ সাল থেকে অটোরিকশা খাতে নৈরাজ্য চলছে। সে সময় পৌনে দুই লাখ টাকার অটোরিকশা নিবন্ধন নম্বর যুক্ত হওয়ার পর পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এই বাণিজ্য ঠেকাতে নিবন্ধনের অন্তত দুই বছর আগে হাতবদল নিষিদ্ধ করার শর্ত নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০০৪ সালে ঢাকায় নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বিআরটিএ। এর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় চলাচলকারী মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুকের ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের মধ্যে নতুন অটোরিকশা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ যিনি একটি মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুকের প্রকৃত মালিক, তিনি একটি নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন পাবেন।
অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম ভেঙে হাতবদলের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মালিক নির্ধারণ এবং মিশুকের পরিবর্তে অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়ায়ও মোটরযান বিধির লঙ্ঘন করা হয়েছে। যানবাহন বিক্রি হলে ১৪ দিনের মধ্যে মালিকানা বদলের লক্ষ্যে যাবতীয় ফিসহ দলিলাদি বিআরটিএতে জমা দিতে হয়। ফিটনেস সনদ হালনাগাদ থাকলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা বদলি সম্পন্ন হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে নতুন অটোরিকশা দেওয়া হচ্ছে ১৫ বছরের পুরোনো দলিলের ওপর ভিত্তি করে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয়েছে গত মার্চ থেকে। এ পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রায় সাড়ে ৩০০ নিবন্ধন হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই গেছে ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতাদের নামে। বর্তমানে ঢাকায় যে ১১ হাজার অটোরিকশা চলে, সেগুলোর মালিকদের একাধিক সংগঠনের মধ্যে এটি অন্যতম। মগবাজার এলাকার কিছু অটোরিকশার শোরুম মালিকও পেয়েছেন কিছু নতুন অটোরিকশা।
১৯৯৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এমন মিশুকের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অটোরিকশা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই করে দেড় হাজার আবেদনকারীর তালিকা তৈরি করে বিআরটিএ। অবশ্য এই তালিকায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন মাত্র ৭৭ জন। বাকিরা সবাই ১৫ বছরের পুরোনো দলিলে অ্যাফিডেভিট মূলে মালিকানা দাবি করে আবেদন করেছিলেন।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, গত সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০২টি অটোরিকশা বরাদ্দের লক্ষ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এভাবে নীতিমালা ভেঙে অটোরিকশা বরাদ্দ এবং তা আইন অমান্য করে বিক্রির মাধ্যমে দেড় হাজার অটোরিকশা থেকে ১৩৫ থেকে ১৫০ কোটি টাকা বাণিজ্যের পরিকল্পনা নিয়েছে চক্রটি। এই চক্রে বিআরটিএর কর্মকর্তা, অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা দালাল চক্র জড়িয়ে পড়েছে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন যে অটোচালকেরা ইচ্ছেমতো গন্তব্যে যাত্রী বহন ও ভাড়া আদায় করছেন, এর মূল কারণ বরাদ্দ-প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও বেশি দামে হাতবদল। এবার একই পথে চলছে সবকিছু।
সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্যই নতুন অটোরিকশা নামানো হচ্ছে। কিন্তু বেশি দামে হাত বদল করলে তো যাত্রীরা সেই সেবা পাবে না। হাতবদল এবং ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে কি না, তা তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
কীভাবে হাতবদল: বিআরটিএতে রক্ষিত দলিল অনুসারে ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৭৫ অটোরিকশার মালিক ভাটারার জসিম উদ্দিন। কিন্তু এখন এটি চালাচ্ছেন মোহাম্মদপুরের জাবেদ নামের এক ব্যক্তি। গত মাসে ১৩ লাখ টাকায় মগবাজারের দিগন্ত অটো নামে একটি শোরুম থেকে তিনি এটি কিনেছেন। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করেছে দিগন্ত অটো।
নতুন অটোরিকশা কেনার আগ্রহ দেখিয়ে জাবেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বিক্রেতা মালিকানা বদলির দলিলে সই দিয়ে রেখেছেন। তবে বিআরটিএতে জমা দেওয়ার শর্ত দিয়েছেন দুই বছর পর।
জানতে চাইলে দিগন্ত অটোর মালিক গৌতম দাস বলেন, অন্যের অটোরিকশা বিক্রির মধ্যস্থতা করে তিনি দুই থেকে চার হাজার টাকা পান।
একাধিক ক্রেতা জানান, নতুন অটোরিকশা বিক্রি হচ্ছে দুই পদ্ধতিতে। কিছু মালিক নিজে করছেন। তবে তা পরিচিত জন ও আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর অপরিচিতদের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে শোরুমের মাধ্যমে।
ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৮০ নম্বরের অটোরিকশাটির নিবন্ধন হয় আবদুল কুদ্দুস মণ্ডলের নামে। গত মাসে সেটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনে নেন মোহাম্মদপুরের আবদুল কাদির। এখানেও মালিকানা বদলির দলিলে বিক্রেতার সই রেখে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আবদুল কাদিরের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, তাঁর পুরোনো ১০টা অটোরিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচল করছে। মগবাজারের হৃদয় অটো থেকে তিনি নতুনটি কিনেছেন। হৃদয় অটোই বিক্রেতার সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
আর হৃদয় অটোর মালিক জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তিনি এভাবে বিক্রি করেননি। আশায় আছেন, ভবিষ্যতে নিজেই অটোরিকশার নিবন্ধন পাবেন এবং বিক্রি করবেন।
যাত্রাবাড়ী এলাকার শামীম ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৫৫৩৮ নম্বরের অটোরিকশা চালাচ্ছেন। অথচ বিআরটিএর নথি বলছে, এটির মালিক জিগাতলার এস এম জিয়া উদ্দিন কায়সার।
পরিচয় গোপন করে জানতে চাইলে শামীম বলেন, পুরোনো অটোরিকশা তাঁরও আছে। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি বলে নতুন অটোরিকশাটি এক দালালের মাধ্যমে গত মাসে কিনেছেন ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।
মূল সুবিধাভোগী চার পক্ষ: বিআরটিএ সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মিশুকের বয়স হবে নয় বছর। এই সিদ্ধান্তের কারণে ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ প্রায় তিন হাজার মিশুকের প্রায় সব কটিই ঢাকার বাইরে চলে যায়। নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে মিশুক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নাম দিয়ে নতুন অটোরিকশা দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে একটি পক্ষ। এ পরিস্থিতিতে সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতাসহ অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুক ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করা শুরু করে। নতুন অটোরিকশা পেয়ে বিক্রি করে দেওয়ার মূল সুবিধাভোগী এসব মালিকই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নিবন্ধন হওয়া অটোরিকশার মধ্যে মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক মোশাররফ হোসেনসহ সমিতির নেতা ও তাঁদের মনোনীতরা ১৫০টি অটোরিকশা পেয়েছেন। পরের ধাপে অটোরিকশার নিবন্ধনের যে তালিকা হয়েছে, সেখানেও এই নেতাদের নামেই বেশি।
জানতে চাইলে বরকত উল্লাহ দাবি করেন, তিনি ছয়টি অটোরিকশা পেয়েছেন, সেগুলো রাস্তায় নেমেছে। তবে কেউ কেউ বেচা-বিক্রি করছে। ঘুষ-কমিশন দেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আংশিক সত্য থাকতে পারে। সবকিছু যদি আইনে চলত, তাহলে দেশ অনেক এগিয়ে থাকত।’
আর মিশুকের বদলে অটোরিকশা বরাদ্দের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ভূমিকা রাখে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান ও সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএতে অনুষ্ঠিত অটোরিকশা বরাদ্দ-সংক্রান্ত একাধিক বৈঠকে ওসমান আলীকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এ জন্যই ফেডারেশনকে প্রতিটি অটোরিকশার বিপরীতে ৬০ হাজার টাকা কমিশন দেওয়া হচ্ছে বলে একাধিক মালিক জানান।
জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মিশুকের চালকদের স্বার্থে ফেডারেশন যুক্ত হয়েছিল। অটোরিকশা বরাদ্দ-প্রক্রিয়া নিয়মানুযায়ী হওয়া উচিত। আর ফেডারেশনের আয়ের উৎস শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা। অটোরিকশা বরাদ্দ থেকে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ নাম ভাঙিয়ে করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী হওয়ার পর বহু লোক ভুয়া পরিচয় দিয়ে সুযোগ নিতে আসে। কয়েকটা ঘটনা তাঁর কাছে ধরাও পড়েছে। এখানেও এমন কিছু ঘটছে কি না, খতিয়ে দেখা হবে।
ওসমান আলী বলেন, অটোরিকশা খাতে দুর্নীতি হয় না, সেটা বলা যাবে না। তবে তিনি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। ফেডারেশনের নাম ভেঙে কেউ কমিশন নিতে পারে। এমন উদাহরণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিআরটিএর কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকা দুই ভাগ হচ্ছে। মালিকানা বদলি এবং অটোরিকশার নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের ভাগ ৪০ হাজার। আর মেয়াদোত্তীর্ণ মিশুক কেটে অকেজো করার জন্য বিআরটিএর আরেকটি কমিটি আছে। তাদেরও ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। কারণ, কমিটি পুরোনো মিশুক কেটে অকেজো না করেই প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, শ্রমিক ফেডারেশনের কমিশন এবং বিআরটিএর কর্মকর্তা ও অকেজো করার কমিটির ঘুষের ভাগ সংগ্রহ করেন মিশুক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি সারোয়ার হোসেন। এই কমিটির নেতারাও কমিশন পান।
জানতে চাইলে সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘সরকারি ফি ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দেওয়া হচ্ছে। তবে অদৃশ্য কিছু টাকা বিআরটিএর কর্মকর্তাসহ অন্যদের দিতে হচ্ছে। তবে তা পাঁচ-দশ হাজারের বেশি না।’
No comments