যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের অন্ধবন্ধনের রহস্য
ফিলিস্তিন-শাসিত গাজায় ইসরায়েল রক্তগঙ্গা
বইয়ে দিচ্ছে। আর কথিত বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র বিবেকের মাথা খেয়ে অন্ধভাবে
ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গাজা থেকে হামাস রকেট ছুড়ছে—এই অজুহাত তুলে
গত ৮ জুলাই ‘অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ’ নামের শায়েস্তামূলক সামরিক অভিযান শুরু
করে ইসরায়েলি বাহিনী।
গত ২৮ দিনে ইসরায়েলের বর্বর হামলায় এক হাজার ৮২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে নয় হাজারের বেশি। তাদের অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে অনেক নারী ও শিশু রয়েছে। এ ছাড়া লাখো ফিলিস্তিনি হয়েছে বাস্তুচ্যুত।
প্রায় একতরফা এই হামলায় ফিলিস্তিনিদের হতাহতের সংখ্যা পাহাড়চূড়া স্পর্শ করায় বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা—সর্বত্র নিন্দার ঝড়। গাজাবাসীর সমর্থনে এবং ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে দেশে দেশে চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। এমনকি অথর্ব জাতিসংঘও হাঁকডাক মারছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুপ।
গাজায় হতাহতের ঘটনায় ওয়াশিংটন নরম সুরে ‘উদ্বিগ্ন’। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের অজুহাতে গাজায় স্থল ও আকাশ পথে চালানো নৃশংস সামরিক অভিযানের সমর্থনে ওয়াশিংটনের কণ্ঠ ঝাঁজালো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলবিরোধী যেকোনো প্রস্তাবে ভেটো দিতে তারা একপায়ে খাড়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত তেল আবিবকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে ওয়াশিংটন। শুধু তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের এই মিত্রটিকে নিয়মিত সর্বাধুনিক অস্ত্রও সরবরাহ করে আসছে মার্কিন প্রশাসন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস ওয়াশিংটনে ইহুদি নেতাদের বলেছেন, ‘ইসরায়েলের সমর্থন পেয়েছে আমেরিকা। আমাদের মধ্যে সব সময় সত্যিকারের বিশেষ সম্পর্ক আছে।’
ইসরায়েল প্রশ্নে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারসহ অনেক আইনপ্রণেতার মুখেও একই সুর। কংগ্রেসম্যান কেভিন ম্যাকার্থি তো বলেই দিয়েছেন, ‘ইসরায়েলে যদি একটি রকেট পড়ে, তাহলে তা আমেরিকায়ও পড়ে।’
বিভিন্ন বিষয়ে মার্কিন সিনেটরদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু একটি ক্ষেত্রে। ইসরায়েল প্রশ্নে সব সিনেটররা এক জোট। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের মধ্যকার এই অন্ধবন্ধনের রহস্য-জট খুলতে গিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই দেশের মধ্যকার নীতি ও মূল্যবোধের মিল, ভূ-রাজনীতি, ভোটব্যাংক, ওয়াশিংটনে ইসরায়েলপন্থী শক্তিশালী লবি প্রভৃতি।
স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রথম দিকে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক খুব একটা মসৃণ ছিল না। ১৯৫৬ সালে মিসরে ইসরায়েলের আগ্রাসন সমর্থন করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ষাটের দশক পর্যন্ত তেল আবিবের কাছে অস্ত্রের বড় কোনো চালান বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানায় ওয়াশিংটন।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক মাইকেল বারনেটের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধপূর্ণ মনোভাবের প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটন-তেল আবিবের মধ্যকার সম্পর্কের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৬৭ সালের পর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই দশকের পর দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে কাঙ্ক্ষিত শান্তিপ্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশকারায় ইসরায়েলের একগুঁয়েমি ও নিপীড়নবাদী আগ্রাসী মনোভাব অঞ্চলটিকে সব সময় উত্তপ্ত করে রেখেছে।
১৯৪৮ সাল থেকে অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট তেল আবিবের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বিশেষ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন। তবে ইহুদিদের আন্তর্জাতিক সংগঠন র্যাবাইনিকল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম গারশন মনে করেন, এই সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটেছে ১৬৫৪ সালে। তখন ইহুদিরা আমেরিকায় আসে এবং বিপ্লবে সমর্থন দেয়।
গারশন বলেন, অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইহুদি রাষ্ট্রটি তাঁদের আদর্শ ও মূল্যবোধ গ্রহণ করছে। মার্কিন খ্রিষ্টানরা ইসরায়েলকে বড় ধরনের সমর্থন দিয়ে থাকে। তাদের যুক্তি, পবিত্র ভূমি ইহুদি ধর্মেরই অংশ।
নিউইয়র্ক ডিভিনিটি স্কুলের প্রেসিডেন্ট পাস্তর পল দে ভিরিজের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র দেশ, যেখানে খ্রিষ্টানরা নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, ‘ইসরায়েলের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব।’
অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা তাঁদের ভোটব্যাংকের কথা বিবেচনা করে ইসরায়েলের প্রতি তাঁদের অন্ধ সমর্থন প্রকাশ্যেই অব্যাহত রাখেন। এসব হিসাব-নিকাশের বাইরে, ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের শক্তিশালী লবি রয়েছে। মার্কিন প্রশাসনকে তেল আবিবের পক্ষে নিতে তারা সদা তত্পর।
No comments