পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘হাইজ্যাকড’! by মহিউদ্দিন আহমদ
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় মনে হচ্ছে, যে
কেউ এখন কূটনীতিবিদ হতে পারেন, বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া
উচিত তা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন। বাংলাদেশে মনে হয় চাষবাস,
দোকানদারি, কূটনীতি—যেকোনো পেশা এবং ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ করতে পারে।
৩৪ বছরের ফরেন সার্ভিসে কাজ করার সময় এমন অনেক উদাহরণ আমি দেখেছি। এখনো
দেখে চলেছি। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় আমাদের কিছু নেতা-নেত্রীর কথাবার্তায়
ওপরের কথাগুলো বলতে হলো।
বাংলাদেশে পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত পেশাদার কূটনীতিবিদ মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট গত ১৮ জুলাই সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির শুনানিতে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনে জরুরি ভিত্তিতে সংলাপ দরকার। গ্রামীণ ব্যাংক, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার নিয়েও তিনি এই শুনানিতে মার্কিন সরকারের নীতি তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথাও বলেছেন। কিন্তু সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-নেতা এমন খেপেছেন যে প্রকাশ্যে বার্নিকাটকে তুলাধোনা করা শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী কূটনৈতিক শিষ্টাচারও মানছেন না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইনকানুনে মার্কিন সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটি ‘কনফার্ম’ করলেই প্রেসিডেন্ট ওবামার এই মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে, তারপরই তিনি বাংলাদেশে আসতে পারবেন।
বার্নিকাট যে কথাগুলো বলেছেন, তার প্রায় সব তো সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও বাংলাদেশ সফরে এসে আড়াই বছর আগে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতা–মন্ত্রীকে বলে গিয়েছেন, বলে গিয়েছেন সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট রবার্ট ব্লেক এবং এখন বলছেন তাঁর উত্তরসূরি নিশা দেশাই বিসওয়াল। তো বার্নিকাট কী অপরাধটি করলেন? তিনি তো তাঁর সরকারের কথাই বলবেন। সেই কথা আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য, শ্রুতিমধুর না-ও হতে পারে।
আমাদের মন্ত্রীরা ঝাড়ছেন বার্নিকাটকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জিএসপি-সুবিধা আবার চালু করার জন্য তদবিরও করে চলেছেন। অনুনয়-বিনয়ও চলছে। আবার ঢাকায় ফিরে এসে তিনি রাজনৈতিক কারণে জিএসপি–সুবিধা বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগও করেছেন। তো সরকারের কি কোনো ‘ইউনিফর্ম’ নীতি নেই? একেক মন্ত্রী একেক কথা বলে যাবেন? তাঁরা কি এমনটি করতে পারেন? আমাদের মন্ত্রীদের জানা দরকার, পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীরই কথা বলা উচিত। তা ছাড়া সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কেউ প্রকাশ্যে আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক কিছু বলতে পারেন না। মনে আছে, আফগানিস্তানে যখন হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন, সেই অনুষ্ঠানে উজবেকিস্তানে আমাদের রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত থেকে এই নতুন সরকারকে সমর্থন জানালেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। কিন্তু হামিদ কারজাই সরকারকে প্রকাশ্যে নিন্দা জানালেন খালেদা জিয়ার মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী। নিজামীদের সমর্থন-দোয়া সব সময় তালেবানের পক্ষেই ছিল। সুতরাং কারজাইকে পছন্দ করবে না জামায়াত, তা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকাশ্যে সমালোচনা?
সে সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠে কূটনৈতিক রীতিনীতি এবং শিষ্টাচার সম্পর্কে কিছু সবক দিয়েছিলাম সরকারকে। তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান আমার ওই লেখার তারিফ করে বলেছিলেন, পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে মন্ত্রীদের সংযত করতে লেখাটি তাঁর কাজে লেগেছিল। সবার জানা উচিত, যা বলার কূটনৈতিক ভাষায় ও চ্যানেলেই তা বলতে হবে। আমরা আমেরিকা ও ইউরোপ নই যে রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুমকি-হুংকার দিতে পারি।
তারপর বার্নিকাট বা আমেরিকাকে যদি এতই অপছন্দ হয়, তাদের রাষ্ট্রদূতকে আমাদের দেশে আসতে না দিলেই হয়। আমাদের কিছু নেতা-মন্ত্রীর জানা নেই যে কোনো একজনকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাতে হলে এই মনোনীত ব্যক্তির পক্ষেÿ ওই দেশের পূর্ব অনুমতি লাগে। প্রধানমন্ত্রীর অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ জিয়াউদ্দিন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন আমাদের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে, তাঁর সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তের কথা তো জানি চার মাস আগে। কিন্তু সরকারি ঘোষণার দেরিটা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দিতে এত সময় নিয়েছে। ৩৫ বছর আগে একবার, পাঁচ বছর আগে আরেকবার, আবার সৌদি আরব আমাদের দুজন মনোনীত রাষ্ট্রদূতকে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেয়নি বলে তাঁরা সৌদি আরবে আমাদের রাষ্ট্রদূত হতে পারেননি। পরে তাঁদের অন্য জায়গায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরাও অন্য দুজনকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন দিই। তখন আর তারা আপত্তি তোলেনি।
তো যদি মেরুদণ্ড শক্ত থাকে, আমরাও বার্নিকাটকে ‘এগ্রেমো’ না দিলেই পারি। অথবা আমেরিকার নীতির প্রতিবাদে আমরা ওয়াশিংটনে আমাদের জিয়াউদ্দিনকে না পাঠালেও পারি। রাষ্ট্রদূত না পাঠিয়ে ওই ‘পোস্ট’ খালি রাখাও একধরনের কূটনৈতিক প্রতিবাদ।
বাংলাদেশে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আল খতিব যখন বাড়াবাড়ি শুরু করলেন, তখন তাঁর প্রত্যাহার চাইলেন জেনারেল এরশাদের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ আর এস দোহা।সৌদি সরকার আমাদের দাবির মুখে তাঁকে নীরবে প্রত্যাহার করে নিল ঠিকই, কিন্তু প্রতিবাদে তারাও এক বছর কোনো রাষ্ট্রদূত পাঠাল না। অনেক চেষ্টা-তদবির এবং দীর্ঘ বিরতির পর আবদুল লতিফ আল মায়মানি দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় এলেন।
দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং সম্পর্কোন্নয়ন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তো নেতা-মন্ত্রীদের এমন আস্ফালনে সম্পর্কের কি উন্নতি ঘটছে না অবনতি, এর দায় তো পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহন করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা দেশের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল গাজায় হামলা চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। ইরাক নিরাপত্তা পরিষদের মাত্র দুটো সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছিল বলে দেশটিতে অবৈধ হামলা চালায়, দেশটিকে গুঁড়িয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তার বিপরীতে নিরাপত্তা পরিষদের ৬৭টি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল, কিন্তু তার পরও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইসরায়েলকে আগের চেয়ে বেশি বেপরোয়া সন্ত্রাসী করে তুলেছে এই একই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের এমন গণহত্যায় চুপ থাকে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু এসব কারণে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জানাতে পারি। কিন্তু বার্নিকাটের বিরুদ্ধে আক্রোশ জাহির করা তো যৌক্তিক নয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, কয়েক দিন আগে ১৪ দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গাজার মানুষজনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে সেখানে তারা প্রতিনিধিদল পাঠাবে। তাদের এই অনুভূতি বাংলাদেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষেরই। কিন্তু প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কিন্তু এত বড় বড় নেতা বুঝলেন না যে গাজায় কোনো মানুষই এখন নিরাপদ নয়। গাজার মানুষজন এই জায়গা থেকে ওই জায়গায়, এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ছুটছে প্রাণ বাঁচাতে। ২০০৮ থেকে অবরুদ্ধ গাজায় কেউ ঢুকতে পারছে না, এখান থেকে কেউ বেরও হতে পারছে না, জাতিসংঘের কথাও শুনছে না ইসরায়েলের হামলাকারীরা। এমনকি সেখানে ওষুধপথ্য যেতে দিচ্ছে না তারা। এ ধরেনর অনিরাপদ জায়গা থেকে আমাদের দূতাবাসগুলোর একটি রুটিন দায়িত্ব থাকে আমাদের লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় নেওয়া বা দেশে ফেরত পাঠানো। লিবিয়া ও ইরাকে আমরা এমনটিই করেছি। ভারতসহ অনেক দেশ এমন করছে।
এসবের বিপরীতে এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলা হয়েছে গাজায় ১৪ দলের প্রতিনিধিদল পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। তাঁরা নেতা, বড় বড় নেতা, দিন-দুনিয়া সম্পর্কে তাঁদের সাধারণ ধারণা ‘কমনসেন্স’ও আছে বলে তো মনে হয় না। অবাক লাগছে যে ১৪ দলের এই সভায় মাহমুদ আলী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতিতে এমন একটি সিদ্ধান্ত কীভাবে গৃহীত হতে পারল? বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি সমস্যা, অভিজ্ঞ কূটনীতিক হলেও মন্ত্রী হিসেবে তিনি জুনিয়র। সে জন্য বোধ হয় তিনি সিনিয়রদের সামনে স্পষ্ট কথা বলতে পারছেন না।
তৃতীয় এবং শেষ ঘটনাটি হচ্ছে, ১ আগস্ট থেকে শোকের মাস শুরু হয়েছে। এই মাসের শুরুর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেছেন, জাতিসংঘের উচিত বঙ্গবন্ধুর পলাতক হত্যাকারীদের ধরে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো। তো জাতিসংঘ যে এমন দায়িত্বও পালন করে, তা এই নেতার কাছেই জানলাম।
এই নেতা এখন মন্ত্রী নন, তবে আগে ছিলেন। এখনো তিনি জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে প্রায়ই হুমকি দিয়ে থাকেন। এই নেতাকে বলি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয় কয়েক বছর আগে, পাঁচজনের ক্ষেত্রে রায় কার্যকরও হয়েছে। অন্য পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ধরে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য আমরা এত বছরেও জাতিসংঘকে কোনো অনুরোধ করিনি; কারণ, এটা জাতিসংঘের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আর্মি, নেভি এমন ফোর্স নেই যে তারা বিভিন্ন দেশে এদের খুঁজে বেড়াবে, ধরবে আর বাংলাদেশের কাছে সোপর্দ করবে। সেই দায়িত্ব কিছুটা ‘ইন্টারপোল’-এর। কিন্তু ইন্টারপোলও এমন সব ক্ষেত্রে সব সময় সফল হয় না। যেমন হচ্ছে না কলকাতা থেকে নূর হোসেনকে আনতে। সরকারি দলের নেতাদের এমন সব কথায় পলাতক হত্যাকারীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টা হালকা হয়ে যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক বছর ধরেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন হয় না। এই জন্য সরকারের বিভিন্ন জায়গায় অনেক ‘সেল’ এবং ‘সেন্টার’ আছে। তার পরও সবশেষে বলি, বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা দয়া করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করতে দিন।
মহিউদ্দিন আহমদ: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, কলাম লেখক।
mohiudddinahmed1944¦yahoo.com
No comments