ওই অস্ত্রটির প্রয়োগ যেন না হয় by সৈয়দ আবুল মকসুদ
নারী হোক পুরুষ হোক প্রতিটি মানবসন্তান
কোনো না কোনো নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। নারী মাতৃ জাতি। সে হিসেবে
প্রতিটি নারীর শ্লীলতা রক্ষা করা ও নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা
প্রতিটি মানবসন্তানের প্রাথমিক কর্তব্য। কোনো নারীর শ্লীলতাহানি যদি কেউ
নিজে না–ও করে, অন্যকে প্ররোচনা দেয়, তার চেয়ে জঘন্য অপরাধ আর হয় না। তাকে
নরপশু ছাড়া আর কোনো নামে আখ্যায়িত করা যায় না।মানুষের ইতিহাসে সে রকম
এক নরপশুর দেখা পাওয়া গেল গাজায় ইসরায়েলি নারকীয়তার মধ্যে।
অনাদিকাল থেকেই পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ হচ্ছে। এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের, এক জাতির সঙ্গে আরেক জাতির। যুদ্ধে শত্রু বা প্রতিপক্ষকে যতভাবে পরাস্ত করা যায়, সে চেষ্টা উভয় পক্ষই করে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তা না করলে বরং আত্মসমর্পণ করা হয়। যুদ্ধের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতাও চিরকালই হয়, যদিও তা কোনো যুদ্ধনীতিই সমর্থন করে না। যে পক্ষই করুক, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। জঘন্য যুদ্ধাপরাধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দখলদার জাপানি সৈন্যদের জোরপূর্বক যৌনসঙ্গী হতে বাধ্য করা হয়েছিল যেসব কোরীয় নারীকে, যাদের নামকরণ হয়েছিল ‘কমফোর্ট উইমেন’, তাদের বিচারের দাবি এখনো দুই কোরিয়াই করে যাচ্ছে। নির্যাতিতা কমফোর্ট উইমেনের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের বয়স ৯০-এর ওপরে। জাপান সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে, বারবার ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু কোরিয়ার নারীসমাজ ক্ষমা করেনি। কারণ, নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ক্ষমা হয় না।
২০ জুলাই ইসরায়েলের সরকারি রেডিওতে জেরুজালেমের বার ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক মোরদেচাই কেদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ অনেক হয়েছে।এবার বরং গাজায় ঢুকে নারীদের ধর্ষণ করতে শুরু করুক আমাদের সেনারা। কোনো হামাস সদস্যের মা-বোন-স্ত্রীকে যেন বাদ না দেওয়া হয়। জঙ্গিদের ভয় দেখানোর একটাই পথ আছে। যারা আমাদের সেনাদের অপহরণ ও হত্যা করছে, তাদের মা-বোন-কন্যাদের ধর্ষণ করা হলেই তারা চুপ করে যাবে।’ [ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎস]
নারীর বিরুদ্ধে একুশ শতকের এই জঘন্যতম মন্তব্যে সঞ্চালক ওশি হাদার বিব্রতবোধ করেন। তিনি ওই নরপশু মোরদেচাই কেদারকে বলেন, আপনার এমন পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে না আমাদের সেনারা। নির্লজ্জ অধ্যাপক বলেন, তারা কী করবে না করবে সেটা তাদের ব্যাপার। তিনি শুধু হামাসকে শায়েস্তা করার পথ বাতলে দিচ্ছেন।
ইসরায়েলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই আছেন।তাঁরা সংখ্যায় অল্প। প্রতিবাদ হয়েছে তাঁর এই বক্তব্যের। নারী সুরক্ষা সংগঠনগুলোও রাস্তায় নেমেছে।তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। করেনি, কারণ ওই নরপশুর কথায় নেতানিয়াহু সরকার ও ইসরায়েলের শাসকশ্রেণির মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। যুদ্ধ আর কয়েক দিন চললে গাজায় ফিলিস্তিনি মেয়েদের গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা অনিবার্য। তখন ওবামা-ওলাঁদ-ক্যামেরন-ম্যার্কেল বলবেন, আত্মসম্মান রক্ষা ও আত্মতৃপ্তির জন্য ফিলিস্তিনি মেয়েদের ধর্ষণ করার অধিকার ইসরায়েলি সেনাদের রয়েছে। ওরা সব মেয়েকে নয়, বেছে বেছে শুধু হামাস সমর্থকদেরই ধর্ষণ ও হত্যা করেছে।
গত ৮ জুলাই থেকে ইসরায়েল গাজায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। কোনো আন্তর্জাতিক আইনই ইসরায়েলের জন্য প্রযোজ্য নয়। শুরু থেকেই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে অতি আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে ছাদবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ফসফরাস বোমা, ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ বোমা, ডিআইএমই (ডেন্স ইন্টারমেটাল এক্সপ্লোসিভ) প্রভৃতি। গাজায় কর্মরত নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ডাক্তার এরিক ফস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক বোমাও নিক্ষেপ করা হয়েছে। ওই বোমার সিসার আঘাতের ক্ষত থেকে নিরাময়ের অযোগ্য ক্যানসার হয়ে আহত ব্যক্তিরা মারা যাবে। আহতদের মধ্যে রয়েছে শত শত শিশু-কিশোর।
এত রকমের রাসায়নিক মারণাস্ত্র ব্যবহারের পরও, দেড় হাজারের বেশি হত্যার পরও, হাজার হাজার আহত হওয়ার পরও ইসরায়েলি অধ্যাপকের মনে হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের শায়েস্তা করতে ও নির্মূল করতে যথেষ্ট করা হয়নি।নারীর বিরুদ্ধে প্রয়োগের প্রাচীনতম ও ক্ষুদ্রতম অস্ত্রটির কথাই তার মনে পড়েছে।সে অস্ত্র ইসরায়েলি সৈন্যদের লিঙ্গ।তা প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ফিলিস্তিনি শিশুকন্যা, কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধার ওপর।তিন হাজার বছর আগে হজরত মুসা (আ.)-এর জীবৎকালে মানুষের সমাজে যতটা পৈশাচিকতা ছিল, আজ তাঁর আত্মা দেখতে পাচ্ছে তাঁর অনুসারীদের পৈশাচিকতা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, সিআইএ, মোসাদ সম্পর্কে যাঁদের সামান্যতম ধারণা আছে, তাঁরা যা অনুমান করেছিলেন তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।যে ছোট্ট ঘটনার অজুহাতে এই নারকীয়তা, ইসরায়েলের পুলিশ ২৬ জুলাই স্বীকার করেছে, তিন ইসরায়েলি কিশোর অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় হামাসের কেউ জড়িত ছিল না।আগ্রাসনের তিন সপ্তাহ পর ইসরায়েলি পুলিশের মুখপাত্র মিকি রোজেনফিল্ড স্বীকার করেন, যারা তিন কিশোরকে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে হামাসের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ ১২ জুন পশ্চিম তীর থেকে কিশোরদের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে হামাস জড়িত বলে ব্যাপক অভিযোগ তোলা হয়।
সীমাহীন হিংসা ও সর্বৈব বর্বরতার মধ্যেও লক্ষ করি অহিংসা ও সহমর্মিতা দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। মনুষ্যত্বের মৃত্যু নেই। গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরু হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের অনেকে শহরের সেন্ট প্রোফাইরাস চার্চ প্রাঙ্গণে ছুটে যান আশ্রয়ের জন্য। গির্জার খ্রিষ্টান স্বেচ্ছাসেবকেরা তাদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে স্বাগত জানান। ওই গির্জায় আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় পাঁচ শ মুসলমান।গির্জায় থাকা-খাওয়ায় তাঁদের বিশেষ সমস্যা হয়নি।তাঁরা পবিত্র রমজান মাসের রোজাও রেখেছেন এবং নামাজও পড়েছেন গির্জাতেই।বাস্তুচ্যুতদের একজন বলেন, গির্জার যাজক ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী তাঁদের মুসলিম অতিথিদের ধর্মকর্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। স্থানীয় খ্রিষ্টানরা রোজা না রাখলেও দিনের বেলা প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া এড়িয়ে চলেছেন।
ঘটনাটি ছোট নয়। ধর্মোন্মত্ততার পৃথিবীতে এই দৃষ্টান্তের মূল্য বিরাট। মাহমুদ খালাফ নামের এক শরণার্থী ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘খ্রিষ্টানরা আমাদের ভাই হয়ে গেছেন। গত রাতে গির্জার ভেতরেই জামাতে আমরা তারাবির নামাজ আদায় করেছি।’
তরুণ পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের যে যুদ্ধ তা ইহুদি-মুসলমানের লড়াই নয়। জায়নবাদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের মানুষের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। বৃহত্তর ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দেড় হাজার বছর খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম যে দুই মহান ধর্মমত, তা কোনো মুসলমান অস্বীকার করে না। জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করে, তাতে সাধারণ পাঠকের ধারণা জন্মে, অতি সাধু রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মুসলমান সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লড়াই করছে। ব্রিটেন-আমেরিকার চক্রান্তে জায়নবাদীরা যে ফিলিস্তিনিদের ভূমি জবরদখল করেছে, সে কথা মানুষ ভুলে থাকে।
যে অজুহাতেই গাজায় গণহত্যা শুরু হোক, এবারের আগ্রাসন অতি সুপরিকল্পিত।দেড় হাজার মারা যাওয়ার পরও আমেরিকা ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। যদি গোলাবারুদে ঘাটতি দেখা দেয়! পৃথিবীর কোনো দেশেই ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব নেই। আরব নেতাদের ভূমিকা সুবিধাবাদীর।কুলের চেয়ে শ্যামই তাদের পছন্দ। তাদের পায়ের নিচে মাটি না থাকলেও, শ্যাম আমেরিকার আনুকূল্য থাকলেই হলো।গাজার গণহত্যায় তাদের ভূমিকা কাপুরুষের।
পশ্চিমা শাসকেরা নীরবতা অবলম্বন করলেও তাঁদের দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা নীরব নন। জনমত জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ৫১ শতাংশ মানুষ ইসরায়েলি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। প্যারিসে ২৫ হাজার লোকের প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। সিডনিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ ও দল-মতনির্বিশেষে তাতে অংশ নিয়েছে যুবসমাজ। বরং জামায়াত-শিবির-হেফাজতিরাই চুপচাপ।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত ভাষায় বারবার গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।তাঁর বক্তব্য প্রশংসনীয়। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া প্রতিবাদ করেছেন এবং ত্রাণ তৎপরতার জন্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতকে পাঁচ লাখ টাকাও দিয়েছেন।গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সব কর্মকর্তা–কর্মচারী দুই দিনের বেতন দুই লাখ টাকা দিয়েছেন।আমাদের মিডিয়ার ভূমিকা বলিষ্ঠ।
বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার গাজার পাশে আছে তারা মুসলমান বলে নয়, নির্যাতিত বলে। গাজা ও ফিলিস্তিনের কিছু ছেলেমেয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী। দেশে থাকলে তাদের অনেকেই হয়তো মারা যেত। কেউ কেউ হারিয়েছে প্রিয়জন। তাদের মনের অবস্থা অনুমেয়।ওদের কোনো ঈদ নেই। তাই ঈদের দিন মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসী ছাত্র–যুবকদের নিয়ে আমি শহীদ মিনারে সমাবেশ করে সংহতি প্রকাশের কর্মসূচি নিয়েছিলাম। অনিবার্য কারণে কর্মসূচিটি হতে পারেনি। তবে ফিলিস্তিনিদের দুঃখের আমরা সমব্যথী, তার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার কোনো সম্পর্ক নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments