ন্যায়বিচারই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারে by রবার্ট ফিস্ক
সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের হাতে তিনজন ইসরায়েলি কিশোর খুন হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত বর্বর ও নির্মম, এটি ক্ষমার অযোগ্য। এটাও সত্য যে ইসরায়েলের হাতে অন্তত ৩৭ জন লেবানিজ শিশু খুন হয়েছে। এটাও দুঃখজনক, সন্ত্রাসবাদের এই হচ্ছে পরিণতি। ১৯৯৬ সালে লেবাননের কানায় ইসরায়েলি সেনাদের গোলাবর্ষণে ১০৯ জন বেসামরিক ব্যক্তি খুন হয়, এদের মধ্যে অনেকেই ছিল শিশু। এই মানুষেরা জাতিসংঘের একটি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, ফলে নিশ্চিতভাবেই এটা ছিল যুদ্ধাপরাধ। সে কারণে আমি বলতে চাই, এই তিনজন ইসরায়েলি টিনএজারকে হত্যার ঘটনাটিও যুদ্ধাপরাধ।
কথা হচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকাণ্ডের পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত নোংরা, একই সঙ্গে তা প্রাণঘাতীও বটে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই তিনজন টিনএজারকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ‘পশু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাতে কী? মেনাচেম বেগিন কি ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনিদের ‘দুই পায়া জন্তু’ আখ্যা দেননি? এবং তারপর বেগিনের নির্দেশে ফিলিস্তিনের ওপর বিমান থেকে লাখ লাখ গোলাবর্ষণ করা হয়, নেতানিয়াহু যেমন বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য হামাসকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
আর এদিকে রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেস বলেছেন, ইসরায়েল ‘এই জঘন্য সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করবে’। কিন্তু কতজন সংবাদকর্মী জানেন যে এই শিমন পেরেস প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় কানায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। না, কেউই তা জানে না। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ব্যাপার হচ্ছে, এখানে সামষ্টিক স্মৃতির কোনো বালাই নেই। এটা বড় ভুলনশীল এলাকা।
সেই ১৯৬০ সালে ইসরায়েল লেবাননের ‘সন্ত্রাসীদের’ ওপর বিমান আক্রমণ শুরু করে। তারপর অসংখ্য বিমান আক্রমণ হয়েছে। ইসরায়েল এখনো তা করে যাচ্ছে, লেবাননে ‘সন্ত্রাসবাদ মুছে ফেলতে’ বা বেগিনের ভাষ্য অনুসারে, ‘সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করতে’। ইসরায়েল ১৯৮২ সালে যে লেবানন আক্রমণ করেছিল, তাতে ১৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েল যখন গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তখন এক হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি ও ১৩ জন ইসরায়েলি প্রাণ হারান। এই ১৩ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে চারজনই নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির কারণে মারা যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সে সময় চুপ থাকলেও এবার তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠ, তিনি এই ‘কিশোরদের হত্যার মতো মূঢ় কাজের’ সমালোচনা করেছেন।
১৯৯৬ সালে হিজবুল্লাহ বলেছিল, ইসরায়েল ‘নরকের সব দ্বার খুলে দিয়েছে’। হামাস সতর্ক করে বলেছিল, ‘ইসরায়েল নরকের সব দ্বার খুলে দিচ্ছে’। লক্ষ করুন, সেই একই পোকায় খাওয়া পাণ্ডুলিপি। রক্তের বদলে আরও রক্ত, যা হোক, শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ যা বলেছিল, তার কিছুটা সত্যতা তো মিলল।
ফিলিস্তিনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, নেতানিয়াহু যদি সে-বিষয়ক তার নব্য উৎসাহে শাণ দেন, তাহলে আমাদের ভুলে যেতে হবে, ফিলিস্তিন একটা রাষ্ট্র। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সব সহিংসতার অবসান ঘটবে, তাই নয় কি? মাহমুদ আব্বাস মরহুম ইয়াসির আরাফাতের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি আরেক দুর্নীতিগ্রস্ত সংগঠন হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন। এর ফলে, ইসরায়েলের নোংরা রাজনৈতিক প্রশাসন এ কথা বলার সাহস পাচ্ছে যে হামাস ফিলিস্তিন সরকারে থাকলে কোনো শান্তি আসতে পারে না। এমনকি হামাস যখন ফিলিস্তিন সরকারের অংশও ছিল না, তখন নেতানিয়াহু দাবি করেছিলেন, কোনো ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আব্বাস তো আর হামাসের হয়ে কথা বলতে পারেন না।
শেষ পর্যন্ত, এটা আসলে ভূমিরই ব্যাপার। এ অঞ্চলের সব যুদ্ধবিগ্রহের উৎস হচ্ছে এই ভূমি। আরব ভূমিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েল শুধু ইহুদিদের জন্য উপনিবেশ বানিয়েছে। বহুল আলোচিত পশ্চিম তীরেই সেটা তারা বানিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই ইহুদিরাই হিটলারের হাতে লাখে লাখে মারা পড়েছে। সে স্মৃতি আমরা ভুলিনি। সেটা ভোলারও নয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় সেই ইহুদিরাই ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে বসল। এর কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই পশ্চিম তীরেই এই তিনজন ইসরায়েলি কিশোর মারা পড়ল। তারা সেই অবৈধ উপনিবেশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। না, এ যুক্তিতে তাদের হত্যাকাণ্ড বৈধ হয়ে যায় না।
এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে খুবই বর্বর ও নির্মম, একই সঙ্গে তা ক্ষমার অযোগ্যও বটে। এই মৃত্যুতে তাদের পরিবারবর্গ যে দুঃখ পেয়েছে, সেটা তাদের প্রাপ্য নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। হ্যাঁ, ন্যায়বিচার। তার মানে হচ্ছে, খুনিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। একই সঙ্গে, এই চুরি হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের হাতে তা ফেরত দিতে হবে। সেটা করতে হলে অনতিবিলম্বেই এর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এতে হয়তো আরও রক্ত ঝরবে। তবে এতে হয়তো আমাদের অনন্তকাল ধরে রক্তক্ষরণ দেখতে হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক।
কথা হচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকাণ্ডের পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত নোংরা, একই সঙ্গে তা প্রাণঘাতীও বটে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই তিনজন টিনএজারকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ‘পশু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাতে কী? মেনাচেম বেগিন কি ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনিদের ‘দুই পায়া জন্তু’ আখ্যা দেননি? এবং তারপর বেগিনের নির্দেশে ফিলিস্তিনের ওপর বিমান থেকে লাখ লাখ গোলাবর্ষণ করা হয়, নেতানিয়াহু যেমন বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য হামাসকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
আর এদিকে রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেস বলেছেন, ইসরায়েল ‘এই জঘন্য সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করবে’। কিন্তু কতজন সংবাদকর্মী জানেন যে এই শিমন পেরেস প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালে ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় কানায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। না, কেউই তা জানে না। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ব্যাপার হচ্ছে, এখানে সামষ্টিক স্মৃতির কোনো বালাই নেই। এটা বড় ভুলনশীল এলাকা।
সেই ১৯৬০ সালে ইসরায়েল লেবাননের ‘সন্ত্রাসীদের’ ওপর বিমান আক্রমণ শুরু করে। তারপর অসংখ্য বিমান আক্রমণ হয়েছে। ইসরায়েল এখনো তা করে যাচ্ছে, লেবাননে ‘সন্ত্রাসবাদ মুছে ফেলতে’ বা বেগিনের ভাষ্য অনুসারে, ‘সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করতে’। ইসরায়েল ১৯৮২ সালে যে লেবানন আক্রমণ করেছিল, তাতে ১৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৮-০৯ সালে ইসরায়েল যখন গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তখন এক হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি ও ১৩ জন ইসরায়েলি প্রাণ হারান। এই ১৩ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে চারজনই নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির কারণে মারা যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সে সময় চুপ থাকলেও এবার তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠ, তিনি এই ‘কিশোরদের হত্যার মতো মূঢ় কাজের’ সমালোচনা করেছেন।
১৯৯৬ সালে হিজবুল্লাহ বলেছিল, ইসরায়েল ‘নরকের সব দ্বার খুলে দিয়েছে’। হামাস সতর্ক করে বলেছিল, ‘ইসরায়েল নরকের সব দ্বার খুলে দিচ্ছে’। লক্ষ করুন, সেই একই পোকায় খাওয়া পাণ্ডুলিপি। রক্তের বদলে আরও রক্ত, যা হোক, শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ যা বলেছিল, তার কিছুটা সত্যতা তো মিলল।
ফিলিস্তিনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, নেতানিয়াহু যদি সে-বিষয়ক তার নব্য উৎসাহে শাণ দেন, তাহলে আমাদের ভুলে যেতে হবে, ফিলিস্তিন একটা রাষ্ট্র। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সব সহিংসতার অবসান ঘটবে, তাই নয় কি? মাহমুদ আব্বাস মরহুম ইয়াসির আরাফাতের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি আরেক দুর্নীতিগ্রস্ত সংগঠন হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন। এর ফলে, ইসরায়েলের নোংরা রাজনৈতিক প্রশাসন এ কথা বলার সাহস পাচ্ছে যে হামাস ফিলিস্তিন সরকারে থাকলে কোনো শান্তি আসতে পারে না। এমনকি হামাস যখন ফিলিস্তিন সরকারের অংশও ছিল না, তখন নেতানিয়াহু দাবি করেছিলেন, কোনো ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আব্বাস তো আর হামাসের হয়ে কথা বলতে পারেন না।
শেষ পর্যন্ত, এটা আসলে ভূমিরই ব্যাপার। এ অঞ্চলের সব যুদ্ধবিগ্রহের উৎস হচ্ছে এই ভূমি। আরব ভূমিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরায়েল শুধু ইহুদিদের জন্য উপনিবেশ বানিয়েছে। বহুল আলোচিত পশ্চিম তীরেই সেটা তারা বানিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই ইহুদিরাই হিটলারের হাতে লাখে লাখে মারা পড়েছে। সে স্মৃতি আমরা ভুলিনি। সেটা ভোলারও নয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় সেই ইহুদিরাই ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে বসল। এর কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই পশ্চিম তীরেই এই তিনজন ইসরায়েলি কিশোর মারা পড়ল। তারা সেই অবৈধ উপনিবেশে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। না, এ যুক্তিতে তাদের হত্যাকাণ্ড বৈধ হয়ে যায় না।
এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে খুবই বর্বর ও নির্মম, একই সঙ্গে তা ক্ষমার অযোগ্যও বটে। এই মৃত্যুতে তাদের পরিবারবর্গ যে দুঃখ পেয়েছে, সেটা তাদের প্রাপ্য নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। হ্যাঁ, ন্যায়বিচার। তার মানে হচ্ছে, খুনিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। একই সঙ্গে, এই চুরি হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের হাতে তা ফেরত দিতে হবে। সেটা করতে হলে অনতিবিলম্বেই এর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এতে হয়তো আরও রক্ত ঝরবে। তবে এতে হয়তো আমাদের অনন্তকাল ধরে রক্তক্ষরণ দেখতে হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক।
No comments