সমুদ্রে নতুন গোলপোস্ট পেয়েছে বাংলাদেশ -সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ খুরশেদ আলম by মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো :দক্ষিণ তালপট্টি আপনি হারালেন?
খুরশেদ আলম :এ বক্তব্য সঠিক নয়। ১৯৭০ সালে এটি বালির দ্বীপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে উড়িরচরের ঝড়ের পরে এটি ডুবে যায়। ১৯৮৯ সালের পর এটিকে আর পানির ওপরে দেখা যায়নি। সারা বঙ্গোপসাগরে পানি আছে, পানির নিচে মাটি আছে। সুতরাং, অদৃশ্য হওয়ায় এটি গুরুত্ব হারায়। সমুদ্র আইনের নিরিখে এর অস্তিত্ব ছিল না।
প্রথম আলো :এটা হারানোর ফলে আমরা সাগরে জায়গা বেশি বা কম পেয়েছি, সেটা কি বিবেচনায় এসেছিল?
খুরশেদ আলম :তালপট্টি হারানোর প্রশ্ন এখানে আসে না। সেটি দ্বীপ হিসেবে নেই। আমরা পুরোটা পানি হিসেবেই দেখছি। গত বছরের অক্টোবরে বিচারকেরা তালপট্টি শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারত এটা দেখানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। সুতরাং, রায়ে এটাকে শুধুই পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফের যে রোয়েদাদ, তার মূল পাঠ্য ও মানচিত্র অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের তেমন হাত ছিল না। আদালত বলেছেন, রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালে যে লাইন ড্র করে দিয়ে গেছেন, সেটাই সীমান্ত।
প্রথম আলো :তালপট্টি প্রশ্নে, না সার্বিকভাবে বলেছেন?
খুরশেদ আলম :সার্বিকভাবে।
প্রথম আলো :তালপট্টি বিচ্ছিন্ন একটি বিরোধ হিসেবে মীমাংসা করার বিষয় ছিল না।
খুরশেদ আলম :এটাকে কেউ আলাদাভাবে উত্থাপনও করেনি। করলে আরেকটি সমস্যা দেখা দিত। আনক্লোজ বা আন্তর্জাতিক কোনো আদালত কোনো দ্বীপ বা এলাকার সার্বভৌমত্ব নির্ধারণ করতে পারে না। ইস্যু ছিল সীমান্তটা বর্তমানে যেভাবে আছে সেভাবে হবে, নাকি ১৯৪৭ সালের ভিত্তিতে হবে।
প্রথম আলো :১৯৭১ সালে অ্যাডমিরেলটি চার্টে ভারত প্রথম তালপট্টিকে শনাক্ত করে নোটিশ দিয়েছিল।
খুরশেদ আলম :১৯৭৭ সালে হবে।
প্রথম আলো :অনেক বিশেষজ্ঞ ১৯৭১ উল্লেখ করেছেন।
খুরশেদ আলম :এটা ১৯৭৬ হবে।
প্রথম আলো :তাহলে ১৯৮০ সালে সংসদে এর মালিকানা দাবি করে জিয়াউর রহমান যে শ্বেতপত্র পেশ করেছিলেন, তা রায়ের আলোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সেটা কতটা আইনগত আর কতটা রাজনৈতিক ছিল?
খুরশেদ আলম :আইনগত দিকটি সম্ভবত খুব বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কারণ, আইনের কথা ভাবলে প্রথম দরকার ছিল এটা দেখা যে রেডক্লিফের সীমান্ত কোথায় শেষ হয়েছে। এটা দাবি করার আগে বা পরের এমন কোনো নথিপত্র দেখলাম না, যেখানে রেডক্লিফের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়েছে। রেডক্লিফের মানচিত্রও তখন বাংলাদেশের কাছে ছিল না। অথচ এটাই ছিল মূল। তখন যিনি প্রধান বন সংরক্ষক ছিলেন, তিনি বলে গিয়েছিলেন যে এই দ্বীপ দাবি করতে হলে অবশ্যই রেডক্লিফ নির্দেশনা দেখা প্রয়োজন।
প্রথম আলো :তালপট্টির মালিকানা প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে আমরা অনেক উত্তেজনা দেখেছি।
খুরশেদ আলম :সেখানে ভারতীয় জাহাজ এসেছিল। তারা একসময় দখলও করেছিল।
প্রথম আলো :তাহলে কি আমরা বলব যে, ওই সিদ্ধান্ত অদূরদর্শী ছিল?
খুরশেদ আলম :আমি মনে করি, মোটামুটিভাবে আইনগত ইস্যু সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রথম আলো :আপনি যে প্রধান বন সংরক্ষকের কথা বলছেন, যিনি জিয়া প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তার কী প্রমাণ?
খুরশেদ আলম :শ্বেতপত্র প্রকাশের আগে তিনি সেটা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।
প্রথম আলো :তাহলে শ্বেতপত্র বের করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা একটি বন্ধুদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলাম। রায়ে আজ কি সেটাই সত্যে প্রমাণিত?
খুরশেদ আলম :অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় ছিল। আমিও কিন্তু সেখানে জড়িত ছিলাম। তালপট্টির জন্য লড়াই করেছি। আজও দ্বীপটি চেয়েছিলাম। তাই ২০১০ সালে ম্যাপ শুধরালাম। কিন্তু রায় হলো ১৯৪৭ সালের ম্যাপের ভিত্তিতে। তার পরও যাঁরা তালপট্টি গেছে বলে আক্ষেপ করছেন, তাঁদের আবেগের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল থেকেই বলব, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সান্ত্বনা আছে। তালপট্টির আয়তন মাত্র ১ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। আর রেডক্লিফের কল্যাণেই এর চেয়ে কয়েক গুণ বড় গোটা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীটা পেয়েছি। এই নদী ভারত ব্যবহার করত। সেটা এখন তারা পারবে না।
প্রথম আলো :১৯৮০ সালে আপনি কী পদে ছিলেন? আর তালপট্টিতে কী ভূমিকা রেখেছিলেন?
খুরশেদ আলম :আমি একটি গানবোট নিয়ে গিয়েছিলাম। ১৩০ টনের গানবোট। ভারত পাঠিয়েছিল এক হাজার ১০০ টনের চারটি জাহাজ। আমি তখন লে. কমান্ডার ছিলাম।
প্রথম আলো :তালপট্টি দ্বীপে নেমেছিলেন?
খুরশেদ আলম :আগেই ভারত সেখানে অবতরণ করেছিল।
প্রথম আলো :আপনারা দ্বীপের কতটা কাছে গিয়েছিলেন? কী অভিজ্ঞতা ছিল?
খুরশেদ আলম :দ্বীপের প্রায় আধা মাইল কাছাকাছি গিয়েছিলাম। বেতারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কোনো গোলা বিনিময় হয়নি। ভারত সেখানে তাদের পতাকা উড়িয়েছিল। ঘর তুলেছিল। গাড়ি এনেছিল।
প্রথম আলো :তাহলে কি বলবেন যে ভারতীয় উপস্থিতি সঠিক ছিল?
খুরশেদ আলম :না, সেটা বলব না। আমি বলব, সেটা ঠিক ছিল, কি ছিল না, তার সঙ্গে রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলো :কিন্তু রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, ভারতের উপস্থিতি যৌক্তিক ছিল।
খুরশেদ আলম :সেটা যুক্তির কথা।
প্রথম আলো :যদি কোনো দ্বীপ থাকত, তাহলে সেখান থেকে ইইজেড বা টেরিটোরিয়াল সি পরিমাপের বিষয়টি আসত কি না? জটিলতা বাড়ত কি না?
খুরশেদ আলম :জটিলতা বাড়ার সুযোগ ছিল না। কারণ, দ্বীপ থাকলেও সেটা বিরোধপূর্ণ হয়েই থাকত। বিরোধপূর্ণ কোনো এলাকা নিয়ে কেউ আদালতে যায় না। আগে বিন্দুটা ঠিক করতে হবে। রেডক্লিফের সীমান্তের রেখাটা কোথায় শেষ হয়েছে? আদালত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন কোথায় এটি শেষ হয়েছে। এখন তালপট্টি সেই চিহ্নিত বিন্দুর এদিকে পড়ল কি ওদিকে পড়ল, সেটা আদালতের বিবেচ্য নয়।
প্রথম আলো :সেটাই যদি হবে, তাহলে সংবাদ সম্মেলনে কেন বলছেন যে বাংলাদেশের সরকারগুলো কখনো তালপট্টিকে নিজেদের ভূখণ্ডে দেখিয়ে ম্যাপ প্রকাশ করতে পারেনি। এ যুক্তি কিন্তু স্ববিরোধী মনে হচ্ছে।
খুরশেদ আলম :এটা দেখিয়েছি এ কারণে যে, যেহেতু বলা হচ্ছে তালপট্টি আমাদের আর সেটা কি আমরা হারিয়ে ফেললাম? তাই যুক্তির খাতিরে বলেছি। যদি তালপট্টি আমাদেরই হবে, তাহলে আমাদের ম্যাপে তা দেখালাম না কেন? ২০০৯ সাল পর্যন্ত যত ম্যাপ ছাপা হয়েছে, তাতে তা দেখানো হয়নি। যদি আমরা এখন মনে করি হারিয়েছি, তাহলে আমার প্রশ্ন, তাহলে তো আপনার ম্যাপে থাকবে যে এটা আপনার। মুখে বলব আমার, অথচ রাজনৈতিক ম্যাপে দেখাব না, সেটা হয় না।
প্রথম আলো :১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কেন এটা ছাপা হয়নি?
খুরশেদ আলম :এখানে কিন্তু সব সরকারের কথা বলা হচ্ছে।
প্রথম আলো :তালপট্টি আমাদের ছিল না, সেই উপলব্ধি বাংলাদেশ নেভির কবে হয়েছে? আপনি কবে অবসরে এসেছেন?
খুরশেদ আলম :২০০৯ সালে। নেভি তা মনে করে না। এখনো তারা মনে করে, সেই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্ন থেকেও একই ধারণা মিলছে। এখন এই রায়ের মধ্য দিয়ে এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়া উচিত।
প্রথম আলো :তাহলে ২০১০ সালে তালপট্টিকে নিজেদের দেখিয়ে ম্যাপ ছাপালেন কেন? শুধু আদালতকে দেখাতেই?
খুরশেদ আলম :কারণ, আমরা দেখলাম, রেডক্লিফের ম্যাপে এটা আমাদের মধ্যে পড়ে না। তখন আমরা ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ম্যাপ আনলাম।
প্রথম আলো :এখন কি আমরা বলব যে, বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই চিরতরে ও চূড়ান্তভাবে সমুদ্রসীমান্ত ফয়সালা করে নিয়েছে? এর ওপরে আমাদের সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ?
খুরশেদ আলম :নিরঙ্কুশ। শুধু দুটো ‘ধূসর এলাকা’ ব্যতিরেকে।
প্রথম আলো :‘ধূসর এলাকা’ একটু বিস্তারিত বলুন।
খুরশেদ আলম :আপনি যদি সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না করেন, তাহলেই ধূসর এলাকার সৃষ্টি হয়। আমার যেখানে ২০০ নটিক্যাল মাইল শেষ, সেখানে অন্য দেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল শুরু হয়। এখানে একটা ব্যবধান তৈরি হলো। কারণ, আমার ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর যেভাবে আমার অধিকার আছে, তারও ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর তেমনি অধিকার আছে। কিন্তু আমার ২০০-এর নিচে আমার মহীসোপান (পানিতে মহীসোপান হয় না। এটা হলো তলদেশ) আর তার ২০০ ওপরে তার ইইজেড। মিয়ানমার ও ভারত ধূসর এলাকার কেবল মাছ ধরতে পারবে। তলদেশের সব সম্পদ আমাদের।
প্রথম আলো :বিএনপি ২৮টি ব্লক করেছিল। এর ১৭টি মিয়ানমার ও ১০টি ভারত দাবি করেছিল। এখন সেই ১০টির প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশ পেল। বিএনপি একটা কৃতিত্ব তাহলে দাবি করতে পারে?
খুরশেদ আলম :না। কারণ, ভারতের দাবি তখনো ওই লাইনেই ছিল। ১৯৭৪ সালে যখন প্রথম ব্লক দেওয়া হয়, তখন ভারতের বাধার কারণে তা কার্যকর করা যায়নি।
প্রথম আলো :কিন্তু ৭৪-এ করা ছয়টি ব্লক এলাকাতেই বিএনপি ব্লকগুলো করেছিল। রায়েও সেই ব্লকের এলাকাই পেলাম। তাহলে?
খুরশেদ আলম :আগে আইনত সমুদ্রসীমা ঠিক করে তারপর ব্লকের ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল।
প্রথম আলো :৭৪-এ ভারত কি বিদেশি তেল কোম্পানিদের রুখতে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল?
খুরশেদ আলম :না। তারা প্রত্যেক কোম্পানির সদর দপ্তরে আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিল। বলেছিল, তোমরা তেল-গ্যাস পেলে তুলতে পারবে না। কারণ, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হয়নি।
প্রথম আলো :তার মানে ৪০ বছর পরে প্রমাণিত হলো, বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই ব্লক করেছিল। ভারতের বিরোধিতাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে?
খুরশেদ আলম :এক অর্থে আমরা কিন্তু সে ধরনের যুক্তি দিতেই পারি।
প্রথম আলো :আমরা এই রায় থেকে অনতিবিলম্বে কী সুবিধা পাব?
খুরশেদ আলম :১০টি ব্লকের গ্যাস-তেল আহরণে টেন্ডার দিতে পারব। শতকরা ১ শতাংশের কম এলাকা ছাড়তে হবে। এই এলাকায় অবাধে মাছ শিকার ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ করতে পারব। ওশেন ও ব্লু অর্থনীতির ওপর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সাগরে আমাদের এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। বিদেশি দুই হাজার ৬০০ জাহাজ আসে। আমাদের জাহাজ মাত্র ৬৯। কোস্টাল শিপিং চালু করতে পারব। বিশ্বে প্রায় দেড় লাখ সিফারার আছে। আমরা এখানে নগণ্য। এখন এখানে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আসলে একটা নতুন গোলপোস্ট অর্জন করেছে।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ।
খুরশেদ আলম :ধন্যবাদ।
পরিচিতি: রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট)। তিনি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালস ইটলস-এ মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরপরই তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রসীমাবিষয়ক সেলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
খুরশেদ আলম :এ বক্তব্য সঠিক নয়। ১৯৭০ সালে এটি বালির দ্বীপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে উড়িরচরের ঝড়ের পরে এটি ডুবে যায়। ১৯৮৯ সালের পর এটিকে আর পানির ওপরে দেখা যায়নি। সারা বঙ্গোপসাগরে পানি আছে, পানির নিচে মাটি আছে। সুতরাং, অদৃশ্য হওয়ায় এটি গুরুত্ব হারায়। সমুদ্র আইনের নিরিখে এর অস্তিত্ব ছিল না।
প্রথম আলো :এটা হারানোর ফলে আমরা সাগরে জায়গা বেশি বা কম পেয়েছি, সেটা কি বিবেচনায় এসেছিল?
খুরশেদ আলম :তালপট্টি হারানোর প্রশ্ন এখানে আসে না। সেটি দ্বীপ হিসেবে নেই। আমরা পুরোটা পানি হিসেবেই দেখছি। গত বছরের অক্টোবরে বিচারকেরা তালপট্টি শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারত এটা দেখানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। সুতরাং, রায়ে এটাকে শুধুই পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফের যে রোয়েদাদ, তার মূল পাঠ্য ও মানচিত্র অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের তেমন হাত ছিল না। আদালত বলেছেন, রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালে যে লাইন ড্র করে দিয়ে গেছেন, সেটাই সীমান্ত।
প্রথম আলো :তালপট্টি প্রশ্নে, না সার্বিকভাবে বলেছেন?
খুরশেদ আলম :সার্বিকভাবে।
প্রথম আলো :তালপট্টি বিচ্ছিন্ন একটি বিরোধ হিসেবে মীমাংসা করার বিষয় ছিল না।
খুরশেদ আলম :এটাকে কেউ আলাদাভাবে উত্থাপনও করেনি। করলে আরেকটি সমস্যা দেখা দিত। আনক্লোজ বা আন্তর্জাতিক কোনো আদালত কোনো দ্বীপ বা এলাকার সার্বভৌমত্ব নির্ধারণ করতে পারে না। ইস্যু ছিল সীমান্তটা বর্তমানে যেভাবে আছে সেভাবে হবে, নাকি ১৯৪৭ সালের ভিত্তিতে হবে।
প্রথম আলো :১৯৭১ সালে অ্যাডমিরেলটি চার্টে ভারত প্রথম তালপট্টিকে শনাক্ত করে নোটিশ দিয়েছিল।
খুরশেদ আলম :১৯৭৭ সালে হবে।
প্রথম আলো :অনেক বিশেষজ্ঞ ১৯৭১ উল্লেখ করেছেন।
খুরশেদ আলম :এটা ১৯৭৬ হবে।
প্রথম আলো :তাহলে ১৯৮০ সালে সংসদে এর মালিকানা দাবি করে জিয়াউর রহমান যে শ্বেতপত্র পেশ করেছিলেন, তা রায়ের আলোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সেটা কতটা আইনগত আর কতটা রাজনৈতিক ছিল?
খুরশেদ আলম :আইনগত দিকটি সম্ভবত খুব বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কারণ, আইনের কথা ভাবলে প্রথম দরকার ছিল এটা দেখা যে রেডক্লিফের সীমান্ত কোথায় শেষ হয়েছে। এটা দাবি করার আগে বা পরের এমন কোনো নথিপত্র দেখলাম না, যেখানে রেডক্লিফের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়েছে। রেডক্লিফের মানচিত্রও তখন বাংলাদেশের কাছে ছিল না। অথচ এটাই ছিল মূল। তখন যিনি প্রধান বন সংরক্ষক ছিলেন, তিনি বলে গিয়েছিলেন যে এই দ্বীপ দাবি করতে হলে অবশ্যই রেডক্লিফ নির্দেশনা দেখা প্রয়োজন।
প্রথম আলো :তালপট্টির মালিকানা প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে আমরা অনেক উত্তেজনা দেখেছি।
খুরশেদ আলম :সেখানে ভারতীয় জাহাজ এসেছিল। তারা একসময় দখলও করেছিল।
প্রথম আলো :তাহলে কি আমরা বলব যে, ওই সিদ্ধান্ত অদূরদর্শী ছিল?
খুরশেদ আলম :আমি মনে করি, মোটামুটিভাবে আইনগত ইস্যু সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রথম আলো :আপনি যে প্রধান বন সংরক্ষকের কথা বলছেন, যিনি জিয়া প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তার কী প্রমাণ?
খুরশেদ আলম :শ্বেতপত্র প্রকাশের আগে তিনি সেটা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।
প্রথম আলো :তাহলে শ্বেতপত্র বের করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা একটি বন্ধুদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলাম। রায়ে আজ কি সেটাই সত্যে প্রমাণিত?
খুরশেদ আলম :অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় ছিল। আমিও কিন্তু সেখানে জড়িত ছিলাম। তালপট্টির জন্য লড়াই করেছি। আজও দ্বীপটি চেয়েছিলাম। তাই ২০১০ সালে ম্যাপ শুধরালাম। কিন্তু রায় হলো ১৯৪৭ সালের ম্যাপের ভিত্তিতে। তার পরও যাঁরা তালপট্টি গেছে বলে আক্ষেপ করছেন, তাঁদের আবেগের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল থেকেই বলব, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সান্ত্বনা আছে। তালপট্টির আয়তন মাত্র ১ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। আর রেডক্লিফের কল্যাণেই এর চেয়ে কয়েক গুণ বড় গোটা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীটা পেয়েছি। এই নদী ভারত ব্যবহার করত। সেটা এখন তারা পারবে না।
প্রথম আলো :১৯৮০ সালে আপনি কী পদে ছিলেন? আর তালপট্টিতে কী ভূমিকা রেখেছিলেন?
খুরশেদ আলম :আমি একটি গানবোট নিয়ে গিয়েছিলাম। ১৩০ টনের গানবোট। ভারত পাঠিয়েছিল এক হাজার ১০০ টনের চারটি জাহাজ। আমি তখন লে. কমান্ডার ছিলাম।
প্রথম আলো :তালপট্টি দ্বীপে নেমেছিলেন?
খুরশেদ আলম :আগেই ভারত সেখানে অবতরণ করেছিল।
প্রথম আলো :আপনারা দ্বীপের কতটা কাছে গিয়েছিলেন? কী অভিজ্ঞতা ছিল?
খুরশেদ আলম :দ্বীপের প্রায় আধা মাইল কাছাকাছি গিয়েছিলাম। বেতারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। কোনো গোলা বিনিময় হয়নি। ভারত সেখানে তাদের পতাকা উড়িয়েছিল। ঘর তুলেছিল। গাড়ি এনেছিল।
প্রথম আলো :তাহলে কি বলবেন যে ভারতীয় উপস্থিতি সঠিক ছিল?
খুরশেদ আলম :না, সেটা বলব না। আমি বলব, সেটা ঠিক ছিল, কি ছিল না, তার সঙ্গে রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলো :কিন্তু রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, ভারতের উপস্থিতি যৌক্তিক ছিল।
খুরশেদ আলম :সেটা যুক্তির কথা।
প্রথম আলো :যদি কোনো দ্বীপ থাকত, তাহলে সেখান থেকে ইইজেড বা টেরিটোরিয়াল সি পরিমাপের বিষয়টি আসত কি না? জটিলতা বাড়ত কি না?
খুরশেদ আলম :জটিলতা বাড়ার সুযোগ ছিল না। কারণ, দ্বীপ থাকলেও সেটা বিরোধপূর্ণ হয়েই থাকত। বিরোধপূর্ণ কোনো এলাকা নিয়ে কেউ আদালতে যায় না। আগে বিন্দুটা ঠিক করতে হবে। রেডক্লিফের সীমান্তের রেখাটা কোথায় শেষ হয়েছে? আদালত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন কোথায় এটি শেষ হয়েছে। এখন তালপট্টি সেই চিহ্নিত বিন্দুর এদিকে পড়ল কি ওদিকে পড়ল, সেটা আদালতের বিবেচ্য নয়।
প্রথম আলো :সেটাই যদি হবে, তাহলে সংবাদ সম্মেলনে কেন বলছেন যে বাংলাদেশের সরকারগুলো কখনো তালপট্টিকে নিজেদের ভূখণ্ডে দেখিয়ে ম্যাপ প্রকাশ করতে পারেনি। এ যুক্তি কিন্তু স্ববিরোধী মনে হচ্ছে।
খুরশেদ আলম :এটা দেখিয়েছি এ কারণে যে, যেহেতু বলা হচ্ছে তালপট্টি আমাদের আর সেটা কি আমরা হারিয়ে ফেললাম? তাই যুক্তির খাতিরে বলেছি। যদি তালপট্টি আমাদেরই হবে, তাহলে আমাদের ম্যাপে তা দেখালাম না কেন? ২০০৯ সাল পর্যন্ত যত ম্যাপ ছাপা হয়েছে, তাতে তা দেখানো হয়নি। যদি আমরা এখন মনে করি হারিয়েছি, তাহলে আমার প্রশ্ন, তাহলে তো আপনার ম্যাপে থাকবে যে এটা আপনার। মুখে বলব আমার, অথচ রাজনৈতিক ম্যাপে দেখাব না, সেটা হয় না।
প্রথম আলো :১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কেন এটা ছাপা হয়নি?
খুরশেদ আলম :এখানে কিন্তু সব সরকারের কথা বলা হচ্ছে।
প্রথম আলো :তালপট্টি আমাদের ছিল না, সেই উপলব্ধি বাংলাদেশ নেভির কবে হয়েছে? আপনি কবে অবসরে এসেছেন?
খুরশেদ আলম :২০০৯ সালে। নেভি তা মনে করে না। এখনো তারা মনে করে, সেই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্ন থেকেও একই ধারণা মিলছে। এখন এই রায়ের মধ্য দিয়ে এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়া উচিত।
প্রথম আলো :তাহলে ২০১০ সালে তালপট্টিকে নিজেদের দেখিয়ে ম্যাপ ছাপালেন কেন? শুধু আদালতকে দেখাতেই?
খুরশেদ আলম :কারণ, আমরা দেখলাম, রেডক্লিফের ম্যাপে এটা আমাদের মধ্যে পড়ে না। তখন আমরা ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে ম্যাপ আনলাম।
প্রথম আলো :এখন কি আমরা বলব যে, বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই চিরতরে ও চূড়ান্তভাবে সমুদ্রসীমান্ত ফয়সালা করে নিয়েছে? এর ওপরে আমাদের সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ?
খুরশেদ আলম :নিরঙ্কুশ। শুধু দুটো ‘ধূসর এলাকা’ ব্যতিরেকে।
প্রথম আলো :‘ধূসর এলাকা’ একটু বিস্তারিত বলুন।
খুরশেদ আলম :আপনি যদি সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ না করেন, তাহলেই ধূসর এলাকার সৃষ্টি হয়। আমার যেখানে ২০০ নটিক্যাল মাইল শেষ, সেখানে অন্য দেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল শুরু হয়। এখানে একটা ব্যবধান তৈরি হলো। কারণ, আমার ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর যেভাবে আমার অধিকার আছে, তারও ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর তেমনি অধিকার আছে। কিন্তু আমার ২০০-এর নিচে আমার মহীসোপান (পানিতে মহীসোপান হয় না। এটা হলো তলদেশ) আর তার ২০০ ওপরে তার ইইজেড। মিয়ানমার ও ভারত ধূসর এলাকার কেবল মাছ ধরতে পারবে। তলদেশের সব সম্পদ আমাদের।
প্রথম আলো :বিএনপি ২৮টি ব্লক করেছিল। এর ১৭টি মিয়ানমার ও ১০টি ভারত দাবি করেছিল। এখন সেই ১০টির প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশ পেল। বিএনপি একটা কৃতিত্ব তাহলে দাবি করতে পারে?
খুরশেদ আলম :না। কারণ, ভারতের দাবি তখনো ওই লাইনেই ছিল। ১৯৭৪ সালে যখন প্রথম ব্লক দেওয়া হয়, তখন ভারতের বাধার কারণে তা কার্যকর করা যায়নি।
প্রথম আলো :কিন্তু ৭৪-এ করা ছয়টি ব্লক এলাকাতেই বিএনপি ব্লকগুলো করেছিল। রায়েও সেই ব্লকের এলাকাই পেলাম। তাহলে?
খুরশেদ আলম :আগে আইনত সমুদ্রসীমা ঠিক করে তারপর ব্লকের ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল।
প্রথম আলো :৭৪-এ ভারত কি বিদেশি তেল কোম্পানিদের রুখতে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল?
খুরশেদ আলম :না। তারা প্রত্যেক কোম্পানির সদর দপ্তরে আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিল। বলেছিল, তোমরা তেল-গ্যাস পেলে তুলতে পারবে না। কারণ, সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হয়নি।
প্রথম আলো :তার মানে ৪০ বছর পরে প্রমাণিত হলো, বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই ব্লক করেছিল। ভারতের বিরোধিতাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে?
খুরশেদ আলম :এক অর্থে আমরা কিন্তু সে ধরনের যুক্তি দিতেই পারি।
প্রথম আলো :আমরা এই রায় থেকে অনতিবিলম্বে কী সুবিধা পাব?
খুরশেদ আলম :১০টি ব্লকের গ্যাস-তেল আহরণে টেন্ডার দিতে পারব। শতকরা ১ শতাংশের কম এলাকা ছাড়তে হবে। এই এলাকায় অবাধে মাছ শিকার ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ করতে পারব। ওশেন ও ব্লু অর্থনীতির ওপর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সাগরে আমাদের এখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। বিদেশি দুই হাজার ৬০০ জাহাজ আসে। আমাদের জাহাজ মাত্র ৬৯। কোস্টাল শিপিং চালু করতে পারব। বিশ্বে প্রায় দেড় লাখ সিফারার আছে। আমরা এখানে নগণ্য। এখন এখানে কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আসলে একটা নতুন গোলপোস্ট অর্জন করেছে।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ।
খুরশেদ আলম :ধন্যবাদ।
পরিচিতি: রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট)। তিনি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালস ইটলস-এ মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরপরই তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রসীমাবিষয়ক সেলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
No comments