হঠাৎ কেন এই মহা আবিষ্কার? by আবদুল মান্নান
৪ মে খালেদা জিয়া জাতীয় প্রেসক্লাবে
গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের নৃশংস সাত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ডাকা দলীয়
নেতা-কর্মীদের দিনব্যাপী ‘অনশন’ ভাঙাতে। এদিন তিনি শেষ আধা ঘণ্টা আগে এই
‘অনশনে’ যোগ দেন আর দলীয় নেতা-কর্মীদের শরবত খাইয়ে ‘অনশন’ ভাঙান। শেষে
বেগম জিয়া একটি বক্তৃতায় সরকারের তুমুল সমালোচনা করেন, কিন্তু কিছু সময় পর
হঠাৎ তিনি তাঁর প্রয়াত স্বামী জেনারেল জিয়ার হত্যাকােণ্ডর বিষয়ে চলে যান
এবং বলেন, এরশাদই তাঁর স্বামী ও জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন।
আমার জানামতে, গত ৩৩ বছরে এই দ্বিতীয়বার বেগম জিয়া তাঁর প্রয়াত স্বামীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করলেন। একবার করেছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়। একবার আমি জিয়া হত্যার বিচার দাবি করে তাঁর মৃত্যু দিবসে একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছিলাম। আমার একাধিক বন্ধু জানতে চেয়েছেন, কেন আমি হঠাৎ করে জিয়াভক্ত হয়েছি৷ তাঁদের বলেছি, এটি কারও ভক্ত হওয়ার বিষয় নয়, আমি শুধু একটি হত্যাকােণ্ডর বিচার চেয়েছি, যেমনটি আমি সব সময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকােণ্ডর বিচার দাবি করে এসেছি। প্রতিটা হত্যাকােণ্ডরই বিচার হওয়া উচিত, যাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না হয়। বঙ্গবন্ধু ও জিয়া দুজনই রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং তাঁরা দুজনই নিহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে।
যে দেশে হত্যাকােণ্ডর বিচার হয় না, সে দেশে দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। জিয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম কারাগারে একটি ক্যাঙারু কোর্টের মাধ্যমে ১৩ জন সেনাসদস্যকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আটজন সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন সেনানিবাসে কর্মরত আরও ১৯ জন সেনা কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ঘটনাচক্রে এঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, আর বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ও বন্ধুত্ব ছিল। যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তাঁদের পরিবার-পরিজন আদালতের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের বাঁচাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেকের ধারণা, এই দণ্ডগুলোই বোধ হয় জিয়া হত্যাকােণ্ডর বিচারের রায়। আসলে তা নয়। এই হতভাগ্যদের বিচারের নামে প্রহসন হয়েছিল সেনাবিদ্রোহের জন্য, জিয়া হত্যার জন্য নয়। এর আগে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়।
বেগম জিয়া বর্তমান সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে বলেন, অবৈধ সরকারের অধীনে অবৈধ কার্যক্রম চলছে। বর্তমান সরকার কেন অবৈধ, তা তিনি খুলে বলেননি। আর যদি তিনি মনে করেন, যেহেতু নির্বাচনে তাঁর দল অংশ নেয়নি বিধায় এ সরকার অবৈধ, তাহলে সেটি ভুল ব্যাখ্যা। দেখতে হবে নির্বাচনটি সাংবিধানিকভাবে হয়েছে কি না। তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা নিশ্চয় অবৈধ নয়৷ তবে হ্যাঁ, এই নির্বাচনকে হয়তো একটি আদর্শ নির্বাচন বলা যাবে না, কারণ নির্বাচনে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না-করা একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ অংশ নেয়নি, তাই বলে সেই নির্বাচন তো অবৈধ হয়ে যায়নি। তা যদি হতো, তাহলে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধ হলো, তা-ও তো অবৈধ বলে বলতে হয়। অবশ্য এমন কথা ইদানীং বিএনপির কিছু নেতা বলতে শুরু করেছেন। বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর কথা তুলে এনেছেন। সিরাজ শিকদার বাংলাদেশে গলাকাটা রাজনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয়। পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন তিনি নিহত হন। এমন হত্যাকাণ্ড নিশ্চয় নিন্দনীয়।
তবে বেগম জিয়া কীভাবে ভুলে গেলেন তাঁর স্বামী জিয়ার আমলে প্রায় আড়াই হাজার সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যকে অভুত্থ্যান প্রচেষ্টার অজুহাতে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে রাতের আঁধারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার কথা? কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ড কি এত তাড়াতাড়ি ভোলা যায়? উচ্চ আদালত তো রায় দিয়েছেন, এটি ছিল জুডিশিয়াল কিলিং। বেগম জিয়ার তো মনে থাকার কথা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দক্ষিণ বাংলায় আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ধর্ষণ, হত্যা আর দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা। মনে কি পড়ে চট্টগ্রামের গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর কথা? অথবা বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনির কথা? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইউনুস অথবা ড. তাহেরকে ভুলে গেলে পাপ হবে। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা জামালউদ্দিনের পরিবারকে কি কখনো জানানো হয়েছে, তিনি কীভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন? আহসানউল্লাহ মাস্টার অথবা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হমালার কথা আর না-ই বা বললাম।
জিয়ার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠ হন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার। তিনি অনেকটা সবার অজােন্ত জিয়াপত্নী বেগম জিয়াকে ১০ লাখ টাকার একটি এককালীন অনুদান দেন এবং সব নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে সেনানিবাসে সেনাপ্রধানের জন্য নির্ধারিত বািড়টি তাঁকে দীর্ঘমেয়াদি লিজ দেন। সাত্তারকে হটিয়ে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে তিনিও এক অজ্ঞাত কারণে বেগম জিয়াকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁকে গুলশানে কোটি টাকার বেশি দামের একটি বাড়ি লিখে দেন। জিয়ার মৃত্যুর পর সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন ১০ মাসের মতো। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম জিয়া সরকারপ্রধান ছিলেন। এই তিন আমলেও এক রহস্যজনক কারণে জিয়া হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়ার প্রথম সরকারের সময় সংসদে বেগম মতিয়া চৌধুরী তাঁকে জিয়া হত্যার বিচারের জন্য মামলা করার অনুরোধ জানালে জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে মামলা করুন।’ মতিয়া চৌধুরীও জবাব দিয়েছিলেন, ‘জামাই মরেছে আপনার, আর মামলা করব আমি?’
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আমি একজন রাজপথের কর্মী। তিনি যখন জরুির অবস্থা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন কিছুদিন গ্রেপ্তারের ভয়ে আমাকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর গ্রেপ্তার, কারাভোগ অনেককে স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির ক্যাডাররা দলের কাউকে কোথাও কোনো নির্বাচনী সভা করতে দেয়নি। এটি গণতান্ত্রিক রীতির পরিপন্থী। নারায়ণগঞ্জ ইস্যু নিয়ে নাগরিক সমাজকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মানববন্ধন করতে না দেওয়াও সুবিবেচনার লক্ষণ নয়। মাঝেমধ্যে পুলিশের এসব বাড়াবাড়ি সরকারকে বেকায়দায় ফেলে।
এই যে নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনের আস্তানা থেকে হঠাৎ এত মাদক আটক হলো, তা কি পুলিশের অজােন্ত সেখানে ছিল? তেমন কথা একজন শিশুও বিশ্বাস করবে না। সেখান থেকে পুলিশের সব সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবে। মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আস্থা রাখতে চায়।
বেগম জিয়া এরশাদকে তাঁর স্বামীর খুনি হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তবে তিনি কী করে ভুলে গেলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনিই এরশাদকে মঞ্চে তুলেছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তারেক জিয়া গিয়েছিলেন এরশাদের বারিধারার বাসভবনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাঁদের জোটে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে। রাতে এরশাদ তাঁদের ডিনারে আপ্যায়ন করেছিলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে হাসিমুখে তারেক জিয়া জানান, ডিনার ভালোই হয়েছিল। মেন্যুতে ছোট মাছ ছিল, যা তাঁর খুব প্রিয়। তখন এরশাদ যে জিয়ার খুনি ছিলেন, তা বেগম জিয়ার কি জানা ছিল না? নাকি তিনি এ কথাটি জেনেছেন সম্প্রতি প্রথম আলোয় ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে প্রকাশিত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজের লেখা পড়ে? লিফসুলৎজের লেখায় বেশ কিছু ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ আছে। তার পরও জিয়া আর মঞ্জুর হত্যার পেছনের আসল সত্য দেশের মানুষ জানতে চায়। এগুলো হত্যা মামলা। হত্যা মামলা কখনো তামাদি হয় না। এরশাদ শনিবার বলেছেন, তিনি জানেন জিয়ার খুনি কে। নাম বলতে বাধা কোথায়? বেগম জিয়া দেখবেন নাকি একটি মামলা করে আসল সত্য কী ছিল? নাকি অপেক্ষা করবেন পুনরায় ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত? তবে প্রশ্ন, হঠাৎ কেন এত দিনে বেগম জিয়ার স্বামীর মর্মািন্তক হত্যাকােণ্ডর কথা মনে পড়ল?
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments