গুম-হত্যা-সন্ত্রাস এবং আমাদের শিশুরা
খুব ছোটবেলা বলা যায় না, তখন সবে ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি৷ হঠাৎ ছেলেধরা আতঙ্ক। ছেলেধরাদের (শিশু পাচারকারী) নৃশংসতার নানা লোমহর্ষক কাহিিন শিশুমনে এমন আতঙ্ক ছড়াত যে একা স্কুলে যেতে সাহস হতো না। পড়াশোনায় মন দেওয়া দূরে থাক, বাড়ির আিঙনায় অপরিচিত ব্যক্তির আনাগোনা দেখলে শিশুমনে কেমন প্রভাব পড়ত, তা বোধ হয় এখন যাঁরা বড়, তাঁদের অজানা নয়। যে চঞ্চল শিশুটি বন্ধুদের সঙ্গে কীভাবে বিকেল কাটাবে, সে ভাবনায় অস্থির থাকত, তার ঘরের বাইরে বেরোনোর সাহস হতো না, সঙ্গে মা-বাবার বিশেষ সতর্কতা। সময় এগোচ্ছে, আমরা প্রবেশ করছি ডিজিটাল যুগে। শিশুদের একটি নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়া আমাদের সামাজিক দায়িত্ব আর রাষ্ট্রের জন্য তা অবশ্যকর্তব্য। অগ্রগতিও লক্ষণীয়৷ যেমন শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি ভবিষ্যতের দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তরে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার আধুনিকায়ন হচ্ছে, কমছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও। কিন্তু আমরা বড়রা কি শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারছি? নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়া সহ্যক্ষমতা নাহয় আমাদের ইস্পাতকঠিন করে তুলেছে কিন্তু কোমলমতি শিশুদের কী হবে? গুম-খুন-হত্যা-ধর্ষণ আমাদের শিশুদের মনে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা শিশুদের মনে কী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা বোধ হয় বোঝানোর জন্য কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান শিশু মেঘের মানসিক প্রতিক্রিয়া বোঝা অসাধ্য কিছু নয়। অন্য শিশুরাও এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে যে শিশুটি দেখে, তাদের প্রিয় গাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার মানসিক অবস্থা কী? যে শিশুরা সকালবেলা স্কুলে গিয়ে দেখে, কেবল ভোটকেন্দ্র হওয়ার কারণে তাদের প্রিয় ক্লাসরুমে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তাদের মনের অবস্থা বোঝার জন্য কোনো যন্ত্রের সাহায্য প্রয়োজন হয় না। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অপরাধে তার মা-বাবাকে মারধর করার পর তাদের ঘরটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিংবা তার প্রিয় পাঠ্যপুস্তক যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,
তার মানসিক অবস্থা বোঝার ক্ষমতা কি আমাদের কারও নেই? বাসায় পত্রিকা তো আর লুকিয়ে পড়তে পারি না। শিশুরা আজকাল নিজেরাই রিমোট কন্ট্রোলে চাপ দিয়ে চ্যানেল ঘোরাতে পারে। তাই মহামািরর মতো ছড়িয়ে পড়া গুম-খুন-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, চলন্ত বাসে আগুন দেওয়া এবং অগ্নিদগ্ধ লাশ—এসব খবর থেকে শিশুদের দূরে রাখা সম্ভব নয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আমাদের শিশুরা। তাদের কোমল মনে দাগ কাটছে নেতিবাচক সব সংবাদ। রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে তাদের প্রিয় বাবা-মা-ভাইবোনসহ স্বজনদের নিয়ে। একটু বড় হওয়া শিশুরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছে। হত্যা-গুম-খুন তাদের মানসিক বিকাশকে কখনো কখনো ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করছে। সরাসরি ভুক্তভোগী শিশুরা মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলছে। এর দায় কি রাষ্ট্র বা সমাজ এড়াতে পারে কিংবা আমরা যারা নাগরিক, তারা কি অব্যাহতি পাই? শিশুদের জন্য আতঙ্কমুক্ত, শঙ্কামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা কি আমাদের পবিত্র কর্তব্য নয়? সরকারও এই অবস্থায় স্বস্তিতে আছে বলা যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ মহামাির আকারে ছড়িয়ে পড়া অপরাধ দমনে একক ভূমিকায় কতটা এগিয়ে যেতে পারবে? তাই প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধও। প্রতিরোধ শুরু হোক পারিবারিক অবস্থান থেকে রাস্তাঘাট—যেখানেই অপরাধ সংঘিটত হোক, জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমার নিজের জন্য আমার সন্তানের জন্য, কোটি শিশুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য প্রতিরোধ শুরু হোক আজ-এখনই। অপরাধীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম, তাই দৃষ্টান্তমূলক প্রতিরোধ অপরাধ নির্মূলে অবশ্যই সফল হবে। আর কারও মায়ের বুক খালি না হোক, আর কোনো শিশুর অন্ধকার ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে চাই না। শিশুদের জন্য একটি ভীতিমুক্ত নিরাপদ বাংলাদেশ গঠন হোক আমাদের অঙ্গীকার। মোহাম্মদ তানভীর কায়ছার: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়৷
No comments