শিরোনাম নারায়ণগঞ্জ- নূর হোসেন ভয়ংকর by সোহরাব হাসান
গতকাল প্রথম আলো নারায়ণগঞ্জের বহুল
আলোচিত সাত খুনের ঘটনা নিয়ে যে দুই পাতার বিশেষ আয়োজন করেছে, তাতে নিহত
সাত ব্যক্তির স্বজনদের বেদনা, কান্না ও অশ্রুতে মেশা শোকগাথা তুলে ধরা
হয়েছে৷ নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র নজরুল ইসলামই সক্রিয় রাজনীতি করতেন৷
অন্যরা ছিলেন তাঁর সহযোগী বা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত৷ কিন্তু তার পরও
তাঁরা নষ্ট ও ভ্রষ্ট রাজনীতির শিকার হলেন৷ কেউ বা শুধু খুনিদের দেখে ফেলার
কারণেই খুন হয়েছেন৷ দেশের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আমাদের সবাইকে চোখ-কান
বন্ধ রাখতে হবে৷ আর মুখ বন্ধের চেষ্টা চলেছে অনেক আগে থেকেই৷
>>সাত খুনের দুই আসামি নূর হোসেন ও ইয়াছিন মিয়ার সঙ্গে সাংসদ শামীম ওসমান
আমরা
এমন এক দেশে বাস করছি, যেখানে সন্ত্রাসীরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে৷
রাজনীতির নামে নতুন নতুন ইমদু-নূর হোসেন তৈরি হচ্ছে৷ আমরা এমন এক দেশে বাস
করছি, যেখানে নষ্ট রাজনীতির কবলে পড়ে দল, প্রশাসন, রাষ্ট্র—সবকিছু বিপন্ন
হতে চলেছে৷ জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘যারা অন্ধ সব চেয়ে বেশি আজ চোখে
দেখে তারা৷’ সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন হলেন নারায়ণগঞ্জের খুদে
মাফিয়া ডন৷ ডিসি, এসপি, বড় নেতা, ছোট নেতা—সবাই নাকি তাঁর কৃপাপ্রার্থী
ছিলেন৷ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর প্রকশ্যে বিরোধ একটি রাস্তা নির্মাণ
নিয়ে৷ অপ্রকাশ্য বিরোধ সিদ্ধিরগঞ্জ-ফতুল্লার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে৷
কে এই নূর হোসেন? এই নূর হোসেন হচ্ছেন আমাদের নষ্ট রাজনীতির প্রতীক৷ জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও নূর হোসেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে সব দলই। ক্ষমতার স্বার্থে তারা তঁাকে ব্যবহার করেছে, আবার তিনি সেই ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে হয়ে উঠেছেন দুর্ধর্ষ ও ভয়ংকর সন্ত্রাসী৷
নূর হোসেনের উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়৷ প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন বাসের হেলপার। সেই হেলপার থেকে নারায়ণগঞ্জে তাঁর ভয়ংকর সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে সেক্যুলার আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী বিএনপি ও স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টির অবদান আছে। এখানে নীতি ও আদর্শের বালাই নেই৷ আছে অর্থের ভাগ–বাঁটোয়ারা ও অপরাধের অংশীদারি৷ যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, নূর হোসেনরা সেই দলের হয়ে যান৷
আশির দশকের শেষার্ধে নূর হোসেন রাজনীতিতে আসেন তৎকালীন যুব সংহতি নেতা নাসিম ওসমানের হাত ধরে৷ এরপর তিনি ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করেন৷ এরশাদের পতনের পর নূর হোসেন বিএনপিতে যোগ দিয়ে স্থানীয় সাংসদ গিয়াসউদ্দিন আহমদের কাছের লোক হয়ে যান৷ বিএনপি আমলের পাঁচ বছরই তিনি বালুমহাল দখল ও অবৈধ মাদক ব্যবসায় লিপ্ত হন৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে আসেন এবং সাবেক গুরু গিয়াসউদ্দিনকে পরিত্যাগ করেন। এরপর চার বছর তাঁর আধিপত্য চলে৷ ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলে আরও অনেক সন্ত্রাসীর মতো নূর হোসেনও গা ঢাকা দেন। বিএনপির পুরো আমলটি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর তিনি পালিয়ে ছিলেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নূর হোসেন আবার এলাকায় ফিরে আসেন। তাঁর এই আগমন ও প্রস্থানে দীক্ষাগুরুর ভূমিকায় ছিলেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমান নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘নূর হোসেন আমার কর্মী ছিল সত্য, কিন্তু সে এত বড় অপরাধী যে নজরুলকে খুন করতে পারে, এটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এখন আমি সব বুঝতে পারছি। নূর হোসেন খুনি। তার ব্যাপারে আমার অবস্থান বদলেছি। আমি চাই সে দ্রুত গ্রেপ্তার হোক।’
নূর হোসেন কি এই প্রথম খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছেন? না৷ তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলা আছে৷ এসব মামলা থেকে কারা তাঁকে রক্ষা করেছেন? কীভাবে তিনি বছরের পর বছর দখলবাজি, সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারলেন? শামীম ওসমানরা তখন তাঁর গ্রেপ্তার চাননি কেন?
নবম সংসদ নির্বাচনের পরও নূর হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রীর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা অতি জরুরি লিখে একটি চিঠি দেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘নূর হোসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করে। তিনি যেন আইনের আশ্রয় নিতে না পারেন, সে জন্য তাঁকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়।’
মাননীয় উপদেষ্টা তাঁকে ক্রসফায়ারের ভয় থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর হাতেই আরও সাতটি মানুষকে ‘ক্রসফায়ারে’ দিলেন৷ এই সাত খুনের দায় ওই উপদেষ্টা কীভাবে এড়াবেন?
এই চিঠির পরপরই নূর হোসেন সব মামলা থেকে মুক্তি পান৷ ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হন৷ এরপর তাঁকে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি করা হয়।
সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন ও প্রধান শিকার নজরুল ইসলাম—দুজনই শামীম ওসমানের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের সিটি নির্বাচনে নজরুল ইসলাম সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষ নেন। সেটাই তাঁর জীবনের কাল হয়েছে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা৷ সে সময় সিটি নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। এক পক্ষ শামীম ওসমান, অপর পক্ষ আইভীকে সমর্থন জানায়। আইভীর পক্ষে গঠিত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম, সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি। এই নাগরিক কমিটির একাধিক নির্বাচনী সভায় নজরুল ইসলাম এসেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু নূর হোসেন বরাবরই শামীম ওসমানের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি নজরুল অপহরণের পর তাঁর স্বজনেরা শামীম ওসমানের সহায়তা চাইলে তিনি নূর হোসেনকে ডেকে পাঠিয়েছিেলন। কিন্তু তার পর থেকেই নূর হোসেন লাপাত্তা৷
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ আছে। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর পর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৪-১৫ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে না। আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল এস এম আকরামকে সভাপতি ও শামীম ওসমানকে সাধারণ সম্পাদক করে। ২০১১ সােল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যত ভাগ হয়ে যায়। এস এম আকরাম নাগরিক কমিটির প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন জানান৷ আর শামীম ওসমান নিজেই প্রার্থী হন। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আইভীকে সমর্থন করেন, অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা শামীম ওসমানের পক্ষে দাঁড়ান।
গত ১০ সেপ্টেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল সংলাপের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নেতাদেরও ডাকেন। ওই সভায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, দুই নেতা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় সংগঠন চলবে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত একবারও বৈঠক হয়নি৷ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন খোকন সাহা নতুন কমিটির ব্যাপারে নানা শর্ত দেন৷ অমুককে নিতে হবে, অমুককে নেওয়া যাবে না ইত্যাদি৷ এসব কারণে জেলা কমিটির মতো নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগও নিষ্ক্রিয়৷
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ যেভাবে চলছে, দেশের অধিকাংশ জেলার আওয়ামী লীগ সেভাবে চলছে। চালানো হচ্ছে। বছরের পর বছর কমিটি হয় না। সম্মেলন হয় না। দিবসকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা সীমাবদ্ধ। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থার কারণ কী? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ প্রকাশ্যে শামীম ওসমানকে সমর্থন দিলেও অন্য অংশ নীরবতা পালন করছে।
গত রোববার আলাপ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ভালো মানুষের পক্ষে এখন আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। যঁারা নীতি ও আদর্শ নিয়ে আছেন, তঁারা দলে থাকতে পারবেন কি না সন্দেহ। যাঁরা সন্ত্রাসী ও মাস্তান পোষেন, যাঁরা কথায় কথায় নেত্রীর নাম ভাঙাতে পারেন, তাঁরাই রাজনীতি করবেন৷ নেতৃত্ব দেবেন।
নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি নির্বাচনী এলাকা। এর মধ্যে তিনটি আওয়ামী লীগের। আর দুটি জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান মারা যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়ে গেছে। এই আসনে উপনির্বাচনে কে মনোনয়ন পান, সেটাই দেখার বিষয়। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, সদর আসনটি আওয়ামী লীগের হাতেই থাকা উচিত।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা বলছেন, আসনটি জাতীয় পার্টিকে দিলে তঁারা মেনে নেবেন না৷ প্রভাবশালী পরিবারের কেউ মনোনয়ন পেলে তা–ও মানবে না নারায়ণগঞ্জবাসী। নাগরিক কমিটির একজন নেতা বললেন, ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন আমরা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার আর ছাড় নেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
কে এই নূর হোসেন? এই নূর হোসেন হচ্ছেন আমাদের নষ্ট রাজনীতির প্রতীক৷ জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও নূর হোসেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে সব দলই। ক্ষমতার স্বার্থে তারা তঁাকে ব্যবহার করেছে, আবার তিনি সেই ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে হয়ে উঠেছেন দুর্ধর্ষ ও ভয়ংকর সন্ত্রাসী৷
নূর হোসেনের উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়৷ প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন বাসের হেলপার। সেই হেলপার থেকে নারায়ণগঞ্জে তাঁর ভয়ংকর সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে সেক্যুলার আওয়ামী লীগ, জাতীয়তাবাদী বিএনপি ও স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টির অবদান আছে। এখানে নীতি ও আদর্শের বালাই নেই৷ আছে অর্থের ভাগ–বাঁটোয়ারা ও অপরাধের অংশীদারি৷ যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, নূর হোসেনরা সেই দলের হয়ে যান৷
আশির দশকের শেষার্ধে নূর হোসেন রাজনীতিতে আসেন তৎকালীন যুব সংহতি নেতা নাসিম ওসমানের হাত ধরে৷ এরপর তিনি ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করেন৷ এরশাদের পতনের পর নূর হোসেন বিএনপিতে যোগ দিয়ে স্থানীয় সাংসদ গিয়াসউদ্দিন আহমদের কাছের লোক হয়ে যান৷ বিএনপি আমলের পাঁচ বছরই তিনি বালুমহাল দখল ও অবৈধ মাদক ব্যবসায় লিপ্ত হন৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে আসেন এবং সাবেক গুরু গিয়াসউদ্দিনকে পরিত্যাগ করেন। এরপর চার বছর তাঁর আধিপত্য চলে৷ ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলে আরও অনেক সন্ত্রাসীর মতো নূর হোসেনও গা ঢাকা দেন। বিএনপির পুরো আমলটি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর তিনি পালিয়ে ছিলেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নূর হোসেন আবার এলাকায় ফিরে আসেন। তাঁর এই আগমন ও প্রস্থানে দীক্ষাগুরুর ভূমিকায় ছিলেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমান নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘নূর হোসেন আমার কর্মী ছিল সত্য, কিন্তু সে এত বড় অপরাধী যে নজরুলকে খুন করতে পারে, এটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এখন আমি সব বুঝতে পারছি। নূর হোসেন খুনি। তার ব্যাপারে আমার অবস্থান বদলেছি। আমি চাই সে দ্রুত গ্রেপ্তার হোক।’
নূর হোসেন কি এই প্রথম খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছেন? না৷ তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলা আছে৷ এসব মামলা থেকে কারা তাঁকে রক্ষা করেছেন? কীভাবে তিনি বছরের পর বছর দখলবাজি, সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারলেন? শামীম ওসমানরা তখন তাঁর গ্রেপ্তার চাননি কেন?
নবম সংসদ নির্বাচনের পরও নূর হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রীর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা অতি জরুরি লিখে একটি চিঠি দেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘নূর হোসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করে। তিনি যেন আইনের আশ্রয় নিতে না পারেন, সে জন্য তাঁকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়।’
মাননীয় উপদেষ্টা তাঁকে ক্রসফায়ারের ভয় থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর হাতেই আরও সাতটি মানুষকে ‘ক্রসফায়ারে’ দিলেন৷ এই সাত খুনের দায় ওই উপদেষ্টা কীভাবে এড়াবেন?
এই চিঠির পরপরই নূর হোসেন সব মামলা থেকে মুক্তি পান৷ ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হন৷ এরপর তাঁকে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি করা হয়।
সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন ও প্রধান শিকার নজরুল ইসলাম—দুজনই শামীম ওসমানের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের সিটি নির্বাচনে নজরুল ইসলাম সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষ নেন। সেটাই তাঁর জীবনের কাল হয়েছে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা৷ সে সময় সিটি নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। এক পক্ষ শামীম ওসমান, অপর পক্ষ আইভীকে সমর্থন জানায়। আইভীর পক্ষে গঠিত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম, সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি। এই নাগরিক কমিটির একাধিক নির্বাচনী সভায় নজরুল ইসলাম এসেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু নূর হোসেন বরাবরই শামীম ওসমানের সঙ্গে ছিলেন। এমনকি নজরুল অপহরণের পর তাঁর স্বজনেরা শামীম ওসমানের সহায়তা চাইলে তিনি নূর হোসেনকে ডেকে পাঠিয়েছিেলন। কিন্তু তার পর থেকেই নূর হোসেন লাপাত্তা৷
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ আছে। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর পর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৪-১৫ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে না। আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল এস এম আকরামকে সভাপতি ও শামীম ওসমানকে সাধারণ সম্পাদক করে। ২০১১ সােল সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যত ভাগ হয়ে যায়। এস এম আকরাম নাগরিক কমিটির প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন জানান৷ আর শামীম ওসমান নিজেই প্রার্থী হন। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আইভীকে সমর্থন করেন, অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা শামীম ওসমানের পক্ষে দাঁড়ান।
গত ১০ সেপ্টেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল সংলাপের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নেতাদেরও ডাকেন। ওই সভায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, দুই নেতা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় সংগঠন চলবে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত একবারও বৈঠক হয়নি৷ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন খোকন সাহা নতুন কমিটির ব্যাপারে নানা শর্ত দেন৷ অমুককে নিতে হবে, অমুককে নেওয়া যাবে না ইত্যাদি৷ এসব কারণে জেলা কমিটির মতো নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগও নিষ্ক্রিয়৷
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ যেভাবে চলছে, দেশের অধিকাংশ জেলার আওয়ামী লীগ সেভাবে চলছে। চালানো হচ্ছে। বছরের পর বছর কমিটি হয় না। সম্মেলন হয় না। দিবসকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা সীমাবদ্ধ। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থার কারণ কী? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ প্রকাশ্যে শামীম ওসমানকে সমর্থন দিলেও অন্য অংশ নীরবতা পালন করছে।
গত রোববার আলাপ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ভালো মানুষের পক্ষে এখন আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। যঁারা নীতি ও আদর্শ নিয়ে আছেন, তঁারা দলে থাকতে পারবেন কি না সন্দেহ। যাঁরা সন্ত্রাসী ও মাস্তান পোষেন, যাঁরা কথায় কথায় নেত্রীর নাম ভাঙাতে পারেন, তাঁরাই রাজনীতি করবেন৷ নেতৃত্ব দেবেন।
নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি নির্বাচনী এলাকা। এর মধ্যে তিনটি আওয়ামী লীগের। আর দুটি জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমান মারা যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়ে গেছে। এই আসনে উপনির্বাচনে কে মনোনয়ন পান, সেটাই দেখার বিষয়। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, সদর আসনটি আওয়ামী লীগের হাতেই থাকা উচিত।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা বলছেন, আসনটি জাতীয় পার্টিকে দিলে তঁারা মেনে নেবেন না৷ প্রভাবশালী পরিবারের কেউ মনোনয়ন পেলে তা–ও মানবে না নারায়ণগঞ্জবাসী। নাগরিক কমিটির একজন নেতা বললেন, ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন আমরা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার আর ছাড় নেই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net
No comments