ঝুঁকিমুক্ত হোক সব শিশুর জীবন
বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা, পেনসিল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, দুরন্তপনা ও চঞ্চলতা নিয়ে খোলা মাঠে মুক্ত হাওয়ায় ঘুড়ির মতো উড়ে উড়ে বেড়ানোর কথা, সহপাঠীদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠার কথা, সে বয়সে শিশুটিকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মা-বাবা ও অভিভাবকেরা পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। তাই তাঁরা ঘরের শিশুটিকে উৎসাহিত করেন যেকোনো কাজে নিয়োজিত হতে। কখনো কখনো আবার শিশুরা নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান ও বাসাবাড়িতে শিশুরা কাজ করছে। কৃষি খাতেও উল্লেখযোগ্য শিশু কাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে শিশুদের নিয়োগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা উদ্বেগজনক। যেমন: ওয়েল্ডিং কারখানায়, গাড়ি মেরামত কারখানায়, বিড়ি তৈরির কারখানায় ও জাহাজভাঙা শিল্পে বহু শিশু কাজ করছে। অথচ শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের খুব একটা উদ্যোগ নেই। যখন আমরা ‘আবার জেগে ওঠো বাংলাদেশ, এগিয়ে যাও বাংলাদেশ’ আর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি, তখন শিশু-কিশোরদের আধুনিক সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রটা মোটেই আশাপ্রদ নয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক এবং কৃষি খাতে শিশুশ্রম বিদ্যমান। শিশুশ্রমিকেরা ছুটি পায় না, মজুরি অনেক কম, অনেকেই কাজ করে পেটেভাতে, কর্মঘণ্টার কোনো সীমা নেই, তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় ও আত্মমর্যাদায় প্রতিনিয়তই আঘাত হানছেন নিয়োগকর্তারা। একটি স্বাধীন দেশে শিশুশ্রমের এ পরিস্থিতি অনভিপ্রেত। শিশুশ্রম শুধু শিশুদের কল্যাণ ও উন্নয়নই ব্যাহত করে না, সামগ্রিকভাবে শিশুশ্রম জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রগতি ও অর্জনগুলোকে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা মূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১০ লাখ শিশু কোনো দিনই স্কুলে যায়নি। যারা যায়, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে ও শ্রমে নিয়োজিত হয়। কর্মজীবী শিশুদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা স্কুলে যায় না, কারণ যাওয়া-আসার খরচ, স্কুলের দূরত্ব, স্কুল ইউনিফর্ম না থাকাসহ আরও অন্য খরচের ঘাটতি থাকা। তা ছাড়া প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে আকর্ষণ বোধ না করাও শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার একটি বড় কারণ। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো একটি নির্ভরশীল লাভজনক বিনিয়োগ হয়ে ওঠেনি দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত মা-বাবার কাছে। ১০ থেকে ১৫ বছর লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের। লেখাপড়া করার পরেও কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত নয় ভেবে অভিভাবকেরা অনেক সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে সন্তানদের শ্রমের দিকেই ঠেলে দেন। তাই সরকারিভাবে প্রত্যেক শিশুকে স্কুলমুখী করে আনন্দময়, জীবনমুখী ও গুণগত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা ও লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহন নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদসহ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার শিশুবিষয়ক অধিকাংশে সনদ অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশে শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জবরদস্তিমূলক শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অধিকার ক্ষুণ² হওয়ার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে প্রতিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। সংবিধান ছাড়াও শিশুশ্রমের বিষয়টির আইনগত অবস্থান স্পষ্ট। যেসব আইন/সনদ শিশুশ্রম নিরসনের দিকনির্দেশনা দেয়, সেগুলো হলো শিশু আইন, ২০১৩; বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬; জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ (২৯ নং আইন); জাতীয় শিশুনীতি, ২০১১; নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০২); গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা, ২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা, ২০১০। এসব আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে জানাতে হবে। এগুলোকে সন্নিবেশিত করে প্রচার ও প্রচারণা চালাতে হবে এবং এসবের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের শ্রমে নিয়োগ আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সব শিশুকে স্কুলমুখী করে তাদের স্কুলে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিশু উন্নয়ন ও শিশুর সুরক্ষার জন্য আনুপাতিক হারে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে এবং এই অর্থ শিশুদের উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের কাজে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়ন হলে শিশুশ্রমের নিরসন হতে পারে।
ওয়াহিদা বানু: নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয় বাংলাদেশ৷
ওয়াহিদা বানু: নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয় বাংলাদেশ৷
No comments