আমি ব্যথিত দুঃখিত, এটাও দেখতে হলো by মতিউর রহমান চৌধুরী
নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূস বললেন,
কুয়ালালামপুর বসে যখন শুনলাম সরকার সত্যি সত্যি গ্রামীণ ব্যাংক তার
নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে, তখন শুধু ভাবলাম- এটা কি করে সম্ভব!
একটা
সরকার কি গরিব মানুষের একটি প্রতিষ্ঠান দখল করতে পারে? আমার প্রতিক্রিয়া
কি জানবেন? কি-ই বা বলবো? আমি বলেছি যে, এটা করবেন না। দুনিয়াও বলেছে। কে
কার কথা শোনে? তারা ভেঙে দিলো এর কাঠামো। গরিব মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার
করে দিলো। প্রতিক্রিয়া একটাই- এ সর্বনাশা পথ গ্রামীণের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ
করে দেবে। আমার কষ্টের কথা আর বলবো না। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। কি
স্বপ্নই না দেখলাম এই ব্যাংকটিকে নিয়ে! কুয়ালালামপুরে সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ
সম্মেলন ২০১৩-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শেষে এই প্রতিনিধির কাছে এক
সাক্ষাৎকারে এমন প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করলেন প্রফেসর ইউনূস। বললেন, আমার
এখনও বিশ্বাস হয় না সরকার এ কাজ করতে পারে! ৮০ লাখ মানুষের এই প্রতিষ্ঠানটি
এখন খেয়াল-খুশিমতো চলবে। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন চাই। অথচ নারীদের ক্ষমতাই
কেড়ে নেয়া হলো। প্রশাসনিক এক আদেশ এখন আইনে পরিণত করে এই প্রতিষ্ঠানটি দখল
করা হলো। গরিব মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরাজিত হলো। দেশের জনগণও দেখলো কিভাবে
একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হলো।
৫৫০ জন দেশী-বিদেশী অতিথি সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১০২ জন। এবারই প্রথম এশিয়ায় এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের প্রতিনিধিরা এসেছেন নতুন স্বপ্ন আর ধারণা নিয়ে। দু’দিনের এই শীর্ষ সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রফেসর ইউনূস বলেন, একদিন এটা ছিল স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নটি ছিল পেপারওয়ার্কে বন্দি। এখন তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পরিণত হয়েছে সামাজিক এক আন্দোলনে। নিউ ইয়র্কে যখন ২০ হাজার মানুষ সামাজিক ব্যবসা শুরু করলেন তখন ভাবিনি আমেরিকার অন্য শহরগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়বে। সুইডেনে এই ব্যবসা তো শুরু হওয়ার কথা নয়। কারণ, বেকারদের সরকার ভাতা দেয়। এখন তারাই এগিয়ে আসছে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে। চীন, ভারত, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মনে হয়, এই ব্যবসার সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে- মানুষ চায় বেকারত্ব মুছে ফেলতে। তিনি বলেন, ২০৫০ নয় ২০৩০ সালের মধ্যেই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংক বলেছে, জাতিসংঘও এগিয়ে এসেছে এ লক্ষ্যে।
প্রফেসর ইউনূসকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এখন আপনার ভাবনা কি? জবাবে বললেন, আমি ব্যথিত, দুঃখিত। এটাও দেখতে হলো! যে প্রতিষ্ঠানটি দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনলো, সে প্রতিষ্ঠানটির ভাগ্য কণ্ঠভোটে বদলে গেল। এক সর্বনাশা পথে ঠেলে দেয়া হলো। গরিব মানুষের মালিকানা কেড়ে নেয়া হলো। বরাবরই আমরা চিন্তা করেছি- গ্রামীণ হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে সরকার কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এখন আইন পরিবর্তন করে সর্বময় ক্ষমতা নেয়া হলো সরকারের কাছে। সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। গ্রামীণ হয়তো এখনই থমকে দাঁড়াবে না। যখন সরকার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেবে তখন প্রতিষ্ঠানটি আঘাতপ্রাপ্ত হবে। ধ্বংসের পথে চলে যাবে। যাই হোক আমাদের এখন কাজ হবে সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করা। এর আগেই যেন আমরা রুখে দাঁড়াতে পারি। এ ব্যাপারে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। ১৬ কোটি মানুষ যদি চায় তাহলে এটা কোন বিষয়ই নয়। আমরা জনগণকে বোঝাবো এটা ভুল সিদ্ধান্ত। এটা সংশোধন করা দরকার। যারা সংশোধন করার জন্য এগিয়ে আসবে তাদের নির্বাচিত করতে হবে। যাতে গরিব মানুষের সম্পত্তি গরিবের কাছে ফিরে আসে। এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন বিকল্প নেই। যারা এটাকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের তো আর সমর্থন করা যায় না। নির্বাচিত করা যায় না।
কেমন সরকার চান? এ রকম এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমরা এমন এক সরকার চাই- যে সরকার গণমানুষের কথা বলবে। জনগণকে সঠিক নেতৃত্ব দেবে। লোভ-লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। মনে রাখতে হবে- তরুণরা হচ্ছে এখন বড় শক্তি। এ শক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। দেখুন না, আমরা যখন মালয়েশিয়ায় বসে কথা বলছি- তখন নিকট অতীতের কথাই আমাদের মনে পড়ে। পুরনো কুমিল্লা শহরের মতো ছিল এই কুয়ালালামপুর। এখন তো চেনাই যায় না। স্বপ্নের মতো বদলে গেছে। সবই সম্ভব হয়েছে এক দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের জন্য। তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন যে একেবারেই হয়নি তা নয়। আমাদের আরও উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল। কেন হয়নি এটা সবাই জানেন। নতুন করে কিছু বলার নেই।
No comments