গণতন্ত্র- সবার আগে শিশুর পুষ্টি by ফজলে হাসান আবেদ
উন্নয়নসংক্রান্ত যেকোনো আলোচনাতেই
বাংলাদেশ এখন একটি পরিচিত নাম। উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি সূচকেই আমাদের
উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
বৈশ্বিক
প্রেক্ষাপটে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার জন্য
আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও আমাদের সাফল্য
বিস্ময়কর। ১০ বছরে আমাদের মাতৃমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
সাক্ষরতার হার ৩০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় দেশ
জেন্ডারসাম্য অর্জন করেছে। ২০১৫ সালের নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা ক্ষুধার্ত
মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছি। বিগত দুই দশকে আমাদের দেশে
সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। যেকোনো বিচারেই সাফল্যের এই
উপাখ্যান উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু এতসব ইতিবাচক অর্জনের আড়ালে শিশুর অপুষ্টির
বিষয়টি আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নপ্রয়াসে যেন এক অদৃশ্য চোরাবালি হিসেবে থেকে
গেছে। অন্যসব অর্জনের পাশাপাশি অপুষ্টির আগ্রাসনকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা
করতে না পারলে আমাদের অর্জনগুলো চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
তাই সময় এসেছে একে এক নম্বর লক্ষ্য হিসেবে মোকাবিলা করার।
প্রথমে কিছু বাস্তবতা দেখা যাক। এ দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ অপুষ্টির কারণে হয়ে থাকে। অপুষ্ট শিশুদের কারও বয়সের তুলনায় ওজন কম, আবার কারও বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। কারও আবার উচ্চতার তুলনায় ওজন কম। অপুষ্ট শিশুরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকে, তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঠিকমতো হয় না, কর্মক্ষমতাও কমে যায়। অসুখ হলে তখন আর তাকে ঠেকাতে পারে না। এভাবে তাদের সামগ্রিক বিকাশের পথ জীবনের শুরুতেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশু খর্বাকায় (স্টানটেড)। এই একই বয়সের ৩৬ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজনবিশিষ্ট এবং ১৬ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় কম ওজনবিশিষ্ট। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫১ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। অপরদিকে ৪২ শতাংশ সন্তান ধারণ উপযোগী বয়সের নারী রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত। দেশে প্রতিবছর ৫৩ হাজার শিশু অপুষ্টিজনিত জটিলতায় ভুগে মারা যায়। এটি লক্ষণীয়, বাংলাদেশের পুষ্টিপরিস্থিতি আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চলের চেয়ে অনেক শোচনীয়। মোট কথা, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুষ্টির দিক থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থানে রয়েছে। লাখ লাখ শিশু অপুষ্টির অভিশাপ নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অপুষ্টির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, তাতে জয়লাভ করা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়।
আসলে পুষ্টিকে খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা ভুল হবে। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমানে তিন গুণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করার পর আমাদের ক্ষুধা অনেকাংশে দূর হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় পুষ্টিপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। উৎপাদনের বিপুল সাফল্যহেতু খাদ্যনিরাপত্তার জাল আমরা অনেকটাই ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু পুষ্টিনিরাপত্তার জাল সেভাবে ছড়ানো যায়নি। এর কারণ, পুষ্টি একটি বহুমাত্রিক বিষয়, এর সঙ্গে আমাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। শিশুপালন ও পুষ্টিবিষয়ে আমাদের প্রচলিত জ্ঞান প্রায় ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানবিরোধী। এ ছাড়া আছে নানা ধরনের কুসংস্কার এবং পুষ্টি সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব।
প্রথমে আসি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু রীতি প্রসঙ্গে, যার পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে রন্ধনপ্রণালি এবং খাদ্য পরিবেশন, এ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবজি কাটা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না পর্যন্ত সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার ফলে খাদ্যের অনেক পুষ্টিগুণ আমরা হারিয়ে ফেলি। সবজির খোসা ছাড়ানোর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা, রান্নার সময় বেশি সময় ধরে সেদ্ধ করা, অতিরিক্ত পাতলা করে সবজি কাটা এবং কাটার পরে ধোয়া, শাকসবজি বেশিক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখা ইত্যাদি নানা কারণে খাদ্যের পুষ্টিমান কমে যায়। এসব বিষয়ে সহজেই সচেতন হওয়া চলে, কিন্তু সেই সহজ কাজটি না করে আমরা নিজেদের ক্ষতি করছি, পুষ্টিলাভের সুযোগ পেয়েও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
সেই সঙ্গে আমাদের পরিবারগুলোর ভেতরে পুষ্টিগ্রহণের ক্ষেত্রে বহু বছরের কিছু ভয়ানক বৈষম্য রয়েছে। বাড়িতে সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা সবার আগে খেয়ে নেয়। পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য তখন পরিমাণে ও গুণমানে অল্প খাবার অবশিষ্ট থাকে। আবার অনেক মা কিংবা গৃহবধূ ইচ্ছা করেই নিজেদের জন্য কম খাবার রেখে দেন এবং সবশেষে খাদ্য গ্রহণ করেন। একইভাবে আমাদের ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুরা খাদ্য ও পুষ্টিলাভের ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার, কারণ পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেশিশুই সব সময় অগ্রাধিকার পায়। এটা মেয়েশিশুর পুষ্টিলাভের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথমে কিছু বাস্তবতা দেখা যাক। এ দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ অপুষ্টির কারণে হয়ে থাকে। অপুষ্ট শিশুদের কারও বয়সের তুলনায় ওজন কম, আবার কারও বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। কারও আবার উচ্চতার তুলনায় ওজন কম। অপুষ্ট শিশুরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকে, তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঠিকমতো হয় না, কর্মক্ষমতাও কমে যায়। অসুখ হলে তখন আর তাকে ঠেকাতে পারে না। এভাবে তাদের সামগ্রিক বিকাশের পথ জীবনের শুরুতেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশু খর্বাকায় (স্টানটেড)। এই একই বয়সের ৩৬ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজনবিশিষ্ট এবং ১৬ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় কম ওজনবিশিষ্ট। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫১ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। অপরদিকে ৪২ শতাংশ সন্তান ধারণ উপযোগী বয়সের নারী রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত। দেশে প্রতিবছর ৫৩ হাজার শিশু অপুষ্টিজনিত জটিলতায় ভুগে মারা যায়। এটি লক্ষণীয়, বাংলাদেশের পুষ্টিপরিস্থিতি আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চলের চেয়ে অনেক শোচনীয়। মোট কথা, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুষ্টির দিক থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থানে রয়েছে। লাখ লাখ শিশু অপুষ্টির অভিশাপ নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অপুষ্টির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, তাতে জয়লাভ করা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়।
আসলে পুষ্টিকে খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা ভুল হবে। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমানে তিন গুণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করার পর আমাদের ক্ষুধা অনেকাংশে দূর হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় পুষ্টিপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। উৎপাদনের বিপুল সাফল্যহেতু খাদ্যনিরাপত্তার জাল আমরা অনেকটাই ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু পুষ্টিনিরাপত্তার জাল সেভাবে ছড়ানো যায়নি। এর কারণ, পুষ্টি একটি বহুমাত্রিক বিষয়, এর সঙ্গে আমাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। শিশুপালন ও পুষ্টিবিষয়ে আমাদের প্রচলিত জ্ঞান প্রায় ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানবিরোধী। এ ছাড়া আছে নানা ধরনের কুসংস্কার এবং পুষ্টি সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব।
প্রথমে আসি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু রীতি প্রসঙ্গে, যার পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে রন্ধনপ্রণালি এবং খাদ্য পরিবেশন, এ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবজি কাটা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না পর্যন্ত সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার ফলে খাদ্যের অনেক পুষ্টিগুণ আমরা হারিয়ে ফেলি। সবজির খোসা ছাড়ানোর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা, রান্নার সময় বেশি সময় ধরে সেদ্ধ করা, অতিরিক্ত পাতলা করে সবজি কাটা এবং কাটার পরে ধোয়া, শাকসবজি বেশিক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখা ইত্যাদি নানা কারণে খাদ্যের পুষ্টিমান কমে যায়। এসব বিষয়ে সহজেই সচেতন হওয়া চলে, কিন্তু সেই সহজ কাজটি না করে আমরা নিজেদের ক্ষতি করছি, পুষ্টিলাভের সুযোগ পেয়েও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
সেই সঙ্গে আমাদের পরিবারগুলোর ভেতরে পুষ্টিগ্রহণের ক্ষেত্রে বহু বছরের কিছু ভয়ানক বৈষম্য রয়েছে। বাড়িতে সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা সবার আগে খেয়ে নেয়। পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য তখন পরিমাণে ও গুণমানে অল্প খাবার অবশিষ্ট থাকে। আবার অনেক মা কিংবা গৃহবধূ ইচ্ছা করেই নিজেদের জন্য কম খাবার রেখে দেন এবং সবশেষে খাদ্য গ্রহণ করেন। একইভাবে আমাদের ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুরা খাদ্য ও পুষ্টিলাভের ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার, কারণ পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেশিশুই সব সময় অগ্রাধিকার পায়। এটা মেয়েশিশুর পুষ্টিলাভের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এ ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্যাভ্যাসও পুষ্টির অপ্রাপ্যতার একটি কারণ। ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য আমরা ধান ও গম উৎপাদন এবং তার ভোগের ওপর জোর দিয়েছি। ডাল, তেলবীজ, ফলমূল, শাকসবজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে জোর দিইনি। শস্য খাতে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি মৎস্য ও পশুসম্পদ খাতেও উৎপাদনের ব্যাপক সাফল্য নিয়ে আসতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের ভোগ বাড়িয়ে পুষ্টিলাভ নিশ্চিত করতে হবে। মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান জিংক। খুব কম মাত্রায় এটি গ্রহণ করতে হয় বলে একে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অণুপুষ্টি নামে অভিহিত করা হয়। জিংকের অভাবজনিত অপুষ্টি গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। এর ফলে নবজাতকের ওজন কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্বাভাবিক প্রাণিজ আমিষ ভোগের পরিমাণ বাড়িয়ে জিংকের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু প্রাণিজ খাদ্য তথা মাছ-মাংসের অত্যধিক মূল্য জিংকপুষ্টি গ্রহণের পথে একটি বড় বাধা। অপরদিকে ভাত, আটা, আলু ও শাকসবজিতে জিংকের পরিমাণ স্বল্প। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা গ্রুপ একটি প্রকল্প গ্রহণ করে লৌহ, জিংক ও ভিটামিন এ-সমৃদ্ধ খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নয়টি দেশের প্রধান খাদ্যশস্য অণুপুষ্টি দ্বারা সমৃদ্ধ করার কাজ চলছে। জিংকস্বল্পতা এবং সে কারণে অপুষ্টি মোকাবিলায় আমরা এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব এ দেশের পুষ্টিসমস্যার জন্য বহুলাংশে দায়ী। একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ্য বাড়লে তথা খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেই এ সমস্যার সমাধান হয় না। যে খাদ্য আমরা গ্রহণ করছি, তা থেকে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকেরই পুষ্টির বিষয়ে তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। কোন খাদ্যের পুষ্টিমান কেমন, কোন খাদ্য কখন কী পরিমাণে খাওয়া উচিত—এসব বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই হয় অজ্ঞ, নয় উদাসীন। অনেকের তো এমন ধারণাও আছে, ভিটামিন খেলে শক্তি বাড়ে, পুষ্টি হয়। কিন্তু ভিটামিনে যে শক্তি বা পুষ্টি কোনোটাই বাড়ে না, বরং শুধু রোগ প্রতিরোধ করে, এটা তাঁরা জানেন না। কুসংস্কারে বিশ্বাস করে তাঁরা গর্ভবতী মায়েদের অনেক খাবার খেতে বাধা দেন। এমনকি কম খাওয়ার পরামর্শ দেন। এর ফলে তাঁর প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেলে না। সংসারজীবনে সাধারণভাবে মায়েরাই রান্নাবান্না এবং খাদ্য পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদেরও খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা খুবই কম।
মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে আমাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতার অভাব পুষ্টিলাভের পথে বাধা। জন্মের পরপর মায়ের বুকের শালদুধ শিশুর জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু এই দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে লোকজন মোটেই সচেতন নন। প্রায় সবাই শালদুধ ফেলে দিয়ে তারপর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করেন। এভাবেই শিশুর প্রথম পুষ্টিলাভের বিরাট একটি সুযোগ নষ্ট হয়।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রথম দুই বছর শিশুকে যথানিয়মে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, না হলে পুষ্টিলাভে তারা পেছনে পড়ে থাকবে। গ্রামীণ মায়েরা এ বিষয়ে সচেতন হলেও শহুরে মায়েদের এ ব্যাপারে অনীহা দেখা যায়। তাঁরা শিশুকে বোতলজাত দুধ খাওয়ান। এ ব্যাপারে যথাযথ প্রচারাভিযান চালিয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো (এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং)। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস মায়ের বুকের দুধই হবে শিশুর একমাত্র খাদ্য। এ সময় তাকে পানি, মধু তথা অন্য কোনো খাবার খেতে দেওয়া যাবে না। শিশুর সাত মাস বয়স থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোটাও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সচেতনতার অভাব লক্ষ করা যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্পূরক খাবার না দিলে তা শিশুকে যথাযথ পুষ্টি দিতে পারে না। দেশের সব প্রসূতি মাকে এই বিষয়গুলোতে অত্যন্ত কঠোরভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এ বিষয়টিকে আমাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির অংশ করে তুলতে হবে। আসলে যেকোনো ভালো কাজকে সংস্কৃতির অংশ করে নিতে পারলে কাজটি সহজ হয়ে যায়। তখন আর বিষয়টি বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
আমাদের দেশে পুষ্টির বিষয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার উন্নতি ঘটাতে শিক্ষা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। পুষ্টিবিষয়ক তথ্যগুলো সবাইকে, বিশেষ করে মায়েদের জানাতে হবে, এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও শিক্ষাকে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য নানা পর্যায়ে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কারিকুলামে সব শিক্ষার্থীর জন্য পুষ্টির বিষয়ে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করাটা অত্যন্ত জরুরি। একইভাবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। যত দিন আমরা মায়েদের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের পুষ্টির বিষয়ে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে না পারব, তত দিন পর্যন্ত অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না।
পুষ্টিবিদেরা শিশুর জীবনের প্রথম এক হাজার দিনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। মাতৃগর্ভে জীবনের অভিমুখে যাত্রা শুরু করার পর দুই বছর বয়স পর্যন্ত তাকে সঠিক মাত্রায় পুষ্টি উপাদানের জোগান দেওয়া প্রয়োজন। না হলে শিশু শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। সুতরাং ‘শিশুর প্রথম এক হাজার দিন’ সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রচারাভিযান চালানো প্রয়োজন।
শিশুর জন্মোত্তর পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তার জন্মপূর্ব পুষ্টিলাভের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থানকালে মায়ের পুষ্টিই শিশুর পুষ্টিলাভের উৎস। গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিলাভ ব্যাহত হলে তাঁর গর্ভস্থ শিশুও এর প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বস্তুত, গর্ভবতী মায়ের অপুষ্টি শিশুর অপুষ্টির মূল কারণ। আয়োডিনের অভাব, কম ক্যালরি গ্রহণ গর্ভবতী নারীর জন্য মারাত্মক প্রতিকূলতা তৈরি করে। পুষ্টিহীন মা কম ওজনের শিশু জন্মদান করেন। অতঃপর পুষ্টিহীনতার ধারাবাহিক পর্ব শুরু হয়ে তা প্রজন্মপরম্পরায় চলতে থাকে।
পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশু যখন জীবনের পথে পা ফেলে, তখন একটি ধারাবাহিক রুগ্ণ অভিযাত্রার সূচনা হয়। সেই অভিযাত্রা পদে পদে বিঘ্নিত হয়, দৃপ্ত পায়ে সে আর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। বস্তুত, শিশুর অপুষ্টি আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নপ্রয়াসের পথে একটি বড় বাধা। আমরা যদি আমাদের সমগ্র উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্য আনতে চাই, তাহলে বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের আহ্বানে অপুষ্টি দূর করার লক্ষ্যে স্কেলিং আপ নিউট্রিশন তথা এসইউএন (সান) নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এটি একটি অনন্য আন্দোলন এবং এর মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টিতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক, গবেষক, জাতীয় নেতারা এবং নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এটি সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স ফর স্কেলিং আপ নিউট্রিশন, বাংলাদেশ (সিএসএ ফর এসইউএন, বিডি) নামে কাজ শুরু করেছে। যথাযথ নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে পুষ্টিলক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
বস্তুত, শিশুর অপুষ্টি একক কোনো স্বাস্থ্যসমস্যা নয়। এটি দূর করার জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ, প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। আমরা জানি, খাদ্য, ক্ষুধা ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িত। কোনো দেশের সরকার যখন সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তখন দ্রুত অগ্রগতি অর্জিত হয়। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো এ ক্ষেত্রে চমৎকার দৃষ্টান্ত। গত তিন দশকে ব্রাজিলও ক্ষুধা দূরীকরণে অসাধারণ তৎপরতা প্রদর্শন করেছে। বিপরীত দিকে শ্রীলঙ্কা ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শিশুর স্বল্প ওজনের ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চলের তুলনায় এই হার প্রায় দ্বিগুণ। এসব দেশের সরকারগুলো যত দিন ক্ষুধা ও অপুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ না করবে, তত দিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। সুতরাং, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বোচ্চ অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো সরকারের আমলে আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় স্তরে পুষ্টিবিষয়ক এজেন্ডাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুধার্ত ও অপুষ্ট জনসংখ্যা হ্রাসে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে পুষ্টির বিষয়টিকে জনবিতর্কের বিষয়ে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নকর্মীদের পুষ্টির বিষয়ে স্থানীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য নেতাদের চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা লাভ একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে নিয়ে যেতে হবে। সরকারকে পৃথক পুষ্টি মন্ত্রণালয় স্থাপন করে দেশব্যাপী জোরদার কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের গণমাধ্যমকে সক্রিয় হয়ে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইতিহাসের নানা কালপর্বে আমরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছি, লাখো মানুষের জীবনহানি, শোক আর সন্তাপের মধ্য দিয়ে আমরা সেসব সময় পাড়ি দিয়েছি। বিশ শতক দুর্ভিক্ষ জয়ে সক্ষম হয়েছে, আমরা এখন ক্ষুধামুক্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। বর্তমানে দুর্ভিক্ষ যদি হয়ও, তা হয় সোমালিয়ার মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে অথবা উত্তর কোরিয়ার মতো স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রে। এখন আর ক্ষুধা নয়, অপুষ্টিই আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের বিজয়ী হতে হবে। ক্ষুধা ও অপুষ্টি আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে বিনষ্ট করে দেয়, খর্ব করে দেয়। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ হবে এরই বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
No comments