গণতন্ত্র- বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি by আনিসুজ্জামান
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পশ্চিমবঙ্গ ও
পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা হয়েছে। বরিশাল জেলার আগরপুর
ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদিয়া গ্রামে কয়েক হাজার হিন্দু আশ্রয় নেয়।
তাদের
রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন বরিশাল সদর মহকুমা মুসলিম লীগের সভাপতি, বরিশাল
জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি এবং আগরপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আলতাফউদ্দীন।
তিনি কিছুসংখ্যক গ্রামবাসী নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার সংকল্প করেন এবং
নিজেই বন্দুক হাতে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রহরায় নিযুক্ত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি
তারিখে দাঙ্গাকারীরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে আসে। আলতাফউদ্দীন তাদের নিরস্ত
করতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। দুর্বৃত্তেরা দূর থেকে তাঁকে লক্ষ করে বল্লম ছোড়ে।
আলতাফউদ্দীন তাতে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর
আত্মাহুতিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে অনেকে এগিয়ে আসে এবং পরদিন বরিশালের
অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র পুলিশ-বাহিনী ওই গ্রামে এসে
দাঙ্গা দমন করতে থেকে যায়। আলতাফউদ্দীনের আত্মত্যাগের ফলে সেদিন বহু প্রাণ
রক্ষা পেয়েছিল। তাঁর জীবনদান নিয়ে জসীমউদ্দীন একটি মর্মস্পর্শী কবিতা
লেখেন, রণদাপ্রসাদ সাহা তাঁর স্মৃতিরক্ষায় ৩৫ হাজার টাকা দান করেন এবং আরো
৭০ হাজার টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। আগরপুরে আলতাফউদ্দীন-প্রতিষ্ঠিত মডেল
একাডেমীর নাম পরিবর্তন করে শহীদ আলতাফউদ্দীন মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউশন করা হয়
এবং সরকার তাঁর পরিবারের সাহায্যার্থে ৫০ বিঘা খাস জমি প্রদান করে।
মৃত্যুর সময়ে আলতাফউদ্দীনের বয়স ছিল ৪৩ বছর।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে সীমান্তের দুপারে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ঢাকায় নবাবপুর রোডে ছিল আমীর হোসেন চৌধুরীর রিমা কেমিক্যালসের কারখানা এবং তাঁর বাসভবন। আমীর হোসেন চৌধুরী ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কনিষ্ঠ ভগ্নী হোমায়েরা খাতুনের একমাত্র পুত্র। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও মুকুন্দ দাস সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন, নজরুলের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং সুতি কাপড়ে রঙিন মুদ্রণ ও ছাতার কাপড় সম্পর্কেও ইংরেজিতে বই লেখেন। দাঙ্গার সময়ে প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়ি আক্রান্ত হলে আমীর হোসেন চৌধুরী তাদের রক্ষা করতে ছুটে যান এবং দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।
সেবারই দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরো একজন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তিনি জিন্নাত আলী মাস্টার। সে-বছরের শেষে প্রকাশিত জীবনকথা বইটি জসীমউদ্দীন উৎসর্গ করেছিলেন আমীর হোসেন চৌধুরী, জিন্নাত আলী মাস্টার আর যাঁরা নিজের জীবন বিপন্ন করেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সকলকে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই এক চিত্র।
দুই.
স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের উচ্ছেদ হওয়ায় এবং সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গৃহীত হওয়ায় আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশে আর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। এই মনে হওয়ার ওপরে বেশি জোর দেওয়ায় কিছু কিছু বিষয় আমরা গুরুত্ব দিইনি। ১৯৭১ সালে যাঁরা বাস্তুত্যাগী হিন্দুর সম্পত্তি দখল করেছিলেন, ১৯৭২-এ তা কেউ কেউ ফেরত দেননি এবং এ-বিষয়ে সরকার থেকেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত রমনা কালীবাড়ি পুনর্নির্মাণের দাবি কোনো সরকারই পূরণ করেনি। ১৯৭২-৭৩-এ পুজোর সময়ে এদিকে ওদিকে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যে, তুলনায় পাকিস্তানের কালে সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা ও নিরাপত্তা বেশি ছিল বলে ভাবার কারণ ছিল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ, ইসলামের প্রতি রাষ্ট্রের প্রকাশ্য পক্ষপাত, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ক্ষমতাসীন হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই উৎসাহিত করেছে। আমরা আশির দশকে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করেছিলাম এবং রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা রুজু করেছিলাম, কিন্তু তাতে অমুসলমানদের আস্থা বা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাঁরা ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ’ গঠন করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার পথ খুঁজেছেন। সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা যে সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা উশকে দেয়, তার দৃষ্টান্ত আমরা পৃথিবীর বহু দেশে দেখেছি।
একটি দৈনিক পত্রিকার মিথ্যা প্রচারণার ফলে ১৯৯০ সালে এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯২ সালে দেশের নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ১৯৬৪ সালে যেমন রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ একযোগে দাঙ্গা-প্রতিরোধে সফলভাবে অগ্রসর হয়েছিল, ১৯৯০ ও ১৯৯২-তে তেমন উদেযাগ অনেক দুর্বল ছিল। প্রশাসনের তৎপরতায় ছিদ্র ছিল, অন্যেরাও জোর প্রতিরোধ করতে পারেনি। অমুসলমান নাগরিকেরা আওয়ামী লীগের ভোট-ব্যাংক, আওয়ামী লীগই তাদের রক্ষা করুক—সরকারের মনোভাব ছিল এ-রকম। আর নাগরিকদের নিরাপত্তাদানের দায়িত্ব সরকারের, তাদেরকেই যা করার তা করতে হবে—আওয়ামী লীগের মনোভাব ছিল অনেকটা এমন।
তারপর ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে যে-সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ঘটে, তা ন্যক্কারজনক। বিজয়ী দলের রাজনৈতিক কর্মীরা অত্যাচার করলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দেখলো। আমরা যখন গোপালগঞ্জের এক শরণার্থী শিবিরে দাঁড়িয়ে, আমাদের মাথার উপর দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উড়ে গেলেন হেলিকপ্টারে এবং ঢাকায় নেমে বললেন, তিনি কোনো আশ্রয়প্রার্থী দেখেননি। এই সময়ে হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছে, যারা রয়ে গেছে, তারা নিজেদের স্বার্থ পৃথক বলে ভাবতে শুরু করেছে, এমন কী স্বতন্ত্র নির্বাচনব্যবস্থার কথাও চিন্তা করেছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের এও এক চিত্র।
এর মধ্যেই শামসুর রাহমান ‘সুধাংশু যাবে না’র মতো অসাধারণ কবিতা এবং হাসনাত আবদুল হাই মর্মবিদারী দুটি গল্প লিখেছিলেন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা একাধিক রচনাসংকলন প্রকাশ করেছিলেন।
তিন.
গত এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পুবে-পশ্চিমে উত্তরে-দক্ষিণে নানা জায়গায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের পীড়ন করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর ধরন একইরকম। বাড়িঘর ও লোকজন তেমন আক্রান্ত হয়নি, কিন্তু উপাসনালয় ও প্রতিমাবিগ্রহের ধ্বংসসাধন করে উপাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। ভয় পেয়ে তারা যেন ভিটেবাড়ি ও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, সেটাই, মনে হয়, আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। প্রশাসনের যে-সক্রিয়তা আশা করা গিয়েছিল, তা দেখা যায়নি—ঔদাসীন্য বা অপারগতা ছিল তার মূলে। নাগরিক সমাজ এসব প্রতিরোধ করতে তাৎক্ষণিক ও তাৎস্থানিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, পরে কিছু কিছু প্রতিবাদ হয়েছে। কিছু সাংগঠনিক উদেযাগও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সরকার অনেক ধর্মস্থান পুনর্নির্মাণ করে দিচ্ছেন বটে, তাতে ভাঙাবাড়ি জোড়া লাগবে, ভাঙামন জোড়া লাগবে কি?
আমরা যখন বলি, বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ, তখন কি এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা বিস্মৃত হয়ে বলি? যারা বলি, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তারা কি নিজেদের প্রবোধ দিই মাত্র? বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়, এ-কথা আমি সাধারণভাবে মানি। কিন্তু তাদের মধ্যে যে অনেকে সাম্প্রদায়িক এবং সক্রিয়ভাবে অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট, তার প্রমাণ তো চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা গেলেও রাষ্ট্রধর্মের বিধান বর্জিত হয়নি—সে কাদের মুখ চেয়ে? এই গোঁজামিলের মতো অবস্থাই বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির। বেশ আছি আমরা—পরস্পর ভাই ভাই—কিন্তু কখন যে তোমার মাথায় বাড়ি দেবো, তার ঠিক নেই, আর দিলে ওটা অগ্রজের শাসন বলে মেনে নিও।
নিজেদের ব্যর্থতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আছে, আছে সামাজিক ব্যর্থতাও। যাঁরা ধর্মপ্রাণ, তাঁরা সকলকে বোঝাতে পারেননি যে, অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থী। যাঁরা ইহজাগতিক, যাঁরা নিত্য মানবতা, শুভাশুভ, ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলেন, তাঁরাও সমাজে যথোচিত প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হননি। ধর্মকে নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা বরঞ্চ ভেদবুদ্ধির মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন মানুষের কানে। আজ হিন্দু মুসলমান আলাদা, কাল শিয়া সুন্নি পৃথক, পরশু আহমদিয়ারা মুসলমান নয়—বলেই যাচ্ছেন এবং তাঁদের কথা শোনার মতো লোকও পাচ্ছেন। একাত্তরের ঐক্য কোথায় গেল? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে অতি অল্পসময়ে রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তেমন নেতৃত্ব আজ কোথায়?
নাগরিক সমাজকে জেগে উঠতে হবে—প্রতিরোধ করতে হবে তাদেরকে, যারা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। বাংলাদেশকে কলুষমুক্ত করতে হবে সবাই মিলে।
আনিসুজ্জামান: লেখক ও শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে সীমান্তের দুপারে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ঢাকায় নবাবপুর রোডে ছিল আমীর হোসেন চৌধুরীর রিমা কেমিক্যালসের কারখানা এবং তাঁর বাসভবন। আমীর হোসেন চৌধুরী ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কনিষ্ঠ ভগ্নী হোমায়েরা খাতুনের একমাত্র পুত্র। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও মুকুন্দ দাস সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন, নজরুলের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং সুতি কাপড়ে রঙিন মুদ্রণ ও ছাতার কাপড় সম্পর্কেও ইংরেজিতে বই লেখেন। দাঙ্গার সময়ে প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়ি আক্রান্ত হলে আমীর হোসেন চৌধুরী তাদের রক্ষা করতে ছুটে যান এবং দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।
সেবারই দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আরো একজন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তিনি জিন্নাত আলী মাস্টার। সে-বছরের শেষে প্রকাশিত জীবনকথা বইটি জসীমউদ্দীন উৎসর্গ করেছিলেন আমীর হোসেন চৌধুরী, জিন্নাত আলী মাস্টার আর যাঁরা নিজের জীবন বিপন্ন করেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা দূর করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সকলকে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই এক চিত্র।
দুই.
স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের উচ্ছেদ হওয়ায় এবং সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গৃহীত হওয়ায় আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশে আর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। এই মনে হওয়ার ওপরে বেশি জোর দেওয়ায় কিছু কিছু বিষয় আমরা গুরুত্ব দিইনি। ১৯৭১ সালে যাঁরা বাস্তুত্যাগী হিন্দুর সম্পত্তি দখল করেছিলেন, ১৯৭২-এ তা কেউ কেউ ফেরত দেননি এবং এ-বিষয়ে সরকার থেকেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিধ্বস্ত রমনা কালীবাড়ি পুনর্নির্মাণের দাবি কোনো সরকারই পূরণ করেনি। ১৯৭২-৭৩-এ পুজোর সময়ে এদিকে ওদিকে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যে, তুলনায় পাকিস্তানের কালে সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা ও নিরাপত্তা বেশি ছিল বলে ভাবার কারণ ছিল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ, ইসলামের প্রতি রাষ্ট্রের প্রকাশ্য পক্ষপাত, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ক্ষমতাসীন হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তন সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই উৎসাহিত করেছে। আমরা আশির দশকে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করেছিলাম এবং রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা রুজু করেছিলাম, কিন্তু তাতে অমুসলমানদের আস্থা বা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাঁরা ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ’ গঠন করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার পথ খুঁজেছেন। সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা যে সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা উশকে দেয়, তার দৃষ্টান্ত আমরা পৃথিবীর বহু দেশে দেখেছি।
একটি দৈনিক পত্রিকার মিথ্যা প্রচারণার ফলে ১৯৯০ সালে এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯২ সালে দেশের নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ১৯৬৪ সালে যেমন রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ একযোগে দাঙ্গা-প্রতিরোধে সফলভাবে অগ্রসর হয়েছিল, ১৯৯০ ও ১৯৯২-তে তেমন উদেযাগ অনেক দুর্বল ছিল। প্রশাসনের তৎপরতায় ছিদ্র ছিল, অন্যেরাও জোর প্রতিরোধ করতে পারেনি। অমুসলমান নাগরিকেরা আওয়ামী লীগের ভোট-ব্যাংক, আওয়ামী লীগই তাদের রক্ষা করুক—সরকারের মনোভাব ছিল এ-রকম। আর নাগরিকদের নিরাপত্তাদানের দায়িত্ব সরকারের, তাদেরকেই যা করার তা করতে হবে—আওয়ামী লীগের মনোভাব ছিল অনেকটা এমন।
তারপর ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে যে-সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ঘটে, তা ন্যক্কারজনক। বিজয়ী দলের রাজনৈতিক কর্মীরা অত্যাচার করলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দেখলো। আমরা যখন গোপালগঞ্জের এক শরণার্থী শিবিরে দাঁড়িয়ে, আমাদের মাথার উপর দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উড়ে গেলেন হেলিকপ্টারে এবং ঢাকায় নেমে বললেন, তিনি কোনো আশ্রয়প্রার্থী দেখেননি। এই সময়ে হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছে, যারা রয়ে গেছে, তারা নিজেদের স্বার্থ পৃথক বলে ভাবতে শুরু করেছে, এমন কী স্বতন্ত্র নির্বাচনব্যবস্থার কথাও চিন্তা করেছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের এও এক চিত্র।
এর মধ্যেই শামসুর রাহমান ‘সুধাংশু যাবে না’র মতো অসাধারণ কবিতা এবং হাসনাত আবদুল হাই মর্মবিদারী দুটি গল্প লিখেছিলেন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা একাধিক রচনাসংকলন প্রকাশ করেছিলেন।
তিন.
গত এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পুবে-পশ্চিমে উত্তরে-দক্ষিণে নানা জায়গায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের পীড়ন করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর ধরন একইরকম। বাড়িঘর ও লোকজন তেমন আক্রান্ত হয়নি, কিন্তু উপাসনালয় ও প্রতিমাবিগ্রহের ধ্বংসসাধন করে উপাসকদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। ভয় পেয়ে তারা যেন ভিটেবাড়ি ও দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, সেটাই, মনে হয়, আক্রমণকারীদের লক্ষ্য। প্রশাসনের যে-সক্রিয়তা আশা করা গিয়েছিল, তা দেখা যায়নি—ঔদাসীন্য বা অপারগতা ছিল তার মূলে। নাগরিক সমাজ এসব প্রতিরোধ করতে তাৎক্ষণিক ও তাৎস্থানিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, পরে কিছু কিছু প্রতিবাদ হয়েছে। কিছু সাংগঠনিক উদেযাগও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সরকার অনেক ধর্মস্থান পুনর্নির্মাণ করে দিচ্ছেন বটে, তাতে ভাঙাবাড়ি জোড়া লাগবে, ভাঙামন জোড়া লাগবে কি?
আমরা যখন বলি, বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ, তখন কি এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা বিস্মৃত হয়ে বলি? যারা বলি, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তারা কি নিজেদের প্রবোধ দিই মাত্র? বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়, এ-কথা আমি সাধারণভাবে মানি। কিন্তু তাদের মধ্যে যে অনেকে সাম্প্রদায়িক এবং সক্রিয়ভাবে অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট, তার প্রমাণ তো চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা গেলেও রাষ্ট্রধর্মের বিধান বর্জিত হয়নি—সে কাদের মুখ চেয়ে? এই গোঁজামিলের মতো অবস্থাই বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির। বেশ আছি আমরা—পরস্পর ভাই ভাই—কিন্তু কখন যে তোমার মাথায় বাড়ি দেবো, তার ঠিক নেই, আর দিলে ওটা অগ্রজের শাসন বলে মেনে নিও।
নিজেদের ব্যর্থতা আমাদের স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আছে, আছে সামাজিক ব্যর্থতাও। যাঁরা ধর্মপ্রাণ, তাঁরা সকলকে বোঝাতে পারেননি যে, অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা ধর্মীয় নির্দেশের পরিপন্থী। যাঁরা ইহজাগতিক, যাঁরা নিত্য মানবতা, শুভাশুভ, ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলেন, তাঁরাও সমাজে যথোচিত প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হননি। ধর্মকে নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা বরঞ্চ ভেদবুদ্ধির মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন মানুষের কানে। আজ হিন্দু মুসলমান আলাদা, কাল শিয়া সুন্নি পৃথক, পরশু আহমদিয়ারা মুসলমান নয়—বলেই যাচ্ছেন এবং তাঁদের কথা শোনার মতো লোকও পাচ্ছেন। একাত্তরের ঐক্য কোথায় গেল? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে অতি অল্পসময়ে রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তেমন নেতৃত্ব আজ কোথায়?
নাগরিক সমাজকে জেগে উঠতে হবে—প্রতিরোধ করতে হবে তাদেরকে, যারা ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। বাংলাদেশকে কলুষমুক্ত করতে হবে সবাই মিলে।
আনিসুজ্জামান: লেখক ও শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments