নথি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব

[আমেরিকার আন্তর্জাতিক আর্কিভিস্ট ট্রুডি হাসকাম্প পিটারসন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি জাতীয় জাদুঘরে আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তিন দিনের ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন। বর্তমানে তিনি আইসিআইয়ের হিউম্যান রাইটস ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারপারসন। ট্রুডি যুদ্ধাপরাধের বিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ের আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যে নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং বিচার শেষে এসব নথির ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন। রচনাটি তিনি প্রথম আলোর জন্য লিখেছেন।] ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসে সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালতের আপিল প্যানেল ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সিয়েরা লিওনের যুদ্ধে লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলরকে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন।
১৯৯০ সালে পেরুতে একজন অধ্যাপকের জবরদস্তি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় জেনারেল কার্লোস আলবার্তো পাজ ফিগুএরাওয়াকে একই সময়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ ছাড়া ১৯৮৪ সালে গুয়াতেমালায় একজন ছাত্র ও শ্রমিকনেতাকে জোরপূর্বক নিখোঁজ করে দেওয়ার জন্য সাবেক জাতীয় পুলিশ-প্রধান হেক্টর বল দ্য লা ক্রুজকেও এই মাসে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। টেইলরকে ৫০ বছর, পাজ ফিগুএরাওয়াকে ১৫ বছর এবং বল দ্য লা ক্রুজকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ও অভিযুক্ত ব্যক্তির অ্যাটর্নিদের দ্বারা ব্যবহূত নথিপত্র এবং মামলা চলাকালীন আদালত কর্তৃক সৃষ্ট নথিপত্র উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেট ডয়লে, যিনি বল দ্য লা ক্রুজ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, লেখেন, ‘(গুয়াতেমালা জাতীয় পুলিশের) নথিগুলো রাষ্ট্রপক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল।’ টেইলরের মামলায় নথিপত্র অনেক বেশি ছিল। এসব নথি লাইবেরিয়া, যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং সিয়েরা লিওন, যেখানে তিনি অপরাধ সংঘটনে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন—উভয়কে ঐতিহাসিক তথ্য প্রদান করছে। অন্যদিকে পাজ ফিগুএরাওয়াকের বিরুদ্ধে মামলায় আদালতকে মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে হয়েছিল।
জো-মারি বার্ট, যিনি পাজ ফিগুএরাওয়াকের মামলা সম্পর্কে অনেক লিখেছিলেন; তাঁর মতে, ‘সাধারণভাবে সামরিক বাহিনী গৃহযুদ্ধকালীন নথিপত্রের অস্তিত্ব নিয়মিতভাবে অস্বীকার করে আসছিল, যদিও রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগের সপক্ষে বেশ কিছু নথি সংগ্রহ করেছিল এবং বিবাদীরাও তাদের নির্দোষত্ব প্রমাণ করতে আদালতে নথি উপস্থাপন করেছিল।’ এ কারণে অর্থাৎ নথিপত্রের অভাবে মৌখিক সাক্ষ্য বিচারিক তথ্যপ্রমাণের অংশ হয়ে পড়ছে এবং ভবিষ্যৎ মামলাসমূহে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একটি ঘটনা যেটি এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো থেকে অনেক কম গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি হলো জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সেপ্টেম্বর অধিবেশনে পাবলো দ্য গ্রিফের প্রতিবেদন। পাবলো দ্য গ্রিফ জাতিসংঘের সত্য, ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং পুনরাবৃত্তি-সম্পর্কিত বিশেষ প্রতিবেদক। তিনি লিখেছেন যে, সফল ট্রুথ কমিশন ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সত্য পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, নাগরিকের আস্থাকে লালন করে এবং আইনের শাসন জোরদার করতে ভূমিকা রাখে।’ তিনি বিশেষভাবে আর্কিভিস্টদের উদ্দেশে ট্রুথ কমিশন দ্বারা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় নথি ও ট্রুথ কমিশনের সৃষ্ট নথির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার শর্ত মেনে ট্রুথ কমিশন এবং জাতীয় আর্কাইভস সত্য জানার অধিকার এবং আরও অনেক বিচারিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আর্কাইভিংয়ে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে নথির অংশবিশেষ গোপন রাখা সম্ভব—এই কৌশলটি এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের উপযুক্ত নিয়মগুলো প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ প্রতিবেদক আর্কাইভিংয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের কথা বলেন এবং এ ধরনের উদ্যোগকে জোরালোভাবে সমর্থন দেন। বিশেষ প্রতিবেদকের নির্দেশনা ট্রুথ কমিশনের পরিধিকেও ছাড়িয়ে যায় এবং দ্য গ্রিফ জোর দেন যে, ‘সত্য একক বা যৌথভাবে ন্যায়বিচার,
ক্ষতিপূরণ এবং পুনরাবৃত্তি রোধের নিশ্চয়তার বিকল্প হতে পারে না।’ এ বিষয়ে মেনে চলার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাধানিষেধ রয়েছে, যা বাস্তব, নৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়নে বাধ্য করে। উপরন্তু বিশ্বাসযোগ্য বাস্তব প্রমাণ বিচারিক আদর্শ হিসেবে সর্বোত্তম ফলদায়ক হবে, যদি তা বিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ না করে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা ও কার্যকর করা হয়। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে টেইলরের বিচার এবং জাতীয় পর্যায়ে পেরু ও গুয়াতেমালার বিচারের দিকে পুনরায় আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সাধারণভাবে বিবাদী অ্যাটর্নির নথিপত্র হয় ব্যক্তিগত উপাদান আর সরকারপক্ষ এবং আদালতের নথিপত্র হয় সরকারি নথিপত্র। এগুলো দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিচারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এসব দলিল সংরক্ষণ করা দেশের অন্যতম প্রধান আর্কাইভাল দায়িত্ব। এটি বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং এ জন্য যে মামলার একটি অংশ উন্মুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। সেপ্টেম্বর মাসে মানবাধিকারের সামগ্রিক লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক মানবকল্যাণের বিচ্যুতি নিয়ে তিনটি আদালতে যথোপযুক্ত রায় হয়েছে। এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যেন বিষয়টি এখানেই সীমিত না থাকে এবং সামনের মাসগুলোতে সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালত বা পেরু ও গুয়াতেমালার বিচারব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে এ ধরনের সব কটি আদালতে দ্রুত এবং পেশাগতভাবে আর্কাইভাল ব্যবস্থাপনার সাহায্য নিয়ে নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়।
ট্রুডি পিটারসন: আন্তর্জাতিক আর্কিভিস্ট, যুদ্ধাপরাধের বিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ের আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.