রাজনীতি- বিএনপি আর কী করতে পারে? by ইনাম আহমদ চৌধুরী
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যেকোনো উপায়ে একটি লোক দেখানো নির্বাচনের মহড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
কথা
ছিল, সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে সর্বদলের অংশগ্রহণে একটি
সুষ্ঠু নির্বাচনের পদ্ধতি প্রণীত হবে। কিন্তু একটি অফলপ্রসূ ফোনালাপ এবং
ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রদের কয়েকটি ঘোষণা সে আশার প্রদীপকে ঢেকে দিয়েছে
ভিজে কম্বল দিয়ে। তার ওপর জুটেছে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা।
ফোনালাপ নিয়ে বহু আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তবে একটি বিষয় খোলাসা করা খুবই প্রয়োজন। একটি অকেজো লাল ফোন (যা পূর্ব-পরিজ্ঞাত না থাকার কোনো কারণ নেই) দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘দীর্ঘকালীন’ বিফল প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনার সূচনাতেই একটি ‘অবিশ্বাস’ বা ‘অভিসন্ধি-উপস্থিতি’র জন্ম দিয়েছিল। লাল ফোন ওঠালেই সংশ্লিষ্ট বিশেষ ‘এক্সচেঞ্জে’ একটি সতর্কধ্বনি হয়। আর কথোপকথন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই (যদি বারণ না থাকে) রেকর্ডকৃত হয়। কখনো যোগাযোগ স্থাপিত না হলে তা সঙ্গে সঙ্গেই এক্সচেঞ্জের জানার কথা। তা ছাড়া, উৎসস্থল হচ্ছে যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফোন। দ্বিতীয়ত, রেড ফোন চালু রাখার দায়িত্ব সরকারেরই (অর্থাৎ সরকারাধীন টেলিফোন কর্তৃপক্ষের)। তা ছাড়া, বিরোধীদলীয় নেতার লাল ফোনের অকার্যকর অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করাও হয়েছিল। রিপোর্ট না করলেও তা কর্তৃপক্ষের জানার এবং কার্যকর রাখার কথা। ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত, তা কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের একটি গুরুতর কর্তব্য-বিচ্যুতি। আর এ জন্যই হয়তো বিরোধীদলীয় মাননীয় নেত্রী শুরুতেই ভেবেছেন, তাঁকে কোণঠাসা করার জন্যই ‘আপনি ফোন ধরছেন না’—এ ধরনের অভিযোগ সমন্বিত কথোপকথনের সূচনা। এখানে আন্তরিকতার অভাবও পরিলক্ষিত হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, এর রেশ সারা ৩৭ মিনিটের ফোনালাপেই থেকে গেল। হলো না কোনো ফলাফল।
এই ফোনালাপের পরবর্তী পদক্ষেপ যখন মহাগুরুত্বপূর্ণ তখন দেখা যাক, ‘সংলাপ’ নিয়ে কী আলোচনা হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব ছিল (ক) ২৮ তারিখ সন্ধ্যাকালীন আলোচনা ও নৈশভোজ। (খ) হরতাল প্রত্যাহার। দুটোতেই অপারগতা জানিয়ে মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন (ক) হরতাল প্রত্যাহার করে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ তারিখের প্রস্তাবিত আলোচনা ও ভোজে যোগদানে তিনি অসমর্থ; (খ) কিন্তু সংলাপে তিনি আগ্রহী এবং তার জন্য ৩০ তারিখ বা এর পরবর্তী যেকোনো দিন সংলাপের জন্য তিনি প্রস্তুত। অর্থাৎ ২৮ তারিখের জন্য না হলেও অন্য যেকোনো দিনের জন্য তিনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং তদনুসারে আলোচনায় আগ্রহী। সুতরাং বিএনপি সংলাপে রাজি নয় বলে যে একটি বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যাচার হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনভিপ্রেত।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গণভবন প্রস্তুত, বিরোধীদলীয় নেত্রী সংলাপে আসতে পারেন। কিন্তু সেটা কবে? আসল কথাটাই-বা কেন বলছেন না? দিনক্ষণ স্থির না হলে কি বেগম খালেদা জিয়া গণভবনের দ্বারে সঙ্গী-সাথি নিয়ে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করবেন—‘আমি অতিথি এসেছি তোমারি দ্বারে, খোলো খোলো দ্বার ওগো... ফিরায়ে দিয়ো না মোরে?’ আওয়ামী কর্তৃপক্ষ বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে জিজ্ঞাসা—সংলাপে
সরকারি দলের বিন্দুমাত্র অভিলাষ থাকলে বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁরা কোনো দিনক্ষণ কেন জানাচ্ছেন না?
এটা যদি না হয়, তাহলে জাতির মনে এই ধারণাই যদি বদ্ধমূল হয় যে ফোনালাপের প্রচেষ্টা ছিল একটি প্রহসনমূলক নাটক, তা কি অসংগত হবে?
তা ছাড়া, ফোনালাপের বিবরণ সাধারণ্যে প্রকাশ (তাতে যদিও বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি) একটি অভিসন্ধির উপস্থিতির সন্দেহের উদ্রেক করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিনা অনুমতিতে এই ফোনালাপ রেকর্ড করা এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা নিঃসন্দেহে অনৈতিক ও শিষ্টাচারবিবর্জিত হয়েছে, সম্ভবত বেআইনিও। ৩১ অক্টোবরের দৈনিক বণিক বার্তায় সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম সংগত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন—‘অনেকের মনে আছে, কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক প্রধান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপে করা আলাপচারিতা প্রকাশ করেছিল একটি পত্রিকা। সেটি ছিল তাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা। এ যুক্তি দেখিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়ে মামলা করা হয় ওই পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে। দুই নেত্রীর এই আলাপচারিতা (যেখানে ব্যক্তিগত ব্যাপারও ছিল) প্রকাশ কি একই অপরাধের আওতায় পড়ে না?’ ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোয় সাংবাদিক সোহরাব হাসান লিখেছেন ‘মনে হয়েছে এক
পক্ষের কাছে আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে আমন্ত্রণের বার্তাটি দেশবাসীর কাছে প্রচার করাই মুখ্য ছিল। অপর পক্ষ সেই সুযোগে মনের মতো রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।’
তা ছাড়া, এর পরবর্তীকালীন সরকারের আচরণ, মন্ত্রীসহ আওয়ামী নেতাদের বিবৃতি, বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকল্প ঘোষণা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড—এসব কিছুই সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টির যে শুধু প্রতিকূলই নয়, মনে হচ্ছে সংলাপ যাতে কিছুতেই না হতে পারে, তারই নিশ্চয়তা বিধান করা হচ্ছে। এবং তা বিএনপিকে অনিবার্য কারণেই করে তুলছে আন্দোলনমুখী। কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি ও ১৮ দল এবং তাদের সমর্থকেরা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের যে বক্তব্য—‘নির্বাচন সর্বদলীয় হবে’ বা ‘নির্বাচনকালীন সরকার সর্বদলীয় হবে’—তা সম্পূর্ণ নিরর্থক। বিএনপি ও এর অনুসঙ্গীরা নির্বাচনে না এলে সে নির্বাচন কিছুতেই সর্বদলীয় এবং কোনো অবস্থাতেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা শুধু বিএনপি বা ১৮ দলের বক্তব্য নয়—গণফোরাম, বিকল্পধারা, গণঐক্য ফোরাম, বাম মোর্চা, বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সর্বোপরি দেশের জনগণ (জরিপ অনুযায়ী) এই একই কথা বলছেন। বাম মোর্চা (দৈনিক সমকাল, ২ নভেম্বর) বলেছে—‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে একক নির্বাচন করার কোনো অবকাশ নেই। বিরোধী দলগুলোকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাঁয়তারা দেশবাসী গ্রহণ করবে না। সরকারি দলের পক্ষে এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবও হবে না।’ (দৈনিক সমকাল, ২ নভেম্বর)। তাই চেষ্টা করতে হবে বিকল্প সমাধানের। এ প্রসঙ্গে নাগরিক সমাজে সংগঠন ‘সুজন’ দুটি সম্ভাব্য প্রস্তাব রেখেছে, যা প্রণিধানযোগ্য।
আমি দেখে খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে ১ নভেম্বরের প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ বলেছেন— ‘কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি এবং গণমাধ্যম প্রায়ই বলে থাকেন, উচ্চ আদালত নাকি আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এটা অর্ধসত্য।’ এটা কি ঠিক হলো? আদালতের বক্তব্য উদ্ধৃতি দিলেই তো কোনো ‘অর্ধসত্য’ থাকছে না। পূর্ণ বিচারাদেশে বলা হয়েছে—‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র পরবর্তী দুটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।’ এখানে তো এটাই বলা হচ্ছে যে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা, যা ছিল একটি সর্বদল স্বীকৃত চালু ব্যবস্থা, তা আগামী দুই সাধারণ নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংসদ চালু রাখতে পারে। তা না করে জাতীয় সংসদ সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এককভাবে পছন্দমতো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ব্যাপারে ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে তাঁর বিচারাদেশে আগামী দুই সাধারণ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার সুযোগ সংসদের ছিল। তাঁর বিচারাদেশের অজুহাতে সেটার অন্যথা করা তো অসংগত হয়েছে। বিচারাদেশের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিরোধী দল যে কিছু বলছে না, তা বিচারপতি খায়রুল হকের বিবৃতি পড়লেই বোঝা যাবে। তা ছাড়া মোদ্দা কথা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারাধীন দলীয় নির্বাচন বিরোধী দলগুলো ও জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না।
ওই প্রবন্ধে আরও মন্তব্য করা হয়েছে—‘এসব দুর্বৃত্তপনা আর নৈরাজ্যের দায়িত্ব অবশ্যই বিরোধী দলকে নিতে হবে।’ কেন? বর্তমানের এই রাজনৈতিক সংকট, অচলাবস্থা এবং সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি কে করেছে? প্রশাসনের দুর্বৃত্তায়ন ও দলীয়করণ কে করেছে? এ নির্বাচনের একটি সর্বদল স্বীকৃত ব্যবস্থা রাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা পাল্টে দিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা কে সৃষ্টি করেছে? প্রধানমন্ত্রীকে গদিনশিন রেখে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন যে হবে না, জনগণের এই দৃঢ় মনোভাব জেনেও তার একগুঁয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে কে এই রক্তক্ষয়ী সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে? হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে কে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করছে? নির্বাচনের সময়েও সব ধরনের সভা-সমাবেশ, এমনকি ঘরোয়া সমাবেশ, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে গণতন্ত্রবিরোধী স্বৈরাচারী আদেশ কে জারি করেছে?
এসব প্রশ্নের একটিই উত্তর। এবং তা হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই প্রাবন্ধিক আরও বলেছেন ‘বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে শুধু কাগজে-কলমে বিএনপির প্রধান।’ তাঁর শঙ্কা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বিএনপির স্বার্থের প্রাধান্য দিচ্ছেন না। তাঁর জ্ঞাতার্থে বিনীত নিবেদন—বেগম খালেদা জিয়া যে শুধু কাগজে-কলমে নন, বাস্তবিক পক্ষেই বিএনপির (এবং ১৮-দলীয় জোটেরও) প্রধান, তা কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তা প্রভাতকালীন সূর্যোদয়ের মতোই অবিসংবাদিত সত্য। দলের স্বার্থ এবং জনগণের মঙ্গলচিন্তাই তাঁর সিদ্ধান্তের নিয়ামক।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপির চেয়ারপারসন।
No comments