ভারতে মৌলবাদের উত্থান

মৌলবাদ আবারও তার জঘন্য মাথা তোলা শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) খোলাখুলি জানিয়েছে যে তারা সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করবে। অন্যদিকে, উদারমনা জামায়াতে উলামা-ই-হিন্দ মুসলিম ভোটের কথা তুলেছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচন হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপে ফেলেছে। তারা চাইছে হিন্দু-মুসলিমের সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট করে উভয় পক্ষের মেরুকরণ ঘটাতে। আরএসএসের কথাই প্রথমে আসুক। আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা বিজেপির কাজকর্ম নিয়ে অসন্তুষ্ট। আরএসএস মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে। এবং এ ব্যাপারে আরএসএস হয়তো বিজেপির মধ্যে অপেক্ষাকৃত উদারমনা হিসেবে পরিচিত এলকে আদভানি, সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলির ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই বিজেপি ভারত ভাগ হওয়ার পরের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেলকে সামনে নিয়ে আসছে। আরএসএস তাদের গঠনতন্ত্রে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিখেছিল যে তারা কখনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে না। মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর নিষিদ্ধ হয়েছিল দলটি। সে সময় রাজনীতিতে যোগ না দেওয়ার শর্তে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ওঠানো হয়।
গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে আরএসএসের যোগাযোগ ছিল। সরদার প্যাটেল হিন্দুত্বপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে গান্ধী হত্যার সঙ্গে আরএসএস জড়িত। ১৯৪৮ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি এমন দাবিই করেছিলেন। তবে প্যাটেলের বিশ্বাস ছিল, গান্ধীর নিহত হওয়ার বাস্তবতা তৈরিতে আরএসএসের সহিংস কাজের ধরনের সম্পর্ক ছিল। সে সময়ের সংঘের প্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়াকার দোষী সাব্যস্ত হননি। তার পরও সংঘকে সে সময় তাদের গঠনতন্ত্রে লিখতে হয়েছিল যে, তাদের মনে কোনো ‘রাজনীতি’ থাকবে না; তারা ‘সম্পূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত’ থাকবে। এত কিছুর পর আরএসএসের বর্তমান প্রধান মোহান ভাগতের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত প্যাটেলের কাছে দেওয়া সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ। তাহলেও ব্যাপারটা দেখার দায়িত্ব এখন নির্বাচন কমিশনের। কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এক লাফে রাজনৈতিক বৃত্তে ঢুকে পড়ে? এমনকি আরএসএস যদি তাদের গঠনতন্ত্রও বদলায়, নিষিদ্ধকরণ প্রত্যাহারে দেওয়া মুচলেকাকে তাহলে তারা কীভাবে জায়েজ করবে? জামায়াতে উলামা-ই-হিন্দের প্রধান মাহমুদ মামদানির কথাই ধরা যাক, তিনি সেক্যুলার নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তাঁরা নরেন্দ্র মোদির জুজু দেখিয়ে মুসলিম ভোটারদের ভীত করা না হয়। তিনি বরং দাবি করেছেন, যাতে দলগুলো যার যার আমলে পালিত প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যতে কী তারা করবে, তার ইশতেহারের ভিত্তিতে ভোট চায়। মাদানি যা বলেছেন তার সবকিছুর সঙ্গেই আমি একমত।
তবে ‘মুসলিম ভোট’ কথাটা ব্যবহার নিয়ে কথা আছে। হিন্দু বা মুসলিম ভোট বলে কিছু নেই, সবই ভারতীয় ভোট। এক সম্প্রদায়ের জন্য যা ভালো, তা অন্য সম্প্রদায়ের জন্যও ভালো। মুসলিমদের আলাদা করে চিহ্নিত করা হলো সেটাই, যা আরএসএস হিন্দুদের বেলায় করে। কংগ্রেস বলেছে, ‘আমরা কোনো ব্যক্তিকে মাথায় রেখে আমাদের কৌশল ঠিক করিনি। আমাদের কৌশল আমাদের দলের নীতি ও কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত।’ কিন্তু কার্যত কংগ্রেস মোদিকে আলাদাভাবে আক্রমণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে কংগ্রেস উন্নয়নের মতো সারবত্তাসম্পন্ন কোনো ইস্যুকে সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং তারা মোদির হাতেই খেলছে। আর মোদিও দারুণভাবে ২০১৪-এর নির্বাচনকে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের মতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেলতে পেরেছেন। পাশাপাশি, নিজের হিন্দু মৌলবাদী চেহারা ঢাকতে আশ্রয় নিয়েছে উন্নয়নের বুলির। কংগ্রেসের দুর্বলতা হলো তাদের দুর্বল শাসন এবং মেয়াদ ফুরানোর সময়কার সমালোচনা। আমি চেয়েছিলাম যাতে আগাম নির্বাচন হয় এবং যাতে করে নতুন সরকার দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য কোনো কর্মসূচি হাতে নিতে পারে। কিন্তু এখন থেকে নির্বাচনে আগের ছয় মাসে আসলে তেমন কিছুই করা যাবে না। এদিকে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। তবে সবচেয়ে খারাপ কাজটি অযোধ্যায় করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি। তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং হাজারো মুসলিমকে হত্যার জন্য দায়ী।
তারা এবারও সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য রথযাত্রার পরিকল্পনা করেছিল, যা কেন্দ্রীয় সরকার সঠিকভাবেই বাতিল করে দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম, এই দুটি দল দলিতদের অধিকারের জন্য কাজ করুক। কিন্তু তাদের মনে সেই চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। দলিতরা এমনকি আদালতের কাছেও কোনো সুবিচার পায় না। সম্প্রতি বিহারের ভূমিহারে ভূমিহার সম্প্রদায়ের লোকেরা ২৭ জন নারী, ১০ শিশুসহ ৫৮ জন দলিতকে হত্যা করেছে। উচ্চবর্ণের বিচারক অভিযুক্ত ১৬ জনকেই কোনো প্রমাণ না থাকার কথা বলে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন। এটা ন্যায়বিচারের পরিহাস। অথচ নিম্ন আদালত এই অভিযুক্ত ১৬ জনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের বিচারক যদি পর্যাপ্ত প্রমাণ না পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর উচিত ছিল বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করা। এই দলের কাজ করার কথা উচ্চ আদালতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে নতুন করে তদন্ত করা। তা না করে বিচারক রায়ে বলেছেন, দলিতরা তাদের চৌদ্দ পুরুষের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অর্থাৎ কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি! ভূমিহারের লক্ষ্মণপুরে দলিতদের যে অবস্থা, সেই একই অবস্থা সারা দেশে। আইনের সমানাধিকারের যে বুলি সংবিধানে মহিমান্বিত হয়ে আছে, তা আসলে এক পরিহাস।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.