রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী by মাহমুদুল বাসার
গত
৪ অক্টোবর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশ ইতিহাস
সম্মিলনীর উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক গণবক্তৃতা সম্মিলনে বক্তারা
বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হল গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র পথ। এর কোনো বিকল্প
নেই। রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার ফল কখনও সুখকর হয়নি। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রকে
আলাদা করেই দেখতে হবে। এ সম্মিলনে বাংলাদেশ থেকে উগ্র ধর্মীয়
সাম্প্রদায়িকতা রুখতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের জোরালো আহ্বান
জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যুগ যুগ
ধরে চলছে। এ নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও নতুন কিছু নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি
সময়ে এ প্রবণতা মাহামারী আকার ধারণ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এর বাইরে
নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও
রাজনীতিকরা এ সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন বলে উদ্যোক্তারা বক্তৃতায় বলেছেন।
সম্মিলনে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছেন। সম্মিলনে প্রধান অতিথির
বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে ভারত উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। এ সম্মিলনের জ্ঞানী বক্তাদের বক্তব্য থেকে আরও ভালো করে তা জানা গেল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যারা পালাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তারা কেউ সরাসরি ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে জঙ্গিবাদ প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কেউ নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে মোলায়েম কৌশলে ধর্মকে রাষ্ট্রের নীতিমালার সঙ্গে মিশিয়ে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য খাড়া রাখার স্বার্থে প্রায় সব পক্ষ কোনো না কোনো কৌশলে ধর্মকে ব্যবহার করছেন। এতে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে নানা অশান্তি, রক্তপাত চলছে। রাষ্ট্রগুলো এক একটি স্ববিরোধী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করতে গিয়ে। এই সম্মিলনের প্রত্যেক বক্তাই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রত্যেক বক্তার বক্তৃতার সারমর্ম অভিন্ন, তা হল রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনা হলে বিপদ বাড়বে ছাড়া কমবে না। পৃথিবীর তাবৎ মনীষী বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হয় না, রাষ্ট্র পুরোপুরি অর্থনীতি ও সংস্কৃতিভিত্তিক। এ সম্মিলনের প্রধান বক্তা ভারতের জামিয়া মিল্লাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মশিরুল হাসান বলেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র পথ। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের বিরোধিতা নয়। তিনি বলেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতিকরা অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন করার লক্ষ্যে তেমন কোনো কাজ করেননি। যদি তারা সেভাবে কাজ করতেন, তাহলে অসাম্প্রদায়িক সামাজ গঠন সম্ভব হতো। তিনি বলেন, মুসলিম সমাজে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে নারীরা পিছিয়ে আছেন। মুসলিম নারীদের রাষ্ট্রগঠনে যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়নি।
এ বক্তব্যের মাধ্যমে যে ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা ফুটে উঠেছে তা আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ভেবে দেখা দরকার। পাকিস্তানের লাহোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক রহমান বলেন, অসাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একত্র হয়েছি। নানা মত, ভাবনা আর পরামর্শে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা দরকার বলে আমরা মনে করি। তারিক রহমান পাকিস্তানে নির্বিচারে ধর্মের অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেন তার বক্তৃতায়। ব্যাপক ইসলামীকরণের প্রভাবে পাকিস্তানের খ্রিস্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়ও প্রভাবিত হচ্ছেন। এতে নিঃসন্দেহে নাগরিক মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞান, ইতিহাস ও যুক্তিমনস্কতা অবরুদ্ধ হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। এর বিরুদ্ধে এখনই সজাগ হতে হবে। যারা ডেমোক্র্যাট, লিবারেল, তারা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থানকে ধর্ম দিয়ে প্রতিরোধ করতে চায় কখনও কখনও। কিন্তু সেটা একপর্যায়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সে কারণে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কথাটা বোধ করি অতি ব্যবহারে একটু মলিন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার অর্থ আরও স্পষ্ট করা দরকার। না হলে নাস্তিক খেতাব কপালে জুটবে। বলা দরকার, রাজনীতির মঞ্চে ধর্মচর্চা আর ধর্মের মঞ্চে রাজনীতিচর্চা চলবে না। এসব ফেরেববাজি চললে রাষ্ট্রে ধর্মের ফেরকা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। রাজনৈতিক পক্ষকে রাজনৈতিক ইস্যু দিয়েই ঘায়েল করা বাঞ্ছনীয়, যখনই ধর্মীয় ইস্যু দিয়ে ঘায়েল করা হয় তখনই বিপত্তি ঘটে, জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সম্মিলনে মূল্যবান কথা বলেছেন মননশীল লেখক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ধর্ম মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটি গণভাবে ব্যবহার করা বিধি নয়। ধর্মকে ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন তারা একটি নীতি দিয়েছিল, ভাগ কর, শাসন কর। এ নীতি নেয়ার ফলে তাদের শাসন করতে সুবিধা হয়। পাশাপাশি তখন মুসলিম লীগও ধর্ম ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিণতিতে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ভাগ হয়। ড. চৌধুরী আরেকটি চমৎকার কথা বলেছেন- দেশে এখন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ সমাজের ধনীরা এলাকায় গিয়ে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে না। আর মাদ্রাসায় পড়ছে গরিব শিক্ষার্থীরা। সেখানে কোনো ধনীর সন্তানেরা পড়ে না। আসলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। ধর্ম ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এর চেয়ে সহজ ব্যাখ্যা আর হতে পারে না। শ্রীলংকার অধ্যাপক রোহান গুনারত্নে বাংলাদেশ থেকে উগ্রধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা রুখতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। অধ্যাপক রোহানের মতে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ পাশাপাশি অবস্থান করে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এর উৎস। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, যারা ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন করে শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া বুদ্ধিভিত্তিক ও আদর্শগত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাস সম্পর্কে অধ্যাপক রোহান কাটা কাটা সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তবে এখনও তা অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় পৌঁছেনি। এখনই ব্যবস্থা নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী। এটা মৌলবাদিতা রুখতে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, ২০০২, ০৩, ও ০৬ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আল কায়দার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সে সময়ের সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে ব্যবস্থা না নিয়ে এড়িয়ে গেছে। অথচ সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবেলা করতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
ড. আবুল বারাকাত বরাবারের মতো ধর্মীয় মৌলবাদীদের অর্থনীতির উৎস পরিসংখ্যান আকারে তুলে ধরেন এ সম্মিলনে। তিনি বলেন, জামায়াত সুসংগঠিত জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করতে চায়। এ জন্য তারা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড দেশেকে হাজার বছর পিছিয়ে দেবে। কারণ তারা যুক্তির ধার ধারে না। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত। দেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হল মাদ্রাসা শিক্ষা।
অতন্ত ভয়ংকর একটি মুহূর্তে বাংলাদেশে দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস সম্মিলন হল। সামনে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষমতা পরিবর্তন যদি দেশের সংখ্যালঘু বিতাড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বিকৃত হয়, সাম্প্রদায়িক উগ্রতা হালে পানি পেয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশে অন্ধকার নেমে আসবে।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে ভারত উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। এ সম্মিলনের জ্ঞানী বক্তাদের বক্তব্য থেকে আরও ভালো করে তা জানা গেল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যারা পালাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তারা কেউ সরাসরি ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে জঙ্গিবাদ প্রশ্রয় দিচ্ছেন, কেউ নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে মোলায়েম কৌশলে ধর্মকে রাষ্ট্রের নীতিমালার সঙ্গে মিশিয়ে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য খাড়া রাখার স্বার্থে প্রায় সব পক্ষ কোনো না কোনো কৌশলে ধর্মকে ব্যবহার করছেন। এতে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে নানা অশান্তি, রক্তপাত চলছে। রাষ্ট্রগুলো এক একটি স্ববিরোধী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করতে গিয়ে। এই সম্মিলনের প্রত্যেক বক্তাই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রত্যেক বক্তার বক্তৃতার সারমর্ম অভিন্ন, তা হল রাজনীতিতে ধর্ম টেনে আনা হলে বিপদ বাড়বে ছাড়া কমবে না। পৃথিবীর তাবৎ মনীষী বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হয় না, রাষ্ট্র পুরোপুরি অর্থনীতি ও সংস্কৃতিভিত্তিক। এ সম্মিলনের প্রধান বক্তা ভারতের জামিয়া মিল্লাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মশিরুল হাসান বলেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র পথ। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের বিরোধিতা নয়। তিনি বলেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতিকরা অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন করার লক্ষ্যে তেমন কোনো কাজ করেননি। যদি তারা সেভাবে কাজ করতেন, তাহলে অসাম্প্রদায়িক সামাজ গঠন সম্ভব হতো। তিনি বলেন, মুসলিম সমাজে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে নারীরা পিছিয়ে আছেন। মুসলিম নারীদের রাষ্ট্রগঠনে যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়নি।
এ বক্তব্যের মাধ্যমে যে ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা ফুটে উঠেছে তা আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ভেবে দেখা দরকার। পাকিস্তানের লাহোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক রহমান বলেন, অসাম্প্রদায়িক ইস্যুতে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একত্র হয়েছি। নানা মত, ভাবনা আর পরামর্শে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা দরকার বলে আমরা মনে করি। তারিক রহমান পাকিস্তানে নির্বিচারে ধর্মের অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেন তার বক্তৃতায়। ব্যাপক ইসলামীকরণের প্রভাবে পাকিস্তানের খ্রিস্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়ও প্রভাবিত হচ্ছেন। এতে নিঃসন্দেহে নাগরিক মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞান, ইতিহাস ও যুক্তিমনস্কতা অবরুদ্ধ হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। এর বিরুদ্ধে এখনই সজাগ হতে হবে। যারা ডেমোক্র্যাট, লিবারেল, তারা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থানকে ধর্ম দিয়ে প্রতিরোধ করতে চায় কখনও কখনও। কিন্তু সেটা একপর্যায়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সে কারণে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কথাটা বোধ করি অতি ব্যবহারে একটু মলিন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার অর্থ আরও স্পষ্ট করা দরকার। না হলে নাস্তিক খেতাব কপালে জুটবে। বলা দরকার, রাজনীতির মঞ্চে ধর্মচর্চা আর ধর্মের মঞ্চে রাজনীতিচর্চা চলবে না। এসব ফেরেববাজি চললে রাষ্ট্রে ধর্মের ফেরকা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। রাজনৈতিক পক্ষকে রাজনৈতিক ইস্যু দিয়েই ঘায়েল করা বাঞ্ছনীয়, যখনই ধর্মীয় ইস্যু দিয়ে ঘায়েল করা হয় তখনই বিপত্তি ঘটে, জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সম্মিলনে মূল্যবান কথা বলেছেন মননশীল লেখক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ধর্ম মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটি গণভাবে ব্যবহার করা বিধি নয়। ধর্মকে ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন তারা একটি নীতি দিয়েছিল, ভাগ কর, শাসন কর। এ নীতি নেয়ার ফলে তাদের শাসন করতে সুবিধা হয়। পাশাপাশি তখন মুসলিম লীগও ধর্ম ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিণতিতে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ভাগ হয়। ড. চৌধুরী আরেকটি চমৎকার কথা বলেছেন- দেশে এখন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ সমাজের ধনীরা এলাকায় গিয়ে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে না। আর মাদ্রাসায় পড়ছে গরিব শিক্ষার্থীরা। সেখানে কোনো ধনীর সন্তানেরা পড়ে না। আসলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। ধর্ম ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এর চেয়ে সহজ ব্যাখ্যা আর হতে পারে না। শ্রীলংকার অধ্যাপক রোহান গুনারত্নে বাংলাদেশ থেকে উগ্রধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা রুখতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। অধ্যাপক রোহানের মতে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ পাশাপাশি অবস্থান করে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এর উৎস। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, যারা ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন করে শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া বুদ্ধিভিত্তিক ও আদর্শগত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাস সম্পর্কে অধ্যাপক রোহান কাটা কাটা সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তবে এখনও তা অপ্রতিরোধ্য অবস্থায় পৌঁছেনি। এখনই ব্যবস্থা নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী। এটা মৌলবাদিতা রুখতে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, ২০০২, ০৩, ও ০৬ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আল কায়দার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সে সময়ের সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে ব্যবস্থা না নিয়ে এড়িয়ে গেছে। অথচ সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবেলা করতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
ড. আবুল বারাকাত বরাবারের মতো ধর্মীয় মৌলবাদীদের অর্থনীতির উৎস পরিসংখ্যান আকারে তুলে ধরেন এ সম্মিলনে। তিনি বলেন, জামায়াত সুসংগঠিত জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখল করতে চায়। এ জন্য তারা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড দেশেকে হাজার বছর পিছিয়ে দেবে। কারণ তারা যুক্তির ধার ধারে না। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত। দেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হল মাদ্রাসা শিক্ষা।
অতন্ত ভয়ংকর একটি মুহূর্তে বাংলাদেশে দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস সম্মিলন হল। সামনে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষমতা পরিবর্তন যদি দেশের সংখ্যালঘু বিতাড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বিকৃত হয়, সাম্প্রদায়িক উগ্রতা হালে পানি পেয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশে অন্ধকার নেমে আসবে।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
No comments