নাইউজি মসজিদ ও রেডগার্ড by মঈনুস সুলতান
সাড়ে তিন বছরের কন্যা কাজরিকে নিয়ে আমরা
সন্ধ্যের পর বসেছি বেইজিং শহরের একটি রেস্তোরাঁয়। এখানকার অত্যন্ত আন্তরিক
বাবুর্চি আজ পরিবেশন করেছেন কুজয়াও ইউ বলে শির্কায় জারিত গোলমরিচের ফোঁড়ন
দেয়া আস্ত একটি মাছ। কাজরির জননী হলেন চপস্টিকে এক টুকরা মাছ উঠাতে গিয়ে
অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে আছে কাচের জানালায় লাগানো চীনের সিয়ন অঞ্চলের সপ্তম
শতাব্দীতে কায়েম ঐতিহাসিক মসজিদের ছবির দিকে। সম্পূর্ণ চীনা স্থাপত্য
রীতিতে টালির ঘেরা কার্নিশ দেয়া মসজিদটির ছবি সে অনেকবার দেখেছে, কারণ আমরা
বেইজিংয়ে আছি সপ্তাহ দুয়েক হল এবং প্রায় প্রতিদিনই সপ্তায় ডিনার করছি এ
রেস্তোরাঁয়। এখানকার বাবুর্চি (তিনিই একমাত্র কর্মচারী সম্ভবত মালিকও),
সিয়ান থেকে আগত হুই সম্প্রদায়ের মুসলিম। সাদামাটা এ রেস্তোরাঁর বাইরের
দিকের কাচে লাগানো আছে কাবা শরিফ ও মদিনা মনওয়ারার দুটি স্টিকার। হুই
গোত্রের এ কুক দেখতে অনেকটা মিনিয়েচার চিত্রে আঁকা ছোট ছোট চোখের যৎসামান্য
দাড়িওয়ালা মোগল সিপাহির মতো। চোখজোড়া আকারে বেজায় ছোট্ট হলেও তার হৃদয়
অত্যন্ত দরাজ। স্টিকার দেখে তার ধর্ম নির্ণয় করে আমরা প্রথম যেদিন এখানে
ঢুকি; স্লামালেকুম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাত বাড়িয়ে মোসাফা করে
আমাদের বসতে দেন। কাজরি দুষ্টুমিতে বেসামাল হয়ে সয়-সসের কৌটা উল্টে দিলে
তাকে টেনে নেন তার প্রশস্থ বুকে। তারপর তার সংকীর্ণ দুই চোখ আরেক প্রস্থ
ছোট করে তার সঙ্গে খুনসুটিতে মাতলে এবং পরে তার খাবারের দাম চার্জ না করলে
আমরা বুঝতে পারি তার আন্তরিকতা অশেষ এবং আমাদেরও এখানে আসতে হবে অনেকবার।
আজকের পারিবারিক ডিনার কিছুতেই জমে উঠছে না। আমরা বসেছি লেডি সুজান নামে পরিচিত একটি গোলটেবিলে, যাতে আলগা কাচের চাকতির উপর খাবারের বাটিগুলো রাখা। তার জননী হলেন নিশ্চুপ হয়ে আছে বলে সে চাকতি ঘোরালে তাতে রাখা সুয়ানালা টাং বা হট এন্ড সাওয়ার স্যুপের বাটি উপচে টেবিলক্লথ ছলকে পড়ে উষ্ণ তরল। হলেন তাতে ভ্রুকুটি করে কাঁধ হেলালে তার তাম্রবর্ণের ব্র“নেট চুলের বাঁকানো কার্লে এসে পড়ে লোহিত ট্যাসেল ঝোলা চীনা লণ্ঠনের আলো। বিকালের দিকে একটা বিষয়ে আমাদের দ্বন্দ্ব হয়েছে, সে থেকে বাতচিত প্রায় বন্ধ। আজকের সকাল কিন্তু আমাদের মোটমির্যা ভালোই কেটেছে। ৯টার দিকে বাজার বাও আরও ১০ জন পর্যটকের মতো আমরা ঢুকে পড়ি। নিষিদ্ধ নগরীর ঈশান কোনে ৬৯ হেক্টরে বিস্তৃত চীন সম্রাটদের দশম শতাব্দীতে তৈরি বাগিচা বিলাস বেইহাই পার্কে। এখানে সরোবরের ভেতর একটি কৃত্রিম দ্বীপে পাহাড়ের চূড়ায় অমিতাভ গৌতমের শ্বেত মর্মরের প্যাগোডা। সরোবরের পাড় ঘেঁষে জলের উপর ভাসমান জোড়া প্যাভেলিয়ন। আমরা তার চাতালে বসে ঘুরে তাকালে একটি ব্রিজের তিনটি দৃষ্টিনন্দন বৃত্ত ও পাহাড়ে মন্দিরের আকৃতি চলে আসে সমান্তরাল রেখায়। কাজরি অন্য চীনা বাচ্চাদের সঙ্গে ছোটাছুটি করে। তাদের মা-বাবা শ্বেতাঙ্গিনী রমণীর সঙ্গে জুটে যাওয়া বাঙালি পুরুষের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আমাদের অত্যন্ত মশলাদার কুড়মুড়ে খাবার অফার করলে; তার সর্ষে-মরিচময় ঝাঁঝ শুঁকে আমাদের মেজাজ খুশ হয়ে যায়। হলেন সরোবরে ফোটা পদ্মের দিকে তাকিয়ে ইম্পিরিয়েল গার্ডেনের ম্যাজেস্টিক বিউটিতে মুগ্ধ হয়ে প্রিন্সেস অব চায়নার বিশুদ্ধ সুর শিস দিয়ে ভাঁজে।
বিকালের দিকে বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে যাই ট্রেনে চড়ে মঙ্গোলিয়ার উলানবাটরে যাওয়ার খোঁজ নিতে। আমাদের আরও সপ্তাহ দুয়েকের সাবকাশ আছে সুতরাং অবকাশ যাপনের জন্য উলানবাটরে যাওয়া যায়। কিন্তু হলেন সহসা সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে মঙ্গোলিয়ায় যেতে চায় না। হঠাৎ মতান্তর দেখা দিলে আমি বেজায় আতান্তরে পড়ি। উলানবাটরে যাওয়ার আইডিয়া আদিতে তারই ছিল। এমনিতেই বেইজিংয়ের অলিগলিতে চীনা জবান বুঝতে আমাদের লবেজান হওয়ার দশা, তার উপর উলানবাটরে চলে মঙ্গোলিয়ান আর অল্পবিস্তর রুশ; দুটোই আমাদের আজানা। সুতরাং সে আরেকটি স্রেফ বেগানা ভাষা নিয়ে ডিল করতে চায় না। কিন্তু ভাষা না জেনে কি মানুষজন ভিন্ন দেশে যাচ্ছে না? পর্যটকরা তো ভাষাতত্ত্বের পয়লোয়ান না, তারা তো কেউ লবেজান হচ্ছে না, দিব্যি ট্রেন চড়ে পাড়ি দিচ্ছে মঙ্গোলিয়ার দিকে?
এ দ্বন্দ্ব বিস্তৃত হতে হতে এখন কথা বন্ধে দাঁড়িয়েছে। রেস্তোরাঁর গোলটেবিলে খাবার সামনে নিয়ে আমরা ডিনারের ভান করছি, এমন সময় বাবুর্চি এসে কিছু বলার চেষ্টা করেন। তার বাচনিকে আমরা কিছু না বুঝে আরও দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। তিনি কাজরিকে চীনা মিষ্টান্নের একটি প্যাকেট দিয়ে ডেসপারেট হয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে আজানের ভঙ্গি করে রুকু সেজদায় রীতিমতো নামাজের নিশানা করেন। বিষয় কি? মূকাভিনয়ে তার যে কিছু প্রতিভা আছে তার পরিচয় তিনি আগেও দিয়েছেন। প্রথম দিন আমাদের মাংস পরিবেশন করলে তা কীসের মাংস আমরা জানতে চাই। তার বক্তব্য, আমাদের বোধগম্য না হলে তিনি কুকরুকু ধ্বনিতে মোরগার মতো পাখা ঝাপটিয়ে তথ্য পরিবেশন করেন। এবার তার রুকু সেজদার সঙ্গে লা ঈদ লা ঈদ ধ্বনিত হলে হলেনের মুখে হাসি ফোটে। সে বাবুর্চির আচরণ থেকে আবিষ্কার করে আগামীকাল ঈদ। তিনি একটি চিরকুটে বেইজিংয়ের নাইউজি মসজিদের ঠিকানা লিখে দেন।
রেস্তোরাঁ থেকে অল্প দূরে বেইজিংয়ে ডংচেং ডিস্ট্রিক্টের একটি সস্তা হোটেলে আমরা বাস করছি। ওখানে ফেরার পথে বুঝতে পারি ঈদ শব্দটি সিসিম ফাঁকের ম্যাজিকের মতো খুলে দিয়েছে আমাদের মনের সিন্ধুক। নানা দেশে পারিবারিকভাবে ঈদ উদযাপনের কিছু মুখরোচক মেমোরি আমাদের আছে। সুতরাং হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বেইজিংয়ে কীভাবে ঈদ পালন করা যায় তা নিয়ে হলেন পরিকল্পনা করতে শুরু করে। হোটেলে ঢুকতেই আমার মাথায় সংশয় চাগিয়ে ওঠে। বাবুর্চি তো লা ঈদ বলে সংবাদ দিলেন। শব্দটা আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি তো? সব কিছুতে থরোভাবে জেনেশুনে কাজে নামার প্রবণতা হলেনের আছে। তাই বিষয়টি কনফার্ম করার জন্য হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে সে কথা বলতে চায়। এ হোটেলে ম্যানেজারই একমাত্র ব্যক্তি যার চল্লিশটি মতান্তরে পচপান্নটি ইংরেজি শব্দের উপর দখল আছে। বেশ রাত হয়েছে, তার কামরার সামনের দুয়ার বন্ধ। হলেন ঠেলে পেছনের দুয়ার দিয়ে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ভদ্রলোক তাড়তাড়া নোট ছড়িয়ে বসেছেন। রিসিপশনিস্ট তরুণী ডেক্সের উপর পা ঝুলিয়ে বসে গুনছে ভাংতি পয়সা। খোলা ক্যাশবক্সের পাশে রাখা তার সিল্কের স্টার্কিংস ও কাওলিয়াং জু বলে সরগম ওয়াইনের খোলা শিশি। মনে হয় আমরা তাদের প্রাইভেট মুহূর্তে ঢুকে পড়েছি। হলেনের মুখে ঈদ শব্দটি শুনে ম্যানেজার এমন তেড়ে ওঠেন যেন আমরা সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছি তার কক্ষে।
শেষ রাতের দিকে কাজরি জেগে উঠে-বাপি হোয়েন ইজ ঈদ... ঈদ করলে আমাদের ঘুমনিদ তেমন ভালো হয় না। মসজিদে যাওয়ার জন্য কি পরব তা নিয়েও একটু বিভ্রান্তি হয়। হলেন আমাকে মাও-জ্যাকেট বের করে দেয়। এ ছাড়া মসজিদে পরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পোশাক-আশাকও পাই না। বেইজিংয়ে আগমনের প্রথম সপ্তাহে আমি একটি পঞ্চতারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে যোগ দেই। ক্যাজুয়েল পোশাকে ওখানে ঢুকতে গেলে দুয়ারে দাঁড়ানো মিলিটারি পোশাকের এক চৌকিদার পথ আটকে ফর্মাল ড্রেসকোড তথা স্যুট পরে আসতে বলে। উপায়ান্তর না দেখে হোটেলের শপিং আর্কেডের দোকান থেকে রেডিমেড স্যুট কেনার চেষ্টা করি। কিন্তু অনভ্যাসবশত টাই পরতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ গলবন্ধ বাঁধাকে ধাঁধার চেয়েও জটিল মনে হয়। সুতরাং স্যুটের পরিবর্তে মাও-জ্যাকেট খরিদ করে তার সঙ্গে মাথায় কমরেড লিনপিয়াও স্টাইলের হ্যাট পরে রেডগার্ডের মতো বীরদর্পে সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করি। মাও-জ্যাকেট দিয়ে সেমিনার জয় করলেও তা পরে মসজিদে যেতে কেমন যেন খুঁতখুঁত করে। আয়নায় তাকালে নিজের চেহারাকে কিরকম সাবেক আমলের ব্যর্থ বিপ্লবীর মতো দেখায়।
ট্যাক্সিতে নাইউজি মসজিদে আসতে আমাদের বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না। সম্পূর্ণ চীনা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ মসজিদের লোহিত নীলে রঙিন কাঠের কাঠামোতে নানা কোনবিশিষ্ট টালির কাজ দেখে ভাবি- উপাসনার এ ইমারতটি তৈরি হয়েছে চীনা সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ইসলামী বিশ্বের মসজিদ স্থাপত্যের সনাতনী ধারার ব্যতিক্রম হিসেবে। তার সামনে ততক্ষণে মুসল্লিরা জমায়েত হতে শুরু করেছেন। রোয়াকে বিক্রি হচ্ছে টুপি, তসবিহ, হেজাব, মেয়েলি শাল ও ঊর্ণা। আমি চট করে কাজরিদের জন্য দুটি ঊর্ণার সঙ্গে জরির কাজ করা একটি টুপি কিনে নিলে আমাকে চীনা ভাষায় নামাজের নিওত ও তকবির লেখা ফ্রি প্যাম্ফলেট দেয়া হয়।
তোরণের পাশে ছোট্ট মিনারের তিন স্তরে পর পর রাখা মস্ত ঢাক, ঘণ্টা ও একদম উপরের থাকে ছোটখাটো বৃক্ষের মতো ডালপালায় প্রসারিত বিশাল মোমদান। নিচে মাও-জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে জনা চারেক প্রৌঢ়। তাদের লেবাস দেখতে পেয়ে আমার বদখত পোশাকের জন্য আর কোনো খেদ থাকে না। একজন এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করেন। চীনা এ মুরব্বি গোছের বান্দার থুঁতনিতে আঙ্গুলে গোনা যায় এরকম তেরো কিংবা চৌদ্দটি দাড়ি। তিনি তা চুমরিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলেন, লিয়াও বংশের সম্রাটদের আমলে ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। সে আমলে ইমামের পুত্র নজরুদ্দীন স্থপতি হিসেবে কাজ করেন। তখন তাবৎ চীন দেশে মুসলমানরা ছিলেন হাজার দশেকের মতো। হালফিল তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৮ মিলিওন বা এক কোটি আশি লাখ। তিনি মিনারের পেছন দিকে রঙিন টাইলস বসানো কিছু পাথরের ভাঙা টুকরা ও একটি মিনারের অগ্রভাগ দেখিয়ে বলেন, এসব চেংগিস খানের কীর্তি। হলেন বিদ্রুপ করে বলে, গ্রেইট খান, যেখানে যা পান তা চুরমার করাই তো কারবার ছিল উনার। এগুলোর পাশেই একটি শিলালিপিতে চিইং বংশের সম্রাটের ১৬৯৪ সালে দেয়া ডিক্রি।
এ সনদের মর্মার্থ বোঝার আগে মসজিদের আঙিনায় এসে দাঁড়ান মাও-জ্যাকেটের সঙ্গে মাথায় পাগড়ি পরা এক দল বৃদ্ধ। সবাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন কানজোকা লাঠি। হলেন জানতে চায় এদের হাতে লাঠি কেন? মুসল্লিদের ভিড় বাড়ছে, ইংরেজিতে যিনি সব বুঝিয়ে বলছিলেন তিনি সরে গেছেন। ভিন দেশে রীতিনীতি ভিন্ন, চীনারা কেন কাঠি দিয়ে ভাত খায়, কেন লাঠি নিয়ে মসজিদে আসে, এসব ব্যাখ্যা করা কঠিন। হেজাব পরা এক মহিলা এসে কাজরি ও হলেনকে নিয়ে যান মহিলাদের জন্য নির্ধারিত জায়গায়।
মসজিদের ভেতরে কাঠের দেয়াল ও ছাদে লালনীলের জ্যামিতিক প্যাটার্নে হাল্কা সোনালি মেশানো চীনা নকশার সঙ্গে সুচারুভাবে মিশেছে ইসলামী ক্যালিওগ্রাফের আরবি বর্ণমালা। বারান্দায় কাগজের স্ক্রলে খাগের কলম দিয়ে চীনা ক্যালিওগ্রাফিতে কিছু লেখছেন চশমা চোখে সফেদ দাড়িওয়ালা এক অশীতিপর বৃদ্ধ। মুসল্লিদের একে তাকে জিজ্ঞেস করি, কি লিখছেন এ বুজুর্গ? খানিক খুঁজতেই একটু আগে ইংরেজি কথা বলনেওয়ালা মুরব্বিকে পেয়ে যাই। তিনি ব্যাখ্যা করেন- সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় রেডগার্ডদের হাতে মৃত্যু হয়েছিল বেশ কিছু মুসলমানের। তখন নিগৃহীত হয়েছিলেন এ বৃদ্ধ। তিনি এখন স্ক্রলে ক্যালিওগ্রাফ করে লিখছেন তাদের মাগফিরাতের জন্য প্রার্থনা। তার বক্তব্য থেকে আরও বুঝতে পারি, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উল্লেখ করে মাইক্রোফোনে মোনাজাত করা বা ছাপিয়ে কিছু প্রকাশ করা আজ ইস্তক বেআইনি। কিন্তু খাগের কলম দিয়ে স্ক্রলে লেখাজোকাতে আইনি কোনো বাধানিষেধ নেই। নামাজিদের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকলে অনেকেই আঙিনায় জায়নামাজ বিছিয়ে কাতার বাঁধেন। খুতবার পর পর বড়সড় এক টুপির ভেতর স্ক্রল রেখে তা নামাজিদের হাতে হাতে চলে যায় কাতারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তারা হাত দিয়ে স্ক্রল স্পর্শ করে মৃদু আওয়াজে উচ্চারণ করেন আমিন।
নামাজ শেষ হতেই আঙ্গিনাতে বেরিয়ে আসি। কাজরি চমৎকার ঝালর দেয়া কালো পোশাকের ছোট্ট একটি চীনা বাচ্চার সঙ্গে মিনারের আশপাশে ছোটাছুটি করে খেলছে। ওখানে চেয়ার-টেবিল পেতে বসেছেন আমাদের অভ্যর্থনা করা মাও-জ্যাকেট পরা চার প্রৌঢ়। তাদের সামনে মস্ত মস্ত লেজার বুক, দোয়াতদানী ও কলম। লোকজন সারি বেঁধে সম্ভবত ফিতরা বা জাকাত জমা দিচ্ছে। তারা টাকা ক্যাশবাক্সে রেখে সিরিয়াসলি সিলছাপ্পড় মেরে রসিদ দিচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটিকে তহসিল অফিসে খাজনা দেয়ার মতো দেখায়। কাজরি চীনা মেয়েটির সঙ্গে ছুটে যাচ্ছে তোরণ পেরিয়ে । আমরা পিছু পিছু ফুটপাতে এসে দেখি এক লোক নিয়ে এসেছেন ভাত, আলু, চানা ও মটরশুঁটির পাশে বৃত্তাকারে ডিম দিয়ে সাজানো খাবারের খুঞ্চা। তিনি ইশারায় ডেকে বাটিতে ধনেপাতা ছড়িয়ে তা ধরিয়ে দেন আমাদের হাতে। ঠিক তখনই অন্য মেয়েটির হাত ধরে কাজরি এসে বলে-বাপি, মিষ্টি... মিষ্টি। কী সৃষ্টি ছাড়া আবদার, চীনে মিষ্টি পাব কোথায়?
তখন মিনারের ঢোলে চাটি পড়লে রীতিমতো গোল বেঁধে যায়। নামাজিরা বড় বড় ঝাঁটা, শাবল, নিড়ানি, খন্তা, ঝাঁঝরি ও পানি দেয়ার হুজপাইপ নিয়ে সাজসাজ রবে কাতার বাঁধেন। তাদের সামনে মস্ত ডালায় তাজা ফুল নিয়ে সিল্কের সিয়োংসাম বা সনাতনী কেতার ফুলতোলা কামিজ পরা কয়েকটি তরুণী। জানা যায় যে, ঈদের নামাজের পর রীতি হচ্ছে গোরস্থানে গিয়ে পূর্বপুরুষদের কবর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে তাতে ফুল ছড়িয়ে আগরবাতি জ্বালানো। কাজরি ততক্ষণে ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে চেপে বসেছে একটি রিকশায়। আমরা তাকে নামিয়ে আনতে গেলে মেয়েটি তাকে জিজি বা বড় বোন বলে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটির মা-বাবা আরেকটি রিকশা ডাকেন। পুরুষটি ইংরেজি বলেন মোটামুটি ভালোই। তারা বাস করেন পাশের একটি গলিতে। তো আমরা রিকশা চড়ে চলে আসি তাদের বাসায়।
তাদের বাসাবাড়ির অবস্থান নাইউজি মসজিদের পাশেই সিচিয়েং ডিস্ট্রিকটে। এ মহল্লায় প্রায় হাজার দশেক মুসলমান বাস করেন সনাতনী কেতার ঘরদুয়ারে। আমরা যে পরিবারে আজ ঈদের মেহমান হয়েছি তাদের পুরনো ধাঁচের বাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভেতরের স্কোয়ার শেইপের আঙ্গিনা। তা লতানো কুঞ্জে ঝুলানো পাখির পিঞ্জিরায় সজ্জিত। চারদিকে একাধিক কক্ষের টানা বারান্দা ঘেরা এ উঠানে সিরামিকের টবে রাখা বনসাই, সংগৃহীত পাথরে ঝরঝর করে ঝরছে জল, কাচের চৌবাচ্চায় রাখা গোল্ডফিস, পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছে তুলতুলে পশমি বিড়াল। আমরা অর্কিডকুঞ্জের জালের চাঁদোয়ার নিচে বেতের চেয়ারে বসি। পাশেই ইজিচেয়ারে বসেছেন ছোট্ট মেয়েটির পিতামহ। তাকে আমরা মসজিদে কানজোকা লাঠি হাতে অন্য বৃদ্ধদের সঙ্গে দেখেছি। তিনি এখন তার হাঁটুতে পাগড়ি খুলে রেখে ফোকলা দাঁতে হেসে তসবিহ টিপেন। একটু দূরেই এ পরিবারের আরেক সদস্য গ্রিলে শিককাবাব চাপিয়ে পাখা দিয়ে অঙ্গারে বাতাস করছেন।
গ্রীন-টি পরিবেশিত হলে গোলটুপি মাথায় দিয়ে গৃহকর্তা আমাদের সঙ্গে চা-পানে যোগ দেন। আমি তাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ থেকে ৩২ বছর আগে তারা কোয়ানঝু অঞ্চলের লিয়াংসান পার্বত্য এলাকা থেকে বেইজিংয়ে আসেন। অনেক বছর আগে তাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ, পেশায় জাহাজি আরব, বাণিজ্য করতে চীন দেশে এসে স্থানীয় নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থিতু হন এখানে। তার পিতা মাথায় পাগড়ি দিয়ে পুত্রকে চীনা ভাষায় কিছু বলেন। ছেলে উঠে ঘর থেকে নিয়ে আসেন বাঁধানো একটি ফটোগ্রাফ ও রেশমি কাপড়ে ঢাকা বেতের ঝুড়ি। ছবিতে গিলাফ মোড়া পাশাপাশি দুটি কবর। এ মাজার দুটির একটি হচ্ছে ইমাম হাশিম ও অন্যটি হচ্ছে ইমাম জাফর সাদেকের। এ ইমাম দুজন ইসলাম প্রচারে চীন দেশে এসেছিলেন। চীনা ভাষায় মুসলিম সম্প্রদায়ে তারা যথাক্রমে সা কে ঝু ও উ কো শান নামে পরিচিত। লিয়াংসান পর্বতের পাদদেশে যুগল-মাজারের পাশেই এ বৃদ্ধের ছিল আদি বসতবাড়ি।
১৯৬৫ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় রেডগার্ডের অত্যাচার তীব্র হলে পরিবারটি কোয়ানঝু এলাকা ছেড়ে বেইজিংয়ে চলে আসে স্থায়ীভাবে। পুত্র রেশমী ঢাকনা সরিয়ে ঝুড়ি খুলে একটি সিরামিকের আগরদানের ভাঙ্গাচোরা টুকরা দেখান। ঝুড়িতে আরো আছে একটি জায়নামাজের পোড়া অংশবিশেষ। পরিবারে রসুম ছিল ঈদেচান্দে যুগল-মাজারে গিয়ে আগরবাতি জ্বালানো। রেডগার্ডের ছেলেমেয়েরা ঈদের দিন তার বাড়িতে ঢুকে এসব জিনিস ভেঙেচুরে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়। তবে একটি জিনিস তারা পুড়াতে পারেনি। পুত্র এবার ঝুড়ি থেকে বের করেন সিরামিকের বয়াম। তার ভেতরে রাখা হাতে লেখা মিনিয়েচার অজিফা। রেডগার্ডরা যখন মুসলমান প্রতিবেশীদের ঘরদুয়ারের উপর তুলতবিল চালাচ্ছিল তখন তিনি বুদ্ধি করে তার আরব পূর্বপুরুষের স্মৃতি বয়ামের ভেতর ঢুকিয়ে তা পুঁতে ফেলেন মাটির নিচে। অনেক বছর পর বেইজিং থেকে কোয়ানঝু এলাকায় ফিরে গিয়ে তা উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
রেডগার্ডের নিপীড়নের স্মৃতিতে বিষণ্নতা ও ক্ষোভ থাকলেও পরিবারের অন্য সদস্য রঙিন ফুলে ছাওয়া পিওনি গাছের পাশে টেবিল পাতলে কথাবার্তায় আবার ঈদের আমেজ ফিরে আসে। ছোট্ট মেয়েটির মা খাবার সাজান। কাজরি সিল্কের সিয়োংসাম পরে চীনা বাচ্চা সেজে ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে ডেক ডেকচি দিয়ে পুতুলের জন্য খাবার রাঁধছে। বৃদ্ধ বাটিতে ভিজিয়ে রাখা দাঁত ব্রাশ দিয়ে মেজে মুখে দিয়ে হাসলে তার হাবভাবে মনে হয় তিনি কাবাব খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা টেবিলের চারপাশে টুলে বসি। পরিবেশিত হয় লামিয়ান বলে হাতে তৈরি নোডুলসের সঙ্গে শির্কায় জারিত সবজি। এ খাবারটির নাম সোয়ানচি, স্বাদে অপূর্ব। খানিক পর আরেক প্রস্ত সবুজ-চা খেয়ে আমরা সেসমি সিড ছড়ানো রুটির সঙ্গে কাবাব খাই। পিওনি ফুলের পুষ্পিত কুঞ্জের পাশেই ঝুলছে পোশা পাখিদের বেশ ক’টি পিঞ্জিরা। তাতে মৃদুমন্দ কাকলি ধ্বনিত হচ্ছে। আঙিনার সবুজ বাতাবরণে কুজন শুনতে শুনতে আমাদের ঈদের ভোজন মোটমির্যা ভালোই হয়। তবে সমস্যা বাঁধে এ পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়। কাজরি কিছুতেই ছোট্ট মেয়েটিকে ছেড়ে আমাদের সঙ্গে আসতে চায় না। আর ছোট্ট মেয়েটিও জিজি বলে তাকে জড়িয়ে ধরে। Mainussultan@hotmail.com
No comments