নির্বাচন সমঝোতার ভিত্তিতেই হওয়া দরকার by ড. শরীফ মজুমদার
প্রধানমন্ত্রীর
জাতিসংঘের অধিবেশনে যেতে গড়িমসি করাটা কিছুটা নতুন চিন্তার খোরাক হয়ে দেখা
দিয়েছে। বিরোধী দলের সন্দেহ যদি সত্য হয় তাহলে এটা কিছুটা নিশ্চিত যে,
প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচনের পক্ষে এ মুহূর্তে তেমন কোনো
টেকসই যুক্তি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরতে পারবেন না, সে কারণেই হয়তো
এই গড়িমসি এবং তেমনটাই স্বাভাবিক। মুখে জোর দিয়ে বলাটা খুব একটা কঠিন নয়
যে, জাতিসংঘের খবরদারি কাম্য নয়। কিন্তু জাতিসংঘের দিক থেকে চিন্তা করলে
এটা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ নিয়ে এ মুহূর্তে তাদের ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আমাদের অগ্রগতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা উপেক্ষা করার যৌক্তিকতা নিতান্তই
প্রশ্নবিদ্ধ। হয়তো ক্ষমতাসীন উন্নত দেশগুলোকে জাতিসংঘ সব সময় বিতর্কিত
সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না কিন্তু অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল
দেশগুলোর উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা খুব একটা বিতর্কিত নয়। সুতরাং ভবিষ্যৎ
অগ্রগতিতেও জাতিসংঘকে পাশে পেতে আমাদের সব সময় সচেষ্ট থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
জাতিসংঘ সমঝোতার কথা বলেছে এবং তা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ মনে হওয়ার
তেমন কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ এ সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে
জাতিসংঘের পক্ষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে তার দায়িত্ব পালন
করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল- জাতিসংঘ বাংলাদেশকে
‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার’ প্রবক্তা হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তৃতীয় বিশ্বের
অন্য দেশগুলোতেও ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ চালুর ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়েছে।
সুতরাং ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার’ প্রচলন প্রশ্নবিদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে
জাতিসংঘকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। সমঝোতার নির্বাচন না হলে দেশ নিশ্চিতভাবে
এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতায় নিপতিত হবে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর
অর্জনগুলোও ভেস্তে যেতে পারে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে যতটা না নির্বাচনে
তার দলের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হবে তার চেয়ে বেশি ভাবতে হবে তার অর্জনগুলো
ধরে রাখতে। সেখানেই তার জন্য দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষা। তাছাড়া জাতিসংঘ
নিশ্চিত করতে চাচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন গণতান্ত্রিক নিয়মেই হচ্ছে।
‘এ গণতান্ত্রিক নিয়মটি’ উন্নত দেশে যেভাবে সংজ্ঞায়িত হয় আমাদের
পরিপ্রেক্ষিতে সেভাবে সংজ্ঞায়িত নাও হতে পারে এবং জাতিসংঘ তা জানে।
জাতিসংঘের দায়িত্ব হল, অধিকাংশ জনগণ যে পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় সে পদ্ধতিতে
নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করা। হয়তো আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
ভবিষ্যতে কখনও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলে বুঝতে পারবেন জাতিসংঘ
কেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন।
সমঝোতার নির্বাচন না হলে জাতি আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়কার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তার পুনরাবৃত্তি দেখতে বাধ্য হতে পারে, যা কোনো পরিপক্ব গণতন্ত্রের ভিত্তি হতে পারে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, জোর করে ‘তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচন’ করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তার অর্জনগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার নিদর্শন, না জনগণের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন দিয়ে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা একই দলের পুনর্নির্বাচনের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার নিদর্শন। তিনি যেভাবে বিলবোর্ড আর সভা-সমাবেশে তার সাফল্যের বর্ণনা করেছেন তা যদি সত্য হয় তাহলে তো তিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে থাকার কথা। কারণ একমাত্র তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে নির্বাচন হলেই জনগণ তার সাফল্যের যথার্থ প্রতিদান দিয়ে তাকে কোনো ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ছাড়াই আবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসাতে পারে! কিন্তু তিনি যদি মনে করেন যে কোনোভাবে একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়াটাই উদ্দেশ্য, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল কী করল না তা তার মাথাব্যথা নয়, তাহলে জনগণ বলবে তার মুখে অন্তত গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার দোহাই মানায় না এবং জনগণ অবশ্যই সন্দেহ করবে তিনি যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচনের কথা বলছেন এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি লুকানো। হয়তো এ ব্যাপারগুলোই জাতিসংঘের মহাসচিব বা অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা তার কাছে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরবেন বলেই তিনি জাতিসংঘের সমাবেশ এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। নিজের সুবিধা হলে জাতিসংঘের কার্যপ্রণালীর উদাহরণ দেয়া আর নিজের অসুবিধা হলে জাতিসংঘের খবরদারি বলে মন্তব্য করাটা রাষ্ট্রের পরিচালনা পর্ষদের জন্য নিতান্তই বেমানান।
যাহোক জনগণ অবশ্যই চাইবে জাতিসংঘ আমাদের এ চরম ক্রান্তিকালে আরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা কী বলল না বলল তা জাতিসংঘ আমলে নেবে না। মূলত সদস্য দেশগুলোর ক্রান্তিকালে সহায়তা এবং পরামর্শ দেয়াটা জাতিসংঘের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করে গণতন্ত্র সুসংহত রাখা বাংলাদেশে জাতিসংঘের কার্যপ্রণালী বাস্তবায়নেরই একটি অংশ। সুতরাং জাতিসংঘকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ভাষা বুঝলেই চলবে না, আপামর জনসাধারণের ভাষা বুঝতে হবে। জাতিসংঘ একুশে আগস্টকে যেভাবে নিন্দা করেছে সেভাবেই নিন্দা করেছে নির্বাচনকালীন লগী-বৈঠা অধ্যায়কেও। অতএব জাতিসংঘের কাছে দুই দলের কেউই অতিমাত্রায় গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং জাতিসংঘ নিশ্চিত করবে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা যেন এই সভ্য স্বাধীন দেশে আর স্থান না পায় এবং সেখানেই জাতিসংঘের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ করার এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন নিশ্চিত করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা। জাতিসংঘ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল দেখেছে; সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে আপামর জনগণের মূল্যায়ন কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। সুতরাং বিলবোর্ডের ভাষা, সভা-সমাবেশের বক্তব্য আর মানুষের মনের কথায় জাতিসংঘ মিল খুঁজে পাচ্ছে না। এই অমিলই জাতিসংঘকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জোর তাগিদ দিতে বাধ্য করেছে। সেই তাগিদ কতটা সুন্দরভাবে প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করছেন তা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সে তাগিদের ফলে বস্তুত কী পরিবর্তন হচ্ছে। জনগণ আশা করবে জাতিসংঘ প্রকৃত পরিবর্তন নিশ্চিত না করে বাংলদেশে কোনো নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে তাদের দ্বিমতের কথা সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেবে।
অন্যদিকে জনগণ আশা করবে, জাতিসংঘ বিরোধীদলীয় নেতাকেও বোঝাবে যে একবারে তথাকথিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ না হলে নির্বাচনে যাবে না সে ধরনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে। দলীয় সরকারের আধিপত্য থাকবে না এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এ ধরনের সরকার হলেই বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই যায় এবং সে ধরনের একটি সরকার গঠনে জাতিসংঘের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়াটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে সাধারণ জনগণের কাছে কখনোই মনে হবে না। দায়িত্বশীলতার পরিচয় শুধু সরকারকে দিতে হবে তা নয়; বিরোধী দলেরও অনেক ছাড় দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের সরকার তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য যে কারও নেতৃত্বের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে তাদের আপত্তি করাটা কিছুটা মাত্রাতিরিক্ত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ কথা কিছুটা হলেও সত্য যে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে কারও পক্ষে রাতারাতি ভোটের ফলাফল পাল্টে ফেলার চিন্তা করাটা অনেকটা অবাস্তবিকই বৈকি। শুধু তাই নয়, এ মিডিয়ার জগতে বর্তমান বাংলাদেশে ভোট কারচুপির চিন্তা করাটাও অনেকটা কঠিন। ছাড় দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা বিরোধী দলের জন্যও লাভজনক; কারণ তাতে দায়িত্বশীলতার যেমন পরিচয় দেয়া হবে, তেমনি পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতা এড়িয়ে চলাও সম্ভব হবে।
জাতি ৯০ দিনের জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের ভয়ে তত্ত্বাবধায়কহীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে পরে কয়েক বছরের জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দেশটাকে তুলে দিতে চাইবে না। তাছাড়া যা বাস্তব সত্য তা হল তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুব যে অগণতান্ত্রিক কিছু করেছে তা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। তাদেরও যদি বিলবোর্ড আর সভা-সমাবেশ করে নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে হয়তো আমাদের অনেক তথাকথিত রাজনৈতিক দল রাজনীতির ময়দানে সমস্যায় পড়ে যেত। দুই নেত্রীকে কিছুটা কোণঠাসা করে তারা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছেন তা অসত্য নয়। আবার এটাও অসত্য নয় যে, তা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যেই পড়ে এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এখন যা করতে চেষ্টা করছেন তা সেই প্রবৃত্তির বাইরে কিছু নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি বাইরের আর্থিক সাহায্য পেত তাহলেই বোঝা যেত তুলনামূলক বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে কতটা ভালো বা খারাপ। কিন্তু দুঃখজনক হল, ‘গণতন্ত্রের’ নামে সেটি আর হয়ে ওঠে না। জাতিসংঘ এ বিষয়গুলো সার্বিক বিবেচনায় এনে এ ব্যাপারে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেবে এটাই সবার কামনা। তাতে কে ঠোঁট ফুলাল আর কে হেসে দিল তা জাতিসংঘের বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। তাদের বিবেচনা হবে একটাই, তা হল দাতাগোষ্ঠীর টাকায় যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে তা যেন কারও ঠোঁট ফুলানো বা কারও হাসির কারণে থেমে না যায়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমঝোতার নির্বাচন না হলে জাতি আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়কার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তার পুনরাবৃত্তি দেখতে বাধ্য হতে পারে, যা কোনো পরিপক্ব গণতন্ত্রের ভিত্তি হতে পারে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, জোর করে ‘তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচন’ করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তার অর্জনগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার নিদর্শন, না জনগণের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন দিয়ে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা একই দলের পুনর্নির্বাচনের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার নিদর্শন। তিনি যেভাবে বিলবোর্ড আর সভা-সমাবেশে তার সাফল্যের বর্ণনা করেছেন তা যদি সত্য হয় তাহলে তো তিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে থাকার কথা। কারণ একমাত্র তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে নির্বাচন হলেই জনগণ তার সাফল্যের যথার্থ প্রতিদান দিয়ে তাকে কোনো ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ছাড়াই আবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসাতে পারে! কিন্তু তিনি যদি মনে করেন যে কোনোভাবে একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়াটাই উদ্দেশ্য, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল কী করল না তা তার মাথাব্যথা নয়, তাহলে জনগণ বলবে তার মুখে অন্তত গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার দোহাই মানায় না এবং জনগণ অবশ্যই সন্দেহ করবে তিনি যে গণতান্ত্রিক পরিপক্বতার দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়কহীন নির্বাচনের কথা বলছেন এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি লুকানো। হয়তো এ ব্যাপারগুলোই জাতিসংঘের মহাসচিব বা অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা তার কাছে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরবেন বলেই তিনি জাতিসংঘের সমাবেশ এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। নিজের সুবিধা হলে জাতিসংঘের কার্যপ্রণালীর উদাহরণ দেয়া আর নিজের অসুবিধা হলে জাতিসংঘের খবরদারি বলে মন্তব্য করাটা রাষ্ট্রের পরিচালনা পর্ষদের জন্য নিতান্তই বেমানান।
যাহোক জনগণ অবশ্যই চাইবে জাতিসংঘ আমাদের এ চরম ক্রান্তিকালে আরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা কী বলল না বলল তা জাতিসংঘ আমলে নেবে না। মূলত সদস্য দেশগুলোর ক্রান্তিকালে সহায়তা এবং পরামর্শ দেয়াটা জাতিসংঘের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করে গণতন্ত্র সুসংহত রাখা বাংলাদেশে জাতিসংঘের কার্যপ্রণালী বাস্তবায়নেরই একটি অংশ। সুতরাং জাতিসংঘকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ভাষা বুঝলেই চলবে না, আপামর জনসাধারণের ভাষা বুঝতে হবে। জাতিসংঘ একুশে আগস্টকে যেভাবে নিন্দা করেছে সেভাবেই নিন্দা করেছে নির্বাচনকালীন লগী-বৈঠা অধ্যায়কেও। অতএব জাতিসংঘের কাছে দুই দলের কেউই অতিমাত্রায় গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং জাতিসংঘ নিশ্চিত করবে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা যেন এই সভ্য স্বাধীন দেশে আর স্থান না পায় এবং সেখানেই জাতিসংঘের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ করার এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন নিশ্চিত করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা। জাতিসংঘ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল দেখেছে; সরকারের উন্নয়নের ব্যাপারে আপামর জনগণের মূল্যায়ন কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। সুতরাং বিলবোর্ডের ভাষা, সভা-সমাবেশের বক্তব্য আর মানুষের মনের কথায় জাতিসংঘ মিল খুঁজে পাচ্ছে না। এই অমিলই জাতিসংঘকে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জোর তাগিদ দিতে বাধ্য করেছে। সেই তাগিদ কতটা সুন্দরভাবে প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করছেন তা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সে তাগিদের ফলে বস্তুত কী পরিবর্তন হচ্ছে। জনগণ আশা করবে জাতিসংঘ প্রকৃত পরিবর্তন নিশ্চিত না করে বাংলদেশে কোনো নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে তাদের দ্বিমতের কথা সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেবে।
অন্যদিকে জনগণ আশা করবে, জাতিসংঘ বিরোধীদলীয় নেতাকেও বোঝাবে যে একবারে তথাকথিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ না হলে নির্বাচনে যাবে না সে ধরনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন রয়েছে। দলীয় সরকারের আধিপত্য থাকবে না এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এ ধরনের সরকার হলেই বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই যায় এবং সে ধরনের একটি সরকার গঠনে জাতিসংঘের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়াটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে সাধারণ জনগণের কাছে কখনোই মনে হবে না। দায়িত্বশীলতার পরিচয় শুধু সরকারকে দিতে হবে তা নয়; বিরোধী দলেরও অনেক ছাড় দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের সরকার তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য যে কারও নেতৃত্বের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে তাদের আপত্তি করাটা কিছুটা মাত্রাতিরিক্ত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ কথা কিছুটা হলেও সত্য যে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে কারও পক্ষে রাতারাতি ভোটের ফলাফল পাল্টে ফেলার চিন্তা করাটা অনেকটা অবাস্তবিকই বৈকি। শুধু তাই নয়, এ মিডিয়ার জগতে বর্তমান বাংলাদেশে ভোট কারচুপির চিন্তা করাটাও অনেকটা কঠিন। ছাড় দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা বিরোধী দলের জন্যও লাভজনক; কারণ তাতে দায়িত্বশীলতার যেমন পরিচয় দেয়া হবে, তেমনি পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতা এড়িয়ে চলাও সম্ভব হবে।
জাতি ৯০ দিনের জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের ভয়ে তত্ত্বাবধায়কহীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে পরে কয়েক বছরের জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দেশটাকে তুলে দিতে চাইবে না। তাছাড়া যা বাস্তব সত্য তা হল তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুব যে অগণতান্ত্রিক কিছু করেছে তা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। তাদেরও যদি বিলবোর্ড আর সভা-সমাবেশ করে নিজেদের সাফল্যের কথা তুলে ধরার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে হয়তো আমাদের অনেক তথাকথিত রাজনৈতিক দল রাজনীতির ময়দানে সমস্যায় পড়ে যেত। দুই নেত্রীকে কিছুটা কোণঠাসা করে তারা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছেন তা অসত্য নয়। আবার এটাও অসত্য নয় যে, তা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যেই পড়ে এবং আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এখন যা করতে চেষ্টা করছেন তা সেই প্রবৃত্তির বাইরে কিছু নয়। গণতান্ত্রিক সরকারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি বাইরের আর্থিক সাহায্য পেত তাহলেই বোঝা যেত তুলনামূলক বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে কতটা ভালো বা খারাপ। কিন্তু দুঃখজনক হল, ‘গণতন্ত্রের’ নামে সেটি আর হয়ে ওঠে না। জাতিসংঘ এ বিষয়গুলো সার্বিক বিবেচনায় এনে এ ব্যাপারে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেবে এটাই সবার কামনা। তাতে কে ঠোঁট ফুলাল আর কে হেসে দিল তা জাতিসংঘের বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। তাদের বিবেচনা হবে একটাই, তা হল দাতাগোষ্ঠীর টাকায় যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে তা যেন কারও ঠোঁট ফুলানো বা কারও হাসির কারণে থেমে না যায়।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments