অনড় অবস্থান আর একগুঁয়েমি ভালো নয় by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
দেশ
ও মানুষের সমস্যা আর সমাধান নিয়ে আবর্তিত হয় রাজনীতির দাবা খেলা।
দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা এ খেলার মূল খেলোয়াড়। তারাই সাধারণ মানুষের সেবক।
জনগণের সমস্যার সমাধান করে তাদের জীবনমান উন্নত করাই রাজনীতিবিদের স্বপ্ন।
তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক হওয়ায় তীব্র প্রতিযোগিতা
মোকাবেলা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গণসেবার লক্ষ্যে
নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের ম্যান্ডেট নিতে হয়। জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত
রাজনৈতিক দলই সাংবিধান নিয়মানুযায়ী সরকার গঠন করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য
জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে। তবে কোনো দলীয় সরকার প্রতিশ্র“ত দায়িত্ব
পালনে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে জনগণ ওই দলকে ম্যান্ডেট না দিয়ে অন্য কোনো দলকে
সরকার পরিচালনার জন্য পছন্দ করেন। এভাবে জনগণ সরকার পরিবর্তন করতে পারেন
বলেই গণতন্ত্রে তাদের ‘কিং মেকার’ বলা হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়
জনগণকে অসন্তুষ্ট করে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সরকারের পক্ষে ক্ষমতায়
থাকা সম্ভব হয় না। এসব জেনেও স্বৈরতন্ত্রের লেবাসধারী অনেক তথাকথিত
গণতান্ত্রিক সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতা
দীর্ঘায়িত করার অপচেষ্টা করেন। এদের কেউ কেউ সাময়িক সাফল্য পেলেও পরে
গণইচ্ছার কাছে এদের পরাজিত হতে হয়। জনগণের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে
একগুঁয়েমি করে দেশ পরিচালনা বা ক্ষমতায় থাকার চেষ্টার পরিণতি কখনও ভালো হয়
না। যুগপৎ সামরিক ও বেসামরিক সরকারকে অনেক সময় জনমতকে প্রাধান্য না দিয়ে
একক সিদ্ধান্তে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যর্থ হতে দেখা যায়। এ দেশে এমন
উদাহরণ রয়েছে।
বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের (১৯৯১-১৯৯৬) সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রধান দুটি আসনে জয়লাভের পর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে সংসদ নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করে। বহুল আলোচিত মাগুরা উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত হলেও ওই দুর্নীতিতে সরকারি দল বেশি বাড়াবাড়ি করায় আওয়ামী লীগ মাগুরা উপনির্বাচনকে অছিলা বানিয়ে বিএনপি সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে ওই দাবি আদায়ে জামায়াত-জাপাকে সঙ্গে রেখে জোরালো আন্দোলন শুরু করে। বেগম জিয়া প্রথমে এই দাবি মানতে রাজি হননি। তার যুক্তি ছিল, বিএনপি সরকার একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ভালো হয়েছে এবং ওইসব নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা ভালো করেছেন। কাজেই সংবিধান অনুযায়ী এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। অসাংবিধানিক কোনো দাবির কাছে মাথানত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়া যাবে না। এর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে দীর্ঘ দুই বছরে দেশী-বিদেশী অনেক প্রচেষ্টা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ব্যক্তি কে হবেন সে বিষয়ে দুই বড় দলের মধ্যে মতৈক্য না হওয়ায় সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
উল্লেখ্য, উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মধ্যস্থতা প্রচেষ্টায় ওই সময় শামিল হয়েছিলেন কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল এমেকা এনিওকু, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার লর্ড ওয়াডিরিল, আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট রবিন র্যাফেল এবং ঢাকাস্থ বিদেশী কূটনীতিকরা। এ ছাড়া দেশীয় প্রচেষ্টার মধ্যে জি-ফাইভ (যার সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, সাবেক আমলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং মুজিব সরকার আমলের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান) এ মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওই রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে ২১টি ফর্মুলা প্রদত্ত হয়েছিল, যার মধ্যে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের ফর্মুলাটি কূটনীতিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। বিএনপি প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ১০ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগ এই বলে নাকচ করে দিয়েছিল যে, এর ফলে বিরোধীদলীয় নির্দলীয় সরকারের দাবি বাস্তবায়িত হবে না। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদ থেকে সম্মিলিত পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি অধিকতর জটিলাকার ধারণ করে। জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিএনপিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য একটি যেনতেন নির্বাচন করে স্বল্পায়ুর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে এককভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজয়বরণ করতে হয়। ওই সময় বিএনপি যদি বিরোধী দলকে দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে না দিয়ে ওই আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছু দিন পরই গণনাড়ির স্পন্দন অনুভব করে সংসদ থেকে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সম্মিলিত পদত্যাগের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচন দিত, তাহলে দলটি পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে আরও ভালো করতে পারত। বেগম জিয়া প্রথমে অনড় অবস্থান নিয়ে কিছুটা একগুঁয়েমি করে বিরোধী দলকে দুই বছর আন্দোলন ও দেড় শতাধিক হরতাল করিয়ে তারপর তাদের দাবি মানার কারণে ওই সময় সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার চরিত্র প্রায় একই রকম। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্বেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের করা আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চলমান ১৮ দলীয় আন্দোলনের কিছুটা পার্থক্য আছে। প্রথম আন্দোলনটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো যত বেশি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল, বর্তমানের আন্দোলনটিতে ১৮ দলীয় জোট তত বেশি আন্দোলন-হরতাল-সংগ্রাম করেনি। আবার প্রথম আন্দোলন মোকাবেলায় সরকার যতটা কঠোরতা অবলম্বন করেছিল, বর্তমানে আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবেলা করতে হামলা, মামলা, পুলিশ-র্যাব, দলীয় নেতাকর্মী ও ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবহার করে সরকার তার চেয়ে অনেক বেশি কঠোরতা অবলম্বন করছে। আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোরনীতি অবলম্বন করার কারণে বিএনপির আন্দোলন কৌশলও হচ্ছে ভিন্ন রকম। এ ব্যাপারে বিএনপি অনেকটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলা যায়। কারণ প্রথম থেকেই জোরালো আন্দোলন শুরু করলে সে আন্দোলনকে সরকারি কঠোর দমননীতি মোকাবেলা করে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রেখে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা কঠিন হবে মনে করে দলটি প্রথমে ধীরগতির আন্দোলন করে নিজ দাবির পক্ষে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত করার জন্য অহিংস রোডমার্চ, সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক ক্লাস, সেমিনার, আলোচনা সভা, মানববন্ধন প্রভৃতি ধরনের কর্মসূচি পালন করে নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখছে। পরে চূড়ান্ত অবস্থায় গিয়ে দলটি সর্বশক্তি নিয়ে কঠোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করার নীতি অবলম্বন করেছে। অন্যদিকে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে বিরোধী দলগুলো তাদের দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আলোচ্য অচলাবস্থা নিরসনে পরাশক্তিগুলোকে আগ্রহী করতে সমর্থ হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভূমিকা পালনে তৎপর দেখে মনে করা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের আলোচ্য সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্র কখনও স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হতে আগ্রহী হতো না, যেমন- চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রকেও বিরোধীদলীয় কূটনৈতিক তৎপরতায় এ ব্যাপারে জড়িত করা সম্ভব হয়েছে। আলোচ্য সমস্যার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর মনোযোগ দেখে ভাবা যায়, এ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে গ্লোবাল ভিলেজে বাস করে সরকারের পক্ষে বিরাধী দলকে হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে অযৌক্তিকভাবে যা খুশি তাই করা খুব একটা সহজ হবে না।
সরকারের ভুলে না যাওয়া ভালো যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিটি কেবল ১৮ দলীয় জোটের দাবি নয়, দেশের অধিকাংশ মানুষও এমনটিই চান। যেহেতু এ ব্যবস্থায় নির্বাচনী স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে কারণে এ ব্যবস্থাকে না মেনে আদালত বা সংবিধানের ওপর অনড় থাকার ‘একচুলও না নড়ার তত্ত্ব’ উপস্থাপন করে বিরোধী দলকে আন্দোলনে ঠেলে দিলে সরকারের জনসমর্থন বাড়বে না। প্রধানমন্ত্রী এর আগে কখনও বিরোধীদলীয় অংশগ্রহণযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে, আবার কখনও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে, এখন সেসব বক্তব্য থেকে সরে এসে সম্প্রতি সচিবদের সভায় ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এ বক্তব্য অনুযায়ী তিনি সংসদ বহাল রেখে, মন্ত্রী-এমপি-প্রধানমন্ত্রিত্ব বজায় রেখে সাজানো প্রশাসনে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে না আছে তার প্রাসঙ্গিক পূর্বের বক্তব্যের কোনো সাদৃশ্য, না আছে বিরোধীদলীয় দাবির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যে যে অনড় থাকবেন এমনটি সরকারে শরিক দলগুলোর নেতা, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রী, এমনকি নির্বাচন কমিশনও বিশ্বাস করছে না। এ কারণে সবচেয়ে কম কথা বলা ইসি কমিশনার আবু হাফিজ প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার বক্তব্যে বিশ্বাস না করে ৪ সেপ্টেম্বর, ‘এটা ওনার শেষ কথা কি-না, তা আমরা জানি না’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী তার সংসদ-মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে নির্বাচন করার নীতিতে অটল থাকেন, নাকি সংসদ ভেঙে দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আপসরফা করার দিকে অগ্রসর হন। দ্রুত আপসরফা করে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সাফল্য দেখিয়ে নির্বাচনে গেলে সরকারি দলের জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, কিছুটা ভালো করার সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু ‘যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন জিততেই হবে’ নীতিতে অটল থেকে চরম একগুঁয়েমি করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তা এবং দেশকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ঠেলে দিলে সরকারি দলকে একদিকে যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিণতি বরণ করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে ভবিষ্যতে অনাকাক্সিক্ষত কারণে বিলম্বিত নির্বাচন হলে এবং সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এখন দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি জনগণের পছন্দনীয় আপসরফায় মনোযোগী হয়ে হৃত জনপ্রিয়তা উদ্ধারে মনোযোগী হবেন, নাকি জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজস্ব একগুঁয়েমিতে অনড় থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অসন্তুষ্ট ও জনমতকে উপেক্ষা করে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার পথ বেছে নেবেন। সরকারপ্রধান অবিবেচকের মতো ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে, সংসদ-মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে, বিরোধীদলীয় দাবি অগ্রাহ্য করে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে, চরম একগুঁয়েমির পথ ধরে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইলে যে তার পরিণতি ভালো হবে না সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া যায়।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের (১৯৯১-১৯৯৬) সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রধান দুটি আসনে জয়লাভের পর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে সংসদ নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করে। বহুল আলোচিত মাগুরা উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত হলেও ওই দুর্নীতিতে সরকারি দল বেশি বাড়াবাড়ি করায় আওয়ামী লীগ মাগুরা উপনির্বাচনকে অছিলা বানিয়ে বিএনপি সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে ওই দাবি আদায়ে জামায়াত-জাপাকে সঙ্গে রেখে জোরালো আন্দোলন শুরু করে। বেগম জিয়া প্রথমে এই দাবি মানতে রাজি হননি। তার যুক্তি ছিল, বিএনপি সরকার একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ভালো হয়েছে এবং ওইসব নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা ভালো করেছেন। কাজেই সংবিধান অনুযায়ী এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। অসাংবিধানিক কোনো দাবির কাছে মাথানত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়া যাবে না। এর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে দীর্ঘ দুই বছরে দেশী-বিদেশী অনেক প্রচেষ্টা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ব্যক্তি কে হবেন সে বিষয়ে দুই বড় দলের মধ্যে মতৈক্য না হওয়ায় সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
উল্লেখ্য, উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মধ্যস্থতা প্রচেষ্টায় ওই সময় শামিল হয়েছিলেন কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল এমেকা এনিওকু, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার লর্ড ওয়াডিরিল, আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট রবিন র্যাফেল এবং ঢাকাস্থ বিদেশী কূটনীতিকরা। এ ছাড়া দেশীয় প্রচেষ্টার মধ্যে জি-ফাইভ (যার সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, সাবেক আমলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং মুজিব সরকার আমলের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান) এ মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ওই রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে ২১টি ফর্মুলা প্রদত্ত হয়েছিল, যার মধ্যে ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের ফর্মুলাটি কূটনীতিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। বিএনপি প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে ১০ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগ এই বলে নাকচ করে দিয়েছিল যে, এর ফলে বিরোধীদলীয় নির্দলীয় সরকারের দাবি বাস্তবায়িত হবে না। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা সংসদ থেকে সম্মিলিত পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি অধিকতর জটিলাকার ধারণ করে। জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিএনপিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য একটি যেনতেন নির্বাচন করে স্বল্পায়ুর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে এককভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজয়বরণ করতে হয়। ওই সময় বিএনপি যদি বিরোধী দলকে দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে না দিয়ে ওই আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছু দিন পরই গণনাড়ির স্পন্দন অনুভব করে সংসদ থেকে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সম্মিলিত পদত্যাগের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচন দিত, তাহলে দলটি পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে আরও ভালো করতে পারত। বেগম জিয়া প্রথমে অনড় অবস্থান নিয়ে কিছুটা একগুঁয়েমি করে বিরোধী দলকে দুই বছর আন্দোলন ও দেড় শতাধিক হরতাল করিয়ে তারপর তাদের দাবি মানার কারণে ওই সময় সরকারের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার চরিত্র প্রায় একই রকম। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্বেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের করা আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চলমান ১৮ দলীয় আন্দোলনের কিছুটা পার্থক্য আছে। প্রথম আন্দোলনটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো যত বেশি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল, বর্তমানের আন্দোলনটিতে ১৮ দলীয় জোট তত বেশি আন্দোলন-হরতাল-সংগ্রাম করেনি। আবার প্রথম আন্দোলন মোকাবেলায় সরকার যতটা কঠোরতা অবলম্বন করেছিল, বর্তমানে আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবেলা করতে হামলা, মামলা, পুলিশ-র্যাব, দলীয় নেতাকর্মী ও ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবহার করে সরকার তার চেয়ে অনেক বেশি কঠোরতা অবলম্বন করছে। আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোরনীতি অবলম্বন করার কারণে বিএনপির আন্দোলন কৌশলও হচ্ছে ভিন্ন রকম। এ ব্যাপারে বিএনপি অনেকটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলা যায়। কারণ প্রথম থেকেই জোরালো আন্দোলন শুরু করলে সে আন্দোলনকে সরকারি কঠোর দমননীতি মোকাবেলা করে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রেখে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা কঠিন হবে মনে করে দলটি প্রথমে ধীরগতির আন্দোলন করে নিজ দাবির পক্ষে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত করার জন্য অহিংস রোডমার্চ, সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক ক্লাস, সেমিনার, আলোচনা সভা, মানববন্ধন প্রভৃতি ধরনের কর্মসূচি পালন করে নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখছে। পরে চূড়ান্ত অবস্থায় গিয়ে দলটি সর্বশক্তি নিয়ে কঠোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করার নীতি অবলম্বন করেছে। অন্যদিকে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে বিরোধী দলগুলো তাদের দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আলোচ্য অচলাবস্থা নিরসনে পরাশক্তিগুলোকে আগ্রহী করতে সমর্থ হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে ভূমিকা পালনে তৎপর দেখে মনে করা যায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের আলোচ্য সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্র কখনও স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত হতে আগ্রহী হতো না, যেমন- চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রকেও বিরোধীদলীয় কূটনৈতিক তৎপরতায় এ ব্যাপারে জড়িত করা সম্ভব হয়েছে। আলোচ্য সমস্যার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গভীর মনোযোগ দেখে ভাবা যায়, এ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে গ্লোবাল ভিলেজে বাস করে সরকারের পক্ষে বিরাধী দলকে হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে অযৌক্তিকভাবে যা খুশি তাই করা খুব একটা সহজ হবে না।
সরকারের ভুলে না যাওয়া ভালো যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিটি কেবল ১৮ দলীয় জোটের দাবি নয়, দেশের অধিকাংশ মানুষও এমনটিই চান। যেহেতু এ ব্যবস্থায় নির্বাচনী স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে কারণে এ ব্যবস্থাকে না মেনে আদালত বা সংবিধানের ওপর অনড় থাকার ‘একচুলও না নড়ার তত্ত্ব’ উপস্থাপন করে বিরোধী দলকে আন্দোলনে ঠেলে দিলে সরকারের জনসমর্থন বাড়বে না। প্রধানমন্ত্রী এর আগে কখনও বিরোধীদলীয় অংশগ্রহণযুক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে, আবার কখনও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে, এখন সেসব বক্তব্য থেকে সরে এসে সম্প্রতি সচিবদের সভায় ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এ বক্তব্য অনুযায়ী তিনি সংসদ বহাল রেখে, মন্ত্রী-এমপি-প্রধানমন্ত্রিত্ব বজায় রেখে সাজানো প্রশাসনে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে না আছে তার প্রাসঙ্গিক পূর্বের বক্তব্যের কোনো সাদৃশ্য, না আছে বিরোধীদলীয় দাবির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যে যে অনড় থাকবেন এমনটি সরকারে শরিক দলগুলোর নেতা, সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রী, এমনকি নির্বাচন কমিশনও বিশ্বাস করছে না। এ কারণে সবচেয়ে কম কথা বলা ইসি কমিশনার আবু হাফিজ প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার বক্তব্যে বিশ্বাস না করে ৪ সেপ্টেম্বর, ‘এটা ওনার শেষ কথা কি-না, তা আমরা জানি না’ বলে মন্তব্য করেছেন।
এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী তার সংসদ-মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে নির্বাচন করার নীতিতে অটল থাকেন, নাকি সংসদ ভেঙে দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আপসরফা করার দিকে অগ্রসর হন। দ্রুত আপসরফা করে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সাফল্য দেখিয়ে নির্বাচনে গেলে সরকারি দলের জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, কিছুটা ভালো করার সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু ‘যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন জিততেই হবে’ নীতিতে অটল থেকে চরম একগুঁয়েমি করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তা এবং দেশকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ঠেলে দিলে সরকারি দলকে একদিকে যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিণতি বরণ করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে ভবিষ্যতে অনাকাক্সিক্ষত কারণে বিলম্বিত নির্বাচন হলে এবং সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এখন দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি জনগণের পছন্দনীয় আপসরফায় মনোযোগী হয়ে হৃত জনপ্রিয়তা উদ্ধারে মনোযোগী হবেন, নাকি জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজস্ব একগুঁয়েমিতে অনড় থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অসন্তুষ্ট ও জনমতকে উপেক্ষা করে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার পথ বেছে নেবেন। সরকারপ্রধান অবিবেচকের মতো ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে, সংসদ-মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে, বিরোধীদলীয় দাবি অগ্রাহ্য করে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে, চরম একগুঁয়েমির পথ ধরে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাইলে যে তার পরিণতি ভালো হবে না সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেয়া যায়।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments