অর্জনগুলো ধরে রাখতে হবে by কাজী ফারুক আহমেদ
একান্ন
বছর আগে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনকারীদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। আজ ‘শিক্ষা
দিবসে’ বিশেষভাবে স্মরণ করছি আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী স্কুলছাত্র বাবুল,
বাস কন্ডাক্টর মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কয়টি
মোটা দাগের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচন,
বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ
নির্বাচন। এর মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে ২১ ফেব্র“য়ারি
সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ইতিহাস নির্ধারণকারী অন্য দিনগুলো এখনও
প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা দিবসের আলোচনায় দিনটির
সরকারি স্বীকৃতির দাবি উঠছে। শিক্ষার ভিত্তিতে দেশের ষোল কোটি মানুষকে
সম্পদে রূপান্তরের কথা আজ যখন সরকারি-বেসরকারি সবাই এক সুরে বলেন, তখন
অর্ধশতকের বেশি সময় আগের দেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম ক্ষেত্র
প্রস্তুতকারী, শিক্ষা উন্নয়ন, অর্থায়নের বিষয়কে ধারণ করে সূচিত ও বিস্তৃত
আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি প্রাপ্তির দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার প্রস্তাব
সমর্থন করতে হয়।
প্রতিবছর শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরে দিবসটি পালন করে থাকে। ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং ২০১০ সালে সংসদে তা অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে প্রধানত শিক্ষানীতিকে ঘিরে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং বাংলাদেশ দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৩, শিক্ষায় অর্থায়ন, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকের অধিকার এবং জাতীয় বাজেটে ন্যায়পরায়ণতা প্রসঙ্গ।
বর্তমানে শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় ‘শিক্ষা আইনের’ বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশের পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষা উন্নয়নে নিয়োজিত বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, জাতীয় সংবাদ মাধ্যম ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরের জনগণের পক্ষ থেকে এ নিয়ে মতামত ব্যক্ত হয়েছে। সরকারিভাবে ৩৪টি, বেসরকারিভাবে ৯৪টি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ১০৬টিসহ মেটি ২৩৪টি মতামত পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৫টি মতামত পূর্ণাঙ্গ। জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট খসড়া শিক্ষা আইনে কতিপয় নতুন ধারা সংযোজন এবং কয়েকটি সংশোধন ও প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে। সংযোজন প্রস্তাবে রয়েছে, সমযোগ্যতা ও সমঅভিজ্ঞতাসম্পন্ন, সমদায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ বেতন-ভাতা, প্রবৃদ্ধি, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, এমপিও প্রাপ্তির জন্য যোগ্যতার শর্ত পূরণকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও প্রদান, শিক্ষকদের প্রচলিত চাকরিবিধি সংস্কার ও কর্মচারীদের চাকরিবিধি প্রবর্তনসহ শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য ইউনেস্কো/আইএলও কর্তৃক যৌথভাবে প্রণীত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের সুপারিশমালা কার্যকর করাসহ পেশাগত বিভিন্ন দাবির সঙ্গে ১০টি প্রস্তাব : শিক্ষক নিয়োগ/নির্বাচন কমিশন গঠন, ২. শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষা, ৩. শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন, ৪. প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে পার্বত্য অঞ্চলসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা, ৫. শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ এলাকাগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান, ৬. দেশ-বিদেশের কর্ম বাজারের চাহিদার আলোকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক পর্যায়ের সব কারিকুলাম নিয়মিত পরিবর্তন ও পরিমার্জন ৭. (১) শিক্ষক, (২) অভিভাবক, (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি, (৪) শিক্ষক সংগঠনের করণীয়, (৫) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আচরণ সংক্রান্ত মোট ৫টি স্বতন্ত্র কোড অব কন্ডাক্ট/আচরণবিধি প্রণয়ন, ৮. শিক্ষাক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, ৯. শিশু অধিকার সুরক্ষা জাতীয় কমিশন গঠন, যা প্রতিবন্ধী, অটিস্টিকসহ সব শিশুর বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ করবে। প্রতিবন্ধী শিশুর বিশেষ চাহিদার ওপর নির্ভর করে পাঠ্যক্রম, পাঠদান, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে নমনীয়তার নীতি অবলম্বন করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবক থাকবেন, ১০. প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম একজন পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকবেন। তিনি প্রতিবন্ধীসহ বৈষম্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর শিশুর শিক্ষার বিষয়ে ন্যূনতম ৬ মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন। খসড়া শিক্ষা আইনে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শাস্তি প্রসঙ্গে ফ্রন্টের সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হইলে শিক্ষকদের চাকরিবিধিতে উল্লেখিত পেশাগত অসদাচরণের মধ্যে তাহা অন্তর্ভুক্ত করিয়া (যাহা শিক্ষকদের অধিকার ও করণীয় সংক্রান্ত ইউনেস্কো আইএলও সনদ ১৯৬৬ ও ১৯৭৭-এর সহিত সঙ্গতিপূর্ণ হইবে), দেশে প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে। শুধু শিক্ষকদের কথা উল্লেখ না করিয়া সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি/ ব্যক্তিবর্গকে (ব্যবস্থাপনা কমিটি/ কর্তৃপক্ষসহ) দেশে প্রচলিত আইনে প্রযোজ্য শাস্তির আওতায় আনিতে হইবে। বেসরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ অপরাধের/ অসদাচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারী শিক্ষকদেরও একইভাবে একই ব্যবস্থায় শাস্তির আওতায় আনা হইবে।’ প্রত্যাহার প্রস্তাবে রয়েছে- ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়া একতরফা বেতন কর্তন অবৈধ, অনৈতিক ও অসাংবিধানিক বিধায় এ ধারা প্রত্যাহার করিতে হবে। সামারী ট্রায়ালে শিক্ষকদের শাস্তি বিধানের ধারা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় এডুকেশন ওয়াচের পক্ষ থেকে সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত সংকলিত করে ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তা উপস্থাপন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তার উপস্থাপিত ২২টি বিশেষ সংযোজনী প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে : ষ আইনটির শিরোনাম শিক্ষা আইন ২০১৩-এর পরিবর্তে বাংলাদেশ শিক্ষা আইন ২০১৩ করা প্রয়োজন। ষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সরকার সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা করবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক এবং এই শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে ও ব্যাপকভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধাভিত্তিতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এছাড়াও শিক্ষা আইনে শিশু অধিকার সনদ এবং শিশু শিক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিভিন্ন ধারা অনুসরণ করতে হবে। ষ প্রত্যেক বাক্যের শেষে ‘করা হবে’ এই শব্দ দুটির পরিবর্তে ‘করিতে হইবে’ লিখতে হবে। কোনো আইন অমান্য বা লংঘন করলে কী শাস্তি প্রদান করা হবে বা তার প্রতিকার কী হবে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। ষ যৌন হয়রানির বিষয়ে হাইকোর্টের যে রায় রয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ আইনে একটি ধারা সংযোজন করা প্রয়োজন। ষ শিক্ষায় শ্রমজীবী শিশুদের অন্তর্ভুক্তির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করতে হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে ক্যাডেট কলেজ ও মিলিটারি একাডেমি বিষয়ে কোনোরকম উল্লেখ নেই, এগুলোর সঙ্গে ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই আইনের আওতায় আনতে হবে। ষ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো কমিশন গঠন করতে হবে। ষ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর নির্দেশনা শিক্ষা আইনেও প্রতিফলিত হওয়া দরকার। ষ এ আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতার নীতিমালা থাকতে হবে। ষ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। ষ শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এসএমসি, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সরকারি প্রশাসন স্থানীয় সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও পরিদফতরের কার কী দায়িত্ব, কিভাবে, তা কোন সময়সীমার মধ্যে পালন করতে হবে এবং বাস্তবায়নের জন্য অর্থ ও পরিসম্পদের উৎস ইত্যাদি বিষয়ে নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। ষ শিক্ষা কার্যক্রমকে হরতালের আওতামুক্ত রাখার জন্য একটি আইন থাকা উচিত। ষ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক, গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, যথাযথ শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে স্কুলে এমনভাবে পাঠদান করতে হবে যাতে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং পদ্ধতি নিরুৎসাহিত হয়।
এ কথা মানতে হবে, সরকারি-বেসরকারি উভয় উদ্যোগে বাংলাদেশের শিক্ষা অনেক দূর এগিয়েছে। এখন এর গতি বৃদ্ধি ও সীমা সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত প্রয়াস ও উদ্যোগ দরকার। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষক-অভিভাবক ফোরাম ও সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অংশগ্রহণ ও সমর্থন শিক্ষার প্রসার ও মান উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত আইনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ একটি ‘স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন’ করা হলে সময়ের প্রয়োজনে দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও প্রয়োজনে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান রাখা সম্ভব হবে। আশা করি, শিক্ষায় এরই মধ্যে অর্জিত সাফল্যগুলো ধরে রাখতে এবং শিক্ষার ভিত্তিতে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উপলব্ধি থেকে শিক্ষা আইন পাস হবে। তা বাস্তবায়নের সমবেত, সমন্বিত উদ্যোগও সফল হবে।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; চেয়ারম্যান, আইএইচডি
প্রতিবছর শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরে দিবসটি পালন করে থাকে। ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং ২০১০ সালে সংসদে তা অনুমোদিত হওয়ার পর থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে প্রধানত শিক্ষানীতিকে ঘিরে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং বাংলাদেশ দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০১৩, শিক্ষায় অর্থায়ন, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকের অধিকার এবং জাতীয় বাজেটে ন্যায়পরায়ণতা প্রসঙ্গ।
বর্তমানে শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় ‘শিক্ষা আইনের’ বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বিশেষ করে ৫ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশের পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষা উন্নয়নে নিয়োজিত বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, জাতীয় সংবাদ মাধ্যম ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্তরের জনগণের পক্ষ থেকে এ নিয়ে মতামত ব্যক্ত হয়েছে। সরকারিভাবে ৩৪টি, বেসরকারিভাবে ৯৪টি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ১০৬টিসহ মেটি ২৩৪টি মতামত পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৫টি মতামত পূর্ণাঙ্গ। জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট খসড়া শিক্ষা আইনে কতিপয় নতুন ধারা সংযোজন এবং কয়েকটি সংশোধন ও প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে। সংযোজন প্রস্তাবে রয়েছে, সমযোগ্যতা ও সমঅভিজ্ঞতাসম্পন্ন, সমদায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুরূপ বেতন-ভাতা, প্রবৃদ্ধি, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, এমপিও প্রাপ্তির জন্য যোগ্যতার শর্ত পূরণকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও প্রদান, শিক্ষকদের প্রচলিত চাকরিবিধি সংস্কার ও কর্মচারীদের চাকরিবিধি প্রবর্তনসহ শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য ইউনেস্কো/আইএলও কর্তৃক যৌথভাবে প্রণীত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের সুপারিশমালা কার্যকর করাসহ পেশাগত বিভিন্ন দাবির সঙ্গে ১০টি প্রস্তাব : শিক্ষক নিয়োগ/নির্বাচন কমিশন গঠন, ২. শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষা, ৩. শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন, ৪. প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে পার্বত্য অঞ্চলসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা, ৫. শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ এলাকাগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান, ৬. দেশ-বিদেশের কর্ম বাজারের চাহিদার আলোকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক পর্যায়ের সব কারিকুলাম নিয়মিত পরিবর্তন ও পরিমার্জন ৭. (১) শিক্ষক, (২) অভিভাবক, (৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি, (৪) শিক্ষক সংগঠনের করণীয়, (৫) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আচরণ সংক্রান্ত মোট ৫টি স্বতন্ত্র কোড অব কন্ডাক্ট/আচরণবিধি প্রণয়ন, ৮. শিক্ষাক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, ৯. শিশু অধিকার সুরক্ষা জাতীয় কমিশন গঠন, যা প্রতিবন্ধী, অটিস্টিকসহ সব শিশুর বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ করবে। প্রতিবন্ধী শিশুর বিশেষ চাহিদার ওপর নির্ভর করে পাঠ্যক্রম, পাঠদান, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে নমনীয়তার নীতি অবলম্বন করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবক থাকবেন, ১০. প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম একজন পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকবেন। তিনি প্রতিবন্ধীসহ বৈষম্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর শিশুর শিক্ষার বিষয়ে ন্যূনতম ৬ মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন। খসড়া শিক্ষা আইনে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শাস্তি প্রসঙ্গে ফ্রন্টের সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘বর্ণিত অপরাধ সংঘটিত হইলে শিক্ষকদের চাকরিবিধিতে উল্লেখিত পেশাগত অসদাচরণের মধ্যে তাহা অন্তর্ভুক্ত করিয়া (যাহা শিক্ষকদের অধিকার ও করণীয় সংক্রান্ত ইউনেস্কো আইএলও সনদ ১৯৬৬ ও ১৯৭৭-এর সহিত সঙ্গতিপূর্ণ হইবে), দেশে প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে। শুধু শিক্ষকদের কথা উল্লেখ না করিয়া সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি/ ব্যক্তিবর্গকে (ব্যবস্থাপনা কমিটি/ কর্তৃপক্ষসহ) দেশে প্রচলিত আইনে প্রযোজ্য শাস্তির আওতায় আনিতে হইবে। বেসরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ অপরাধের/ অসদাচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারী শিক্ষকদেরও একইভাবে একই ব্যবস্থায় শাস্তির আওতায় আনা হইবে।’ প্রত্যাহার প্রস্তাবে রয়েছে- ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়া একতরফা বেতন কর্তন অবৈধ, অনৈতিক ও অসাংবিধানিক বিধায় এ ধারা প্রত্যাহার করিতে হবে। সামারী ট্রায়ালে শিক্ষকদের শাস্তি বিধানের ধারা প্রত্যাহার করিতে হইবে।’
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় এডুকেশন ওয়াচের পক্ষ থেকে সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত সংকলিত করে ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তা উপস্থাপন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তার উপস্থাপিত ২২টি বিশেষ সংযোজনী প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে : ষ আইনটির শিরোনাম শিক্ষা আইন ২০১৩-এর পরিবর্তে বাংলাদেশ শিক্ষা আইন ২০১৩ করা প্রয়োজন। ষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সরকার সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা করবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক এবং এই শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে ও ব্যাপকভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধাভিত্তিতে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এছাড়াও শিক্ষা আইনে শিশু অধিকার সনদ এবং শিশু শিক্ষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বিভিন্ন ধারা অনুসরণ করতে হবে। ষ প্রত্যেক বাক্যের শেষে ‘করা হবে’ এই শব্দ দুটির পরিবর্তে ‘করিতে হইবে’ লিখতে হবে। কোনো আইন অমান্য বা লংঘন করলে কী শাস্তি প্রদান করা হবে বা তার প্রতিকার কী হবে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। ষ যৌন হয়রানির বিষয়ে হাইকোর্টের যে রায় রয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ আইনে একটি ধারা সংযোজন করা প্রয়োজন। ষ শিক্ষায় শ্রমজীবী শিশুদের অন্তর্ভুক্তির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করতে হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে ক্যাডেট কলেজ ও মিলিটারি একাডেমি বিষয়ে কোনোরকম উল্লেখ নেই, এগুলোর সঙ্গে ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই আইনের আওতায় আনতে হবে। ষ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো কমিশন গঠন করতে হবে। ষ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর নির্দেশনা শিক্ষা আইনেও প্রতিফলিত হওয়া দরকার। ষ এ আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতার নীতিমালা থাকতে হবে। ষ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। ষ শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এসএমসি, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সরকারি প্রশাসন স্থানীয় সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও পরিদফতরের কার কী দায়িত্ব, কিভাবে, তা কোন সময়সীমার মধ্যে পালন করতে হবে এবং বাস্তবায়নের জন্য অর্থ ও পরিসম্পদের উৎস ইত্যাদি বিষয়ে নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। ষ শিক্ষা কার্যক্রমকে হরতালের আওতামুক্ত রাখার জন্য একটি আইন থাকা উচিত। ষ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক, গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, যথাযথ শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে স্কুলে এমনভাবে পাঠদান করতে হবে যাতে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং পদ্ধতি নিরুৎসাহিত হয়।
এ কথা মানতে হবে, সরকারি-বেসরকারি উভয় উদ্যোগে বাংলাদেশের শিক্ষা অনেক দূর এগিয়েছে। এখন এর গতি বৃদ্ধি ও সীমা সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত প্রয়াস ও উদ্যোগ দরকার। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষক-অভিভাবক ফোরাম ও সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অংশগ্রহণ ও সমর্থন শিক্ষার প্রসার ও মান উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে শিক্ষানীতিতে বর্ণিত আইনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ একটি ‘স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন’ করা হলে সময়ের প্রয়োজনে দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও প্রয়োজনে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলমান রাখা সম্ভব হবে। আশা করি, শিক্ষায় এরই মধ্যে অর্জিত সাফল্যগুলো ধরে রাখতে এবং শিক্ষার ভিত্তিতে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উপলব্ধি থেকে শিক্ষা আইন পাস হবে। তা বাস্তবায়নের সমবেত, সমন্বিত উদ্যোগও সফল হবে।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; চেয়ারম্যান, আইএইচডি
No comments