ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনা- সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা? by আশিস আচার্য
ওয়াশিংটনের ঐতিহাসিক বৈঠকের শুরুতে ইসরায়েলের বিচারমন্ত্রী সিপি লিভনি
বলেছিলেন, ‘আসুন, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় না, এমন মানুষে পরিণত হই।’
অন্যদিকে ফিলিস্তিনি আলোচক সায়েব এরকাত জানান, সব ইস্যুই আলোচনার জন্য খোলা রয়েছে, তাতে তিনি আনন্দিত।
এ দুজনের বক্তব্য থেকে আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ আছে।
ওয়াশিংটনে দুই দিনের আলোচনার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানান, নয় মাসের মধ্যে চূড়ান্ত মর্যাদা প্রশ্নে আলোচনার জন্য কাজ করতে প্রস্তুত ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের আলোচকেরা। তিন বছর পর সরাসরি আলোচনা শুরু হওয়ার দুই দিনের মাথায় এত বড় ঘোষণা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণের প্রতিবাদে ২০১০ সালে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের নেতারা।
ওয়াশিংটনের বৈঠকে ইসরায়েলের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী সিপি লিভনি। আর ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন সায়েব এরাকাত। প্রথম দিনের আলোচনার পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে ‘গঠনমূলক সংলাপ’ হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র রমজানে ইফতারের মধ্য দিয়ে ওই আলোচনা শুরুর ঘটনাটিকে ‘বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন জন কেরি।
ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি-প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তা ও বৈপরীত্যে ঠাসা। প্রত্যেকেই জানে, বছরের পর বছর ধরে চলমান এই আলোচনার সফল সমাপ্তির জন্য কী করতে হবে। কিন্তু কারও সেই কাজটি করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা দেখা যায় না। অথচ সব সময়ই বলা হয়, বিবদমান এ দুই পক্ষের চেয়ে শান্তির জন্য এতটা উন্মুখ আর কেউ নয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আবার প্রমাণ করলেন, এই দুই পক্ষকে সরাসরি আলোচনায় বসাতে তৃতীয় পক্ষের উদ্যোগ একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। দশকের পর দশক ধরে চলমান এই শান্তি-প্রক্রিয়ায় এটিও প্রমাণ হয়েছে যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি দেশের ধৈর্যশীল অংশগ্রহণের প্রয়োজন থাকলেও তা একটি ঐতিহাসিক চুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। বিগত বছরগুলোয় এই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেই দেখা গেছে।
ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলোর টেবিলে গত ছয় মাস ধরে বহু বৈঠক ও ভোজের পর জন কেরি অতিসম্প্রতি দুই পক্ষকে ওয়াশিংটনে গিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেরির সতর্ক বক্তব্যে এটা স্পষ্ট ছিল যে ওয়াশিংটনের আলোচনাটি হবে কেবল আলোচনা শুরুর খাতিরেই। এতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি মধ্যস্থতাকারীদেরই অংশগ্রহণ থাকবে, শীর্ষ নেতাদের নয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে জন কেরির প্রায় অমানুষিক পরিশ্রম আর অটল কূটনীতির কারণেই শান্তি আলোচনার দুর্গম পথে এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। জন কেরি গত মাত্র পাঁচ মাসে ছয়বার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। আলোচনায় আংশিক সাফল্য এলেও সেটি সব পক্ষের মুখ রক্ষা করবে। তিনি ব্যর্থ হলে অবশ্য ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কাউকেই দায়ী করার সুযোগ থাকবে না। কারণ, বহু বিষয়ে মতভেদ সত্ত্বেও উভয় পক্ষই শান্তি প্রতিষ্ঠায় জন কেরির বিশেষ লক্ষ্যকে স্বাগত জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থন নিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে কেরির নিষ্ঠারও ঘাটতি ছিল না।
সমঝোতার লক্ষ্যে সরাসরি আলোচনা আবার শুরুর ব্যাপারে খুব কম তথ্যই প্রকাশ করা হয়েছে। উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সতর্ক। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা এখনো অসন্তুষ্ট যে তাঁদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের সীমানা রক্ষায় ইসরায়েল রাজি হয়নি। নতুন ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ বন্ধের দাবিটিও ফিলিস্তিনিরা জোরালোভাবে জানিয়ে আসছেন। অগ্রগতির পথে এটাই প্রধান বাধা। বসতি নির্মাণ বন্ধ না করলে আলোচনা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ওপর চাপ রয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিদের অন্য একটি বড় দাবি প্রসঙ্গে জন কেরি ইসরায়েলিদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন। আর সেই দাবিটি হচ্ছে, ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা এক শর বেশি বন্দীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। যাঁরা অন্তত ১০ বছর ধরে বন্দী রয়েছেন, তাঁদের আগে মুক্তি দেওয়া হবে। শান্তি উদ্যোগে এটা একটা বড় অগ্রগতি।
ফিলিস্তিনিদের সুনির্দিষ্ট দাবি হচ্ছে, একতরফা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না বলে নিশ্চয়তা দিতে হবে। দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ মধ্যস্থতাকারী সম্প্রতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ইসরায়েল কোনো বাস্তব সমঝোতার পথে আসেনি।
ওয়াশিংটন বৈঠকের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সমঝোতার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। শান্তি আলোচনা সফল করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখা হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।
আলোচনার পরিবেশ ‘ইতিবাচক’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি মন্ত্রী লিভনি। তিনি জানান, এই আলোচনা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহে শুরু হয়নি, বরং উভয় পক্ষই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।
লিভনির আশঙ্কা, ইসরায়েলে জোট সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হয়তো আলোচনায় বাধা তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত হিসেবে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন ইসরায়েলে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্টিন ইন্ডিক। বর্ষীয়ান এই কূটনীতিক ২০০০ সালের আলোচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। আগামী দফা আলোচনা হবে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। তাতে নেতৃত্ব দেবেন মার্টিন ইন্ডিকই।
২০ বছর আগে অসলোয় অনুষ্ঠিত সমঝোতা আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী ইসরায়েলি কর্মকর্তা ইউরি সাভির জানান, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এবার আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী উভয় দেশের সম্মতিক্রমে ভূমি বিনিময় করতে হবে। এ ছাড়া অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ ‘গঠনমূলক’ নয় বলে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। করণীয় সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানলেও সমঝোতার উদ্যোগে বাস্তবে সাফল্য আসবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
No comments