সিরিয়া সংকট- চ্যালেঞ্জের নাম রাসায়নিক অস্ত্র by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়, রাসায়নিক অস্ত্র
ব্যবহার করে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ‘রেড লাইন’ বা চূড়ান্ত
সীমা অতিক্রম করেছেন।
কাজেই এখন তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। পাশ্চাত্যের নেতারা
একসুরে বলছেন, নিরীহ জনগণের ওপর এত বড় নির্মমতা আন্তর্জাতিক বিশ্ব চুপ
করে মানবে না।মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ও শীর্ষ সেনা
কর্মকর্তারা এরই মধ্যে বলেছেন, সমরাস্ত্র নিয়ে পুরোপুরি তৈরি মার্কিন
সেনারা। এখন শুধু ওবামার হুকুমের অপেক্ষা। দুনিয়ার সবচেয়ে পরাক্রমণশালী
সমরযন্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের এ ঘোষণার পর থেকে দৃশ্যত সিরিয়া অভিযান সময়ের
ব্যাপার মাত্র।বিশেষ করে রাশিয়ার সামরিক সহায়তাপুষ্ট সিরিয়া শক্তির
বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যের মোটামুটি সমীহ জাগানো দেশ। হামলার ভয়ে তারা
কুঁকড়ে যায়নি; বরং দম্ভ প্রকাশ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ
মোয়াল্লাম বেশ তেজের সঙ্গেই বলেছেন, সিরিয়ার কাছে এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
আছে, যা গোটা বিশ্বকে চমকে দেবে। তবে পাশ্চাত্যের অভিযানের মুখে শক্তিশালী
ইরাকের পরিণতির কথা মাথায় রাখলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথায় সিরীয়দের
ভরসা পাওয়ার বিশেষ কারণ নেই।প্রশ্ন উঠেছে, সিরিয়ায় হামলা চালালে
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা লিবিয়ার ঘটনার মতো সহজেই জয়ী হতে পারবে কি
না; নাকি জড়িয়ে পড়বে আরেক ইরাকজাতীয় ফাঁদে। এ উদ্বেগ থেকেই
যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া অভিযানে নামতে এত দিন গড়িমসি করছিল। সপ্তাহ খানেক
আগে দেওয়া ভাষণেও ওবামা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাশার বাহিনীর রাসায়নিক
অস্ত্র প্রয়োগ করার অভিযোগটি খতিয়ে দেখছে। তিনি হুট করেই আরেকটি যুদ্ধে
জড়াতে চান না।লিবিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা শক্তির বেশ তফাত রয়েছে।
বাশার নীরবে সমরাস্ত্রের বিশাল এক মজুত গড়ে তুলেছেন। এর উল্লেখযোগ্য
অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাপক বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র। আগেও বিভিন্ন সময়
সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে ও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে।
গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাশারবিরোধী বিদ্রোহীরাও কখনো কখনো এ কাজ
করেছে বলে অভিযোগ আছে।সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানো হলে সংগত কারণেই
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হবে বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস
করা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সতর্ক না হলে হামলার পরিণতি হবে
মারাত্মক। জাহাজ বা বিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ভুল জায়গায়
পড়লে রাসায়নিক অস্ত্র বিস্ফোরিত হয়ে যে গ্যাস ও ক্ষতিকর পদার্থ ছড়াবে,
তাতে বেঘোরে মারা পড়বে হাজারো নিরীহ মানুষ। এ জন্য পেন্টাগন কর্মকর্তারা
খুব সতর্কভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ও ঘাঁটিতে
হামলা চালানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু
মুখে বললেই সুনির্দিষ্টভাবে বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুতে আঘাত হানা
সহজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না,
বিপজ্জনক সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাসে ভরা রাসায়নিক অস্ত্রগুলো কোথায়
লুকিয়ে রেখেছেন বাশার। আর বিভিন্ন স্থানে রাখা এই মারণাস্ত্রের মজুত এতটাই
বিশাল যে যতই ধ্বংস করা হোক না কেন, কিছুটা থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশ
জোরালো। তা পড়তে পারে জঙ্গিদের মতো আরও বিপজ্জনক পক্ষের হাতেও। সেটা
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দুঃস্বপ্ন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে
পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা ছিল, সিরিয়ার ভেতর ১৫টি বা তার বেশি
গোপন স্থানে রাসায়নিক অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সেই যুদ্ধের বয়স এখন
দুই বছর পার হয়েছে। এত দিনে পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়ে থাকতে
পারে।ওয়াশিংটনের হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড
ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের শিক্ষক ও সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা এলিয়ট কোহেন
বলেন, এত দিনে এসব রাসায়নিক অস্ত্র আরও কয়েকটি গোপন স্থাপনায় ছড়িয়ে
দিয়েছে বাশারের অনুগত সেনারা। নতুন স্থানগুলোর হদিস করা এবং খুঁজে খুঁজে
সেখানে হামলা চালানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাঁর মতে, রাসায়নিক অস্ত্রের
মজুতে আঘাত হানলে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে ঘটনাটি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তা হচ্ছে
আশপাশের লোকজন এর সংস্পর্শে আসা।এলিয়ট কোহেনের মতে, বরং স্থলপথে সেনা
অভিযান চালিয়ে স্থাপনা অবরোধ করে অস্ত্রগুলো যদি উদ্ধার করা যায়, তাহলে
জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্থল অভিযান
যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। খরচের বোঝা বাড়া ও বিপদের ঝুঁকি ছাড়াও এর
মধ্যে তাদের নিজস্ব আইনি জটিলতার ব্যাপার আছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা
মন্ত্রণালয় পেন্টাগন হিসাব করে দেখেছে, এ ধরনের অভিয়ানে ৭৫ হাজার সেনার
প্রয়োজন হতে পারে।
গত মাসে সিরিয়ায় সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেনা ও সামরিক
সরঞ্জামের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (জয়েন্ট
চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান) জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি। কংগ্রেসের সশস্ত্র
বাহিনীসংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান মিশিগানের ডেমোক্র্যাট সিনেটর কার্ল
লেভিনের কাছে এ বিবরণ দেন তিনি। মার্টিন ডেম্পসি বলেন, রাসায়নিক অস্ত্রের
স্থানান্তর ও সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এই মজুতের অংশবিশেষ ধ্বংস
করে দেওয়া যায়। একই সঙ্গে এসব অস্ত্র ব্যবহারের সরঞ্জামও বাজেয়াপ্ত করা
যায়। কিন্তু তা করতে গেলে অন্তত উড্ডয়ননিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করতে হবে। সে
ক্ষেত্রে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ভারী অস্ত্র লাগবে। লাগবে আরও
বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ব্যবহারে লাগবে আবার কয়েক শ যুদ্ধবিমান,
যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ এবং এ ধরনের যান ও সরঞ্জাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
এলাকাগুলোতে অভিযান চালাতে লাগবে বিশেষ ও পদাতিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা।
কিন্তু ওবামা বা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ কেউই চান না সিরিয়ার মাটিতে
মার্কিন সেনারা যাক। এ জন্য ওবামা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা
আকাশযুদ্ধের কথাই ভেবেছেন।
বিমান হামলাও শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত হবে না যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। যুদ্ধবিমান
ভূপাতিত করার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে বাশারের বিমানবাহিনীর। এ জন্য রাশিয়া
পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে সিরিয়াকে। যদিও সিরিয়ার বিমানবিধ্বংসী
অস্ত্রসরঞ্জামের কতগুলো কর্মক্ষম আর যথেষ্ট হালনাগাদ, তা নিয়ে প্রশ্ন
রয়েছে।
কিছু মার্কিন কর্মকর্তা আবার দূরপাল্লার টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে
স্থলে আঘাত হানার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এসব ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার
পাউন্ডের বেশি যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম নয়। এই যুদ্ধাস্ত্র মাটির এতটা
গভীরে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত
রয়েছে।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অ্যামি স্মিথসন বলেন,
রেটামাহক দিয়ে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করার চেষ্টা একটা বড়
ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই ক্ষেপণাস্ত্র যদি অর্ধেক রাসায়নিক
অস্ত্রও ধ্বংস করে, এর বিপরীতে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যাবে বহুগুণ। ধ্বংস
হওয়া রাসায়নিক অস্ত্র থেকে যে প্রাণঘাতী গ্যাস বেরোবে, তা নিকটবর্তী
এলাকার মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
অ্যামি স্মিথসনের মতে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর আগে রাসায়নিক
অস্ত্রের মজুত আছে—এমন এলাকার লোকজনকে আগেভাগে সতর্ক করে দিতে হবে; নিশ্চিত
করতে হবে তাদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। এ জন্য তাদের গ্যাসরোধী মুখোশ দিতে
হবে। এ পরামর্শ যে যুদ্ধের বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ
হতে হয় না। তার মানে, সিরিয়ায় হামলা চালালে নিরীহ মানুষের ব্যাপক
প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। অথচ কিনা সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্যই এ
অভিযানের আয়োজন বলে দাবি করছে পাশ্চাত্য। তারা এ উদ্বেগের সমাধান কীভাবে
করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
No comments