জনতা, গণতন্ত্র ও সুশাসনজেড by জেড এ খান
আজীবন শুনে এসেছি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের
পালনের কথা। শুনে এসেছি জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সোচ্চার হয়ে নেতাদের বলতে
শুনেছি, প্রথমে জনগণ, তারপর দেশ এবং সবশেষে দল।
কিংবদন্তি
আব্রাহাম লিংকনের কালজয়ী বক্তব্য 'গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের, মানুষের জন্য
এবং মানুষ দ্বারা পরিচালিত' অহরহই আমাদের মনে পড়ে। এসব সুবাক্যের আমাদের
সামাজিক জীবনে কিংবা জাতীয় জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটেছে বা ঘটানোর জন্য
আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি, তা ভাবার সময় এসেছে।
লাখো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। পাকিস্তান স্বাধীনতার ২৪ বছরের মাথায় আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অগ্রাহ্য করে একটি ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করেছিল আমাদের 'মুসলমান' বানাতে ও পাকিস্তানকে বাঁচাতে। অনেক বাঙালি মহারথীকে গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, 'আল্লাহকে ধন্যবাদ যে পাকিস্তান বাঁচল।'
একটি ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় ও কয়েকটি প্রত্যাশা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হিংস্র পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেমেছিল, যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ হবে শোষণমুক্ত। এ দেশে ধনী ও গরিবের মধ্যকার দূরত্ব কমবে। সম্পদের আপেক্ষিক সমবিভাজন হবে। প্রকৃত গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা হবে ও বাকস্বাধীনতা থাকবে। প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি?
এ প্রশ্নের উত্তর সহজেই অনুমেয়। গত চার দশকেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর তেমন কোনো ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি না বললে অত্যুক্তি হবে না। এর জন্য দায়ী কে? কোনো এক টিভি চ্যানেলের আলোচনায় আমি বলেছিলাম, কুরাজনীতি (Flawed Politics) ও সিংহভাগ নির্লিপ্ত ও নির্বিকার জনগণ (Indifferent People) এর জন্য দায়ী। এতে ওই আলোচনায় অপর আলোচক আমাকে শোধরানোর জন্য বললেন, জনগণকে দোষ দেওয়া উচিত নয়। তাদের আমরা দেখেছি নির্বাচনের সময় সঠিক রায় দিতে। তার প্রতি আমার প্রশ্ন ছিল, তারা কি প্রার্থীকে ভোট দেয়, না প্রতীককে ভোট দেয়?
আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের রাজনীতি কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা বেশির ভাগ নাগরিকের অজানা নয়। কোনো সংজ্ঞাতেই আমাদের বর্তমান রাজনীতিকে দেশ ও দশের রাজনীতি বলা যাবে না। এখানকার রাজনীতি কেবল দলীয় রাজনীতি, নির্বাচনে জয়ের রাজনীতি। একটি দল সরকার গঠন করে যদি পাঁচ বছর ক্ষমতায় আসীন থাকে, স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা উন্নয়ন হবে। কেননা তাদের ক্ষমতার বাইরের দলগুলোর কাছে জবাবদিহি হতে হবে ক্ষাণিকটা হলেও এবং বিশ্বের কাছেও ইমেজ ধরে রাখতে হবে; নতুবা সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। যা না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে এবং নিজেদেরও টুপাইস আয়ের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাবে।
এখন দেখা যাক জনগণ আমাদের রাজনীতিতে অথবা আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কতটা ভূমিকা রাখে বা রাখতে দেওয়া হয়। গণতন্ত্র হচ্ছে প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি। সব পর্যায়ে কারা জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন এবং কিভাবে হচ্ছেন? গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো হচ্ছে অবাধ নির্বাচন, সঠিক সময়ে ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতা মূলত সংসদের মাধ্যমে। আমাদের গত তিন দশকের রাজনৈতিক আচরণ পুঙ্খানুরূপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র বহুলাংশে বিঘ্নিত হয়েছে এবং জনগণকে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় স্বার্থে বিরোধী দলকে তোয়াক্কা না করেই।
কিভাবে জনগণকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে? আমাদের অজানা নেই যে আমাদের সিংহভাগ জনগণ যেকোনো বিবেচনায় বহুলাংশে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যে কারণে গণমাধ্যমের সুফল তারা ভোগ করতে পারে না এবং এটাও ঠিক যে আমাদের গণমাধ্যমও একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। এদের অনেক লিখনীতে পক্ষপাতিত্বের গন্ধ পাওয়া যায়। আমাদের স্বল্প পরিসরের সিভিল সোসাইটিও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে পালন করে না বলে অনেককেই অভিযোগ করতে শুনি। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, আমাদের সংসদের বেশির ভাগ সদস্য হচ্ছেন ব্যবসায়ী; যার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। প্রথম সংসদের ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী থেকে আজকের সংসদে ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী উন্নীত হয়েছে।
তৃণমূল পর্যায় থেকে যাঁরা রাজনীতি করে আসছেন, আজ তাঁরা অবহেলিত। কেননা ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা অর্থ দিয়ে আমাদের দরিদ্র জনগণকে তাঁদের পক্ষ নিয়ে যাচ্ছেন, সৃষ্টি করছেন মাস্তানবাহিনী; যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন। যার কারণে ধনী ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। গ্রামগঞ্জে নির্বাচনের সময় বেশির ভাগ স্লোগান ওঠে দলের প্রতীকের ওপর, যিনি প্রার্থী তাঁর ওপর নয়। এর কারণ হচ্ছে, এসব প্রার্থী প্রায়ই উড়ে এসে জুড়ে বসে বলে তাঁদের খুব কম ভোটারই চেনে। এ ছাড়া তাঁদের ছবি ব্যালট পেপারে থাকে না এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বেশির ভাগ ভোটার পড়তে সক্ষম না হওয়ার কারণে তারা প্রতীককে ভোট দেয়। তা না হলে কী করে নিজ এলাকায় হেরে দুই মাসের মাথায় অন্য এলাকায় প্রার্থী হয়ে ভোটে জেতেন?
অর্থ ও পেশিশক্তির উপস্থিতির কারণে জনগণ আজ বিচলিত কি না জানি না, তবে তারা যে ক্ষিপ্ত তাতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। এরাই কবিগুরুর 'আধমরা' মানুষ কি না জানি না। তবে তাদের চাহিদাকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় না সে ব্যাপারে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। তাই যদি হতো তাহলে দরিদ্র দরিদ্রতর হতো না আর ধনীরা আরো ধনবান হতো না। ধনবান হতে মেধার প্রয়োজন আছে, তা আমাদের অজানা নয়। তবে আমাদের সিংহভাগ ধনকুবের মেধা যতটা না ব্যবহার করেন তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করেন চোরাগোপ্তা পন্থা; যেখানে আছে শঠতা, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির অবাধ ব্যবহার।
আমাদের বিরাটসংখ্যক ব্যবসায়ী তাঁদের জীবন শুরু করেন 'চোরাপথ' ধরে। সময়ের উত্তরণের সঙ্গে তাঁরা অনেকেই শুধরে ফেলেন নিজেদের; কিন্তু তত দিনে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা জাগে সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার। এর জন্য সহজ পথ রাজনীতি মনে করে তাঁরা নেমে যান। নেমে যখন দেখেন তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তখন তাঁরা তাঁদের সম্পদ ব্যবহার করেন। বছর না ঘুরতেই তাঁরা দলের নমিনেশনের 'ব্যবস্থা' করে ফেলেন এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেন।
তাঁদেরকে ভোট দেয় জনগণ অবশ্যই। তারা কেন অগ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়? কেন তারা এসব জনপ্রতিনিধিকে প্রশ্ন করে না, তিনি এলাকার জন্য কী করলেন? কেন তারা সরকারের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়? যদি জনগণ দলের অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রমকে প্রশ্ন করত এবং এর অবসান চাইত, তাহলে আমাদের রাজনীতি জনকল্যাণমূলক হতো। বলতে পারেন, দল জনগণের পক্ষে কথা বলে। আমার প্রশ্ন, কোন দল দেশ ও জনগণের কথা বলে? জাতীয় সমস্যা নিয়ে একটা লোকদেখানো বক্তব্য দেয় মাত্র। কিন্তু এর বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোনো আন্তরিক ভূমিকা রেখেছে বলে দৃশ্যমান নয়।
আমার সুপারিশ হচ্ছে রাজনীতিকে গণমুখী করা হোক। জনকল্যাণকে সামনে রেখে রাজনৈতিক বাগ্বিতণ্ডা শুরু হোক দলের ভেতরে ও বাইরে। দলকে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হোক; যাতে সর্বস্তরের জনগণের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তৃণমূল থেকে আসা রাজনীতিবিদদের পরিচর্চা করা হোক, যাতে তাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। কমপক্ষে তিন বছর দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে তাঁকে যেন নির্বাচনে প্রার্থিতা না দেওয়া হয়। কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে যেন দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয়।
আমি মনে করি, জনগণকে কেবল দলের স্বার্থে ব্যবহার করলে দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়, যা আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব ঈপ্সিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পরিপন্থী। আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে গণতন্ত্রকে লালন করতে হবে এবং জনগণকে সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎসে পরিণত করতে হবে। দুর্নীতি রোধ করতে হবে। রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। জনগণ সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড অথবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে তাদের বিরুদ্ধে দমননীতি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। একমাত্র এই পন্থায়ই গণতন্ত্রকে সুসংহত করা যাবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঞ্চালিত হবে এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক : রাজনীতিবিদ
লাখো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। পাকিস্তান স্বাধীনতার ২৪ বছরের মাথায় আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অগ্রাহ্য করে একটি ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করেছিল আমাদের 'মুসলমান' বানাতে ও পাকিস্তানকে বাঁচাতে। অনেক বাঙালি মহারথীকে গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, 'আল্লাহকে ধন্যবাদ যে পাকিস্তান বাঁচল।'
একটি ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় ও কয়েকটি প্রত্যাশা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হিংস্র পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেমেছিল, যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ হবে শোষণমুক্ত। এ দেশে ধনী ও গরিবের মধ্যকার দূরত্ব কমবে। সম্পদের আপেক্ষিক সমবিভাজন হবে। প্রকৃত গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা হবে ও বাকস্বাধীনতা থাকবে। প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি?
এ প্রশ্নের উত্তর সহজেই অনুমেয়। গত চার দশকেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর তেমন কোনো ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি না বললে অত্যুক্তি হবে না। এর জন্য দায়ী কে? কোনো এক টিভি চ্যানেলের আলোচনায় আমি বলেছিলাম, কুরাজনীতি (Flawed Politics) ও সিংহভাগ নির্লিপ্ত ও নির্বিকার জনগণ (Indifferent People) এর জন্য দায়ী। এতে ওই আলোচনায় অপর আলোচক আমাকে শোধরানোর জন্য বললেন, জনগণকে দোষ দেওয়া উচিত নয়। তাদের আমরা দেখেছি নির্বাচনের সময় সঠিক রায় দিতে। তার প্রতি আমার প্রশ্ন ছিল, তারা কি প্রার্থীকে ভোট দেয়, না প্রতীককে ভোট দেয়?
আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের রাজনীতি কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা বেশির ভাগ নাগরিকের অজানা নয়। কোনো সংজ্ঞাতেই আমাদের বর্তমান রাজনীতিকে দেশ ও দশের রাজনীতি বলা যাবে না। এখানকার রাজনীতি কেবল দলীয় রাজনীতি, নির্বাচনে জয়ের রাজনীতি। একটি দল সরকার গঠন করে যদি পাঁচ বছর ক্ষমতায় আসীন থাকে, স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা উন্নয়ন হবে। কেননা তাদের ক্ষমতার বাইরের দলগুলোর কাছে জবাবদিহি হতে হবে ক্ষাণিকটা হলেও এবং বিশ্বের কাছেও ইমেজ ধরে রাখতে হবে; নতুবা সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। যা না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে এবং নিজেদেরও টুপাইস আয়ের রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাবে।
এখন দেখা যাক জনগণ আমাদের রাজনীতিতে অথবা আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কতটা ভূমিকা রাখে বা রাখতে দেওয়া হয়। গণতন্ত্র হচ্ছে প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি। সব পর্যায়ে কারা জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন এবং কিভাবে হচ্ছেন? গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো হচ্ছে অবাধ নির্বাচন, সঠিক সময়ে ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতা মূলত সংসদের মাধ্যমে। আমাদের গত তিন দশকের রাজনৈতিক আচরণ পুঙ্খানুরূপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গণতন্ত্র বহুলাংশে বিঘ্নিত হয়েছে এবং জনগণকে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় স্বার্থে বিরোধী দলকে তোয়াক্কা না করেই।
কিভাবে জনগণকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে? আমাদের অজানা নেই যে আমাদের সিংহভাগ জনগণ যেকোনো বিবেচনায় বহুলাংশে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যে কারণে গণমাধ্যমের সুফল তারা ভোগ করতে পারে না এবং এটাও ঠিক যে আমাদের গণমাধ্যমও একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। এদের অনেক লিখনীতে পক্ষপাতিত্বের গন্ধ পাওয়া যায়। আমাদের স্বল্প পরিসরের সিভিল সোসাইটিও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে পালন করে না বলে অনেককেই অভিযোগ করতে শুনি। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, আমাদের সংসদের বেশির ভাগ সদস্য হচ্ছেন ব্যবসায়ী; যার সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। প্রথম সংসদের ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী থেকে আজকের সংসদে ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী উন্নীত হয়েছে।
তৃণমূল পর্যায় থেকে যাঁরা রাজনীতি করে আসছেন, আজ তাঁরা অবহেলিত। কেননা ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা অর্থ দিয়ে আমাদের দরিদ্র জনগণকে তাঁদের পক্ষ নিয়ে যাচ্ছেন, সৃষ্টি করছেন মাস্তানবাহিনী; যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন। যার কারণে ধনী ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। গ্রামগঞ্জে নির্বাচনের সময় বেশির ভাগ স্লোগান ওঠে দলের প্রতীকের ওপর, যিনি প্রার্থী তাঁর ওপর নয়। এর কারণ হচ্ছে, এসব প্রার্থী প্রায়ই উড়ে এসে জুড়ে বসে বলে তাঁদের খুব কম ভোটারই চেনে। এ ছাড়া তাঁদের ছবি ব্যালট পেপারে থাকে না এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের বেশির ভাগ ভোটার পড়তে সক্ষম না হওয়ার কারণে তারা প্রতীককে ভোট দেয়। তা না হলে কী করে নিজ এলাকায় হেরে দুই মাসের মাথায় অন্য এলাকায় প্রার্থী হয়ে ভোটে জেতেন?
অর্থ ও পেশিশক্তির উপস্থিতির কারণে জনগণ আজ বিচলিত কি না জানি না, তবে তারা যে ক্ষিপ্ত তাতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। এরাই কবিগুরুর 'আধমরা' মানুষ কি না জানি না। তবে তাদের চাহিদাকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয় না সে ব্যাপারে আমার খুব একটা সন্দেহ নেই। তাই যদি হতো তাহলে দরিদ্র দরিদ্রতর হতো না আর ধনীরা আরো ধনবান হতো না। ধনবান হতে মেধার প্রয়োজন আছে, তা আমাদের অজানা নয়। তবে আমাদের সিংহভাগ ধনকুবের মেধা যতটা না ব্যবহার করেন তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করেন চোরাগোপ্তা পন্থা; যেখানে আছে শঠতা, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির অবাধ ব্যবহার।
আমাদের বিরাটসংখ্যক ব্যবসায়ী তাঁদের জীবন শুরু করেন 'চোরাপথ' ধরে। সময়ের উত্তরণের সঙ্গে তাঁরা অনেকেই শুধরে ফেলেন নিজেদের; কিন্তু তত দিনে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা জাগে সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার। এর জন্য সহজ পথ রাজনীতি মনে করে তাঁরা নেমে যান। নেমে যখন দেখেন তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তখন তাঁরা তাঁদের সম্পদ ব্যবহার করেন। বছর না ঘুরতেই তাঁরা দলের নমিনেশনের 'ব্যবস্থা' করে ফেলেন এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেন।
তাঁদেরকে ভোট দেয় জনগণ অবশ্যই। তারা কেন অগ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়? কেন তারা এসব জনপ্রতিনিধিকে প্রশ্ন করে না, তিনি এলাকার জন্য কী করলেন? কেন তারা সরকারের অপকর্মকে প্রশ্রয় দেয়? যদি জনগণ দলের অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রমকে প্রশ্ন করত এবং এর অবসান চাইত, তাহলে আমাদের রাজনীতি জনকল্যাণমূলক হতো। বলতে পারেন, দল জনগণের পক্ষে কথা বলে। আমার প্রশ্ন, কোন দল দেশ ও জনগণের কথা বলে? জাতীয় সমস্যা নিয়ে একটা লোকদেখানো বক্তব্য দেয় মাত্র। কিন্তু এর বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোনো আন্তরিক ভূমিকা রেখেছে বলে দৃশ্যমান নয়।
আমার সুপারিশ হচ্ছে রাজনীতিকে গণমুখী করা হোক। জনকল্যাণকে সামনে রেখে রাজনৈতিক বাগ্বিতণ্ডা শুরু হোক দলের ভেতরে ও বাইরে। দলকে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হোক; যাতে সর্বস্তরের জনগণের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তৃণমূল থেকে আসা রাজনীতিবিদদের পরিচর্চা করা হোক, যাতে তাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। কমপক্ষে তিন বছর দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে তাঁকে যেন নির্বাচনে প্রার্থিতা না দেওয়া হয়। কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে যেন দলের সব পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হয়।
আমি মনে করি, জনগণকে কেবল দলের স্বার্থে ব্যবহার করলে দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়, যা আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব ঈপ্সিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পরিপন্থী। আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে গণতন্ত্রকে লালন করতে হবে এবং জনগণকে সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎসে পরিণত করতে হবে। দুর্নীতি রোধ করতে হবে। রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। জনগণ সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড অথবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে তাদের বিরুদ্ধে দমননীতি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। একমাত্র এই পন্থায়ই গণতন্ত্রকে সুসংহত করা যাবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঞ্চালিত হবে এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক : রাজনীতিবিদ
No comments