সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল পাস ইন্টারনেটের কথা ও ছবি মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ হবে
ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা অন্য কোনোভাবে
ইন্টারনেটে ব্যবহূত আলোচনা, কথাবার্তা, স্থির বা ভিডিওচিত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ
হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে। কেউ বিদেশে অপরাধ করে বাংলাদেশে আশ্রয়
নিলে তাঁর বিচার এ দেশেই করা যাবে।
কারও বিরুদ্ধে দেশে বা বিদেশে আল-কায়েদা বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে বিচারের আওতায় আনা যাবে।
এই বিধান রেখে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩ পাস হয়েছে।
বিলটি পাসের প্রতিবাদে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। এ সময় বিএনপির সাংসদ মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সন্ত্রাস দমনে নয়, বিরোধী দলকে দমনে এই নিকৃষ্ট আইন করা হচ্ছে। এটি ইতিহাসে কালো আইন বলে চিহ্নিত হবে। এ আইনে পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে আইনের অপব্যবহার হবে। আমরা এর প্রতিবাদে ওয়াকআউট করছি।’ এক মিনিট পর তাঁরা আবার সংসদে ফিরে আসেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯’ পাস হয়। তবে আইনটি পাসের পর বলা হয়, এটি যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ধরনও দ্রুত বদলে যেতে থাকে। এ কারণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদণ্ড অনুসরণ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরপর গত বছর এক দফা আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু তারপর আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনুরোধ আসে। এসব বিষয় যুক্ত করতেই সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলের ওপর দেওয়া বিরোধী দলের সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাব, জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। বিরোধী দলের সদস্যরা অংশগ্রহণ করায় বিলটি পাস হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
বিলটি পাসের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে সাক্ষ্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি নয়—এমন আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক সনদ (কনভেনশন) এই প্রথম আইন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আল-কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদে অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া দুটি প্রস্তাবও আইনে পরিণত হলো।
এ আইনের ধারা ২ অনুসারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ম্যানুয়াল/ইলেকট্রনিক/ডিজিটাল কিংবা যেভাবেই লেনদেন করা হোক না কেন, তা এ আইনের আওতায় আসবে। অর্থের উৎস দেশ/বিদেশ যেকোনো স্থান থেকে হতে পারে। শুধু যদি মনে হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে টাকা পাচার করা হচ্ছে, তাহলে তা এই আইনের আওতায় চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে নগদ টাকা পাঠানোর বিষয়টি যে প্রমাণিত হতে হবে, তা নয়। চেক, মানি অর্ডার, পে-অর্ডার, ডিডি, টিটি, ক্রেডিট কার্ড এমনকি ই-মেইল বার্তায় প্রমাণ পাওয়া গেলে তা এই আইনের আওতায় অর্থ পাচারের অভিযোগে সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সন্দেহজনক যেকোনো লেনদেন এ আইনের আওতায় আসবে।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধসংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, মামলার স্বার্থে তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রসঙ্গত, প্রচলিত সাক্ষ্য আইনে এ ধরনের আলামত আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়, ‘এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা করে তদন্তকাজ শুরু করতে পারবেন।’
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। কিন্তু কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তাঁরা বলেন, এতে পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে নিজ থেকেই তদন্ত করতে পারে। এ জন্য কারও অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না।
এই আইনের ১৫ ধারা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংক হিসাব যাচাই করে দেখতে পারবে। কোনো আর্থিক লেনদেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে বা হতে পারে, এমন সন্দেহ হলে তা তদন্ত করে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জানাতে পারবে। যেকোনো ব্যাংক তাদের হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) সংরক্ষিত অর্থের উৎস জানতে প্রয়োজনীয় যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এ জন্য ব্যাংক যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নিতে পারবে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক খাতের কোনো গোয়েন্দা ইউনিট অর্থ পাচারসংক্রান্ত তথ্য চাইলে যেকোনো দেশের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
২৩ ধারায় বলা আছে, যেকোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোনো ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য রেকর্ড করার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি লিখিতভাবে বিবৃতি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁকে তা লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে।
সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার, ব্যক্তি বা সত্তাকে কোনো কাজ করতে বা কাজ করা থেকে বিরত রাখে, তবে তা হবে সন্ত্রাসী কাজ। এ উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আহত, আটক বা অপহরণ করলে তা-ও সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর জখম, আটক বা অপহরণের জন্য অপর কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করা; ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করা বা করার ষড়যন্ত্র করা; অথবা উদ্দেশ্যসাধনে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ বহন বা ব্যবহার করলে তা সন্ত্রাসী কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে কোনো কাজ করতে প্ররোচিত করা বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া সন্ত্রাসী কাজ বলে বিবেচিত হবে।
যদি কোনো ব্যক্তি বা বিদেশি নাগরিক এ ধারার অধীন কোনো অপরাধ করেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২০ ধারার সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ১৮ ধারা অনুযায়ী কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ হলে সরকার সেই সংগঠনের কার্যালয় বন্ধ করে দিতে পারবে। জব্দ করতে পারবে তাদের ব্যাংক হিসাব। সংগঠনের সদস্যদের দেশত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষে বা সমর্থনে কোনো ধরনের বিবৃতি, প্রচারণা, প্রকাশনা বা বক্তৃতা দেওয়া যাবে না। তাদের আয় ও ব্যয়ের সব উৎস সরকার প্রকাশ করতে পারবে এবং সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত প্রমাণিত হলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, ১৮ ধারা অনুযায়ী সরকার যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে যেকোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার দায়ে নিষিদ্ধ করতে পারবে।
৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন, বৈধ বা অবৈধ উৎস হতে স্বেচ্ছায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে—যেকোনো অভিপ্রায়ে অর্থ বা সম্পত্তি সরবরাহ করলে এবং সেই সম্পত্তি বা অর্থ সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহূত হলে বা সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তার কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হলে তা সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সেই ব্যক্তির সর্বোচ্চ ২০ বছর এবং কমপক্ষে চার বছরের কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দামের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা যাবে।
একই আইনে যদি কোনো সত্তা বা সংগঠন অপরাধী সাব্যস্ত হয়, সেই সত্তার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থের তিন গুণ পরিমাণ অথবা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। সত্তার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, তাঁরা অভিযুক্ত হবেন, তিনি সর্বোচ্চ ২০ বছর এবং সর্বনিম্ন চার বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
১১ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা অপরাধ করার চেষ্টা চালালে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তি বা সত্তার প্রধান সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ আইন অনুসারে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বাংলাদেশে রেজিস্ট্রিকৃত কোনো জাহাজ এবং আকাশযান বা বিমানে থাকা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে এ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আইনের ২০-এর ক ধারা অনুসারে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ১২৬৭ ও ১৩৭৩ আইনের আওতাভুক্ত হয়েছে। এ দুটি প্রস্তাবের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২৬৭ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৯ সালে। আল-কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং আল-কায়েদার ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৩৭৩ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় ২০০১ সালে। টুইন টাওয়ার ধসের পর জঙ্গিবাদে অর্থায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বিলের ওপর আলোচনায় বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস দমনের জন্য প্রচলিত আইনই যথেষ্ট। এ আইন করা হচ্ছে গণতন্ত্র হত্যার জন্য।
স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বলেন, সন্ত্রাস দমন নয়, বিরোধী দলকে দমন করার জন্য এ আইন করা হচ্ছে।
এই বিধান রেখে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩ পাস হয়েছে।
বিলটি পাসের প্রতিবাদে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। এ সময় বিএনপির সাংসদ মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সন্ত্রাস দমনে নয়, বিরোধী দলকে দমনে এই নিকৃষ্ট আইন করা হচ্ছে। এটি ইতিহাসে কালো আইন বলে চিহ্নিত হবে। এ আইনে পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে আইনের অপব্যবহার হবে। আমরা এর প্রতিবাদে ওয়াকআউট করছি।’ এক মিনিট পর তাঁরা আবার সংসদে ফিরে আসেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯’ পাস হয়। তবে আইনটি পাসের পর বলা হয়, এটি যুগোপযোগী নয়। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ধরনও দ্রুত বদলে যেতে থাকে। এ কারণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজি) এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদণ্ড অনুসরণ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরপর গত বছর এক দফা আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু তারপর আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনুরোধ আসে। এসব বিষয় যুক্ত করতেই সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলের ওপর দেওয়া বিরোধী দলের সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাব, জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। বিরোধী দলের সদস্যরা অংশগ্রহণ করায় বিলটি পাস হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
বিলটি পাসের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে সাক্ষ্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যগুলো প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি নয়—এমন আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক সনদ (কনভেনশন) এই প্রথম আইন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আল-কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদে অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া দুটি প্রস্তাবও আইনে পরিণত হলো।
এ আইনের ধারা ২ অনুসারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ম্যানুয়াল/ইলেকট্রনিক/ডিজিটাল কিংবা যেভাবেই লেনদেন করা হোক না কেন, তা এ আইনের আওতায় আসবে। অর্থের উৎস দেশ/বিদেশ যেকোনো স্থান থেকে হতে পারে। শুধু যদি মনে হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে টাকা পাচার করা হচ্ছে, তাহলে তা এই আইনের আওতায় চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে নগদ টাকা পাঠানোর বিষয়টি যে প্রমাণিত হতে হবে, তা নয়। চেক, মানি অর্ডার, পে-অর্ডার, ডিডি, টিটি, ক্রেডিট কার্ড এমনকি ই-মেইল বার্তায় প্রমাণ পাওয়া গেলে তা এই আইনের আওতায় অর্থ পাচারের অভিযোগে সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সন্দেহজনক যেকোনো লেনদেন এ আইনের আওতায় আসবে।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধসংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, মামলার স্বার্থে তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রসঙ্গত, প্রচলিত সাক্ষ্য আইনে এ ধরনের আলামত আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়, ‘এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা করে তদন্তকাজ শুরু করতে পারবেন।’
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। কিন্তু কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তাঁরা বলেন, এতে পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে পুলিশ অপরাধ আমলে নিয়ে নিজ থেকেই তদন্ত করতে পারে। এ জন্য কারও অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না।
এই আইনের ১৫ ধারা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংক হিসাব যাচাই করে দেখতে পারবে। কোনো আর্থিক লেনদেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে বা হতে পারে, এমন সন্দেহ হলে তা তদন্ত করে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জানাতে পারবে। যেকোনো ব্যাংক তাদের হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) সংরক্ষিত অর্থের উৎস জানতে প্রয়োজনীয় যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এ জন্য ব্যাংক যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা নিতে পারবে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক খাতের কোনো গোয়েন্দা ইউনিট অর্থ পাচারসংক্রান্ত তথ্য চাইলে যেকোনো দেশের ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
২৩ ধারায় বলা আছে, যেকোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোনো ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য রেকর্ড করার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তি লিখিতভাবে বিবৃতি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁকে তা লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে।
সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার, ব্যক্তি বা সত্তাকে কোনো কাজ করতে বা কাজ করা থেকে বিরত রাখে, তবে তা হবে সন্ত্রাসী কাজ। এ উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আহত, আটক বা অপহরণ করলে তা-ও সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর জখম, আটক বা অপহরণের জন্য অপর কোনো ব্যক্তিকে প্ররোচিত করা; ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করা বা করার ষড়যন্ত্র করা; অথবা উদ্দেশ্যসাধনে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ বহন বা ব্যবহার করলে তা সন্ত্রাসী কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে কোনো কাজ করতে প্ররোচিত করা বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া সন্ত্রাসী কাজ বলে বিবেচিত হবে।
যদি কোনো ব্যক্তি বা বিদেশি নাগরিক এ ধারার অধীন কোনো অপরাধ করেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২০ ধারার সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ১৮ ধারা অনুযায়ী কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ হলে সরকার সেই সংগঠনের কার্যালয় বন্ধ করে দিতে পারবে। জব্দ করতে পারবে তাদের ব্যাংক হিসাব। সংগঠনের সদস্যদের দেশত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষে বা সমর্থনে কোনো ধরনের বিবৃতি, প্রচারণা, প্রকাশনা বা বক্তৃতা দেওয়া যাবে না। তাদের আয় ও ব্যয়ের সব উৎস সরকার প্রকাশ করতে পারবে এবং সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত প্রমাণিত হলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, ১৮ ধারা অনুযায়ী সরকার যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে যেকোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার দায়ে নিষিদ্ধ করতে পারবে।
৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন, বৈধ বা অবৈধ উৎস হতে স্বেচ্ছায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে—যেকোনো অভিপ্রায়ে অর্থ বা সম্পত্তি সরবরাহ করলে এবং সেই সম্পত্তি বা অর্থ সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহূত হলে বা সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তার কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হলে তা সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সেই ব্যক্তির সর্বোচ্চ ২০ বছর এবং কমপক্ষে চার বছরের কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দামের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা যাবে।
একই আইনে যদি কোনো সত্তা বা সংগঠন অপরাধী সাব্যস্ত হয়, সেই সত্তার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থের তিন গুণ পরিমাণ অথবা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। সত্তার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, তাঁরা অভিযুক্ত হবেন, তিনি সর্বোচ্চ ২০ বছর এবং সর্বনিম্ন চার বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
১১ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা অপরাধ করার চেষ্টা চালালে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য উক্ত ব্যক্তি বা সত্তার প্রধান সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ আইন অনুসারে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বাংলাদেশে রেজিস্ট্রিকৃত কোনো জাহাজ এবং আকাশযান বা বিমানে থাকা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে এ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আইনের ২০-এর ক ধারা অনুসারে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ১২৬৭ ও ১৩৭৩ আইনের আওতাভুক্ত হয়েছে। এ দুটি প্রস্তাবের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২৬৭ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় ১৯৯৯ সালে। আল-কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ এবং আল-কায়েদার ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৩৭৩ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় ২০০১ সালে। টুইন টাওয়ার ধসের পর জঙ্গিবাদে অর্থায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বিলের ওপর আলোচনায় বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস দমনের জন্য প্রচলিত আইনই যথেষ্ট। এ আইন করা হচ্ছে গণতন্ত্র হত্যার জন্য।
স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বলেন, সন্ত্রাস দমন নয়, বিরোধী দলকে দমন করার জন্য এ আইন করা হচ্ছে।
No comments