বেগম পাড়ার সাহেব ও দেশ বিক্রিরকচ্ছপেরা by ফারুকওয়াসিফ
যদি বলি কোন প্রাণী নিজের ঘর পিঠে নিয়ে চলে? এর উত্তর হবে ১. কচ্ছপ, ২. এক চীনা কৃষক এবং ৩. কয়েক হাজার বাংলাদেশি বড়লোক। রূপকথার সেই কচ্ছপের গায়ে আদিতে কোনো খোল ছিল না। ঘরের বাইরে বের হলেই শিয়াল, কুকুর, ইগল খেয়ে ফেলত। সে দেখল, ঘরেই সে নিরাপদ। তাই সে কচ্ছপ দেবতার কাছে প্রার্থনা করল, তার শক্ত খোলের ঘরটা যেন সে সব সময় বইতে পারে। সে যুগে দেবতারা সত্যমনে আরজি জানালে পূরণ করতেন। তো, এক সকালে কচ্ছপ দেখল শক্ত খোলের ঘরটা তার পিঠে ও পেটে লেগে গেছে। সেই থেকে কচ্ছপ ঘরসহ নিরাপদে চলাচল করে।
চীনের ৩৮ বছর বয়সী লিউ লিংচাও খুবই গরিব। একে তো নিজস্ব ঘর নেই, তার ওপর ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। এক জবর বুদ্ধি বের করলেন তিনি। বাঁশ আর প্লাস্টিক দিয়ে ছোট্ট একটা বহনযোগ্য ঘর বানালেন। এর ওজন ৬০ কেজি এবং এর সুবিধা হলো, এটা ঘাড়ে নিয়ে হাঁটাচলা করা যায়। সেই থেকে লিংচাও ভ্রাম্যমাণ আছেন। তবে গৃহ কাঁধে চলতে গিয়ে তাঁর গতি হয়েছে একদম শামুকের মতোই। তিন মাসে মাত্র ২০ কিলোমিটার অগ্রসর হতে পেরেছেন। গতি নেই তো কী হয়েছে, নিজের একটা ঘর তো আছে তাঁর।
বাংলাদেশি বড়লোকদের গল্পটাই বেশি দারুণ। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম এই গল্পটা বলেছেন ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়। কানাডার টরন্টোর একটি এলাকাকে স্থানীয় বাংলাদেশিরা ‘বেগম পাড়া’ ডাকে। এই বেগম পাড়ার বেগমদের সাহেবরা তাঁদের সঙ্গে থাকেন না। তাঁরা বাংলাদেশে থেকে কষ্ট করে টাকা বানান; টাকা বানাতে ক্লান্তি লাগলে পরে এসে সেখানে পরিবারের সঙ্গে ‘আরামের’ সময় কাটান। এই বাংলাদেশি ‘বেগম’দের আরাম-আয়েশ দেখলে মোগল বেগমরাও হিংসায় জ্বলতেন। তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো বিলাসসামগ্রীতে ভরা। তাঁদের সন্তানেরা সে দেশের ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। ‘বেগম’দের একমাত্র কাজ হলো ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা আর ‘আরাম’ করা। সারা কানাডায় এ রকম অনেকগুলো ‘বেগম পাড়া’ আছে।
বেগমদের সাহেবরা তো ধনীই হবেন; উপরন্তু বিদেশে তাঁরা ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছেন বিনিয়োগকারী কোটায়। খরচ বেশি নয়; মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার অর্থাৎ এক কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডা আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। বেগমদেরও এই পরিমাণ টাকা দিতে হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন প্রবাসে নিরাপদ ঘর। এই ঘর কচ্ছপের বহন করা ঘরের থেকেও শক্তিশালী, চীনা লিংচাওয়ের ঘরের থেকেও হালকা। যখন আরাম চাইবেন, যখন বিপদের দিনে দেশ থেকে পালাতে চাইবেন; তখন সব সুবিধা আর নিরাপত্তা নিয়ে এই ঘর ‘বেগম সাহেবা’সহ অপেক্ষা করবে। এটা বয়ে বেড়াতে হয় না, বয়ে বেড়াতে হয় কেবল দেড় লাখ ডলার দিয়ে কেনা নাগরিকত্বের কার্ডটা। এই কার্ডটাই আপনাকে আপনার মাতৃভূমির বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করবে। সঙ্গে থাকতে হবে আরেকটি কার্ড, যা দিয়ে আপনি ব্যাংক থেকে খুশিমতো টাকা তুলবেন। একেবারে মোবাইল ব্যবস্থা।
দুদিকেই লাভ। উন্নত বিশ্বের সব নাগরিক সুবিধাও পাচ্ছেন, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগময় বাংলাদেশ থেকে সুরক্ষাও মিলছে। সুতরাং যে টাকা বিনিয়োগ করছেন, তা কোনো না-কোনোভাবে সুবিধা আকারে ফেরত পাবেন। আপনার খাতিরে নয়, এই ব্যবস্থা চালু করার পেছনে কানাডার নিজস্ব স্বার্থ আছে। কানাডীয় বাংলাদেশি সমাজে চালু একটা কৌতুক এমন যে, কানাডা ইউরোপ-আমেরিকার মতো অর্থনৈতিক ধসের স্বীকার হয়নি কেন? উত্তর হলো বাংলাদেশিদের ‘রেমিট্যান্স’। সত্যিই বাংলাদেশি সাহেবরা কত শত-হাজার কোটি টাকা কানাডায় পাচার করছেন, তা জানা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক জানাচ্ছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে (প্রথম আলো)। ইউএনডিপি জানাচ্ছে, অবৈধ পুঁজি পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষে। তারা আরও বলছে, কালোটাকাই এ দেশের অর্থনীতির ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশের চালক।
ঠিক কতজন বাংলাদেশি কত শত-হাজার কোটি টাকায় এভাবে নাগরিকত্ব কিনছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা যায়নি। অবৈধ পথে ব্যয়িত অর্থও অবৈধভাবেই অর্জিত বলেই টাকাটা তাঁরা দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেননি। রাজনীতিবিদেরা হরহামেশাই পরস্পরের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ করেন। দেশের অর্থনীতিকে লুট করে বিদেশের নাগরিকত্ব কেনার এই ব্যবসাই হলো ‘দেশ বিক্রির’ আসল ব্যবসা। সম্প্রতি একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৪০ বছরের আদমশুমারির গোপনীয় ‘র-ডাটা’ বিদেশিদের কাছে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর মতো অনেকেই আছেন। শেয়ার মার্কেট, হল-মার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংকের টাকা আর কোথায় যাবে? এভাবে স্বদেশে ঘুষ-দুর্নীতি-দখলবাজি করে অনেকেই বনে যাচ্ছেন বিদেশের ‘সম্মানিত’ নাগরিক।
তাঁদের জন্যই মালয়েশীয় সরকার ২০০২ সাল থেকে ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি চালু করেছে। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল অবধি কমপক্ষে এক হাজার ৮৬২ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় নাগরিকত্ব কিনেছেন (ডেইলি স্টার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২)। গত বছরের হিসাবে তাঁরা প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছেন। বর্তমানে এসব ‘দেশ বিক্রেতা’র সংখ্যা এবং তাঁদের দেশ বিক্রির টাকার পরিমাণ আরও অনেক বেশিই হবে। এভাবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ধনী বিশ্বের অংশ হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক ধনী পরিবার। বিশেষত, বিগত জরুরি অবস্থার সময়ে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা ধনিকশ্রেণীর অনেকে একটা শিক্ষা নিয়েছেন: টাকা আর পরিবার দেশে রাখা যাবে না। বিশ্বের বহু দেশেই এভাবে ছড়িয়ে আছে তাঁদের সেকেন্ড হোম। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ই টাকা পাচার বেড়ে যায় বলে ইউএনডিপির পূর্বোক্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে।
‘সেকেন্ড হোম’ সন্ধানীরা যখন অর্থনীতিকে রানা প্লাজা বানিয়ে ফেলছেন, তখন ওই সব রানা প্লাজার তলে চাপা পড়া পোশাকশ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকেরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আর রপ্তানি-আয় জোগাতে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে চলেছেন। তাঁরাই আশির দশক থেকে বাংলাদেশকে গঠন করছেন, তাঁরাই জাতি গঠন প্রকল্পের প্রধান কারিগর। যখন গ্রাম থেকে সম্পদ ও টাকা শহরে চলে আসার হিড়িক লেগেছে, তখন এই দুই পেশার শ্রমিকেরাই গ্রামে বিপুল পরিমাণ পুঁজির জোগান দিয়ে চলেছেন। পোশাকশ্রমিক বা প্রবাসী শ্রমিক যেখানেই যান নিজের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেন। আর একজন ‘দেশ বিক্রেতা’ যেখানেই যান, দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার সর্বনাশ ঘটান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সবচেয়ে দৃষ্টিগোচর অবদান হলো বাঙালি শাসক ও বাঙালি পুঁজিপতি ধনিকশ্রেণীর উত্থান। কিন্তু এই শাসক পুঁজিপতি শ্রেণীর বড় অংশের আচরণ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই। ইংরেজরা থাকত এখানে, কিন্তু সম্পদ যেত ব্রিটেনে। পাঞ্জাবি শাসকেরাও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিল। মধ্যকালে যেসব দেশীয় জমিদার ইংরেজের সুবাদে বাংলার যাবতীয় ভূমির মালিক হয়েছিলেন, তাঁরাও তাঁদের ঘরবিলাস, সন্তান-সঞ্চয় পাঠাতেন ঔপনিবেশিক নগর কলকাতায়। শাসক বাঙালি হলেও এখনো এই ধারা অব্যাহতই আছে। এখনো আমাদের সম্পদে মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন থেকে কানাডা লাভবান হয়। কেবল নিঃস্ব ও নিহত হন বাংলার কৃষক আর তাঁদের বংশধর পোশাকশ্রমিকেরা।
সাভার ট্র্যাজেডির মাসপূর্তিতে সেখানকার কাঁটাতারের বেড়ায় ফুল গুঁজে কাঁদছিল নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা। তারা দেশে থেকেও দেশহীন। এরা অনেকেই ভূমিহীন, অনেকেই চীনা লিংচাওয়ের মতো ঘরহীন। এসব মায়েরা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের কবরে শোয়ানোর জন্য লাশ চান, গোরের মাটি চান। তাঁদের বিশ্বাস, যেখানে জন্ম সেখানেই কবর হওয়া উচিত। জন্মমৃত্যুর সেই ভূমিই তাঁদের দেশ। ফুলবাড়ীর কৃষকদেরও খনির জন্য জমি ছাড়তে না চাওয়ার বড় যুক্তি ছিল, এই মাটিতেই বাপ-দাদার কবর আর শ্মশান; ‘এই মাটি হামরা ছাড়বেক লয়’। কিন্তু সেকেন্ড হোমওয়ালাদের মাটির দরকার নাই, তাঁদের দরকার দেশ ও মানুষকে লুটে বড়লোক হওয়ার সুযোগ। বেগম পাড়ার সাহেবরা তাই বছরের বেশির ভাগটা সাবেক ব্রিটিশদের মতো, সাবেক জমিদারদের মতো, সাবেক পাঞ্জাবি শাসকদের মতো দেশেই কাটান। টাকা বানাবার মেশিন চালু রাখেন। তাহলেও এই দেশ এখন আর তাঁদের শেষ ঠিকানা নয়, প্রয়োজন ফুরোলে তাঁরাও চলে যাবেন, যেমন চলে গেছে ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিরা।
কিন্তু এই দেশ যাঁদের প্রথম ও শেষ ঠিকানা, দ্বিতীয়ঠিকানাধারীদের কবল থেকে দেশ বাঁচানো তাঁদের জন্যফরজ। সরকার ও বিরোধীদল উভয়ই যখন বিরাট জাতীয়তাবাদী, তখন শক্ত খোলের মধ্যে থাকা সুবিধাবাদী কচ্ছপেরা লাই পাচ্ছে কেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ওলেখক।
farukwasif@yahoo.com
চীনের ৩৮ বছর বয়সী লিউ লিংচাও খুবই গরিব। একে তো নিজস্ব ঘর নেই, তার ওপর ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। এক জবর বুদ্ধি বের করলেন তিনি। বাঁশ আর প্লাস্টিক দিয়ে ছোট্ট একটা বহনযোগ্য ঘর বানালেন। এর ওজন ৬০ কেজি এবং এর সুবিধা হলো, এটা ঘাড়ে নিয়ে হাঁটাচলা করা যায়। সেই থেকে লিংচাও ভ্রাম্যমাণ আছেন। তবে গৃহ কাঁধে চলতে গিয়ে তাঁর গতি হয়েছে একদম শামুকের মতোই। তিন মাসে মাত্র ২০ কিলোমিটার অগ্রসর হতে পেরেছেন। গতি নেই তো কী হয়েছে, নিজের একটা ঘর তো আছে তাঁর।
বাংলাদেশি বড়লোকদের গল্পটাই বেশি দারুণ। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম এই গল্পটা বলেছেন ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায়। কানাডার টরন্টোর একটি এলাকাকে স্থানীয় বাংলাদেশিরা ‘বেগম পাড়া’ ডাকে। এই বেগম পাড়ার বেগমদের সাহেবরা তাঁদের সঙ্গে থাকেন না। তাঁরা বাংলাদেশে থেকে কষ্ট করে টাকা বানান; টাকা বানাতে ক্লান্তি লাগলে পরে এসে সেখানে পরিবারের সঙ্গে ‘আরামের’ সময় কাটান। এই বাংলাদেশি ‘বেগম’দের আরাম-আয়েশ দেখলে মোগল বেগমরাও হিংসায় জ্বলতেন। তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো বিলাসসামগ্রীতে ভরা। তাঁদের সন্তানেরা সে দেশের ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। ‘বেগম’দের একমাত্র কাজ হলো ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা আর ‘আরাম’ করা। সারা কানাডায় এ রকম অনেকগুলো ‘বেগম পাড়া’ আছে।
বেগমদের সাহেবরা তো ধনীই হবেন; উপরন্তু বিদেশে তাঁরা ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছেন বিনিয়োগকারী কোটায়। খরচ বেশি নয়; মাত্র দেড় লাখ কানাডীয় ডলার অর্থাৎ এক কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিলেই কানাডা আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে। বেগমদেরও এই পরিমাণ টাকা দিতে হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন প্রবাসে নিরাপদ ঘর। এই ঘর কচ্ছপের বহন করা ঘরের থেকেও শক্তিশালী, চীনা লিংচাওয়ের ঘরের থেকেও হালকা। যখন আরাম চাইবেন, যখন বিপদের দিনে দেশ থেকে পালাতে চাইবেন; তখন সব সুবিধা আর নিরাপত্তা নিয়ে এই ঘর ‘বেগম সাহেবা’সহ অপেক্ষা করবে। এটা বয়ে বেড়াতে হয় না, বয়ে বেড়াতে হয় কেবল দেড় লাখ ডলার দিয়ে কেনা নাগরিকত্বের কার্ডটা। এই কার্ডটাই আপনাকে আপনার মাতৃভূমির বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করবে। সঙ্গে থাকতে হবে আরেকটি কার্ড, যা দিয়ে আপনি ব্যাংক থেকে খুশিমতো টাকা তুলবেন। একেবারে মোবাইল ব্যবস্থা।
দুদিকেই লাভ। উন্নত বিশ্বের সব নাগরিক সুবিধাও পাচ্ছেন, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগময় বাংলাদেশ থেকে সুরক্ষাও মিলছে। সুতরাং যে টাকা বিনিয়োগ করছেন, তা কোনো না-কোনোভাবে সুবিধা আকারে ফেরত পাবেন। আপনার খাতিরে নয়, এই ব্যবস্থা চালু করার পেছনে কানাডার নিজস্ব স্বার্থ আছে। কানাডীয় বাংলাদেশি সমাজে চালু একটা কৌতুক এমন যে, কানাডা ইউরোপ-আমেরিকার মতো অর্থনৈতিক ধসের স্বীকার হয়নি কেন? উত্তর হলো বাংলাদেশিদের ‘রেমিট্যান্স’। সত্যিই বাংলাদেশি সাহেবরা কত শত-হাজার কোটি টাকা কানাডায় পাচার করছেন, তা জানা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক জানাচ্ছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে (প্রথম আলো)। ইউএনডিপি জানাচ্ছে, অবৈধ পুঁজি পাচারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষে। তারা আরও বলছে, কালোটাকাই এ দেশের অর্থনীতির ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশের চালক।
ঠিক কতজন বাংলাদেশি কত শত-হাজার কোটি টাকায় এভাবে নাগরিকত্ব কিনছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা যায়নি। অবৈধ পথে ব্যয়িত অর্থও অবৈধভাবেই অর্জিত বলেই টাকাটা তাঁরা দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেননি। রাজনীতিবিদেরা হরহামেশাই পরস্পরের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ করেন। দেশের অর্থনীতিকে লুট করে বিদেশের নাগরিকত্ব কেনার এই ব্যবসাই হলো ‘দেশ বিক্রির’ আসল ব্যবসা। সম্প্রতি একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৪০ বছরের আদমশুমারির গোপনীয় ‘র-ডাটা’ বিদেশিদের কাছে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁর মতো অনেকেই আছেন। শেয়ার মার্কেট, হল-মার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংকের টাকা আর কোথায় যাবে? এভাবে স্বদেশে ঘুষ-দুর্নীতি-দখলবাজি করে অনেকেই বনে যাচ্ছেন বিদেশের ‘সম্মানিত’ নাগরিক।
তাঁদের জন্যই মালয়েশীয় সরকার ২০০২ সাল থেকে ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি চালু করেছে। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল অবধি কমপক্ষে এক হাজার ৮৬২ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় নাগরিকত্ব কিনেছেন (ডেইলি স্টার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২)। গত বছরের হিসাবে তাঁরা প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছেন। বর্তমানে এসব ‘দেশ বিক্রেতা’র সংখ্যা এবং তাঁদের দেশ বিক্রির টাকার পরিমাণ আরও অনেক বেশিই হবে। এভাবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ধনী বিশ্বের অংশ হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অনেক ধনী পরিবার। বিশেষত, বিগত জরুরি অবস্থার সময়ে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পর দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা ধনিকশ্রেণীর অনেকে একটা শিক্ষা নিয়েছেন: টাকা আর পরিবার দেশে রাখা যাবে না। বিশ্বের বহু দেশেই এভাবে ছড়িয়ে আছে তাঁদের সেকেন্ড হোম। বিশেষ করে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ই টাকা পাচার বেড়ে যায় বলে ইউএনডিপির পূর্বোক্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে।
‘সেকেন্ড হোম’ সন্ধানীরা যখন অর্থনীতিকে রানা প্লাজা বানিয়ে ফেলছেন, তখন ওই সব রানা প্লাজার তলে চাপা পড়া পোশাকশ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকেরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আর রপ্তানি-আয় জোগাতে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে চলেছেন। তাঁরাই আশির দশক থেকে বাংলাদেশকে গঠন করছেন, তাঁরাই জাতি গঠন প্রকল্পের প্রধান কারিগর। যখন গ্রাম থেকে সম্পদ ও টাকা শহরে চলে আসার হিড়িক লেগেছে, তখন এই দুই পেশার শ্রমিকেরাই গ্রামে বিপুল পরিমাণ পুঁজির জোগান দিয়ে চলেছেন। পোশাকশ্রমিক বা প্রবাসী শ্রমিক যেখানেই যান নিজের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেন। আর একজন ‘দেশ বিক্রেতা’ যেখানেই যান, দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার সর্বনাশ ঘটান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সবচেয়ে দৃষ্টিগোচর অবদান হলো বাঙালি শাসক ও বাঙালি পুঁজিপতি ধনিকশ্রেণীর উত্থান। কিন্তু এই শাসক পুঁজিপতি শ্রেণীর বড় অংশের আচরণ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই। ইংরেজরা থাকত এখানে, কিন্তু সম্পদ যেত ব্রিটেনে। পাঞ্জাবি শাসকেরাও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিল। মধ্যকালে যেসব দেশীয় জমিদার ইংরেজের সুবাদে বাংলার যাবতীয় ভূমির মালিক হয়েছিলেন, তাঁরাও তাঁদের ঘরবিলাস, সন্তান-সঞ্চয় পাঠাতেন ঔপনিবেশিক নগর কলকাতায়। শাসক বাঙালি হলেও এখনো এই ধারা অব্যাহতই আছে। এখনো আমাদের সম্পদে মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন থেকে কানাডা লাভবান হয়। কেবল নিঃস্ব ও নিহত হন বাংলার কৃষক আর তাঁদের বংশধর পোশাকশ্রমিকেরা।
সাভার ট্র্যাজেডির মাসপূর্তিতে সেখানকার কাঁটাতারের বেড়ায় ফুল গুঁজে কাঁদছিল নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা। তারা দেশে থেকেও দেশহীন। এরা অনেকেই ভূমিহীন, অনেকেই চীনা লিংচাওয়ের মতো ঘরহীন। এসব মায়েরা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের কবরে শোয়ানোর জন্য লাশ চান, গোরের মাটি চান। তাঁদের বিশ্বাস, যেখানে জন্ম সেখানেই কবর হওয়া উচিত। জন্মমৃত্যুর সেই ভূমিই তাঁদের দেশ। ফুলবাড়ীর কৃষকদেরও খনির জন্য জমি ছাড়তে না চাওয়ার বড় যুক্তি ছিল, এই মাটিতেই বাপ-দাদার কবর আর শ্মশান; ‘এই মাটি হামরা ছাড়বেক লয়’। কিন্তু সেকেন্ড হোমওয়ালাদের মাটির দরকার নাই, তাঁদের দরকার দেশ ও মানুষকে লুটে বড়লোক হওয়ার সুযোগ। বেগম পাড়ার সাহেবরা তাই বছরের বেশির ভাগটা সাবেক ব্রিটিশদের মতো, সাবেক জমিদারদের মতো, সাবেক পাঞ্জাবি শাসকদের মতো দেশেই কাটান। টাকা বানাবার মেশিন চালু রাখেন। তাহলেও এই দেশ এখন আর তাঁদের শেষ ঠিকানা নয়, প্রয়োজন ফুরোলে তাঁরাও চলে যাবেন, যেমন চলে গেছে ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিরা।
কিন্তু এই দেশ যাঁদের প্রথম ও শেষ ঠিকানা, দ্বিতীয়ঠিকানাধারীদের কবল থেকে দেশ বাঁচানো তাঁদের জন্যফরজ। সরকার ও বিরোধীদল উভয়ই যখন বিরাট জাতীয়তাবাদী, তখন শক্ত খোলের মধ্যে থাকা সুবিধাবাদী কচ্ছপেরা লাই পাচ্ছে কেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ওলেখক।
farukwasif@yahoo.com
No comments