আদিবাসী, জাতিসংঘ ও সরকার যদি একযোগে কাজ করত by সঞ্জীব দ্রং
এবার জেনেভায় জাতিসংঘ এক্সপার্ট মেকানিজম অন দ্য রাইটস অব ইনডিজিনাস পিপলসের অধিবেশনে আদিবাসীরা সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী—এই তিন পক্ষ মিলে কীভাবে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে কাজ করতে পারে, এ বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন। বিষয়টি আমাদের দেশে স্বপ্নের মতো ব্যাপার। তবে কাজটি হওয়া উচিত। একধরনের শ্রদ্ধাপূর্ণ সংলাপ শুরু হতে পারে। উদ্যোগটা সরকারের তরফ থেকে কবে নেওয়া হবে, আমি জানি না। এ নিয়ে বড় আশা করতে মন চায় না। তবে জাতিসংঘ যদি উদ্যোগটি নিত? বাংলাদেশে ইউএনডিপি যদি এ নিয়ে একটু কাজ করত? জেনেভায় দেখলাম, উদ্বোধনী অধিবেশনে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের হাইকমিশনার মিস নাভানেথিম পিলে বলেছেন, বিশ্বের সব অঞ্চলে আদিবাসী জনগণ ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার এবং ভূমির অধিকার শুধু নয়, বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত। তিনি বলেছেন, বর্তমানে আমাদের মানবাধিকারের উন্নতির স্বীকৃতি ও উৎসব করলেই হবে না, মনে রাখতে হবে, অতীতে আদিবাসীদের অধিকারকে ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ বছর নতুনভাবে ‘জাতিসংঘ-আদিবাসী অংশীদারিত্ব’ নামে আইএলও এবং ইউএনডিপির সঙ্গে যৌথভাবে আদিবাসীদের সহায়তা করার জন্য হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাজ করবে।
এই যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাজ করার কথা বলা হলো, এর প্রতিফলন কি আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাব? বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য।
এ বছরও সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস পালন করছে না। তবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী আজ ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু নারী দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শিশু দিবস ইত্যাদি সরকার যেভাবে পালন করে, সেভাবে আদিবাসী দিবস হচ্ছে না। তবে সারা দেশে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে আদিবাসী দিবস এবার উদ্যাপন করা হচ্ছে। বলা যায়, আদিবাসী দিবস সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি আদিবাসী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আদিবাসী দিবস এবার পালন করছে।
এদিকে সংসদীয় আদিবাসী ককাশ গঠিত হয়েছে। আদিবাসী-বান্ধব মাননীয় দুজন সংসদ সদস্য সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে রয়েছেন—রাশেদ খান মেনন এমপি ও হাসানুল হক ইনু এমপি। আদিবাসীদের সুখ-দুঃখ ও দাবির কথা তাঁরা ভালোমতো জানেন। এই দুজন সাংসদ আদিবাসীদের চিরদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথের সাথি ছিলেন। আশা করতে ইচ্ছে করে, এবার সংবিধান সংশোধনের সময় মৌলিক অধিকার অংশে আদিবাসীদের পরিচয়, সংস্কৃতি, অবদান ও অধিকারের কথা অন্তর্ভুক্ত হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এ ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দেখে। ইশতেহারে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
‘পার্বত্য চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।’
বলা বাহুল্য, বিগত প্রায় ১৮ মাসে আদিবাসী জীবনে নির্বাচনী ইশতেহারের এসব কথার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। তবে আশা করি আগামী দিনে এসবের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব।
আমরা তবুও আশায় বুক বেঁধে চেয়ে আছি। আদিবাসীদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সংলাপ ও আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি হবে। অন্যান্য সময় আদিবাসীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিনিধি ও মন্ত্রী মহোদয়গণ আসেন ও কথা বলেন। বিষয়টি উল্টো করে দিতে চাই। স্বপ্ন দেখতে চাই, আগামী দিনে সরকার নিজে সভার আয়োজন করবে এবং আমরা আদিবাসীরা সেখানে যোগ দিয়ে আমাদের কথা বলে আসব এবং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিনা পয়সায় সরকারকে সহযোগিতা করব। এ ক্ষেত্রে আমরা জাতিসংঘের সহযোগিতা চাইব আমাদের মতো অর্থবলের দিক থেকে গরিব দেশে। কবে হবে এসব?
পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে যে মৈত্রী ও বন্ধন তৈরি হচ্ছে, তা এক কথায় অতুলনীয়। একে যেন আমরা অনেক দূর নিয়ে যেতে পারি।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজের অনেকে এখন আমাদের অধিকারকে সমর্থন করছেন। মিডিয়া এখন বেশ আগ্রহী আদিবাসী ইস্যুতে। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com
এই যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাজ করার কথা বলা হলো, এর প্রতিফলন কি আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাব? বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য।
এ বছরও সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস পালন করছে না। তবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী আজ ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু নারী দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শিশু দিবস ইত্যাদি সরকার যেভাবে পালন করে, সেভাবে আদিবাসী দিবস হচ্ছে না। তবে সারা দেশে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে আদিবাসী দিবস এবার উদ্যাপন করা হচ্ছে। বলা যায়, আদিবাসী দিবস সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি আদিবাসী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আদিবাসী দিবস এবার পালন করছে।
এদিকে সংসদীয় আদিবাসী ককাশ গঠিত হয়েছে। আদিবাসী-বান্ধব মাননীয় দুজন সংসদ সদস্য সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে রয়েছেন—রাশেদ খান মেনন এমপি ও হাসানুল হক ইনু এমপি। আদিবাসীদের সুখ-দুঃখ ও দাবির কথা তাঁরা ভালোমতো জানেন। এই দুজন সাংসদ আদিবাসীদের চিরদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথের সাথি ছিলেন। আশা করতে ইচ্ছে করে, এবার সংবিধান সংশোধনের সময় মৌলিক অধিকার অংশে আদিবাসীদের পরিচয়, সংস্কৃতি, অবদান ও অধিকারের কথা অন্তর্ভুক্ত হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এ ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দেখে। ইশতেহারে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
‘পার্বত্য চুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।’
বলা বাহুল্য, বিগত প্রায় ১৮ মাসে আদিবাসী জীবনে নির্বাচনী ইশতেহারের এসব কথার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। তবে আশা করি আগামী দিনে এসবের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব।
আমরা তবুও আশায় বুক বেঁধে চেয়ে আছি। আদিবাসীদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সংলাপ ও আলোচনার সংস্কৃতি তৈরি হবে। অন্যান্য সময় আদিবাসীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিনিধি ও মন্ত্রী মহোদয়গণ আসেন ও কথা বলেন। বিষয়টি উল্টো করে দিতে চাই। স্বপ্ন দেখতে চাই, আগামী দিনে সরকার নিজে সভার আয়োজন করবে এবং আমরা আদিবাসীরা সেখানে যোগ দিয়ে আমাদের কথা বলে আসব এবং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিনা পয়সায় সরকারকে সহযোগিতা করব। এ ক্ষেত্রে আমরা জাতিসংঘের সহযোগিতা চাইব আমাদের মতো অর্থবলের দিক থেকে গরিব দেশে। কবে হবে এসব?
পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে যে মৈত্রী ও বন্ধন তৈরি হচ্ছে, তা এক কথায় অতুলনীয়। একে যেন আমরা অনেক দূর নিয়ে যেতে পারি।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজের অনেকে এখন আমাদের অধিকারকে সমর্থন করছেন। মিডিয়া এখন বেশ আগ্রহী আদিবাসী ইস্যুতে। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com
No comments